Kaberi Gayen

  • Academic
  • Researcher
  • Writer

Kaberi Gayen

  • Academic
  • Researcher
  • Writer

Kaberi Gayen is a Bengali academic, author, and social activist known for her outspoken views on the oppression of minorities and gender inequality in Bangladesh.

Wikipedia

সেই ছোট্ট দু’টি পা

এক

– ছোড়দিরে দেখলি না রে, এই দৃশ্য দেখলি না। মা’র সাদা ধবধইবা পা দুইটাও কালো হইয়া গেলো আগুনে, পুইড়া কয়লা হইলো, আমি এই দৃশ্য আর দেখতে পারলাম না রে। বোকা মা-টা মইরাই গেলো। সারাদিন কাজ করতো, গরমে-ঘামে আর রাগে মুখ লাল থমথমা হইয়া যাইতো তাও তো খালি সবকিছু পরিস্কার করতো। বোকার মতো কাজ করতে করতে মানুষটা মইরাই গেলো। এখন আর তোর আমার জন্মদিনে পায়াস রান্ধবে কেরা? বোন বাসায় আসো, তোমারে বুকে জড়াইয়া একটু শান্তি পাই সোনা। তোমার জন্য আচার বানাইয়া মা নাম লেইখা রাখছে, প্রথমে বাংলায়, তারপর ইংরেজীতে। তুমি দেখবা না? আসো, আইসা দেইখা যাও…

 

ফোনের ওপারে হেনার হাহাকার। অপ্রকৃতস্থ মনে হচেছ ওকে। মাথার ভেতরটা কেমন হালকা হয়ে যাচ্ছে চানুর, কোন ভার নেই। মা’র আক্ষেপ ঢাকায় কোন ফুল পাওয়া যায় না পূজার জন্য, টবে লাগানো তুলসি শুকিয়ে গেছে রোদে অথচ মাত্রই তো এখানে এখন মে’র শুরু। কেউ বলে ¯িপ্রং, কেউ বলে গার্ডনিং সিজন। চানু যে পাড়ায় থাকে সেখানে উঁচু উঁচু চেস্টনাট, ওক, কপার বীচ, সিকমোর আর এলমের সারা গায়ে নতুন পাতার চকমকি। জুনিপারের গাঢ় সবুজ কাঁটাঝাড় মালাকাইটের আগুনি নাচুনি হয়ে, সবুজ আলো হয়ে ঝুঁকে আছে ডগ ডেইজির প্রান্তরে। আর কোন এক প্রাচীন সন্ন্যাসিনী টেরিজার প্রাচীনতর আবাস আঙ্গিনা জুড়ে চেরি- সাদা, বেগুনি, বারগান্ডি, হালকা গোলাপি, কুসুম রঙা -বাহারি বাতাসে পাঁপড়ির পুরূ স্তর জমেছে আঙ্গিনায়, আঙ্গিনা যেখানে শেষ হয়ে আবাসিক এলাকার রাস্তায় মিশেছে সেই সে শিরোনামহীন গেটে, গেট পেরিয়ে রাস্তায়। বুকটা হু হু করে। সেই কোন ছোট বয়সে ঘোষ বাড়ি কিংবা বিমলাধাম থেকে মা’র পূজার জবা নিয়ে আসার পথে জলে নুয়ে থাকা হিজলের ডাল আর সেই ডালে বসে নুসরাতের সাথে হিজলের মালা গাঁথার স্মৃতি মনে করে বুকটা হু হু করে। হিজলের কালো ডাল ঝুঁকে পড়েছে যে পুকুরে সেই পুকুরের কালো জলে ফ্যাকাশে গোলাপি নাকি বাংগি রঙের হিজল ছড়িয়ে থাকে, হিজল কখনো জড়াজড়ি করে থাকে না জলে, আলাদা আলাদা আলতো ভাসে। নারকেল পাতার সুতা বের করে কিংবা শাপলার ডাঁটা থেকে বের করা চিকন সুতায় মালা গাঁথতে গিয়ে প্রতিদিন দেরি হয় স্কুলে। জোর প্রতিযোগিতা নুসরাতের সাথে, কার মালা কত বড় হয়। নয় বছর বয়সে নুসরাতের সাথে ছাড়াছাড়ি, চানুর বাবার বদলির চাকরি। অথচ এখনো নুসরাতের সাথে খেলার জন্য মনটা দেখো কেমন নির্লজ্জের মতো মুখিয়ে আছে। হেনা তখন ছোট, সব খেলায় দুধ-ভাত। মা-নুসরাত-হেনা-হিজল-পঞ্চমুখি জবা-কুসুমরঙা চেরির পাঁপড়ি- আহ, আবার ফোন। কে করে এতো ফোন?

 

– মা তো জীবনে শান্তি পায় নাই চানু, এবার মা শান্তি পাবে। জানিস, সবাই বলছে দেইখা মনে হয় ঘুমাইয়া আছে। শান্ত মুখ, কোথাও একটু  কষ্টের ছোয়া নাই, মুখ দিয়া একটু কষ গড়ায় পড়ে নাই, শুধু চোখের কোণায় একফোঁটা জল। মা তো এইভাবেই যাইতে চাইছে। মা’র একটু থুতুও তো মোছতে হয় নাই। একবেলা একটু জ্বর হয় নাই। মারে স্নান করাইলাম, পরিস্কার সবকিছু। এতো সুন্দর যাওয়া আর দেখি নাইরে। জানিস মা না তার আঙটিটা খুইলা রাইখা গেছে, ঘরে পরা স্যান্ডেলজোড়া একটা পলিথিনে মোড়াইয়া খাটের নিচেই রাখা, রাত্তিরে পরা শাড়ি দিব্যি ভাঁজ দিয়া বাথরুমের র‌্যাকে রাখা যেনো কারো আবার পরিস্কার করতে না হয়। দুঃখ করিস না চানু, কান্দিস না, প্রার্থনা কর… বড়দি কল্যাণীর গলা বুঁজে আসে… বেশি কাঠ লাগে নাই, পাতলা শরীর, সূর্য ডোবার আগেই পোড়ানো শেষ হইয়া গেছে। মা দিগন্তে মিলাইয়া গেছে রে চানু…

 

মা তাহলে ছাই! নিজের শরীর ধরে ধরে দেখে চানু। মাত্র পরশু বিকেলেই তো কথা হলো, তেমন কোন দুশ্চিন্তা হয় না। জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখার এই বাজে অভ্যেসটা যে কবে কাটবে!। আর ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নেয়া যাক, মিসেস গার্ডনারকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছে চানু ভোর সাড়ে পাঁচটায়, সারারাত ঘুমায়নি সেজন্য। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই বড়দির ফোন, কত সব কথা মাথার চারদিকে, ‘মারে এখন নিয়া যাচ্ছি’…‘মা ছুটির কাছে চইলা গেছে’…‘চানু, কিছু একটু খেয়ে নাও’…। ঘুমের ঘাটতি চানুর বরাবরের, একটু ঘুমাতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যেতো কিন্তু না, তা তো হবার না! আরে চানু খাক না ঘুমাক তা নিয়ে পরামর্শ দিতে শাহানা ভাবিকে কে ফোন করতে বলেছে কানাডা থেকে? যত্তোসব! চানু অতল ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে, টিনের চালে বৃষ্টি নেমেছে, হেনাকে কোলে নিয়ে ছোটনদা দাঁড়ানো, বড়দি দুধ জ্বাল দিচ্ছে, হঠাৎই হেনার পা ঢুকে গেলো উথলে ওঠা দুধের হাঁড়িতে, কী হয়েছে, হয়েছে কী আজ চানুর?

