Kaberi Gayen

  • Academic
  • Researcher
  • Writer

Kaberi Gayen

  • Academic
  • Researcher
  • Writer

Kaberi Gayen is a Bengali academic, author, and social activist known for her outspoken views on the oppression of minorities and gender inequality in Bangladesh.

Wikipedia

ঠাকু’মার ঝুলির সেইসব বুড়ি, সুয়োরানী এবং রাক্ষসীরা

10 mins read

গল্পের খোঁজে

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মায়ের সুর করে পড়া লক্ষীর পাঁচালী আর মঙ্গলবার সকালে মঙ্গল চণ্ডীর ব্রত-কথা চাল-কলা-নারকেলের প্রসাদের জন্যেও বটে আবার ধূপ-চন্দনের অলৌকিক আবহে মায়ের গলায় পড়া কাহিনীর জন্যও বটে বড় আকর্ষণের বিষয় ছিলো শৈশবে। খেলা যতই থাক না কেন বিশেষ করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লক্ষীর পাঁচালীর সময় মায়ের পাশে উপস্থিত হওয়া চাই-ই চাই। অ-লক্ষীস্বভাবা নারীদের কলহপরায়নতা, কর্মবিমুখতা, গৃহধর্মে অমনোযোগ, আলস্য-নিদ্রায় সতত কাল কাটানো, দেব-দ্বিজে ভক্তি না থাকা, যেখানে সেখানে যখন তখন যাওয়া-আসা করা এজাতীয় অসংখ্য ত্রুটির কারণে মর্ত্যবাসী দুঃখভোগ করে বিভিন্ন কাহিনীর মাধ্যমে এসব কারণ ব্যাখ্যা করে লক্ষীর ব্রতের কৃপায় কীভাবে এসব দুঃখ থেকে পরিবার-পরিজন এবং মর্ত্যবাসীকে পরিত্রাণ দেয়া সম্ভব তার কাব্যিক বয়ান অমৃতসমান মনে হতো। আর মঙ্গল চণ্ডীর ব্রত-কথায় কোনো না কোনো সুলক্ষণা, লক্ষীমন্ত, স্বামী-পরিত্যক্ত দুঃখী নারীর অশেষ দুঃখভোগ এবং শেষপর্যন্ত পাশবিক ধৈর্য, অমানবিক শ্রম এবং মঙ্গল চণ্ডীর ব্রতের কল্যাণে সতীনের কূটকৌশলের জাল ছিন্ন করে স্বামীর সাথে মিলিত হতে পারা, সতীনের জন্য যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করা (যে শাস্তি এই সুলক্ষণা, লক্ষীমন্ত রমণী এতকাল ভোগ করেছে তার চেয়েও কঠোর শাস্তি) এবং ধনে-জনে যশলাভে সুখে সংসার করতে পারার অনির্বাচনীয় আনন্দের অংশীদার হয়ে মনটা আনন্দে তৃপ্ত হয়ে উঠত। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে শিশুমনে অশেষ তৃপ্তির উদয় হবে সেই-ই তো স্বাভাবিক। শেষে প্রাসাদ তো রয়েছেই। কালে-ভদ্রে কোনো এক বিরল সন্ধ্যায় হয়ত মা লক্ষীর পাঁচালী পড়ার কিংবা কোনোদিন সকালে (বড়জোর একবার কি দুবার ঘটেছে এমনটা) মঙ্গলচণ্ডীর পাঁচালী পড়ার ভার তার বালিকা কন্যার উপরই ন্যস্ত করতেন। হয়তো পূজার আসন ফুলে-চন্দনে সুন্দর করে সাজানোর প্রশিক্ষণ দেবার জন্য, কিংবা পাঁচালী-পাঠের পূণ্যে কন্যাকেও শরিক করার জন্য কিংবা অন্য কোনো কাজে নিজের বস্ততার জন্য কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে। সেসব সন্ধ্যায় বা সকালে নিজেকে খুব কেজো মানুষ মনে হতো। একই কাহিনী। ভিন্ন ভিন্ন স্থানের ভিন্ন ভিন্ন নামের সতী-লক্ষীদের সতীনের চক্রান্তে অশেষ দুঃখভোগ এবং অবশেষে ইতর ধৈর্যে-শ্রমে এবং লক্ষীর কিংবা মা-চণ্ডীর করুণায় স্বামীর মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষমতালাভ। ধন-জন লাভ। এসব কাহিনীতে এদের স্বামীদের কর্ম কেবল খল স্ত্রী বা স্ত¿ীদের প্ররোচনায় লক্ষীমন্ত স্ত্রীকে নির্বাসন দেয়া এবং পরে লক্ষীর বা মা চণ্ডীর কৃপায় সেই লক্ষীমন্ত স্ত্রী নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে সক্ষম হলে খল স্ত্রী বা স্ত্রীদের শাস্তির বিধান করা। আদালতের বিচারকরা যেমনটা করে থাকেন। যেনো এসব দুঃখভোগের কোনো দায় তাদের নেই। এসব পাঁচালীর বয়ানে কোন নারী লক্ষীমন্ত? সেই নারীই লক্ষীমন্ত যার জীবনে কোনো বিশ্রাম, সুখভোগের কল্পনা থাকবে না, সূর্যোদয়ের আগে পরিবারের সকলের আগে ঘুম থেকে উঠে উঠোনে গোবর-ছড়া দিয়ে শুরু হবে তার কাজের দিন এবং দন্ডের তরেও বিশ্রাম না নিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে তার কাজ। এমনকি দাস-দাসীরও পরে খেতে যাবেন সতী-লক্ষী এবং বাড়ীর সকলে ঘুমিয়ে যাবার পর তিনি শয্যায় যাবেন এবং “সেবিবে তখন সতী স্বামীর চরণ।”

মা, আমি আর পাঁচালী পড়বো না। বুঝে কিংবা না-বুঝে, ধরেই নিতে হয় না-বুঝে, আট বছরের বালিকা আর কোনোও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লক্ষীর পাঁচালী কিংবা মঙ্গলবার সকালে মঙ্গল চণ্ডীর ব্রতকথা না পড়লেও দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুমার ঝুলি, ঠাকুরদার থলে অসীম আগ্রহে পড়েছে বহুকাল, গল্পের খোঁজে। বালিকা বয়স ছাড়িয়ে, কৈশোরে, তারুণ্যে। এখনকার মধ্যে তারুণ্যে। আসলে রূপকথার মোহ, শৈশবের মোহের-ছন্দের-স্বপ্নের যাদু সহজে ছাড়া যায় না, হয়তো কখনোই ছাড়া যায় না। শৈশবে গরম ভাত বেড়ে খেতে যাবার জন্য মায়ের ডাক যেমন ভোলা যায় না, শীতের সকালে বাবার চাদরের নীচে লিচুতলায় রোদ-পোহানোর স্মৃতি যেমন বিপদে-সঙ্কটে সম্পদ হয়ে আগলে রাখে তার একাকী মেয়েকে, ভোলা যায় না চৈত্রের প্রখর দুপুরে পুকুরে সাঁতার কাটার স্মৃতি ঠিক তেমনি কিংবা তার চেয়েও অনেক বেশি তীব্রতায় কিংবা জীবনের সাথে একাকার হয়ে থাকে আমাদের রূপকথার কাল। খুব অল্পই দিদিমার মুখে শুনেছি গল্প: একদেশে ছেলো এক রাজা আর তার ছেলো দুই রানীÑ সুয়োরানী আর দুয়োরানী। মনটা ছ্যাঁৎ করে উঠত। এখনই শুরু হবে সুয়োরানীর চক্রান্ত আর দুয়োরানীর দুঃখের কাল। গল্পে গ্রহণের কাল। কেনো? রাজার দুই রানী থাকার দরকার কী, এক রানী হলেই তো সমস্ত গোল মিটে যায়। কিন্তু না হলে যে রূপকথা হয় না। রাজা যখন, দুই রানী তো কোন ছার, সাত রানী থাকে!

পড়তে শিখে অবধি ঠাকুমার ঝুলি ছিল শয়নে-স্বপ্নে-জাগরণে কল্পলোকের প্রধান চাবি। বহুকাল।
‘বুদ্ধু আমার বাপ!
কী করেছি পাপ?
কোন পাপেতে ছেড়ে গেলি, দিয়ে মনস্তাপ?
শুকপঙ্খী নায়ের পাছে ময়ূরপঙ্খী যায়,
আমার বাছা থাকলে যেতিস মায়ের এই নায়।’
কিংবা
‘দুয়ারে দুয়ারে মঙ্গল ঘড়া
পাঁচ পল­ব ফুলের তোড়া;
আলপনা বিলিপনা, এয়োর ঝাঁক,
পাঠ-পিড়ী আসন ঘিরে, বেজে ওঠে শাঁখ।’

কী ছন্দ! কী ছন্দ! চারিদিকে ফুল-বৃষ্টি, চারিদিকে চন্দন বৃষ্টি; ফুল ফোটে, খৈ ছোটে, রাজপুরীর হাজার ঢোলে ‘ডুম-ডুম’ কাটা পড়িল। সেই ‘ডুম-ডুম’ কাটা কী শুধুই রাজপুরীর হাজার ঢোলে পড়ে? সে কি শোভা! রাজপুরীর চার-চত্বর দল্দল্ ঝল্ঝল্। আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় হুলুধ্বনি, রাজভাণ্ডারে ছড়াছড়ি; জনজনতার হুড়াহুড়ি, এতদিনের ঘুমন্ত রাজপুরী দাপে কাঁপে, আনন্দে তোলপাড়। সেই আনন্দ গায়ে মেয়ে স্কুলে যাওয়া। ছোট বোনকে সেই আনন্দের ভাগ দিয়ে পুলক অনুভব। নৌকা হইতে কুঁচ-বরণ কন্যা উত্তর করিলেন

‘কলাবতী রাজকন্যা মেঘ-বরণ কেশ,
তোমার পুত্র পাঠাইও কলাবতীর দেশ।
আনতে পারে মোতির ফুল ঢো-ল-ডগর,
সেই পুত্রের বাঁদী হয়ে আসব তোমার ঘর।’

তিন বুড়ির রাজ্য পেরিয়ে, রাঙ্গা নদীর জল কাটিয়ে কলাবতীর রাজকন্যার রাজ্য, সেখানে প্রকাণ্ড রাজপুরীর তে-তলায় মেঘ -বরণ চুল কুঁচ-বরণ কন্যা সোনার শুকের সাথে কথা কয়। সে রাজ্যে গাছের পাতায় ফল, গাছের পাতায় অজগর, সেখানে ঢোল-ডগরের ডাহিনে ঘা দিলে হাট-বাজার বসে, বাঁয়ে ঘা দিলে হাট-বাজার ভাঙ্গিয়া যায়। সেখানে এক একশ বচ্ছুরে বুড়ি বসে এক ছোট কাঁথা সেলাই করে। কী অসাধারণ! পাশ-গাদাতে সাত চাঁপা পারুল, গা-ময় সুঁচ রাজার রানী কাঞ্চনমালা এক ডুবে হয়ে যান দাসী আর হাতের কাঁকনে কেনা দাসী রানী, গজমোতির উজল আলোয় বসন্তের সাথে রাজকন্যার বিয়ে, নীল কমল আর লাল কমলের গল্প ‘আমার নাতি হোক তো চিবিয়ে খাক লোহার কড়াই’, ‘দুধ-সাগরের’ ঢেউয়ে লুকিয়ে থাকা এসব গল্প পড়ে পড়ে অজানা রাজ্যের অজানা রাজপুত্রের পাড়ি দেয়া সাত-সমুদ্র তেরো নদীর ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে, স্বপ্ন-কল্পনায় আলোড়িত হতে হতে, একদিন হঠাৎই বুঝি বিস্ময়ের সাথে আবি®কৃত হয় রূপকথার চেনা-অচেনা জমিনে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাধা পড়ে গেছে জীবনের স্বপ্ন-সাধ, গঠন করে ফেলেছে রাজকন্যা-মানস এবং বিস্ময় যুগপৎ যন্ত্রণার জন্ম দেয় যখন ক্রমাগত বেশি করে মনে হতে থাকে ঠাকুমার ঝুলি বাঙ্গালার রূপকথায় আমার জন্য স্বপ্নের-কল্পনার কিংবা আশার কোন দুয়ার খুব অল্পই খোলা আছে।