 

– চানু, তুই কবে আসতে পারবি? ফেব্র“য়ারিতে আসা হবেনা? আ-চ্ছা…খুব মৃদু শোনায় আ-চ্ছা শব্দটা মা’র গলায় ফোনের ও-প্রান্ত থেকে। মার্চের শেষের দিকে আসফি? ততদিনি গরম পড়তি শুরু করবে, এই বাসায় জলছাদ নাই তো, খুব গরম। তা বাবুরা তো নড়বে না এই বাসা ছাইড়া, কী যে মধু পাইছে একেকজন এই বাসায় তা তানারাই কইতে পারবে।

 

– চানু, যা করতি ইচ্ছা করে করবি, যা খাইতে ইচ্ছা করবে খাবি, যেখানে যেখানে যাইতে ইচ্ছা করবে যাবা, জীবন কয়দিনির? এই সোমায় তো আর ফিরা পাবা না। অল্প বয়সে মোক্তারের বউ, নিশু-মিশুর মার শাড়ি দেইখা কী ইচ্ছা হইতো, মোনে হইতো, ইস্ যদি ওইরকম একটা শাড়ি পরতি পারতাম! এখন তো আমার কত শাড়ি আলমারি ভরতি। এইবার নিখিলির বাসায় গেলি নিখিলির আর শিখার যত বন্ধু-বান্ধব আছে, প্রত্যেকেই তো একখান একখান শাড়ি দেছে। কেরা পরে? তুমি তো বোকার হদ্দ, এর তার জন্যি কেনো, নিজির জন্যি কিচচু কেনো না। এতো বছর চাকরি করতিছো, একখান ভালো শাড়িও তো নাই তোমার। চানু আমার কথা শোনো, এবার ভালো দেইখা একটা ড্রেস কেনবা, কথা দেও আমারে। না হইলে কিন্তু আমি খুব রাগ করবো…

 

দুই

তবু ভিসা বাড়াতে যেতে হয়, টিকিট বুকিং দিয়ে অপেক্ষা করতে হয়, ডিপার্টমেন্টে কাজ বুঝিয়ে দিতে হয়, তারপর দিনরাত প্লেনে পার করে তবে দেশে ফেরা যায়।  এইযুগেও ঠিক সাতদিনের দিনই কেবল চানু পা রাখতে পারে দেশের মাটিতে, একবেলা আগে না। চানুর মা’র বড়  আক্ষেপ ছিলো -এই দেশের কোন মানুষ আর দেশে থাকপে না, সবাই বিদেশ যাইতে চায়। আমার তো একটুও ভালো লাগে না সবাইর এই বিদেশ যাওয়া। দেখ তোর নারায়ণ মামার সংসার, তার ছেলেমেয়েরাও শিক্ষিত, কেউ যে অশিক্ষিত তা তো কইতে পারবা না। মেয়েরাও সবাই বি.এ. পাশ করছে, সবাই চাকরি করতিছে, বিয়া করছে, নাতি-পুতি নিয়া নারায়ণের কী শান্তির সংসার। ভাবছিলাম তোমার বাবা রিটায়ার করলি বাবার যে সম্পত্তি পাইছি সেইখানে ঘর তোলবো, পুকুরডা কাটপো, দুইডা গাছ-গাছালি লাগাবো, তা না এই ঢাকা শহরে আইসা উঠিছি। পরের ঘর মুছতি মুছতিই আমার জীবন গেলো। এই তিনতালা ফ্ল্যাটেই চোখ বোজবো তারপর পোস্তগোলা শ্মশানে পোড়ায় দিলিই মিটা গেলো কোন চিন্তা নাই।

 

কথার সাথে সাথে মা’র হাতের মুদ্রাও এতো জীবন্ত! চানু পরিস্কার দেখে। সেই জলছাদহীন পরের তিনতলা ফ্ল্যাটেই মা’র আজীবন ধোয়া-মোছাশেষে চোখের কোণায় একফোঁটা জল। তারপর সেই পোস্তগোলা শ্মশান, ছয়-সাতজন শ্মশানযাত্রী, ঢাকা শহরে এর বেশী আর শ্মশানবন্ধু কীভাবে পাওয়া যাবে?

 

-চানু, আইজকা সকালে খুব গরম তো তাই বারান্দাডা মোছার পর বালতিতে যে জলটুক ছেলো সেই জলটুক বারান্দায় গড়াইয়া দিছি, এট্টুই জল ছেলো, জলটুক গিয়া পড়ছে নীচের সুপারি গাছের তলায় আর ওমনি রি রি কইরা আইসা ধরছে  বাড়িওয়ালার কাজের মাইয়া। সাথে সাথে বারান্দার জলটুক মুইছা নিছি। আবার বেল, এইবার আইছে বাড়িওয়ালার কাজের ছেলে। সব থাকতিও আমার অন্যের কথার তলে থাকতি হয়। আইজ আমার নিজের বাড়িতে থাকলি এই কথা কওয়ার সাহস পায় কেউ? তোর দিদিমা কয়, “আপন মাটি, দোমায় হাটি”। কিন্তু এই সংসারে আমার ইচ্ছার তো কোন মূল্য নাই। আমি আছি এই সংসারে খাটার জন্যি, খাইটা যাবো-তা এই সংসারের দাসি দুইজন, একজন এই বুড়ি দাসি আরেকজন হইলো দশ বছরের পুন্নি দাসি। তারে দিয়া তো আর কাজ হয়না, আর কইলে কী হবে ওই তো এট্টুদানা এট্টু মাইয়া, গরীবির মাইয়া তাই আইছে তোমাগো বাড়ি খাটতি…যান্ত্রিক গোলযোগে কেমন ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায় ফোনের ওপারে মা’র গলা।

 