একি তবে রাজপুত্রদের জন্য রাজপুত্রদেরই কাহিনী?
‘ফিনিক ফোটা’ জ্যোৎস্নায় বাংলার ঠাকু’মা, দিদিমা, মায়েদের মুখের গল্পগুলোকেই অত্যন্ত বিশ্বস্ততায় বাঙালির নিজস্ব বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে-গীতিতে ধরেছেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। এমনই অভিমত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, বইটির ভূমিকায়। বইটি পড়তে পড়তে অভ্যস্ত হয়ে যাবার অনেক পরে খেয়াল হয় রবীন্দ্রনাথ আরো যা লেখেন,
“… এই যে আমাদের দেশের রূপকথা বহুযুগের বাঙালি-বালকের চিত্তক্ষেত্রের উপর দিয়া অশ্রান্ত বহিয়া কত বিপ্লব, কত রাজ্য পরিবর্তনের মাঝখান দিয়া অক্ষুন্ন চলিয়া আসিয়াছে, ইহার উৎস সমস্ত বাংলাদেশের মাতৃস্নেহের মধ্যে। … অতএব বাঙালির ছেলে যখন রূপকথা শোনে তখন কেবল যে গল্প শুনিয়া সুখী হয়, তাহা নহে সমস্ত বাংলাদেশের চিরন্তন স্নেহের সুরটি তাহার তরুণ চিত্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া, তাহাকে যেমন বাংলার রয়ে রসাইয়া লয়।’’

চোখ পড়ে বইটির উৎসর্গপত্রে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার যা লিখেছেন তার প্রতি

নীল আকাশে সূয্যিমামা ঝলক দিয়েছে,
সবুজ মাঠে নতুন পাতা গজিয়ে উঠেছে,
পালিয়ে ছিল সোনার টিয়ে ফিরে এসেছে;
ক্ষীর নদীটির পারে খোকন হাসতে লেগেছে,
হাসতে লেগেছে রে খোকন নাচতে লেগেছে,
মায়ের কোলে চাঁদের হাট ভেঙ্গে পড়েছে।
লাল টুক টুক সোনার হাতে কে নিয়েছে তুলি’
ছেঁড়া নাতা পুরোণ কাঁথার
ঠাকুমার ঝুলি।

খুব পরিষ্কার এ বই বাঙালির ছেলের জন্য, বাঙালির খোকার জন্য তাদের মা-ঠাকুমা-দিদিমাদের হয়ে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। কথা উঠতে পারে ‘বাঙালির ছেলে’ শব্দটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিংবা ‘খোকন’ শব্দটি ব্যবহার করে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুদার আসলে শিশুদের নির্বিশেষে বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু সে কথা মানা শক্ত কারণ যে বয়সে বাঙালির ছেলে তখন মা-ঠাকুমা-দিদিমাদের কাছে রূপকথা শোনে এবং তার তরুণ চিত্ত বাংলার রসে রাঙিয়ে নেয় সেই বয়সে বাঙালির মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে যাবার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য এই মা-ঠাকুমা-দিদিমারাই সুক্তো রান্নায় কী কী ফোঁড়ন দিতে হবে তা শেখানোর জন্য গলদঘর্ম হয়ে পড়েন। শব্দের ব্যবহারে অনেক কিছুই আসে যায়, আসলে সমস্তটাই আসে যায়, তবুও তর্কের খাতিরে সে কথা যদিবা মেনেও নেই হোঁচট খেতেই হয় যদি নয়ন মেলে দেখি এসব গল্পের বিষয়বস্তু।

আপাতদৃষ্টিতে এক কিরণমালার কাহিনী বাদ দিলে সব কাহিনীই আসলে রাজপুত্রের কাহিনী। রাজপুত্রদের কাহিনী। বন্দিনী রাজকন্যারা রাজপুত্রদের অসীম গুণাবলী, অপরিমেয় তেজ এবং অশেষ স্বপ্ন বাস্তবায়নের এবং তা প্রকাশের উপলক্ষ মাত্র। রানীরা চক্রান্তকারী অথবা চক্রান্তের শিকার অশুভ শক্তি অথবা অসহায় অস্তিত্ব। এরা গৃহের নারী। বাকী রইল যেসব নারী, তারা রাক্ষসী। হয় রাক্ষসী-পুরীতে তাদের রাজত্ব, যেখানে রাজকন্যারা বন্দী অথবা ছদ্মবেশে মানুষের রাজপুরীতে রানী হিসেবে তাদের অধিষ্ঠান। রাজপুত্র, রাজ্যের মানুষ, পশু-পাখি খেয়ে ধ্বংস করাই যাদের উদ্দেশ্য। এসব চক্রান্তকারী রানী এবং রাক্ষসীদের স্বরূপ উন্মোচন করে অসহায় রানী এবং বন্দী ও ঘুমন্ত রাজকন্যাদের মুক্ত করার যাবতীয় নায়কোচিত কাজের বিবরণই তো এসব কাহিনীর বিষয়বস্তু। যেসব রানী চরিত্র সক্রিয়, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই অশুভ শক্তির প্রতীক। বাকীরা সহানুভূতি কাড়ে, সম্ভ্রম জাগায় না। যদিও বলছি রাজকন্যা কিরণমালা এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম তবুও একসময় আমরা দেখতে পাই কীভাবে কিরণমালার সক্রিয়তা আসলে সমগ্রিক পুরুষপরিমণ্ডলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারই হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

তার অর্থ কি তাহলে এই যে, বাংলার ঠাকুমা, দিদিমা, মায়েরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কেবল তাদের রাজপুত্রদেরই শৌর্যের কথা বলেছেন, ভেবেছেন? বলেছেন তাদের রাজপুত্রদের নিয়ে নিজেদের স্বপ্নের কথা? তাদের বাস্তব জগতে অশুভ শক্তি কি কেবলই নারী? গোটা ঠাকুমার ঝুলিতে একজনও পুরুষ কেনো নেই অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে? কোন সে পরিস্থিতি যেখানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাংলার ঠাকুমা, দিদিমা, মায়েরা তাদের স্বপ্নের-কল্পনার-আশার-উদ্ধারের প্রতিনিধি হিসেবে কেবল তাদের রাজপুত্রদেরই ভেবেছেন? এবং দাঁড় করিয়েছেন অশুভের প্রতীক হিসেবে অন্য নারীর বিপরীতে? এই প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হওয়া যেমন জরুরি তেমিন জরুরি প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি এবং প্রাথমিক কাজ হলো এসব রূপকথা আদৌ এ জাতীয় প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য প্রাসঙ্গিক কী-না, সেটি খুঁজে দেখা।

বুড়িদের রাজত্ব
দুধের সাগর, রূপ-তরাসী এবং চ্যাং-ব্যাং-এই তিনটি পর্বে মোট ১৪টি গল্প নিয়ে ঠাকুমার ঝুলি। দুধের সাগর-এর প্রথম গল্প অর্থাৎ এই বইটির প্রথম গল্প কলাবতীর রাজকন্যা। রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-ছন্দের বিচারে, কাহিনীর বৈচিত্র্যে সেরা গল্প হয়তো এটি, আমার বিবেচনায়। গল্পের শুরুই হচ্ছে এক যে রাজা। রাজার সাত রানী। যে রাজার সাত রানী সে রাজার যে মস্ত-বড় রাজ্য, প্রকাণ্ড রাজবাড়ী, হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, ভাণ্ডারে মাণিক, কুঠরীভরা মোহর, মন্ত্রী, অমাত্য, সিপাই, লস্করে রাজপুরী গমগম করবে এতো অবধারিত। কারণ এসবই যদি না থাকবে তো রাজার সাত রানী হবে কেমন করে? কিন্তু রাজার মনে সুখ নাই। কারণ এক রানীরও সন্তান নাই। ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ এক নয়, দুই নয় সাত রানী পোষেন যে রাজা তার একটিও সন্তান না থাকলে মনে যে সুখ থাকবে না এও তো বাহুল্য কথা। এত প্রকান্ড রাজ্যের রানীরা কিন্তু সকলেই রান্না করা, জল তোলা, কুটনো-কাটা, মশলা করার মত অ-রানী সুলভ কাজ করেন। সন্তান না হওয়ার শাস্তি কি? কারণ এ বইয়ের অন্য কোনো রূপকথায় রানীরা শাস্তি-প্রাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ জাতীয় হীন কাজ করেন না। সন্ন্যাসীর দেয়া শেকড় বাটা খেয়ে পাঁচ রানীর সোনার চাঁদ ছেলে হলো। আর শিল-নোড়া-ধোয়া জল খেয়ে ন-রানী আর ছোট রানীর হলো পেঁচা (ভুতুম) আর বানর (বুদ্ধু)। সোনার চাঁদ ছেলে হওয়া পাঁচ রানীকে জয়ডঙ্কা দিয়ে ঘরে তোলা হলো আর ন-রানী চিড়িয়াখানার বাঁদী এবং ছোট রানী হলেন ঘুঁটে কুড়ানী দাসী। অর্থাৎ রানীদের অবস্থান নির্বাচিত হলো তাদের সন্তানদের সাপেক্ষে। যেমনটা হয় আর কী! আর তাই কাহিনীর শেষে বুদ্ধু-ভুতুমের কৃতিত্বে তাদের মায়েরা আবার স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হন রাজপূরীতে।

‘হাটের সওদা ঢোল-ডগরে, গাছের পাতে ফল
তিন বুড়ির রাজ্য ছেড়ে রাঙ্গা নদীর জল’ এরও ওপারে কলাবতীর পুরের রাজকন্যা অর্থাৎ এ রূপকথার রাজকন্যা স্বাধীন কিন্তু তিনি বিজিত হতে চান, হতে চান বীর-ভোগ্যা। তার নিজেরই কথায়:

“আনতে পারে মোতির ফুল ঢো-ল-ডগর,
সেই পুত্রের বাঁদী হয়ে আসব তোমার ঘর।”

কীভাবে বোঝা গেল রাজকন্যা স্বাধীন ছিলেন? রূপার বৈঠা, হীরের হালের শুকপঙ্খী নাও ভাসিয়ে রাজকন্যা একা বেরিয়েছেন দেশ-বিদেশ ঘুরতে, সঙ্গী তার সোনার শুক। স্বাধীন বৈ কী। কিংবা বুদ্ধুর প্রশ্ন “রাজকন্যা, এখন তুমি কা’র?” এর উত্তরে রাজকন্যার বয়ানেও বোঝা যায়, “আগে ছিলাম বাপের-মায়ের, তা’র পরে ছিলাম আমার, এখন তোমার।” এই তা’র পরে ছিলাম আমার পর্বে রাজকন্যা স্বাধীন, রূপার বৈঠা, হীরার হালের শুকপঙ্খী নাও ভাসিযেছেন স্বাধীন রাজকন্যা। স্বাধীন রাজকন্যা বুদ্ধুকে বিয়ে করে নিজের রাজ্যপট ছেড়ে বুদ্ধুর বাঁদী হয়ে (রাজকন্যা বলিলেন, “এখন তুমি যাহা বলিবে, তাহাই করিব।”) চললেন বুদ্ধুর রাজ্যে।

এ কাহিনীতে তিন বুড়ির রাজ্যের হদিস পাই আমরা। অর্থাৎ তিন বুড়ি ক্ষমতাবান এবং অবধারিতভাবে তারা রাক্ষসী। কেননা “তাহাদিগে দিয়া তিন বুড়ি তিন সন্ধ্যা জল খাইয়া, নাক ডাকাইয়া ঘুমাইয়া পড়িল।” হদিস পাই পাতালপুরী তথা কলাবতীর পুরের নির্জন রাজ্যের এক একশ বচ্ছুরে বুড়ির যে কী-না বসে একটি ছোট কাঁথা সেলাই করছে। এই বুড়িও গল্পে অশুভ শক্তির প্রতীক, যাকে পরাস্ত করে তার ছোট কাঁথাটি নিয়ে নেয়া হয়েছে। ছোট কাঁথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এ কারণে যে কাঁথাটি বুড়ি বুদ্ধুর দিকে ছুঁড়ে মারতেই “হাজার হাজার সিপাই আসিয়া বুদ্ধুকে বাঁধিয়া-ছাঁদিয়া রাজপুরীর মধ্যে লইয়া গেল।” তাহলে এই কাঁথাটি কি বুড়ির শক্তির, ক্ষমতার প্রতীক যা দিয়ে বুড়ি তার রাজ্য শাসন করে, প্রজাকূল তার হুকুম তামিল করে? কলাবতীর রাজকন্যার সাথে বুড়ির সম্পর্কটাই বা কী, এই একশ বচ্ছুরে বুড়ি কি কলাবতীর রাজকন্যারই পূর্ব নারী কোন এক? এসব প্রসঙ্গের উত্তর নেই এ গল্পে। যেমন নেই বুড়ির কাঁথাটি কীভাবে পেল বুদ্ধু। কোন যুদ্ধ, কোন কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল কাঁথাটি হস্তগত করার জন্য? অথচ কাহিনীর শেষে আমরা বুদ্ধুকে দিব্যি বুড়ির সেই কাঁথাটি নিয়ে যেতে দেখি। এই কলাবতীর পুরও সম্ভবত একটি নারী-প্রধান রাজ্য। এখানে দু’টি চরিত্রকে আমরা দেখতে পাই। ছোট কাঁথা সেলাইকারী একশ বচ্ছুরে বুড়ি এবং কলাবতীর রাজকন্যা। অথচ সে রাজ্যে হাজার-হাজার সেপাই আছে, ঢোল-ডগরের নিয়ন্ত্রণে প্রকাণ্ড হাট বসে। অন্য সময় এদের দেখা যায় না। বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এ যেমন দিনের বেলা রাস্তা-ঘাটে পুরুষদের দেখা যায় না। কিংবা হতে কি পারে নারী-প্রধান রাজ্য বলে পুরুষতান্ত্রিক রূপকথাকারের কাছে এ রাজ্যের পুরুষ এবং রাজত্বের অন্য সকল উপাদানকে অদৃশ্যমান মনে হচ্ছে? কিংবা এ রাজ্যের অন্য সকলের উপস্থিতি তাৎপর্যের দিক থেকে এতই অকিঞ্চিৎকর যে বুড়ি এবং রাজকন্যার তুলনায় তাদের উপস্থিতি মূর্ত নয়? তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে তাহলো এ রূপকথার নায়ক ছদ্মবেশী রাজকুমার বুদ্ধু এবং সহযোগী নায়ক অপর ছদ্মবেশী রাজকুমার ভুতুম। এদের বীরত্ব ও কৃতিত্বে তাদের অসহায়, রাজপুরী থেকে নির্বাসিত রানীমায়েরা পুনরায় রাজপুরীতে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। এদেরই বীরত্ব ও কৃতিত্বে মুগ্ধ রাজা “পাঁচ রানীর আর পাঁচ রাজপুত্রের ঘরের উপরে কাঁটা দিয়া, মাটি দিয়া, বুজাইয়া দিলেন।” ন’রানী, ছোট নারী আর তাদের সন্তানদের উপর এতগুলো বছর অন্যায় অবিচারের জন্য রাজা শাস্তি পাওয়া দূরে থাক, নিন্দিতও হলেন না, অশুভ শক্তি হিসেবেও বিবেচিত হলেন না। বরং পুনরায় দণ্ড দিলেন অন্যসব রানী আর রাজপুত্রদের। কারণ তার কোনো ক্ষতি নেই কোনো ব্যবস্থাতেই। একপক্ষকে তাড়িয়ে দিলেন তো অন্যপক্ষ রইল কাছে। কোনো সম্পর্কই কিছু নয় রাজার কাছে। ক্ষমতাবানের অন্যায় ভুল হিসেবেই বিবেচিত মাত্র ভবিষ্যৎ দুই ক্ষমতাধারী বুদ্ধু ও ভুতুমের কাছে। অন্যদিকে রাজত্বধারী তিন বুড়ি এবং জ্ঞানের-অভিজ্ঞতার-ক্ষমতার কাঁথা সেলাইকারী একশ বচ্ছুরে বুড়িকে পরাজিত করে অর্থাৎ স্বাধীন ও সক্রিয় তিন নারীকে অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে, তাদের পরাস্ত করে স্বাধীন কলাবতীর রাজকন্যাকে (… তারপর ছিলাম আমার …) “উদ্ধার” (?) করলো তারা। শ্রীয়ুত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বঙ্গীয় শব্দকোষের ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী বৃদ্ধ শব্দের একটি অর্থ জ্ঞানী। তাহলে এই বৃদ্ধা বা বুড়িরা ছিলেন জ্ঞানী নারী। জ্ঞানী নারী তো বটেই কারণ তারা রাজ্য শাসন করতেন। যেহেতু তারা জ্ঞানী, নারী এবং স্বাধীনভাবে রাজ্য চালান, অশুভ শক্তির প্রতীক তো হবেনই। এইসব স্বাধীন, জ্ঞানী নারীদের পরাজিত করে তারা সাথে নিয়ে গেল এসব স্বাধীন বুড়ির সমস্ত হাতিয়ার হাটের সওদার ঢোল-ডগর, কাঁথা আর কৌটা।

“রাজকন্যা রাজকন্যা, ঘুমে আছ কি?
বরে নিতে ঢোল-ডগর নিয়ে এসেছি।”

ঢোল-ডগর এনেই কেবল রাজকন্যাকে বরণ করা যায় কারণ এই “ঢোল-ডগরের ডাহিনে ঘা দিলে হাট-বাজার বসে, বাঁয়ে ঘা দিলে হাট-বাজার ভাঙ্গিয়া যায়।” হাট-বাজারের ক্ষমতা অর্থাৎ অর্থের ক্ষমতা যার হাতে সেই-ই পারে রাজকন্যাকে বরণ করতে। কাহিনীতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অন্যান্য রাজপুত্ররা এবং তাদের মায়েরা বারবার জিজ্ঞেস করেছে, “রাজকন্যা, এখন তুমি কার?” রাজকন্যা প্রতিবারই নিঃসংশয়ে উত্তর করেছে, “ঢোল-ডগর যার।” অর্থাৎ বাজার নিয়ন্ত্রণ তথা বিত্ত যার হাতে। এই ঢোল-ডগর রাজকন্যারই ছিল। কারণ এই ঢোল-ডগর কলাবতীর রাজকন্যারই সোনার শুকের কাছ থেকে বুদ্ধুর হাতে এসেছে। কীভাবে এলো তার কোনো বিশদ বর্ণনা নেই কিন্তু রাজকন্যা বুদ্ধুর হাতে বিজিত হলেন বলেই যে বুদ্ধু ঢোল-ডগরের মালিকানা পেল এটা পরিষ্কার। নারীর সম্পত্তির অধিকার তো স্বামীরই বটে! কাহিনী অনুযায়ী, বুদ্ধু রাজকন্যার মাথা থেকে মোতির ফুল নেয়ার পর অর্থাৎ তাকে জয় করার পর সোনার শুক ঢোলে কাঠি দিলে হাট-বাজার বসা এবং ভাঙ্গার বিষয়টি দেখে বুদ্ধু ঢোলটি বাজাতে শুরু করে। তাছাড়াও কোনো রাজত্বের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তখনই ভিনদেশী রাজপুত্রের হাতে যাওয়া সম্ভব যখন সে রাজ্যের পতন ঘটেছে ওই ভিনদেশী রাজপুত্রের হাতে। অবশ্য কলাবতীর রাজকন্যা, কাহিনী অনুযায়ী, কি বিজিত হতেই চেয়েছিলেন? অন্যান্য বুড়িদের মত অশুভ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হতে না হয় যেন, সে কারণেই কি? কার উপর কার বিজয়গাঁথা রচনা করলেন আমাদের ঠাকুমা, দিদিমা, আর মায়েরা আর সে কাহিনী অবিরাম গেয়েও চললেন তারাই?

সোনার কাঠি, রূপার কাঠি আর ঘুমন্ত রাজকন্যা

দ্বিতীয় গল্প ঘুমন্ত পুরী। এটি নেহাতই এক রাজপুত্রের গল্প। যে রাজপুত্র ঘুমন্ত রাজকন্যার (রাজকন্যারা বুঝি ঘুমিয়েই থাকেন? কেন?) শিয়রের সোনার কাঠি আর পায়ের কাছের রূপার কাঠি বদল করে জাগিয়েছেন ঘুমন্ত রাজকন্যা এবং রাজপুরীকে। উপহার পেয়েছেন রাজকন্যা আর রাজত্ব। রাজপুত্রের এই নিরঙ্কুশ বিজয়শৌর্যে অন্য কারো অংশীদারিত্ব নেই এবং রাজকন্যা আর রাজত্ব লাভের আকাক্সক্ষা চিরতরে বাঙালি রাজপুত্র-মানসে অমোচনীয় কালিতে খোঁদাই করে গেছে যেসব কাহিনী এ রূপকথাটি সেগুলোরই একটি। কলিম খান হয়তো ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ রীতি অনুযায়ী বলবেন ঘুমন্ত রাজকন্যারা অচেতন কর্মী জনগণ এবং রাজপুত্র উদ্যোমী পরিচালক যে অচেতন কর্মীদের জাগিয়ে রাজত্বরূপ ফললাভ করেছে। তাহলেও কিন্তু অচেতন কর্মী জনগণ হিসেবে রাজকন্যাই প্রতিকায়িত এবং রাজপুত্র উদ্যোমী পরিচালক হিসেবে।

সুয়োরানী বনাম দুয়োরানী কিংবা নারীর বিরুদ্ধে নারী?

আগেই যেমনটা বলেছি বেশিরভাগ রূপকথাতেই রাজ্যের সকল অনিষ্টের মূলে কোনো ডাইনী-স্বভাবা নারী এবং তাদের সকল অপকর্মের শিকার অসহায় নারীকূল। নারীর বিরুদ্ধে নারী। নারীর হিংসা-কপটতা-হিংস্রতার বলি আরেক নারী। যেন নারীর দুর্ভাগ্যের অন্য কোনো কারণ থাকেইনি কখনো। পুরুষ এসেছে অসহায় নারীকে উদ্ধারের জন্য।

কাঁকনমালা-কাঞ্চনমালা গল্পে অশুভ সত্ত¡া কাঁকনমালা। অসহায়, করুণা উদ্রেককারী চরিত্র কাঞ্চনমালা। নিজের গুণে নয়, সুঁচ-রাজার রাখাল বন্ধুর কৌশল ও প্রচেষ্টায় কাঞ্চনমালা উদ্ধার পান। যে রাজার প্রতিজ্ঞাভঙ্গের কারণে এত ঝামেলা, তিনি উদ্ধার পেলেও কাঁকনমালাকে মরে যেতে হয়, তার প্রায়শ্চিত্ত করার উপায় রাখা হয় না। কারণ সে অশুভ শক্তি। সাত ভাই চম্পা গল্পে যথারীতি রাজার সাত রাণী। বড়রাণীরা খুব খারাপ, তাদের দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না। ছোটরাণী খুব শান্ত। এজন্য রাজা ছোটরাণীকে সকলের চাইতে বেশি ভালবাসিতেন। আজও শান্ত মেয়ে, যে সকল কথা মেনে চলে, সেই-ই তো ভালবাসার পাত্রী। ছেলেমেয়ে না হওয়ার কারণে এই রাজাও খুব দুঃখিত। অবশেষে রাজার মনে আনন্দের বন্যা বইল কারণ “ছোটরাণীর ছেলে হইবে”। কীভাবে জানা গেল ছেলেই হবে? সন্তান হওয়া মানেই ছেলে হওয়া? তাই বলি শব্দের ব্যবহারে অনেক কিছুই আসে যায়। বড়রাণীরা হিংসায় জ্বলিয়া মরিতে লাগিল। একেই রাজা ছোটরাণীকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন, তাই ছেলে হবার সম্ভাবনায় রাজা সকলের মধ্যে বিলানোর জন্য রাজভাণ্ডার খুলে দিয়েছেন, খুবই পরিস্কার যে সন্তান হবার পর অন্যরাণীদের পাত্তাও থাকবে না কারণ রাণীদের মর্যাদা নির্ণিত হয় পুত্রসন্তান জন্ম দেয়ার কৃতিত্বের উপর কাজেই অন্য রাণীরা হিংসায় জ্বলবে, এটা কি খুব দোষের? রাণীদের এই হিংসার পিছনে রাজার এতগুলো বিয়ে এবং ছোটরাণীর প্রতি পক্ষপাতকে কখনো দায়ী করা কিন্তু হয় না। যাই হোক বড়রাণীদের চক্রান্তে সাতপুত্র-এককন্যা জন্মদানকারী ছোটরাণী ‘ব্যাঙের ছানা ইঁদুরের ছানা’ জন্ম দেয়ার অপরাধে রাজার এত প্রিয় ছোটরাণী রাজপুরী থেকে নির্বাসিত হলেন। পুত্র জন্ম দিতে না পারার শাস্তি।