সেই সুপারি গাছের পাশ কাটিয়ে, সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনতলার দরজায় চানু। দরজা খুলে যায়, মা দাঁড়িয়ে নেই সেখানে। দরজার পাশেই তুলসির টব। ছোটদা’র গায়ে ধরা । বুকটা ধক করে ওঠে। বারান্দায় পরিত্যক্ত কাঠের টেলিভিশন বাক্সের উপর একটা মাটির ভাঁড়, পাশেই তুলসির টব, সেখানে ধুপ-ধূনো দেয়ার ধূপদানি, দুটো আধ-জ্বলা ধুপকাঠি আর একটা আধাআধি পুড়ে যাওয়া মোম। ওই ভাঁড়ে মা’র ছাই হয়ে হয়ে যাওয়া শরীর, আর এক টুকরো হাঁড়, গঙ্গাঁয় দেয়া হবে বলে রাখা হয়েছে। হেনার যেদিন জন্ম, চানুর স্মৃতির জগত সেদিন থেকে শুরু, বিস্মরণের শুরু কি তবে ওই মাটির ভাঁড়ে? মাথাটা আবার হালকা হয়ে যাচ্ছে।

 

বাবা আসেন ধীর পায়ে, ভেঙ্গে যাওয়া শরীর আরো ভেঙ্গেছে কিন্তু গলার স্বর বরাবরের মতই জীবন্ত।

 

-তোমার মা পূণ্যবতী ছিলেন চানু মা। আমি এমন মৃত্যু দেখা তো দুরের কথা, কোনদিন শুনিও নাই। সারাদিন কাজ করছে, সন্ধ্যায় সন্ধ্যাবাতি দেছে, রাত বারোটা পর্যন্ত টেলিভিশান দেখছে, ভোরের আলো ফোটতে ফোটতে পরমাত্মার কাছে যাত্রা করছে। কেউরে এক মুহুর্তের  জন্য জ্বালায় নাই। জানো তো মা, ওইদিন ছিলো বুদ্ধ পূর্ণিমার সকাল।

 

বন্যার মা বলে, খালাম্মা বড় পূণ্যবতী । কী দিনে গেছেন গো, মিলাদুন্নবীর দিন গেছেন। মালতি বৌদি ঝর্ণা মাসির সাথে সিঁদুর বিনিময় করতে করতে ছলছলে চোখে বলে, মাসিমা সিঁদুর মাথায় নিয়ে দেহ রাখছে, বড় পূণ্যবতী গো, উপস্থিত সবাই সায় দেয় সে কথায়। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শি, বন্ধু-বান্ধব সবাই একে একে সাব্যস্ত করে তিনি পুণ্যবতী ছিলেন। সাক্ষাত প্রমাণও একে একে ভিড়তে থাকে, না কিনা তিনি সিঁথির সিঁদুর নিয়ে গেছেন, ভরা সংসার রেখে গেছেন, কাজ করতে করতে গেছেন, চলে যাবার মূহুর্তেও কাউকে ডাকেননি, আর দু’-দ’টো ধর্মীয় বিশ্বাসের পুণ্য দিনে গেছেন। গা জ্বলে যায়,  আজকের দিনেও এতোসব শিক্ষিত মানুষজন কীভাবে যে এইকথা অবলীলায় দুঃখি-দুঃখি মুখ করে বলতে পারে, আশ্চর্য!  বাবা মা’র চেয়ে অন্তত ঝাড়া বারো-চৌদ্দ বছরের বড়। বাকি সব কথার কোন মানে নেই চানুর কাছে- কাজ ছাড়া মাকে কে কবে দেখেছে? চানুর সবচে’ ছোটদাদা অপু একবার বলেছিলো, “ছোট বেলায় মারে দেইখা মাঝে মধ্যে মনে হইতো এতো রোগা আর এতো ফর্সা মানুষটা কেরা যে সারাদিন মুখ বুইজা কাজ করে আর ডাইন চোখের কোণায় একফোঁটা জল টলটল করে?” আর ভারহীন মা মশারির খাঁজে ঝুলন্ত আবিস্কৃত হয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত কে জেনেছিলো তার ডায়বেটিস? নিদেনপক্ষে অসুস্থ? পূণ্যবতী না ছাই, অহংকারী মহিলা, যেনো কেউ তার আপন ছিলো না। কী অহংকার! “ঠাকুর, হাত-পাও থাকতি থাকতি আমারে পার কইরো”, চোখ জ্বালা করে ওঠে চানুর। শুধু শ্রাদ্ধের দু’দিন আগের সন্ধ্যায় মা’র সকালে হাঁটার সঙ্গী পরিচয়ে মিসেস জেবুন্নেছা নামের এক বোরকা পরা বয়স্ক ভদ্রমহিলা ডুকরে কেঁদে উঠলে হেনা কেমন ভাবলেশহীন চোখে প্রণাম করে তাকে আর চানুর খটখটে লাল চোখ জলের ছোঁয়ায় আশ্বস্ত হতে থাকে…

 

 তিন

-ওয়েট, ওয়েট… ইওর মাম কুকড দ্যাট ডে ফর এভরি বডি অ্যাজ ইউজুয়াল মিনস? সো ইওর মাম ইউজড টু কুক ফর এভরি বডি? হাউ মেনি আর ইন ইওর ফ্যামিলি? এইট? ফানি! হোয়াই এইট ইন দ্য সেম ফ্যামিলি? এনি ওয়ে, য়্যূ ওয়ান্ট টু টেল মি দ্যাট ইয়োর মাম এট হার সিক্সটি ফাইভ ইউজড টু কুক ফর এইট পিপল এভরি ডে? ওয়েল, আই থিঙ্ক সি ডিড ইউ মাচ ফেভার লিভিং টিল  সিক্সটি ফাইভ… নো, নো, প্লিজ ডোন্ট টেল মি এবাউট কালচারাল নর্ম অর এনি থিং এলস। র‌্যাদার আই উড রিকোয়েস্ট য়্যূ টু স্টপ মোনিং, আই থিংক সি কুড ম্যানেজ টু গেট সাম রেস্ট এ্যাট লাস্ট অ্যান্ড য়্যূ স্যুড বি হ্যাপি অ্যাজ অ্যা বি-লা-ভ-ড ডটার, মিসেস গার্ডনার রাগে গড়গড় করে বলে যান, সো ইওর সো-কলড কালচারাল নর্ম অ্যান্ড ফ্যামিলি বন্ডেজ আর বিল্ট অন ইওর মাম’স আন-পেইড স্লেভারি! থ্যাঙ্কস যেসাস, আই ডোন্ট হ্যাভ সাচ না-ই-স অ্যা ফ্যামিলি বন্ডেজ। বিদ্রুপে বেগুনি হয়ে ওঠে মিসেস গার্ডনারের ফর্সা মুখ।

 