শান্ত ছোটরাণী ভালবাসার পাত্রী, পুত্র জন্ম দিতে অক্ষম ছোটরাণী বিতাড়িত।

রাজার প্রতি আমাদের কোনো ক্ষুব্ধতার বোধ পর্যন্ত তৈরি হয় না। যত রাগ এবং ঘৃণা সঞ্চিত হয় বড় রাণীদের উপর। ছাইগাঁদার কাছে পুঁতে রাখা সাত চম্পা-পুত্র ও পারুল-কন্যার বুদ্ধিতে বড়রাণীদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হলে “রাজা তখনই বড়রাণীদিগে হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়া পুঁতিয়া ফেলিতে আজ্ঞা দিয়া, সাত-রাজপুত্র, পারুল মেয়ে আর ছোটরাণীকে লইয়া রাজপুরীতে গেলেন।” রাজা আগে বিতাড়ন করেছিলেন ছোটরাণীকে এখন করলেন বড়রাণীদের। কোনো না কোনো রাণী কিন্তু রয়েই গেলেন রাজার কাছে, সব সময়ই। রাজার কীসের অভাব? রাজার ক্ষমতা রাণীদের বিতাড়নে, রাণীদের দৌড় অন্য রাণীদের পিছনে ফেলে রাজার কাছে গৃহীত হবার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া পর্যন্ত, কার ভাগ্যে কখন শিঁকে ছিড়বে তার অদৃষ্টনির্ভর প্রতীক্ষায়। বড়রাণীদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে রাজার চোখ ফোটানোতে সাত-রাজপুত্র ও পারুল মেয়ের ভূমিকা সমানই ছিল তবুও গল্পটার নাম কিন্তু সাত ভাই চম্পা।

শীত বসন্ত গল্পে সুয়োরাণীর চক্রান্তে “দুঃখিনী দুয়োরাণী টিয়া হইয়া টি-টি করিতে করিতে উড়িয়া গেল।” রাজা দুয়োরাণীর জন্য দুঃখিত হওয়া তো দূরের কথা খোঁজ পর্যন্ত করলেন না। বরং সেই সুয়োরাণী সতীনপুত্রদের রক্ত দিয়ে স্নান করতে চাইলে ‘অমনি রাজা জল­াদকে ডাকিয়া আজ্ঞা দিলেন, “শীত-বসন্তকে কাটিয়া রাণীকে রক্ত আনিয়া দাও।” কী ভয়ঙ্কর! সতীন পুত্রের রক্তে স্নান করতে চেয়ে সুয়োরাণী যতখানি অপরাধ করেছে, আপন সন্তান শীত-বসন্তকে কেটে রাণীকে রক্ত এনে দেবার আদেশ কি সে অপরাধের চেয়ে অনেক বেশি বিভৎস নয়? জল­াদের মনে যে মমতা আছে সে মমতা রাজার মনে নেই আপন সন্তানের জন্য। কারণ ক্ষমতাবানের কাছে স্নেহ-মমতা-ন্যায়-অন্যায়বোধের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, নিজস্ব স্বার্থবোধ, শ্রেয়বোধই একমাত্র চালিকাশক্তি। তবুও রাজা অশুভ বা অনিষ্টকারী সত্ত¡া নন! এজন্য তাকে কোথাও জবাবদিহি পর্যন্ত করতে হয় না। এই পাশবিক আদেশ প্রদানের জন্য রাজাকে ঘৃণা করার আবহ তৈরির কোনো চেষ্টা এ গল্পে নেই। আর একজন রূপবতী রাজকন্যা আছেন কাহিনীটিতে যিনি শুধুই সাজগোজ করেন। সাজগোজ করেন এবং সোনার টিয়াকে জিজ্ঞাসা করেন, “সোনার টিয়া, বল তো আমার আর কি চাই?” সাজগোজের জন্যই সোনার টিয়ার পরামর্শে সয়ম্বর সভায় বায়না ধরেন গজমোতির হারের। একটু লক্ষ্য করলে দেয়া যাবে, রূপকথাগুলোতে অরাক্ষসী রাজকন্যাদের চরিত্র অত্যন্ত অপরিণত, আশা-আকাক্সক্ষাগুলো হাস্যকর। কিছুতেই যেন ব্যক্তি হয়ে ওঠে না। অথচ তাদের আবদার মিটাতে অন্যদের প্রাণান্তকর অবস্থা। “গজমোতির আলোতে দেশ উজল করিতে করিতে বসন্ত রূপবতী রাজকন্যার দেশে আসিলেন।” গজমোতি হচ্ছে সম্পদসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সে সম্পদ অর্জনের জন্য অবশ্য প্রয়োজন বীরত্ব। শীত-বসন্তের সেই বিপুল সম্পদ এবং বীরত্বের কাছেই কেবল রাজকন্যা বিক্রিত হতে পারেন। শীত-বসন্তের কৃতিত্বে তাদের মার জীবনের অমানিশা শেষ হয়। হিংসুটে সুয়োরাণী পাপের প্রায়শ্চিত্ত-স্বরূপ মরে গেছে ইতিমধ্যে। রাজা শীত-বসন্তকে কেটে সুয়োরাণীর জন্য রক্ত নিয়ে আসার আদেশ প্রদানকারী হওয়া সত্তে¡ও যেহেতু কোনো অশুভ শক্তির প্রতিনিধি নন তাই “সকল শুনিয়া বনবাস ছাড়িয়া রাজা আসিয়া শীত-বসন্তকে বুকে লইলেন।” কী আনন্দ!

কিরণমালা একমাত্র ব্যতিক্রমী গল্প যেখানে রাজকন্যা কিরণমালা সক্রিয়। কাহিনীতে সঙ্কটের শুরু যথারীতি রাণীর আপন বড় দুই বোনের হিংসা ও চক্রান্তের মধ্য দিয়ে। তিন তিন বার রাণী সন্তান-সম্ভবা হলে তিনবারই হিংসুক দুই বোন রাজাকে কুকুর ছানা, বিড়াল ছানা এবং কাঠের পুতুল দেখালে রাজ্যের লোকের মন্তব্য “এ অলক্ষণে” রাণী কখখনো মনিষ্যি নয় গো, মনিষ্যি নয়Ñ নিশ্চয় ‘‘পেতœী কি ডাকিনী” শুনে রাজা রাণীকে রাজ্যের বের করে দিলেন। হিংসুক বড়বোনদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলো। প্রশ্ন আসে প্রায় প্রতি গল্পেই কেন রাজারা তাদের সন্তানদের জন্মের এজাতীয় উদ্ভট তথ্যে বিশ্বাস করেন কোনো বিবেচনা ছাড়াই? তাহলে এসব গল্প কোন সময়কে ধারণ করে? তবুও, শুরুটা গতানুগতিক হলেও, এটি হচ্ছে একমাত্র গল্প যেখানে নায়িকা সক্রিয়। একসময় অবশ্য আমরা এই সক্রিয়তার অন্য ব্যাখ্যাও খুঁজে পাবো। মায়া পাহাড়ে মায়ার ডাকে অরুণ, বরুণ দুই ভাই হারিয়ে যাওয়ার পর কিরণমালা মায়া পাহাড়ের উদ্দেশ্যে বের হলেন। মায়া পাহাড়ও কি একটি নারীপ্রধান রাজ্য? না-হলে লক্ষ লক্ষ রাজপুত্র কেনো সেখানে পাথর হয়ে থাকবে? মায়া পাহাড়ের দেশে অরুণ, বরুণ পৌঁছানোর পর যে বর্ণনাটা আমরা পাই একটু খেয়াল করে দেখা যাক,
“অমনি চারিদিকে বাজনা বাজে, অপ্সরী নাচে, পিছন হইতে ডাকের উপর ডাক ‘রাজপুত্র! রাজপুত্র! ফিরে চাও! ফিরে চাও! কথা শোনো!’
অপ্সরী নাচে বোঝা গেলো। কিন্তু কে ডাকে বোঝা গেলো না। ডাকে যে অপ্সরীই সেটা জানা যায় কিরণমালা যখন গেলেন মায়া পাহাড়ে। কোনো মায়ার ডাকেই কিরণমালা পিছন ফেরেন না। অনেকেই ভয় দেখায় বটে, পিঠের উপর বাজনাও বাজে কিন্তু ডাকে অপ্সরী। অপ্সরা নাচে, “রাজপুত্র, এখনো শোন!” আবার কিরণমালা যে কোনো ডাকেই পিছন ফেরেন না, এই দৃঢ় চিত্ততার ক্ষেত্রেও এখানে একটি ফাঁক ধরিয়ে দেয়া আছে। মায়া পাহাড়ে পৌঁছানোর পর অরূন, বরূণ এবং কিরণমালা তিনজনের চারিদিকেই দৈত্য, দানো, বাঘ, ভালুক, সাপ, হাতি, সিংহ, মোষ, ভূত-পেতœী ঘিরে ধরেছে এবং পিছন থেকে ডাকের উপর ডাক দিয়েছে “রাজপুত্র, রাজপুত্র, এখনো শোন!” অরূণ, বরূণ রাজপুত্র তাই পিছন ফিরে তাকিয়ে পাথর হয়ে গেছেন। কিন্তু রাজপুত্রের পোষাক পরে থাকা সত্তে¡ও “কিরণমালা তো রাজপুত্র নন, কিরণমালা কোনোদিকে ফিরে চাহিলেন না।” যাইহোক কিরণমালা নিঝুম মায়া পাহাড়ের পাথর হয়ে যাওয়া সকল রাজপুত্রকে মুক্তি দিয়েছেন যদিও সেই পাহাড় থেকে উপড়ে এনেছেন রূপার গাছ, সোনার ফল ধরা হীরার গাছের ডাল, নিয়ে এসেছেন সোনার ঝারি এবং সোনার পাখি অর্থাৎ যা কিছু সম্পদ মায়াপাহাড়ের। এ কাহিনীতে কিরণমালাই মূল এবং সক্রিয় চরিত্র। একমাত্র ব্যতিক্রমী রূপকথা। তবুও এ কাহিনীতেও নারীর বিরুদ্ধে নারী। মায়া পাহাড়, অর্থাৎ অন্য একটি নারীপ্রধান রাজ্যের পতন ঘটালেন রাজকন্যা কিরণমালা। মায়ার পাহাড়? আজও নারী ছলনাময়ী, রহস্যময়ী, মায়ায় ঘেরা এসব তো অতি সাধারণভাবে, সব সময়ে উচ্চারিত কথাগুলোর একটি। অরূণ-বরূণ-কিরণের কল্যাণে নির্বাসিত রাণী মিলিত হতে পেরেছেন স্বামী-পুত্রের সাথে এবং ফিরে আসতে পেরেছেন রাজপূরীতে। এ কাহিনীতে আর একটি উলে­খযোগ্য দিক হলো রাণীর প্রতি অবিচারের জন্য না হলেও নির্বুদ্ধিতার জন্য রাজা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। অরূণ-বরূণ-কিরণমালার প্রাসাদে নিমন্ত্রণ খেতে এসে মোহরের পায়েস, মোতির পিঠা, মুক্তোর মিঠাই, মণির মোন্ডা এসব মানুষ কেমন করে খাবে প্রশ্ন করলে সোনার সুখপাখী পাল্টা প্রশ্ন করেছে রাজাকে, “মানুষের কি কুকুর-ছানা হয়?” রূপকথায় যুক্তির প্রসঙ্গ। কাহিনী শেষে অরূণ-বরূণ-কিরণমালার দুই হিংসুটে মাসির বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলা হলো। ইউরোপে ডাইনী হত্যার বিবরণ পাওয়া যায়। হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলা কি ডাইনী হত্যার এদেশীয় সংস্করণ যার কোনো রেকর্ড কিংবা পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই?