মাকে চানু রান্না করা থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় কাজ করতে দেখেই  অভ্যস্ত, এটা যে মহা অন্যায় কিছু তা তো কোনদিন মনে হয়নি! এমন না যে চানু অসচেতন, বরং একটু বেশিই সচেতন বুঝি। এমা গোল্ডম্যানের বিবাহ প্রসঙ্গে, এঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাস্ট্রের উদ্ভব থেকে শুরু করে নিদেনপক্ষে হালের বেল হুকস কিংবা ইরিগার-এর লেখালেখির সাথে কমবেশী জানাশোনা তো আছেই। ‘বিয়ের মধ্য দিয়ে কীভাবে একজন মেয়ের শ্রমের উপর পুরুষতন্ত্রের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বিস্তৃত হয়’ সে বিষয়ে স্টেজে দাঁড়িয়ে চাপাবাজির পাকামোও কম করেনি। সে তুলনায় মিসেস গার্ডনার তো কিছুই না, মৃত স্বামির পেনশনভোগী একজন অল্প শিক্ষিত বৃদ্ধ মহিলা মাত্র। তাহলে কি সিস্টেম? যখন দাস ব্যবস্থা চালু ছিল তখন কয়জনই বা ওই ব্যব¯থাকে অন্যায় ভেবেছে? ক্লিশেতম উদাহরণ। যেনো দাস ব্যবস্থা শেষ হয়ে গেছে! এই যে ছোট ছোট মেয়েরা বাসায় বাসায় কাজ করে নামমাত্র বেতনে কে অন্যায় দেখে এসবের মধ্যে? অন্যায় দেখা! খুন্তির ছ্যাকা দিয়ে দিশে পায় না! আর বুয়া চরিত্র আর তাদের ভাষা নিয়ে ক্যারিকেচার না থাকলে যেনো বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত রুচির সর্বোত্তম পরিণতি হুমায়ূন আহমেদের সোপগুলো জমে! ধ্যাত্তরি সব যুক্তি! কথা ভেসে আসে কোন আবছা অতীতের ঘরোয়া গল্প থেকে,

 

-তোর ছোটদা যে রাত্তিরি হইছে, পরদিন সকাল আটটায় তোর বাবা যাবে ট্যুরি। মোখলেস সাহেবও যাবে। তোর বাবা মোখলেস সাহেবের বাসায় গেছে একসাথে যাবে বইলা। মোখলেস সাহেব তখন খাইতে বসবে, তোর বাবার জন্যি অপেক্ষা করতিছে, ভাবছে আগের রাত্তিরে বাচ্চা হইছে কেরা বা নাস্তা বানাবে। তোর বাবা গেলি উনি কইলো, দেরী হইয়া গেছে আসেন আসেন, টেবিলে আসেন। তোর বাবা কইলো, “আমি তো গরম ভাত আর মাছের ঝোল খাইয়া আসছি, খাবো না”। শুইনা  মোখলেস সাহেবের বউ তো অবাক, “কাইল রাইতে  কল্যাণীর ভাই হইলো, ঘরে তো বয়স্ক কেউ নাই, কে রান্না করছে?” তোর বাবা কইলো, “কেন, নিখিলের মা-ই করছে।” শুইনা তো তাগো মাথায় হাত, “বলেন কী?”

 

– ও মা, কী কও? তুমি কেমনে রান্না করছো?

 

– হ, বিশ্বাস করে না। রাত্তির বেলা তোর ছোটদা হইছে, সকাল সাতটায় তোর বড়দি স্টোভ ধরাইয়া আমারে একটু জল গরম কইরা দেছে, সেই জলে সান কইরা চুলা ধরাইয়া মাছ-ভাত রাইন্ধা দিছি, পারবো না বললি তো হবেনা, পারতি হইছে…তাও তো তোমরা যে এতগুলান ভাই-বুন হইছো তা বইলা কি কোনদিন একটু ওষুধ-বিষুদ, ডাকতার-কবিরাজ কি ভালো পথ্য কিছু কি পাইছি? শুধু হেনা হওয়ার পর এক ফাইল মৃত সঞ্জীবনী সুধা আইনা দেছেলো, এই আমার একমাত্র ওষুধ এতোগুলা ছেলেমেয়ে হওয়ার মধ্যি।

 

-থাক মা থাক আর কওয়ার দরকার নাই, থামো, ভয় করে।

 

এ এক জ্বালা হয়েছে, উঠতে-বসতে-খেতে-শুতে-কাজে-অবসরে-অফিসে-বাজারে মিসেস গার্ডনারের শ্লেষ চামড়া ছুলে দেয়া জ্বলুনি দিচ্ছে। জ্বলুনি বেড়ে যাচেছ প্রতিদিন,  চানু ব্রোকেন ফ্যমিলির উদাহরণ টেনে পরিত্রাণ পেতে চাইছে, অথচ প্রকট হয়ে উঠছে মিসেস গার্ডনারের শ্লেষ, “ইওর সো কলড কালচারাল নর্ম অ্যান্ড ফ্যামিলি বন্ডেজ আর বিল্ট অন ইওর মাম’স আন-পেইড স্লেভারি”। ঠিকই, শেষের দিকে আর কুলাতে না পেরে  মা প্রায়ই বলতো- আমি এই শরীরি সত্যিই আর পারিনা। পুরুষ মানুষের রিটায়ারমেন্ট আছে, মেয়েমানুষের নাই। যতদিন বাঁচপো, সংসারের ঘানি আমার টানতিই হবে, বাঁচি আর মরি। …একজন ডাইবিটিসির রুগী আমি তা বইলা একদিনও তো বেলা তিনটার আগে দুুপুরির খাওয়া খাইতে পারিনা। সংসারে পুরুষ মানুষ আর মেয়ে মানুষের এই তো পার্থক্য-ভাবো তো এই সংসারে আমার  অসুখ যদি তোমার বাবার হইতো!

 

আচ্ছা, এদেশের মেয়েরা আর জীবনভর আন-পেইড স্লেভারি করতে চাইছে না বলেই কি পরিবার ক্ষয়ে যাচ্ছে? কিংবা এতটাই কি? একেবারে স্লেভারি! ছেলেমেয়ে সংসারের সাফল্যে কি মা’র আনন্দ ছিলো না? তার মূল্য কি কম? এরা বুঝবে কেমন করে? ডিপার্টমেন্ট থেকে বাসে চড়ে বাসায় ফিরছে চানু, পেন্টল্যান্ড পাহাড়ের গায়ে গোলাপি তুলোট মেঘ,  দূরও ছাই, মিসেস গার্ডনার কী বললো কীই-বা আসে যায়। কিন্তু মা কি কখনো আনন্দিতও ছিলো? শত চেষ্টা করেও মা’র কোন সুখি মুখ চানু মনে করতে পারে না।

 

-মা, পিকনিকে যাচ্ছে সবাই, আমিও যাইতে চাই। চানু তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে।

-তোমার বাবারে কইয়া দেখ, কী কয়…ভাতের ফ্যান ঝরাতে ঝরাতে মা নির্লিপ্ত উত্তর দেয়, হাতে ধরা ভাতের বড় হাঁড়ি।

-মা, আমার স্কুলের রিপোর্ট কার্ডে স্বা´র দিয়া দেও। আরেকদিনের কথা।

মা রিপোর্ট কার্ডে চোখ বুলিয়ে খুশি হয়ে ওঠে, আমি তো দিতি পারবো না তোমার বাবারে দিতি কও।

-ক্যান, বাবা ক্যান? তুমি দিতি পারো না?

-পারবো না ক্যান, কিন্তু দেখ না অভিভাবকের স্বাক্ষর চাইছে, তোমাগো অভিভাবক তো তোমাগো বাবা। কেমন রস-কষহীন গলা মা’র।

মা গো, মাথাটা কেমন হালকা হয়ে যাচ্ছে মা…

 

 

চার

-চানুদি, আপনি তো এভাবে পাগল হয়ে যাবেন। একা একা সারাক্ষণ মাসিমার কথা মনে করলে তো আপনি শান্ত হতে পারবেন না। আপনি না যুক্তিবাদি? সত্যি চানুদি, আপনার মতো মানুষ এইভাবে ভেঙ্গে পড়বে আমি কোনদিন কল্পনাও করি নাই। আসিফের কথা শেষ না হতেই আসিফের ভারতীয় বউ অন্ধ্রের মেয়ে উমা কুমপাট্টালা শুরু করে, ওয়েল চানুদি, হোয়াই ডোন্ট য়্যূ ডু সাম মেডিটেশন? ড্যু য়্যূ হ্যাভ এনি আইডিয়া অফ ওইজা বোর্ড? মিনিট দশেক ওইজা বোর্ডের কার্যকারিতা আর প্রয়োগ-পদ্ধতি বুঝিয়েই চলে উমা ফোনে আটলান্টিকের আরেকপার থেকে।

 

-কলপ্না, য়্যূ হুভারড দ্য করিডোর ফোর টাইমস ইন লাস্ট টেন মিনিটস। প্লিজ কন্ট্যাক্ট দ্য এক্সটেনশন নাম্বার গিভেন বিলো…আওয়ার ইউনিভার্সিটি কাউন্সিলিং সেন্টার ইজ ভেরি রিলায়েবল। ইফ এ্যানি প্রবলেম, প্লিজ ফিল ফ্রি টু গিভ মি অ্যা কল, লাভ-কার্স্টি।

 

-হোয়াট ডু য়্যূ থিঙ্ক অ্যাবাউট টেকিং সেভেরাল ডেজ অফ ফ্রম ওয়র্ক? য়্যূ লুক ভেরি ডিফরেন্ট দিজ ডেজ…প্রফেসর ইয়েন কথাটা পাড়ছেন থেকে থেকেই।

 

-উড য়্যূ প্লিজ থিঙ্ক অ্যাবাউট বিরিভমেন্ট থেরাপি? বিলিভ মি ইট উইল হেল্প। অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট সারাহ দেখা হলেই তাগাদা দিচ্ছে।

 

পাঁচ

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতেই এবার সিকমোর কিংবা মেপল ঝরছে। বাতাসে কেমন টান টান ভাব। টান টান ভাব সারা অবয়বে, আশ্বিন-কার্ত্তিকের দুপুরে ফুল কপি আর কৈ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে নরম রোদে ভরা বারান্দায় “রিদয় নামের সেই হৃদয়হীন ছেলেটি…” পড়ার সময়ে যে টান টান ভাব হতো শরীরে, ঠিক তেমন একটা মিহি আবহ চারপাশে, ধরা যায় আবার যায়না। কেমন যেনো একটা ঘ্রাণ, যেনো আলমারি থেকে গরম কাপড় বের করে মা রোদে দেবে শীঘ্রীই, ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে সারা বারান্দায়, বিকেলের রোদ কমজোরি হতে শুরু করার আগেই রেলিং থেকে মা তুলে নেবে লেপ, আচারের বোয়েমগুলো সারে সারে রোদ পোহাবে সারাদিন, সন্ধ্যা হবার আগেই মা চানু-হেনার চুল বেধে দেবে কষে, তারপর মুড়ি মাখা আর আদা-চা…। এইসব ছবির পাশাপাশি শব্দও ভেসে আসে বহু বহু দিনের ওপার থেকে, “হাউ’জ দ্যাট!”, পাড়ার ছেলেরা ক্্িরকেট খেলছে বড় মাঠে। দু’গ্র“পে খেলা হচেছ , কিশোর গ্র“প আর বড়দের গ্র“প। আরেকদিকে ছোট মাঠে খেলছে মেয়েরা-চানু, নুসরাত ওরফে নিশু, নিশুর ছোটবোন মিশু, হেনা (দুধ-ভাত), ঘোষ পাড়ার পল­বীদি, গাজী পাড়ার বিলকিস আপা আর সুমি আপা, দিনা আর রতœা-এরা খেলছে বৌ ছি, “ছি বুড়ি ছাইয়া, বাবুলের মাইয়া, ছি বুড়ি ছাইয়া, বাবুলের মাইয়া, ছি বুড়ি ছাইয়া, বাবুলের মাইয়া, বাবুলের মাইয়া, বাবুলের মাইয়া, মাইয়া, মাইয়া, মাইয়া…” সুমি আপার খুব দম চানু ছুটে পারে না, সুমি আপা বুড়ি বানিয়ে দেয়। মা কোথায় যাচেছ? বড় মাঠের পাশে ছোট মাঠ, ছোট মাঠের শেষে শুরু হয়েছে কোলা…মা নম্র ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে ছোট মাঠের কিনার ঘেঁষে ঘোষ পাড়ার দিকে, সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মা’র সাদা ধবধবে ছোট্ট কুন্ঠিত পা দুটো যেনো হেঁটে শেষ করতে পারছেনা ওইটুকুন দূরত্ব। চানু জানে মা হাঁটছে  ঘোষ পাড়ার দিকে, কিছু টাকা ধার করার জন্য, নাহলে পরদিন বাজার হবেনা। চানুর বাবার মনি অর্ডার এখনো এসে পৌঁছয়নি, পৌঁছে যাবে দু’একদিনের মধ্যেই অবশ্য। চানু ছুটে মা’র কাছে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়। মা চানু বা হেনাকে সাথে না নিয়ে কোথাও যায় না, কিন্তু চানু খেয়াল করেছে ঘোষ বাড়ির মাসিমা’র কাছে টাকা চাইতে গেলে মা একাই যায়, চানু শুধু একবার দেখে ফেলেছিলো শেফালিদের বাড়ি সন্ধ্যামালতির ফুটে ওঠা দেখতে গিয়ে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল তো, মা’র ভয় করবে না? দোতলার কাঠের রেলিং-এ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতেই চানু দেখে মাঠের সেই একই কিনার ঘেঁষে মা হেঁটে হেঁটে আসছে, কত সময় ধরে! মা’র মাথার কাপড় বাতাসে ফুলে ফুলে উঠছে, অনেকবার ধোয়ার কারনে পাতলা হয়ে গেছে শাড়িটা। আকাশভরা তাঁরা, সন্ধ্যাদির বলা ধাঁ ধাঁ “এক থাল সুপারি, গোনতে পারে কোন ব্যাপারী”র মতোই আকাশজোড়া। মা’র ছোট্ট পা দুটো কখন মাঠ থেকে আকাশে  উঠে গেলো আর কখনই বা ঘরে ঢোকার দরজার সিঁড়িতে রাখা বালতির জলের পাশে দাঁড়ালো! পা ধুয়ে মা হেঁটে আসছে কাঠের সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায়, হেরিকেনের অল্প আলোয় কাঠের পাটাতনে মা’র পা হাঁটছে এক রুম থেকে আরেক রুমে-জানালা বন্ধ করার জন্য, মা আবার সিঁড়ি ভেঙ্গে নামছে রাতের খাওয়ার আয়োজন করতে…কল্পনা, আর য়্যূ ওআম ইনাফ? মিসেস গার্ডনার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালে। কাম অন ডার্লিং, এ্যাট লিস্ট ট্রাই সাম টি, য়্যূ মাইট ফিল বেটার।