সেইসব রাক্ষসীদের পুর
ঠাকুমার ঝুলির রূপ-তরাসী পর্বের সব কটি গল্পে রাজপুত্র এবং রাক্ষসীদের সরাসরি বিরোধের প্রসঙ্গ এসেছে। এবং এই পর্বের রূপকথাগুলো শুরু হওয়ার আগে একটি বড় কবিতায় এক বা দুই লাইনে প্রতিটি গল্পের পরিচয় দেয়া আছে। সেই কবিতারই প্রথম দুই লাইন হলো:

রূপ দেখতে তরাস লাগে, বলতে করে ভয়
কেমন করে রাক্ষসীরা মানুষ হয়ে রয়!

এই পর্বের গল্পগুলোয় আমরা সরাসরি রাক্ষসীদের যেমন দেখি, তেমনি দেখি কোনো রাজার রাজপুরীতে রাণীর ছদ্মবেশে থাকা রাক্ষসীদের। ক্রমে যাদের স্বরূপ উন্মোচিত হবে বলে পাঠক অপেক্ষা করতে থাকেন।

রাক্ষসী-পুত্র অজিত এবং মানবী-পুত্র কুসুমের যৌথ উদ্যোগে রাক্ষসী-রাণী (অজিতের মা), রাক্ষসী-রাণীর সকল রাক্ষস-রাক্ষসী মেরে ফেলার অসম্ভব বর্ণিল কাহিনী নীলকমল আর লালকমল। ছন্দ আর ভাষার অপরূপ কারুকাজ, কাহিনীর ব্যপ্তি এবং বৈচিত্র শৈশব কিংবা কৈশার মানসে অপরূপ রূপকল্প তৈরি করে।

“নীলকমলের আগে লালকমল জাগে
আর জাগে তরোয়াল,
দপ্ দপ্ করে ঘিয়ের দীপ জাগে
কার এসেছে কাল?”

কে-না উদ্দীপ্ত হয় এই সাহসে? রাক্ষক-খোক্কসদের বিরুদ্ধে লালকমল-নীলকমলের বীরত্বের কাহিনী এদেশের বৃটিশবিরোধী সংগ্রাম, পাকিস্তানের আইয়ূব-ইয়াহিয়া-বিরোধী আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে নানা গল্প, উপন্যাস, কবিতা এবং নাটকে। উপনিবেশিক শক্তির প্রতীক হিসেবে রাক্ষস-খোক্কস এবং এদেশের সংগ্রামী জনতার বিজয়ী-বীরের প্রতীক হিসেবে লালকমল-নীলকমলের উপমা বারেবারেই ব্যবহৃত হয়েছে। এই দুই রাজপুত্রের অসম্ভব বীরত্ব ও অসাধারণ কৌশল আমাদের এতই মুগ্ধ করে যে ঘরে ঘরে লালকমল আর নীলকমলের জন্ম সম্ভবত প্রতিটি বাঙালি মানসের আকাক্সক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। রাজপুত্রের জন্য আকাক্সক্ষা। যেমন এক সময়ে ক্ষুদিরামের জন্য হয়েছিল। কাহিনীর এই দিকটির ব্যবহার আমাদের এতই মোহাবিষ্ট করে রাখে যে এর অন্যদিকগুলোতে আমরা দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করি না। জোড়া রাজকন্যা ইলাবতী লীলাবতীর উপস্থিতি এ কাহিনীতে আসে এক লাইনে নীলকমল আর লালকমলের বীরত্বের অর্ধেক উপঢৌকন হিসেবে। বাকী অর্ধেকটা হলো রাজত্ব। রূপকথাগুলোতে রাজপুত্রদের বীরত্বের উপহার হিসেবে রাজকন্যা আর অর্ধেক বা পূর্ণ রাজত্বের বিষয়টি এমনভাবে একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় যে দু’টি যেন একই বস্তু, সমদামের। এই রূপকথায় রাক্ষক-খোক্কস রাজত্বের প্রধান আয়ী-রাক্ষসী যার অধীনে আই রাক্ষস, কাই রাক্ষস, রাক্ষস-খোক্কসদের দঙ্গল। আয়ী-রাক্ষসী রাক্ষস-খোক্কস রাজত্বের প্রধান, এক বিশাল রাজত্ব চালাচ্ছে অন্যদিকে তার কন্যা রাক্ষসীরাণী অজিতের মা অন্য রাজত্ব উজার করে দিচ্ছে। অবশ্যই ছদ্মবেশে। অর্থাৎ রাক্ষস-খোক্কস রাজত্বের প্রধান দুই চরিত্র দুই নারী। তারা অশুভ শক্তির অধিশ্বর। তাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছে রাজপুত্ররা আরামকাটী-বিরামকাটী আর জীয়নকাটী-মরণকাটীর সাহায্যে। স্বয়ং পুত্র দাঁড়িয়েছে মায়ের বিরুদ্ধে। এবং দাঁড়িয়েছে বলেই এই রাক্ষসপুরী, আয়ী-রাক্ষসী, মা-রাক্ষসী, রাক্ষসক‚ল, খোক্কসকূল ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। যেমন বিভীষণ রাবণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই লঙ্কাপুরীর পতন সম্ভব হয়েছিল। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে আমরা ধন্য ধন্য করছি রাজপুত্রদের, তারা ধন্যবাদ পাওয়ারই যোগ্য বটে কিন্তু মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি নিরন্তর হয়রান করে তোলে, এই যে হাজার হাজার রাক্ষস-খোক্কস এবং তাদের রাণী, রাণী-কন্যাকে মেরে ফেলা হলো এটাও কি বিপরীত একটি জেনোসাইড নয়? রাক্ষসী-রাণী খেয়ে খেয়ে রাজত্ব উজাড় করে ফেলছিল, অত্যন্ত অন্যায়। আমরা ভয় পেয়েছি, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে চেয়েছি। অথচ গোটা রাক্ষস-রাজত্ব সংহার হয়ে গেলে আমরা কিন্তু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। গোটা রাক্ষস-রাজত্ব সংহার করে ফেলার মধ্যে কোন অন্যায় থাকতে পারে আমরা স্বপ্নেও ভাবি না। ভাবার কথাও না। ভাবনা আসতে পারে এমন কোনো ফাঁক রেখে তো লেখা হয় নি এসব রূপকথা। রাক্ষসদের বিরুদ্ধে আমাদের (?) রাজপুত্ররা বিজয়ী হয়েছেন। সম্ভবত বিজয়ীর ডিসকোর্স বিজিতের ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। রাক্ষস নিধনের প্রচলিত ব্যাখ্যাটিও খুবই গ্রহণযোগ্য। সকল অশুভ শক্তির বিনাশের মাধ্যমে সত্য-সুন্দর ও শুভের প্রতিষ্ঠা। এ যুক্তির বিরোধিতা করি সে জোর কই? শুখু একটা প্রশ্ন তবুও থেকে থেকেই উত্যক্ত করে, সকল রাক্ষস-রাজত্বের প্রধানই কোনো একজন নারী? তাহলে কি নারী-শাসিত রাজত্ব মাত্রই পুরুষতান্ত্রিক রূপকথাকারের কাছে রাক্ষস-পুরী? ক্ষমতা, কর্তৃত্ব কিংবা বিশেষ কৌশল আয়ত্বে আছে যেসব নারীর তারাই রাক্ষসী নয় তো?

ডালিম কুমার গল্পের কথাই ধরা যাক। রাক্ষসী-রাণী (এখানেও রাক্ষসী রাণী ছদ্মবেশে) যেই দেখলেন ডালিম কুমার তার সাতপুত্রের সাথে দেশ-ভ্রমণে বের হয়েছে অমনি সে সতীন পুত্র যেন পাশাবতীর রাজকন্যাকে পরাস্ত করে তার পাশা নিয়ে না আসতে পারে, পারে যেন তার পুত্র সেজন্য কৌটা খলে সূতাশঙ্খ সাপকে লিখন দিয়ে পাঠলো।

“যাও ওরে সূতাশঙ্খ, বাতাসে করি ভর,
যম-যমুনার রাজ্য-শেষে পাশাবতীর ঘর!
এই লিখন দিও নিয়া পাশাবতীর ঠাঁই,
সাত ছেলের তরে আমার সাত কন্যা চাই।
রিপু অরি যায়, সূতা, চিবিয়ে খাবে তারে,
সতীনের পুত যেন পাশা আনতে নারে।”

অর্থাৎ লিখন বা বার্তা লেখার ক্ষমতা রাণীর আছে, আছে সেই বার্তা বহন করার জন্য অনুগত বাহক এবং সে বার্তা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্ক। তাই রাক্ষসী-রাণীর হুকুম পাওয়ামাত্র লিখন নিয়ে, সূতাশঙ্খ, বাতাসে ভর দিয়া গাছের উপর দিয়া-দিয়া চলিল। পক্ষীরাজও রাক্ষসীর হাতের পুতুল। রাক্ষসী-রাণী আবার যেই মন্ত্র পড়ল,

“পক্ষীরাজ, পক্ষীরাজ, উঠে চলে যা,
পাশাবতীর রাজ্যে গিয়ে ঘাস জল খা।”

অমনি মন্ত্র-পড়া পক্ষীরাজ একেবারে পাশাবতীর পুরে গিয়ে উপস্থিত। অর্থাৎ সাপ, পক্ষীরাজ বা প্রকৃতির অন্যান্য জীবের সাথে এই রাক্ষসী-রাণীর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বনে-জঙ্গলে বিভিন্ন প্রাণীকূলের মধ্যে যেমন আন্তঃনির্ভরতার সম্পর্ক থেকে যায়। এই পাশাবতীর পুরও সম্ভবত একটি নারীপ্রধান রাজ্য কারণ “পাশাবতীর পুরে পাশাবতী দুয়ারে নিশান উড়াইয়া ঘর-কুঠুরী সাজাইয়া, বসিয়া আছে। যে আসিয়া পাশা খেলিয়া হারাইতে পারিবে, আপনি, আপনার ছয় বোন নিয়া তাহাকে বরণ করিবে। …” ধারণা করা যায় পাশাবতীর নামেই এই রাজ্যের নাম পাশাবতীর পুর। এবং কাহিনী অনুযায়ী পাশাবতী ও তার ছয় বোন রাক্ষসী কারণ তাদের পাশা খেলার পণ হলো:

“যে জিনে সে মালা পায়,
হারিলে মোদের পেটে যায়!”