 

-তুই তহন খুব ছোট চানু, নিখিল কলেজে যায়, অখিল মেট্রিক দেবে, অন্যরা স্কুলি যায়, সব পিঠাপিঠি। বাড়িতে এক জামাই থাকে তোমার বাবার গ্যাতি ভাইয়ের জামাই, এক বোচ্ছরের উপর থাইকা চাকরি খোঁজে, আর অতিত-বতিতের তো কামাই নাই, যে  যেখান দিয়া আসে গ্যাঁট হইয়া বসে। একবার আইসা উঠলি পোনারো দিনির আগে যাওয়ার নাম কেউ করে না। আর তোমার বাবার অফিসের অফিসার, কেরানি, সমিতির লোকজন যে আসে তারেই ভাত খাওয়াইয়া দিতি হবে। বুকের ভেতার সব সোমায় তরাস থাকতো, এইডার পর এইডা করবো। তোমার বাবার মুখ দিয়া অর্ডার পড়ার দেরি হইতে পারে কিন্তু অর্ডার তামিল হইতে এক মিনিট দেরি হইতে পারবে না, কথা মুখ দিয়া পড়ার সাথে সাথে কইরা দিতি হবে। মানে লোকটা যা করিছে সারা জীবন, আমি দেইখা ঘর কইরা গেলাম। তহন শীতের দিন, সকালে তোরে রোদি শোয়ায় রাইখা রান্না ঘরে ঢোকতাম চুলা ঠেলতি, সে চুলা আইজকার মতো আধুনিক চুলা না, তহন গ্যাস হয় নাই, কাঠের চুলা, চুঙ্গা ফুয়াইয়া আগুন ধরাতি হয় আর তুই খুব ঠান্ডা ছিলি, রোদির ভেতার ওম পাইয়া ঘুমাইয়া থাকতি, সব কাজ সাইরা তো তোর কাছে আসফো। তোর দিদিমা আইসা তোরে দেইখা চমকাইয়া কয়, করিছিস কি? সোংসারের কাজ করবি দেইখা মাইয়াডার দিকি এট্টু নজর দিবি না? তোর মাইয়ার পাও তো পুইড়া গেছে। হইছে কী, তোরে রোদি শোয়ায় রাখতাম কাঁথা দিয়া ঢাইকা, তোর গা ঢাকা থাকতো কিন্তু পাও যে কাঁথার বাইরে থাকতো তা খেয়াল করার সোমায় ছেলো না, রোদি পুইড়া পা কালা হইয়া গেছে, এর মধ্যি তুই যে একটু লম্বা হইয়া গিছিস তাও আমার চোখি পড়ে নাই, এমনই সংসারের চাপ…

 

চানু ইদানিং বেশ হালকা বোধ করছে। শুরুর দিকের সেই দমবন্ধকরা ভার কেটে যাচ্ছে, চাইলেই চানু মা’র সাথে যোগাযোগ করতে পারে এখন । মা’র এতো কথা চানু এর আগে কখনো শোনেনি, সুযোগই ছিলো না। চানু ছিলো পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত আর মা ব্যস্ত সংসার নিয়ে। এমা আর ওলগা এর মধ্যে কয়েকবারই ছবি দেখতে নিয়ে যেতে চেয়েছে, চেয়েছে কোথাও ঘুরতে যেতে দূরে। আগে হলে খুশিই হতো কিন্তু এখন ঢের বেশি আনন্দ মা’র কথা শোনায়, যেনো এক ধরনের কথা বলাই, এ এক নতুন জগত। হয় মা’র কথা শুনে নয়তো যুক্তি সাজিয়ে দিব্যি সময় কেটে যায়। যুক্তি বলে এমন আর কী খারাপ ছিলো মা’র জীবন? একটা সময় খুব অভাব আর কষ্ট গেছে একথা ঠিক কিন্তু এই তো গড়পড়তা বাঙালি মায়েদের জীবন। বরং মা’র ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত, যে যেখানে আছে ভালোই আছে, দেশ-বিদেশও ঘুরেছে মা খানিকটা, মন্দ কী? অথচ যখন কথা হয় মা’র সাথে, যোগাযোগ হয়, তখন মা’র ক্লান্ত অনিশ্চিত মুখটাই ভেসে ওঠে, সেখানে প্রশান্তি নেই। কেনো যে! কিংবা কে জানে প্রশান্তি হয়তো ছিলো একসময়, চানুর মনে নেই, তারপর পাল্টে গেছে, “কূয়ার ব্যাঙরিও যদি খোঁচাও, খোঁচাতি থাকো, সেও একসোমায় না একসোময় ঘাও দেবে”, একথাও তো চানু মা’র কাছেই জেনেছে। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সে তিলোত্তমা, দুর্গেস নন্দিনী, কপাল কুন্ডলা আর রক্ত করবী পড়া জগত থেকে সটান বিয়ে আর সে বিয়ের প্রবল বাস্তবতায় ত্যক্ত মা তার ঠিক প্রশান্ত হবার মতো অবকাশ খুঁজে পায়নি বুঝি শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত- ঢাকার প্রায় সবকটা জাতীয় দৈনিকের পাতায় নিজস্ব পরিচয় আর ঠিকানাহীন, অস্পষ্ট ছবিসহ এক চিলতে মামুলি শোক সংবাদ হওয়া অবধি। চানু যুক্তি সাজায়।

 

-আমার বাবার সম্পত্তি ছেলো, খাইছি পরিছি কোনতার কোন অভাব ছেলো না কিন্তু কোনদিন তো হাত দিয়া ধরতি পারি নাই আর তার দরকারও হয় নাই। বিয়ার পর কোনদিন কি পারিছি কোনকিছু নিজির ইচ্ছামতো কিনতি বা তোমাগোই কিছু দিতি? আমার বাবা মরার আগে আমার বিয়ার জন্যি খাট বানাইয়া রাইখা গেছে কিন্তু সেই খাটেই কি ঘুমাইতে পারিছি কোনদিন? তোমার বাবা সেই খাট নিয়া তোলছে তার গ্রামের বাড়িতি। তার ভাইঝি-ভাইবেটাগো সম্বন্ধ আসে, ঘরে কোন ফার্ণিচার না থাকলি কেমন দেহায় আর এক এক কইরা সবাইর বিয়া হইতে হইতে যুদ্ধ আইসা পড়লো। তোমাগো গ্রামের বাড়ি পোড়ার সাথে সাথে ওই খাটও পুইড়া ছাই। এহন বাবার সম্পত্তি পাইছি ঠিকই, কিন্তু আইসা উঠিছি ঢাকা শহরে। আমরা তো আর ইন্ডিয়া যাবো না কোনদিন, মরি বাঁচি এই দেশেই থাকপো। যেদিন কেউ টান দিয়া নিয়া যাবে সম্পত্তি নিক, সেদিন দেখফো। এহন কেন পরের বাড়ি ঝাট দেবো? সোফার কভার ভরতে ভরতে মা বলে চলে, দ্যাখো আমরা তো চিরকাল বাইচা থাকপো না, একটা বাড়ি থাকলি তোমরা ভাই-বুনরা যে যেখানেই থাকো না কেন বৎসরে একবার হইলেও আসতা মা-বাবার ভিটায়, নিজিদির মধ্যি একটা দেখা-সাক্ষাত থাকতো, চাকরি-বাকরির বাইরেও একটা পরিচয় মানুষের লাগে, সবকিছু বাদ দেও মানুষের স্মৃতির মুল্যও কি কম? কিন্তু আমার কথা কেরা শোনবে, তোমরা সবাই ছুটতিছো, মা যেনো হঠাৎই প্রসঙ্গ পাল্টায়, এই যে ঢাকা শহরে এতো বছর আছি, এতো নাটক, কবিতা, গান, অনুষঠান এতো কিছু হইয়া যায়, আমার ছেলেমেয়েরা কি তা বইলা কোনদিন আমারে একবেলা কোথাও নিয়া গেছে? আমি হচ্ছি ঘর ঝাট দেবার কারবারি।

 

-যাই কও মা, তোমাগো অবস্থা আসলে আমাগো মতো কর্মজীবী মেয়েদের চেয়ে ভালোই ছেলো। তোমাগো কাজ ছেলো তো বাসায় আর আমরা কাজ করি ঘরে-বাইরে, সমান। আমাগো কোন বিশ্রাম নাই। ঢাকা শহরে বাইরাইলেই যে ধকল! চানুও প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে।

 

-ও কথা বইলো না চানু। আমার বাপ ছেলো না, ভাই ছেলো না । অল্প বয়সী বিধবা মায়ের ঘরে দুই মাইয়া। আরো সমস্যা বাবার ছেলো সম্পত্তি। তহন মাত্র পাকিস্থান হইছে, আমাগো আর লেখাপড়া হয় নাই। অল্প বয়সি বিয়া হইলো, সাধ-আহ্লাদ ওইখানেই শেষ। পরপর তোমরা নয়-দশজন ভাইবুন হইলা। তোমাগো হাতে তোমাগো জীবন, আর আমরা তো করিছি দাসীবিত্তি। বিয়ার একান্ন বছর পর আইজও তরকারির স্বাদ-গন্ধ একবেলা একটু ইদিক-ওইদিক হইলে সংসারে কুরুক্ষেত্র বাইধা যায়…যা সহ্য কইরা সংসার করিছি তা কি তোমরা করবা? তোমাগো সাথে আমাগো তুলনা হয় না। মা’র গলা ভার হয়ে ওঠে।

 

এই একটা বড় কষ্টের জায়গা মা’র, চানু জানে। স্কুলের পড়াশুনা হয়নি বলেই হয়তো পড়ার আগ্রহ শেষ হয়নি কোনদিন । চানু এখনই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে অথচ মা যে কেমন করে এই অভ্যাসটা টিকিয়ে রেখেছে আজীবন এক রাবণের চিতার মতো সংসারে, চানু ভেবে পায় না। এই তো সেদিনের কথা, সুনীলের প্রথম আলো পড়ে উচ্ছসিত মা বললো, যাই কও তিন বাড়ুজ্জির পর সুনীলই বাংলা সাহিত্যের সবচে বড় লেখক- সেই সময়, পূর্ব-পশ্চিম, প্রথম আলো কী সব লেখা একটার পর একটা। কেন মা, দেবেশ রায়ের তিস্তা পারের বিত্তান্তের চাইয়াও কি প্রথম আলো ভালো? মা আমতা আমতা করে বলে, আমি অত তুলনা করতি পারবো না তোমাগো মোতন কিন্তু গরীব-দুঃখীরি নিয়া উপন্যাস না লেখলিই যে সেই লেখা ছোট হইলো এ আমি মানবো না। দুঃখের নানা রকমফের আছে-পড় নাই “ জগত দুঃখময়, প্রিয়ের সাথে বিচ্ছেদ দুঃখ, অপ্রিয়ের সাথে মিলন দুঃখ”। মা বলে যায়, দেশ ভাগ হইলো, পূর্ব-পুরুষির ভিটামাটি ছাইড়া মানুষ দেশান্তরি হইলো, আইজও হচ্ছে, তারা কি কোনদিন সেই দুঃখ ভুলতি পারছে? অথচ মিলতি হইলো কার সাথে? কিনা পাকিস্থানের সাথে! সেই দুঃখির জের কি আইজও কাটাইতি পারছি আমরা?  এই যে তুমি বিদেশ দিয়া খাইয়া না খাইয়া প্রত্যেকদিন ফোন কর এ কি শুধু আমাগো সাথে কথা কওয়ার জন্যি না কি দেশরে মিনিটের জন্যি ভুলতি পারো না সেইজন্যি? লাখ-কোটি মানুষের জীবনের দুঃখরে উনি ধরিছেন। হাজার বিন্দুবাসিনীর বিসর্জনের উপর দাঁড়াইয়া আইজকা তোমরা হাঁটো। বাঙালির যে সময়রে যেভাবে উনি ধরিছেন এইডা নতুন তুমি স্বীকার কর আর নাই-ই কর…

 