কোনো রাজপুত্রই তাদের সাথে পাশা খেলায় জিততে পারে না। এই রাজকন্যার সাথে রাক্ষসী-রাণীরও সম্পর্ক রয়েছে কারণ রাক্ষসী-রাণীর সাত পুত্রের সাথে পাশা খেলার আগে পাশাবতী কোন লিখন আছে কী-না জানতে চায়। সেই লিখন! এই পাশা খেলার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমার কাছে। হতে পারে এই পাশা হচ্ছে এই রাজত্বের সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং পাশা খেলা হচ্ছে কোনো যুদ্ধের প্রতীক। এই পাশা খেলায় হার-জিতের বিষয়টি আসলে রাজপুত্রদের সাথে রাজকন্যা পাশাবতীর যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের প্রতীকী উপস্থাপন। দেখা যাচ্ছে বরাবরই রাজপুত্ররা এই পাশা খেলায় হেরে যাচ্ছে এবং পাশাবতী ও তার ছয় বোন সেসব রাজপুত্র ও তাদের ঘোড়াসহ ভক্ষ্যযোগ্য সকল কিছু খেয়ে ফেলছে। অর্থাৎ এমনকি হতে পারে যে রাজপুত্র যারাই এসেছে এই সাত বোনকে হারিয়ে এ রাজ্য জয় করতে তারা সকলেই হেরেছে আর যুদ্ধে যারা হারে তারা তো বিজয়ী কর্তৃক গ্রাসিতই হয়? তাদের চিহ্ন আর পাওয়া যায় না? যেমন রাজপুত্র ডালিম কুমারের হাতে শেষ পর্যন্ত পাশাবতী যখন হেরে যায় তখন কিন্তু রাজপুত্রের সাথে আমরাও দেখি “সাত পাশাবতী সাত কেঁচো হইয়া মরিয়া রহিয়াছে।” ঠাকুমা’র ঝুলি-র এ পর্যন্ত যে গল্পগুলো দেখেছি সেখানে রাক্ষসী সবাই বুড়ি, বিগত-যৌবনা এবং তাদের আয়ত্বে অনেক ক্ষমতা। কারণ অনুমান করা যায় হয়তো। একদিক থেকে দেখতে গেলে সমাজে বিগত-যৌবনা, বৃদ্ধা নারীরা অসম্মানের পাত্র, যৌন-মূল্য হারিয়ে ফেলার কারণে, কাজেই তাদের উপস্থিতি উপেক্ষণীয়, আলোচনার অযোগ্য। কিন্তু যেসব নারী নিজগুণে এবং জ্ঞানে অনেক ক্ষমতার অধিকারী কিংবা শাসন করছেন নিজের ক্ষমতা বলয় তাদের অগ্রহ্য করা চলে না। তাদের পরাস্ত করতে হয়। পরাস্ত করার জন্য, যুদ্ধ ঘোষণার জন্য তাদের জ্ঞান, ক্ষমতা ও দক্ষতাকে অ-মানবিক, রাক্ষসীর বলে প্রতিষ্ঠিত করা বোধহয় প্রয়োজন হয়। আর একথাও ঠিক অনেক গুণ, দক্ষতা অর্জনের জন্য মানুষকে দীর্ঘ সময় সাধনা করতে হয়। দীর্ঘ সাধনার পর অন্যের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকারী যোগ্যতা অর্জন করতে তাকে বৃদ্ধই হতে হয়। আবার ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী বুড়ি অর্থাৎ জ্ঞানী নারীরা পুরুষতান্ত্রিক একচেটিয়া কর্তৃত্ব-ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। হয়তো এই উভয়বিধ কারণেই কোনো রাজ্যের প্রধান ক্ষমতার অধিকারী রাক্ষসীরা সবাই বুড়িÑ তিন বুড়ির রাজ্য, ছোট কাঁথা সেলাইকারী একশ বচ্ছুরে বুড়ি, রাক্ষস-খোক্কস রাজত্বের আয়ী-রাক্ষসী। কিংবা জ্ঞানী নারী মাত্রই রাক্ষসী। কিন্তু ডালিম কুমার গল্পটিতে পাশাবতী এবং তার ছয় বোন বুড়ি নয়। সুন্দরী-তরুণী। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত কোনো পুরুষের গলায় মালা দেয় নি। এবং স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করছে, যেখানে কোনো রাজপুত্রই এই রাজ্যকে জয় করতে পারছে না। হয়তো তাদের এই স্পর্ধাই তাদের রাক্ষসী অভিধায় প্রতিষ্ঠিত করেছে? আজও সমাজে “বিয়ের বয়স পার হয়ে যাওয়া” নারীকে অহরহই কি রাক্ষসী বা এ জাতীয় অভিধায় অভিহিত হতে দেখি না আমরা?

পাতালপুরীর রাজকন্যা মণিমালা। এই পাতালপুরী হচ্ছে সাপের পুরী। মণিমালা যদি এই পাতালপুরীরই রাজকন্যা হন তাহলে তিনি কিন্তু এই সাপেদেরই কন্যা। তাছাড়া আমরা তো এও জানি নাগ বা সাপ ভারতবর্ষেরই একটি জনগোষ্ঠীর নৃতাত্তি¡ক ঠিকুজি। কোসাম্বা তাঁর অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি বইতে দেখিয়েছেন মাতৃগোত্র এবং পিতৃগোত্র নিয়ে টানাপোড়েনের যুগসন্ধির সময়টাতে বিভিন্ন উপজাতিকে সাধারণভাবে নাগ বলে অভিহিত করা হতো। এবং এদের সামাজিক সংগঠন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল মাতৃপ্রধান। সে যাই হোক, সাপের পুরীর সাপেরা মণিমালার অন্তত কোনো ক্ষতি করে নি। মণিমালা সেখানে রাজকন্যা। যেহেতু সাপের পুরীর সম্পদ সাত-রাজার ধন অজগরের ফণীর মণি রাজপুত্র-মন্ত্রীপুত্রের করতলগত করা সম্ভব হয়েছে অজগরের পক্ষ থেকে বিনা উস্কানিতে কাজেই রাজকন্যাও তাদের হবেন এতে আর আশ্চর্য কী? সাপপুরীকে পরাস্ত করে “মণির আলো মণির বাতি, ঢাক ঢোলে হাজার কাটী, রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র, মণিমালা আর রাজকন্যাকে লইয়া অপনদেশে চলিয়া গেলেন!” অন্যের সম্পদ লুণ্ঠনের এই আগাগোড়া ইতিবৃত্ত বর্ণনার চমকে হয়ে উঠেছে আমাদের প্রিয় রূপকথা। আগেও দেখেছি রাজকন্যারা সম্পদের কাছে বিক্রিত হন। হতে পারে লুণ্ঠক রাজপুত্র সেই সম্পদ তারই রাজত্ব থেকে লুণ্ঠণ করেছেন। এই সম্পদ আর শক্তির কাছে নতজানু যে রাজকন্যা সে রাজবধু হয়ে লুন্ঠণকারী রাজপুত্রের সাথে নিজ দেশের সম্পদ নিয়ে চলে যান, তার রাজকন্যা ইমেজ অটুট থাকে। আর যিনি বিরোধিতা করেন এই লুণ্ঠন এবং পরাধীন হবার চক্রান্তের, তিনি রাক্ষসী। মাত্রই বলেছি সম্পদ যার কাছে, অরাক্ষসী রাজকন্যারা তার কাছেই বিক্রিত হন। তাই বাজারের নিয়ন্ত্রণকারী ঢোল-ডগর যখন বানরের হাতে, রাজপুত্রের প্রত্যাশায় বসে থাকা রাজকন্যা কলাবতী বানরকেই স্বামীর পদে বরণ করে নেন। যতদিন সাত-রাজার ধন অজগরের ফণীর মণি সাপের পুরীর সম্পদ ততদিন রাজকন্যা সাপের পুরীতেই বহাল তবিয়তে রয়েছেন। মণিই যখন রাজপুত্রের হাতে তখন তিনিও রাজপুত্রের। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য মণিমালার নির্বুদ্ধিতায় কিংবা পেঁচোর মা ‘বুড়ি’র (ঠাকুমার ঝুলির ১৮৪ পৃষ্ঠায় বুড়ির ছবিটা একবার দেখে নেয়া যেতে পারে। কী কুৎসিত করেই না আঁকা হয়েছে! ‘বুড়ো হাবড়া মেয়ে মানুষ’, যেন এক রাক্ষসী। পবনের নাও চালানোর কৌশল আয়ত্বে আছে বলেই কি? “হুর্ট হর্ট পবনের না’, মণিমালার দেশে যা” বলে মন্ত্র পড়লেই পবনের না’ মণিমালার দেশে চলে যায় বলে?) কুশলতায় কিছুদিনের জন্য যখন অজগরের মণিটি বুড়ির হাতে তখন পেঁচোর সাথে পেঁচোদের রাজত্বের রাজকন্যার বিয়ে হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। আসলে বিয়েও হয় কারণ তখন তো কেউ জানে না, যে-পেঁচো রাজকন্যাকে বিয়ে করলো সে আসলে ছদ্মবেশী মন্ত্রীপুত্র, ‘বুড়ো হাবড়া মেয়ে মানুষ’ পেঁচোর মায়ের কাছ থেকে মণিটি হাতিয়ে নেয়ার জন্য পেঁচোর রূপ ধারণ করেছেন! কিন্তু বাজারের নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ঢোল-ডগর, রাজ্য-শাসনের হাতিয়ার ছোট কাঁথা, পাশাবতীর পাশা, মণিমালার মণি কোনোটাই প্রকৃতপক্ষে বানর, পেঁচা, পেঁচোর মা দরিদ্র বুড়ির মত সাধারণের নিয়ন্ত্রণে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তাই আমরা দেখি বানর, পেঁচা আসলে ছদ্মবেশী রাজকুমার, পেঁচোর সাজ ধরে পেঁচোর মা দরিদ্র বুড়ির কাছ থেকে অজগরের মণি আত্মসাৎ করে রাজকন্যাকে বিয়ে করে যে-পেঁচো সে আসলে মন্ত্রীপুত্র। এ তথ্য বাসর ঘরে ফাঁস হলে রাজকন্যার মত আমরাও আশ্বস্ত হই আর বেচারী পেঁচোর মা বুড়ি ‘মাথা খুঁড়িয়া’ মরে। আমরা দ্বিতীয়বার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। রাজপুত্র মণিমালা, পাতালপুরীর সকল সম্পদ এবং সাতরাজার ধনের সমতুল্য মণি নিয়ে নিজ দেশে চলে যাবার পর “পাতালপুরীর সাপের রাজ্যের সকল সাপ বাতাস হইয়া উড়িয়া গেল।” গণহত্যা, ধ্বংস আর লুণ্ঠনের কী ভয়ঙ্কর চিত্র অথবা আমরা একবারের জন্য দীর্ঘশ্বাসটুকু পর্যন্ত ফেলতে প্ররোচিত হই না।
সোনার কাটী রূপার কাটী গল্পেও রাজপুত্র বনের মধ্যে রাক্ষসীর রোষের শিকার হলেন। রাক্ষসী খেয়ে ফেলেছে তার তিন বন্ধু মন্ত্রীপুত্র, সওদাগরপুত্র ও কোটালপুত্র এবং তাদের ঘোড়াদের। শুধু রাজপুত্রকেই খেতে পারে নি। এই রাক্ষসী রাজপুত্রকে খাওয়ার জন্য সুন্দরী নারীর বেশ ধরে রাজপুত্রকে তাড়াতে তাড়াতে যে রাজ্যে নিয়ে এসেছে সেই রাজ্যের রাজার রাণী হয়ে রাজপুরীতে প্রবেশ করে। এবং নিরন্তর চেষ্টা চালাতে থাকে রাজপুত্রকে খাওয়ার। যদিও আপন বুদ্ধিমত্তা এবং গাছ, মাছ, গৃহস্থ-বৌয়ের সাহায্যে রাজপুত্র প্রতিবারই রাক্ষসী-রাণীর হাত থেকে রেহাই পেয়ে যান। এই রাক্ষসী-রাণীরও কিন্তু রয়েছে নিজস্ব রাক্ষস-রাজত্ব, সেই রাজত্বের প্রধান, রাক্ষসী-রাণীর মা, একজন আয়ী-রাক্ষসী অর্থাৎ বুড়ি অর্থাৎ জ্ঞানী রাক্ষসী। অর্থাৎ সেই রাজত্বের প্রধান একজন নারী। কিংবা বলা যায় যেহেতু ওই রাজত্বের প্রধান একজন নারী, তাই তিনিই রাক্ষসী। সূত্র অনুযায়ী তিনি রাক্ষসী এবং বুড়ি। এই বুড়ি রাক্ষসী এবং তার বাহিনী এক রাজ্য বিজয় করে সকলকে খেয়ে ফেলেছেন কিন্তু শত্র“র শেষ এক রাজকন্যাকে স্নেহে প্রতিপালন করছেন। শত্র“র শেষ রাখার কোনো নির্বুদ্ধিতা কোনো রাজপুত্রই কখনো দেখান নি। সোনার কাটী, রূপার কাটী বদল করে রাজপুত্র প্রথমে রাজকন্যাকে জাগিয়েছেন এবং পরে এই রাজকন্যাই আয়ী-রাক্ষসীর কাছ থেকে স্নেহের প্রশ্রয়ের সুযোগে জেনে নিয়েছেন রাক্ষস-রাজত্বের সকল মৃত্যু-কবচ, জেনে নিয়েছেন রাজপুত্রের পিছু নেয়া আয়ী-রাক্ষসীর মেয়ে রাক্ষসী-রাণীর মরণ-বানের হদিস। আয়ী-রাক্ষসীর কথা থেকে বোঝা যায়, তাদের রাজত্ব এবং জীবন অত্যন্ত সুরক্ষিত। “… এ পিত্থিমির মোঁদের কিঁচ্ছুতে মঁরণ নাঁই। …” মানবপুত্রীকে আয়ী-রাক্ষসী শুধু যে অপত্য স্নেহে লালন করেছেন তাই-ই নয়, তার ছলনায় ভুলে তাকে আশ্বস্ত করার জন্য তাদের সবার প্রাণ-ভোমরার গুপ্ত খবরও বাতলে দিয়েছেন। পুকুরের ফটিক-স্তম্ভের ভেতর সেই রাজ্যের, রাজ্যের অধিবাসীদের রাজ্য-ও-জীবনব্যবস্থা সংরক্ষনের মাস্টার-প্ল্যান যা জানতে পারলেই কেবল সেই রাজত্ব এবং সেই রাজ্যের অধিবাসীদের ধ্বংস করা যায়। এই মাস্টার-প্ল্যান আবার জানা সম্ভব কেবল ভিতরের মানুষের কাছ থেকেই। রাজকন্যা আয়ী-রাক্ষসীর প্রিয় বিশ্বস্ত মানুষ বলেই তাকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে এই রাজত্বের সকল অধিবাসীর জীবন ও সম্পদ সংরক্ষণের গোপন মাস্টার-প্ল্যান উদ্ঘাটনের দুর্লভ কাজটি সম্পাদনে। রাজকন্যার কাছ থেকে সেই মাস্টার-প্ল্যান জানার পর রাজপুত্র কিন্তু এক মুহুর্ত দেরী করেন নি। রাজপুত্র নিঃশ্বাস বন্ধ করে তালগাছে উঠে তালপত্র খাঁড়া পেড়েছেন, তারপর পুকুরে নেমে স্ফটিকস্তম্ভ ভেঙ্গে সাতফণা সাপের গলা কেটে ফেলেছেন এক ফোঁটা রক্তও মাটিতে পড়তে না দিয়ে। আয়ী-রাক্ষসীসহ রাক্ষস-রাজত্বের সকল রাক্ষসের মুন্ডু খসে পড়ে গেলো। তারপর হাসন চাঁপা নাটন কাটী, চিরণ দাঁতের চিকন পাটি এবং শুক পাখী নিয়ে রাক্ষসী-রাণীর রাজত্বে গিয়ে শুক পাখীর গলা ছিঁড়ে তাকেও মেরে ফেলেছেন রাজপুত্র। এবং এভাবে তার বীরত্ব, কুশলতা এবং নৈপুণ্যের চমৎকারিত্বে “পৃথিবীতে যত রাক্ষস জন্মের মত ধ্বংস হইয়া গেল।” কী ভয়ঙ্কর! ঠাকুমার ঝুলির একের পর এক গল্পগুলোতে আর কোনো সুয়োরাণী-দুয়োরাণী, রাজপুত্র-রাজকন্যা এবং রাক্ষসীর গল্প নেই। সম্ভবত এ কারণে যে সকল সুয়োরাণীকে হেঁটে কাঁটা, উপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলার কাজ সুসম্পন্ন হয়ে গেছে, তিন বুড়ি, একশ বচ্ছুরে বুড়িসহ সকল বুড়িদের অর্থাৎ জ্ঞানী নারীদের পরাস্ত করে তাদের ক্ষমতা-কর্তৃত্ব এবং সম্পদ লুট করার কাজ শেষ হয়ে গেছে। অবাধ্য-রাণীদের সকল রাজত্ব ধ্বংস করে পৃথিবীর সকল রাক্ষসকে জন্মের মত নিশ্চিহ্ন করার কাজটি সম্পাদিত হয়ে পৃথিবীতে রাজপুত্রদের রাজত্ব কায়েম হয়ে গেছে।

কলাবতীর পুর, তিন বুড়ির রাজ্য, পাশাবতীর পুর, নীলকমলের আয়ীমার রাজ্য, পাতালপুরীর সাপেদের রাজ্য, সোনার কাটী-রূপার কাটীর রাক্ষসী-রাণীর রাজ্যসহ সকল নারীপ্রধান রাজ্য ততদিনে পরাস্ত, লুণ্ঠিত হয়েছে। নারীপ্রধান রাজ্যগুলোর সকল ক্ষমতা ও সম্পদ স্তুপীকৃত হয়েছে রাজপুত্রদের রাজত্বে। নারীপ্রধান রাজত্বের যেসব কন্যা এই নতুন ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছেন তারা বেঁচে গেছেন, রাণীর (নাকি দাসীর?) জীবন-যাপন করছেন। যারা মানেন নি তারা নিহত হয়েছেন। রাজপুত্রদের নতুন পুরীতে, নতুন ব্যবস্থায় রচিত এবং গীত হচ্ছে তাদেরই বিজয়গাঁথা। গাইছেন হার-মানা, বশ্যতা স্বীকারকারী নারীরা। যারা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশ ও উপাদান হয়ে পড়েছেন ইতিমধ্যে। যেমন বলছেন হালের ইকোফেমিনিস্টগণ: কেবল যে পুরুষই নারীকে অবদমিত করেছে, অমর্যাদা-অপমান করেছে তা নয়। সমস্ত পুরুষ-পরিমণ্ডল গ্রহণ করেছে নিয়ন্ত্রকের বা শাসকের ভূমিকা, আর নিয়ন্ত্রিত দমিত ও শাসিত হচ্ছে সমগ্র স্ত্রী-পরিমণ্ডলটাই। তারা এও বলেছেন যে, ওই স্ত্রীপরিমন্ডলের মধ্যে শুধুমাত্র যে নারীই এমন নয়, আছে নিম্নবগীয় মানুষ, অর্ধসভ্য বর্বর, জীবজন্তু, জড়প্রকৃতি, বন, নদী, পাহাড়, সমুদ্র সব্বাই।

ইকোফেমিনিস্টদের এই ব্যাখ্যায় এসে একটা গুরুতর ধন্দের মীমাংসার ইঙ্গিত বুঝি পাওয়া যায়। ঠাকু’মার ঝুলিতে রাক্ষসীদের চেহারার যে বর্ণনা বা ছবি দেয়া আছে, বারবারই মনে হয়েছে এরা কারা? কোন নরগোষ্ঠীকে কল্পনা করে আঁকা হয়েছে এসব ছবি? কখনো মনে হয়েছে রাক্ষসীদের অন্তর্গত বিকটত্ব বোঝানোর জন্য বুঝি এমন ছবি আঁকা হয়েছে। হতেই পারে এটি একটি সম্ভাব্য কারণ। আবার এমনও হতে পারে এরা ভারতবর্ষের নিম্নবর্গীয় মানুষ, কালো, অন্ত্যজ। আর্য-নান্দনিকতাবোধ যাদেরকে রাক্ষস বা বিকট হিসেবে দেখিয়েছে। রামায়ণেও আমরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে রাক্ষস হিসেবেই চিহ্নিত হতে দেখি। তাড়কা রাক্ষসীর কথা এক্ষেত্রে উলে­খ করা যেতে পারে। আজকের দিনে এসে সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষকরা যেমনটা বলছেন অরণ্যচারী আদিবাসী কোনো জনগোষ্ঠীর মাতৃতান্ত্রিক প্রধান হচ্ছেন তাড়কা রাক্ষসী। মুনিদের সাথে তাদের যুদ্ধের কারণ হচ্ছে এসব মুনিরা জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করেছিলেন। অন্যদিকে অরণ্য ছিলো এসব সমাজের বেঁচে থাকার রসদ জোগানোর উৎস। তাড়কাদের সমাজটা তখনও সংগ্রহজীবী। তাড়কা যে কারণে রাক্ষসী, হতে পারে সেই একই ধরনের কারণে রূপকথার এই নারী চরিত্রগুলোও রাক্ষসী। আজও অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী, যাদেরকে তথাকথিত সভ্যসমাজ নিম্নবর্গীয়, অর্ধসভ্য বর্বর মনে করে তাদের মধ্যে এখনও মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। প্রচলিত রয়েছে সংগ্রহজীবীতা। আমাদের দেশে মধুপুরের গড়ে গারো জনগোষ্ঠী বন থেকে যে সামান্য পাতা, পড়ে থাকা বৃক্ষের ডাল বা মধু সংগ্রহ করে সেই বিষয়টিকেই আমরা বাঙালিরা রঙ চড়িয়ে বন নিধনের দায়ে তাদের অভিযুক্ত করি অথচ একটা সত্য আমরা মাথায় রাখি না নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই গারো জনগোষ্ঠী কখনো বন ধ্বংস করবে না। এখনো সংগ্রহজীবীতা তাদের সমাজে বেঁচে থাকার অন্যতম উপায়। অদ্ভূত আরও একটি সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে। রূপতরাসী পর্বের গল্পগুলোতে সরাসরি রাক্ষসীদের উপস্থিতি দেখতে পাই। এসব রাক্ষস-রাজত্বের প্রদান, আয়ী-রাক্ষসীসহ সকলেই প্রতিদিন সকালে যায় খাদ্যের সংগ্রহে। তাহলে কি এসব রাক্ষসী সেইসব অরণ্যচারী সংগ্রহজীবী মাতৃতান্ত্রিক সমাজের মায়েরা? যাদের সাথে নিরেট বস্তুগত প্রয়োজনেই যুদ্ধ বেধেছে রাজপুত্র তথা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্যোমী পুরুষদের?

কেমন করে রাক্ষসীরা মানুষ হয়ে রয়!
কখনোবা দেখা যাচ্ছে অপূর্ব সুন্দরী রাক্ষসী রাণী হয়ে অবস্থান করছেন কোনো রাজার পুরীতে, কিংবা নিজ রাজত্বে পাশা খেলছেন। বোঝার জো-টি নেই যে সে রাক্ষসী। অথচ ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে তার রাক্ষসী পরিচয়। আচারে, বাহ্যিক চেহারায়। হতে কি পারে শুধু নিম্নবর্গীয় নারীরাই নয় উচ্চশ্রেণীর স্বাধীনচেতা নারী, নারী-রাজ্যের প্রধান বিপুল ক্ষমতার অধিকারী অবিবাহিত নারী (যেমন পাশাবতী এবং তার ছয় বোন) যাদেরকে সহজেই, আপসেই বশ করে সম্পত্তিসহ নিজ রাজ্যে নিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে হয়েছে অথচ সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় নি তাদের ক্ষেত্রেই সুন্দরী নারীর ক্রমে রাক্ষসী পরিচয় প্রকাশিত হবার রূপকটি ব্যবহৃত হয়েছে? আমার মনে হয় এসব গল্প সমগ্র পুরুষ-পরিমন্ডলের সমগ্র স্ত্রী-পরিমন্ডলের উপর নিয়ন্ত্রণ বা শাসন প্রতিষ্ঠার কাহিনী। তাই জীব-জন্তু, জড়প্রকৃতি, বন, নদী, পাহাড় কোনো কিছুর প্রতিই রাজপুত্রদের মমতা দেখা যায় না। আজকের ইকোফেমিনিস্টরা যেমনটা বলছেন যে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসন এবং বিস্তার প্রকৃতি-পরিবেশকে খুব সামান্যই বিবেচনায় নিয়েছে। অবলীলায় বুদ্ধু পাতায় পাতায় ফল যে গাছে তার গোড়ায় জড়ানো অজগরকে কেটে গাছের সমস্ত ফল পেড়ে নেয়, বুড়ির কাঁথা-ঢোল-ডগর-কৌটা সব লোপাট করে নিয়ে যায়। রাজপুত্র বসন্ত গজমোতি নেবার জন্য পাহাড়ের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে গজমোতির উপর পড়ার সাথে সাথে “ক্ষীর সাগর শুকাইয়া গেল, পদ্মের বন লুকাইয়া গেল”, তবুও বসন্ত গজমোতি নিয়ে গেলো। কিরণমালা মায়া পাহাড় থেকে উপরে নিয়ে এলেন রূপার গাছ, সোনার ফল ধরা হীরার গাছ, সোনার পাখী, মায়া পাহাড়ের মুক্তাঝরণা-জলের ঝারী, পাহাড় রিক্ত হয়ে গেলো। লালকমল আর নীলকমল খোক্কস রাজত্বের সকল খোক্কস এবং রাক্ষস রাজত্বের সকল রাক্ষসকে হত্যা করলো। ডালিমকুমার চূর্ণ করেছেন কড়ির পাহাড়, চূর্ণ করেছেন হাড়ের পাহাড়, রক্তের তরঙ্গ, রক্তের ঢেউ উঠেছে, কেটে ফেলেছেন সূতাশঙ্খ সাপ, নিহত হয়েছেন সাত পাশাবতী, ফেঁটে চৌচির হয়েছে রাজপুরীর তালগাছ। পাতালকন্যা মণিমালা-য় স্রেফ অজগরের মণির লোভে কাল অজগরকে কেটে ফেলা থেকে শুরু করে পাতালপুরীর সাপের রাজ্যের সকল সাপকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। সোনার কাটী-রূপার কাটীতে চিরদিনের মত নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে রাক্ষস-প্রজাতিকে। রাজপুত্রদের প্রতিটি বিজয়ের সাথে সাথে ধ্বংস হয়েছে অরণ্য, নদী, প্রান্তর, পাহাড়, জীব-জন্তু, বিভিন্ন মানবপ্রজাতি, বিভিন্ন বসতি। ধ্বংস হয়েছে জীববৈচিত্র্য। হত্যা আর ধ্বংসের নিষ্ঠুরতার উপর গড়ে উঠেছে বুধকুমার-রূপকুমার-ডালিমকুমার-লালকমল-নীলকমলদের বিজয়-কাহিনী, বাঙালির রূপকথা ঠাকুমার ঝুলি। রাক্ষসীরা কীভাবে মানুষ হয়ে রয়, সে বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। আসলে ওরা তো মানুষ। মানুষ হয়ে রইবে কেনো?

তবে কি আমারই পরাভব-গাঁথায় মানস সাজাই?

মানস গড়ে তোলা হয়েছে নিজেকে বন্দিনী রাজকন্যা হিসেবে ভাবতে। স্বপ্নের রাজকুমার আসবে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, ময়ূরপঙ্খীর নায়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর জল ছাড়িয়ে উদ্ধার করতে। পাঁচালীতে বড় সরাসরি কথা ছিলো, বালিকা-মন বিদ্রোহ করতে পেরেছে। রূপকথার জগত বর্ণিল, স্বপ্নের ছবি আঁকা, শৈশবের নিবিড় মমতা মাখা। মানুষ কখনোই আর শৈশবে ফিরে যেতে পারে না বলেই হয়তো শৈশবের অনুষঙ্গ, শৈশবের স্মৃতি-স্বপ্ন-সাধ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে পারে না। শৈশবে মস্তিষ্কে গেঁথে দেয়া পুরুষপরিমন্ডলের এই সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ছন্দে-ভাষায় গ্রথিত এসব রূপময় জগতের কাহিনী থেকে নিজেকে পরিত্রাণ দেয়া যায় না বলেই হয়তো বারবার পড়ি আমরই পরাভবের, অবমাননার রূপকল্প। ঘুরে মরি এ জগতের চারিধারে অথচ মনে হয় এখানে আমাকে দারুণ বঞ্চনা করা হয়েছে। দুই দিক থেকেই এ আমার পরাভবগাঁথা। যদি আমি রাজকন্যা তবে আমি বন্দিনী, আমাকে উদ্ধার করে নতুন বন্দীশালায় সোনার নুপুর কিংবা সোনার শেকল পরান রাজপুত্র। যদি আমি বুড়ি কিংবা রাক্ষসী, আমার জ্ঞান, স্বাধীনতা, আমার রাজত্ব ধ্বংস করে আমাকে নির্ব্বংশ করেছেন রাজপুত্ররা। রূপ-রস-ছন্দে-কল্পনায় বিকল্প কাহিনী নির্মাণের এবং শ্রবণের জন্য বড় আর্তি বোধ করি অন্তরে।

ভারতের অনেক অঞ্চলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিলো তথ্য হিসেবে এ অতি পুরণো। কিন্তু সে-বিষয়ের উপর স্পষ্ট ইতিহাসের বড় অভাব, ইউরোপের ইতিহাসে যেমন একটা স্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যায় এ অঞ্চলের ইতিহাসে বড় ধরনের এক বিচ্ছিন্নতায়, অস্পষ্টাতায় আছি আমরা। কলিম খান যাকে বলেন ইতিহাসের সাথে এক পর্যায়ে এসে আত্মবিচ্ছেদ ঘটেছে আমাদের। ভারতবর্ষের সামাজিক ইতিহাসের বিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনায় ঘুরে ফিরে বিভিন্ন বৈদিক সাহিত্য, উপনিষদ, পুরাণ, বিভিন্ন কিংবদন্তীর বিশ্লেষণকে সাক্ষ্য হিসেবে দেখা হয়। যেমন প্রাচীন ভারতে মাতৃপ্রাধান্য: কিংবদন্তীর পুনর্বিচার গ্রন্থে সুজিৎ চৌধুরী দেখিয়েছেন বৃহদারণ্য উপনিষদের একেবারে শেষ অধ্যায়ে একই সঙ্গে ছত্রিশজন উপনিষদকারের তালিকা পাওয়া যাচ্ছে যারা সকলেই মাতৃপদবীধারী। তিনি দেখিয়েছেন সাতবাহন যুগে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে মাতৃগোত্রধারীদের ব্যাপক সামাজিক সংগঠন মহিমান্বিতরূপে বিরাজমান ছিলো। এসব তথ্য থেকে তিনি দুটি প্রশ্ন তুলেছেন। প্রথমত, সুদূর অতীতে কি উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত একটি বিস্তৃত মাতৃগোত্রধারী সমাজের অস্তিত্ব ছিলো? সাতবাহনরা কি সেই ধারারই লুপ্তপ্রায় অবশেষ? দ্বিতীয়ত, বৈদিক গোত্রপিতা বলে যারা পরবর্তী যুগে যারা স্বীকৃত, তাঁরা কি মূলত মাতৃগোত্রেরই ধারক ছিলেন? অর্থাৎ গোত্রমাতারা কি পিতৃতান্ত্রিকতার পরবর্তী প্রবাহের চাপে গোত্রপিতায় রূপান্তরিত হয়েছেন? বলা বাহুল্য, সামাজিক এই পালাবদল একদিনে হয় নি, অবলীলায় অনায়াসেও হয় নি। মেরলিন স্টোন তাঁর প্যারাডাইজ পেপারস গ্রন্থে দেখিয়েছেন, মিশর ও পশ্চিম এশিয়ায় এই পালাবদল সংঘাত, দ্ব›দ্ব, রক্তপাত ও নিপীড়নের কী বিভৎস পটভূমি তৈরি করেছিল!

ইতিহাসের কোন কালপর্বে বাংলার কোন অঞ্চলে কোন ধরনের যুদ্ধ বা কী কী পরিস্থিতিতে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখা সম্ভব না-হলেও একটা কাঠামো থাকা প্রয়োজন আমাদের সামনে। হয়তো ইতিহাস খুঁড়লেই পাওয়া যাবে শত ঝর্ণার জল, সেই জলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে রূপকথার কাহিনীগুলো, অবয়ব পাবে। এদেশের সামাজিক ইতিহাসের বিবর্তন সম্পর্কে ব্যাপক এবং সচেতন সেই গবেষণাটি শুরু করা প্রয়োজন শুধু নয়, আশু কর্তব্য।

গবেষণা না-করে, পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই এ জাতীয় লেখার সাহস করে বসা গর্হিত, সেটুকু বোধ আমার আছে। তবে প্রতিটি টেক্সটই নিজেও কিছু ধারণা দেয় বা বলা নিরাপদ যে এই টেক্সটগুলো আমার অনুধাবনের জগতে অর্বাচিন কিছু প্রশ্ন, কিছু ধারণার জন্ম দিয়েছে। অকপটে সে কথাগুলোই লিখলাম। আমি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি। সেটা সম্ভবও নয় নিবিড় গবেষণা, পূর্বাপর নিদ্ পাঠ ছাড়া। একজন নারী হিসেবে আমার মানসগঠনে পাঁচালী, রূপকথা এসবের প্রভাব এবং সেখান থেকে এসব বিষয়ে আমার একান্ত নিজস্ব কিছু উপলব্ধি হিসেবে লেখাটিকে দেখলে আমার প্রতি সুবিচার করা হবে। যেসব সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনা করলাম সেগুলো ছাড়াও কেউ যদি আমার চিন্তা-পদ্ধতির ফাঁকগুলো ধরিয়ে দেন, কৃতজ্ঞ হবো। যেকোনো সমালোচনা, যত কঠিনই হোক, আমার এ বিষয়ের পঠন-পাঠন, জানা-বোঝা-আত্মীকরণের পরিসরকে সমৃদ্ধ করবে। আমি মনে করি উত্থাপিত প্রসঙ্গগুলো রূপকথার কাহিনী বলে পাশ কাটিয়ে চলা যায় বটে, তবে তা হবে, অন্তত মেয়েদের ক্ষেত্রে, আত্মবিস্মৃতি ইতিহাসের উপর আরো একপোঁচ ধুলো জমতে দেবার সচেতন বা অসচেতন প্রশ্রয়। কোনো টেক্সটই কি শেষ পর্যন্ত তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে ভিন্ন কিছু? এমন কি হতে পারে যে আমাদের মা-দিদিমা-ঠাকু’মারাই তাঁদের পরাভব-গাঁথার সংকেত রেখে গেছেন উত্তর প্রজন্মের কাছে, গল্পের ছলে, সেসব সংকেত উন্মোচনের জন্য?

দৈনিক সংবাদ-এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’-তে জুন-জুলাই ২০০০-এ তিন সংখ্যায় প্রকাশিত।

Your Opinion

Hello! Thanks for your time. I love to hear your perspectives, please do not hesitate to write back to me.

Got something to say?

    Follow the chariot
    of thoughts.

    Since I write sporadically and publish them here and there (sometimes only in here…), please subscribe to get updates!

      In Progress

      TBA

      Voluptas sed necessitatibus repellendus molestiae molestiae tenetur necessitatibus molestiae et aliquid occaecati et aperiam in soluta rem et ducimus deserunt atque quo repellendus consequatur nemo ratione voluptatem omnis omnis earum in explicabo porro quibusdam rerum sit aliquam ex quia necessitatibus consequatur cupiditate quo voluptas iure id ut reprehenderit amet quod quo qui non eius repudiandae omnis animi voluptates quis nobis saepe et ad consequuntur tenetur molestiae blanditiis nisi quae iste ipsa rerum hic quas.