ছয়

চানুর বাবা বড় সন্তান বৎসল, ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছেন সমান যতেœ  – তোমাগো মা বড় ঘরের মেয়ে কিন্তু বিয়ার পর যখন দ্যাখলাম তোমার মা’র যে-কোন সামান্য প্রয়োজনেও আমার কাছে হাত পাততে হয় সেইদিনই ঠিক করছি, ঠাকুর আমার যদি কোনদিন মেয়ে হয় তা’হইলে তাগো সাফিসিয়েন্টলি প্রতিষিঠত না কইরা আমি বিয়া দেবো না। মনে আছে চানুর, মাস্টার্স পরীক্ষার ঠিক দু’দিন আগে বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। জ্ঞান ফিরলেই তার প্রথম কথা চানু যেনো কোন অবস্থাতেই পরীক্ষা বাদ না দেয়। আর প্রথম পরীক্ষা দিয়ে বাবার সাথে দেখা করতে গেলে বাবা এক ফাঁকে দুর্বল গলায় বললেন, আমাকে কিন্তু মা একটা কথা দিতে হবে, কী কথা বাবা? চানুর ভয় ভয় করে, বাবা বুঝি বিয়ের জন্য বলবেন। দুপুরের কড়া রোদে কেমন আবছা রেখা জানালার বাইরে-চোখ ধা ধা করে, পিজির ছয়তলা কড়িডোর সুনসান, ফ্যানের শব্দ দূরের কোন বারান্দায় মিলিয়ে যেতে থাকা চটির আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠছে, ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বাবা মাথা তোলেন একটু, মাস্টার্স ডিগ্রি কিছু না মা, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে, কথা দাও, বাবার চোখে জল। খাঁ খাঁ দুপুরের স্মৃতি আছে মা’র সাথেও, তুঁতেরঙা শাড়িতে মেটে পাড়, মা চুঙ্গা ফুকায়, কাঠ ভেজা, মা’র চোখ লাল, স্মৃতির গন্ধ যদি খাঁ খাঁ রোদে গাব ফুলের ঘ্রাণ স্মৃতির শব্দ তাহলে আবুল ফেরিওয়ালার ডাক-

 

-পুরানা কাপড়, ভাঙ্গা শিশি-বোতল, হাড়ি-কড়াই-গামলা-বালতি আছে গো আম্মা!  পুরানা কাপড়, ভাঙ্গা শিশি-বোতল, হাড়ি-কড়াই দিয়া নতুন হাড়ি-কড়াই-গামলা-বাটি লইয়া লন গো আম্মা! আছে পুরানা কাপড়, ভাঙ্গা শিশি-বোতল, হাড়ি-কড়াই-গামলা-বালতি আছে গো আম্মা! … দুপুর রোদে দাদারা স্কুলে, বাবা অফিসে, গলায়-ঘাড়ে পাউডার মাখানো ছোট্ট হেনা হাতকাটা নীল গেঞ্জি গায়ে ঘুমাচ্ছে। ফেরিওয়ালার সুরেলা ডাক ফিকে হয়ে পাড়া ছেড়ে যাবার আগে আগেই মা চানুকে বলে ফেরিওয়ালাকে ডেকে আনার জন্য।

 

– কী কও আবুল, এতোগুলান পুরানা কাপড় দেলাম, একটা ডেকচি দেলাম, একটা গামলা দেলাম তাও তোমার ওই ছোট্ট কড়াইডা কেনা যাবেনা? থাক থাক তুমি যাও। মা’র মুখটা কালো হয়ে যায়।

 

-আম্মা, মোর উপার রাগ হইলে কাম অইবে না, ওজনে না বনলে মুই কী হরমু? ওই ভাঙা শিশি-বোতলগুলান দেলেই তো ফাকডু সাইরগা যায়। আবুল ফেরিওয়ালা চানু-হেনা-বিলু-অপুর কটকটি খাওয়ার জন্য গুছিয়ে রাখা শিশি-বোতলগুলোর দিকে লোভী চোখ বাড়ায়।

 

-না, না, বলিছি তো কেনবো না, তুমি যাও।

 

-ও মা, দিয়া দেও না, কী সুন্দার কড়াইডা। চানু শিশি-বোতলগুলো এনে মা’র পাশে রাখে।

 

কড়াইটা নিয়ে মা পুরানো এক ট্রাংকের ভেতর ঢুকাতে ঢুকাতে চানুকে বলে, “খবরদার, তোমার বাবা আসলেই যেনো কইতে যাইও না, তুমি তো আবার খবরি, পেটে কোন কথা রাখতি পারো না। কয়দিন যাক, আমিই বলবো। কী কষ্ট কইরা যে ফুটা কড়াইয়ে রান্না করতি হয় সে শুধু আমি জানি, আটার পট্টি কি আর বেশিক্ষণ থাকে!…পুরুষ মানুষ তো রান্না খাবার পাইলেই হইলো, না পাইলে দাপট, কেমন কইরা কী হয় সেই খবর কেরা রাখে…” মা গজ গজ করতে করতে নীচে নেমে যায়।

 

এতদিন পরেও চানু বেশ মনে করতে পারে, বাসায় একজন অতিথি এলেই বাবার সে কী হাঁক-ডাক পড়ে যেতো, …এই কাপ কেন…?  আর মা সুজি রান্না শেষ করে প্লেটে গ্লাসগো বিস্কুট সাজাতে সাজাতে চুপিচুপি চানুকে বলতো বড়দির সাথে নিশু-মিশুদের বাসা থেকে কাপ-প্লেট ধার করতে যেতে। চানু অনেক ভেবেছে, কাপ-প্লেট না কিনতে পারার জন্য বাবাকে কোনভাবেই দোষ দিতে পারে না। সব ভাইবোন পড়াশুনা করছে তখন, অতি সৎ সরকারি চাকুরে বাবা । কালো একটা প্যান্ট আর কলারের কাছে পলেস্তারা খসে যাওয়া সাদা শার্ট পরে সপ্তাহে ছয়দিন অফিস করেন। অফিস শেষে ক্লান্তিতে মাথা নীচু করে কতটা পথ হেঁটে বাসায় ফিরেই সবার পড়াশুনার তদারকিতে বসে যান। কিন্তু বাবার তো জানাই ছিলো বাসায় কাপ-প্লেট নেই, তাহলে ? …“একের পিঠে দুই, চৌকি চেপে শুই, শান বাঁধানো ভূঁই, ইলশে মাগুর রুই, পোটলা বেধে থুই …কাঁদিস কেনো তুই?”…কোনদিন যদি চানু ছড়াটা ঠিকমতো মনে করতে পারে!

 

সাত

সামারে মণীষা এলো ওর মা-বাবাসহ, মাত্র দু’দিনের জন্যই। কী যে অসহ্য লাগে রান্না করতে! ওভেনে রান্না চাপাতে চাপাতে, খাবার টেবিলে সাজাতে সাজাতে মা’র জন্য বুকটা মুচড়ে ওঠে। তাতানো কড়াইতে মাছ ছাড়ছে মা, কেমন ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারদিক, চোখ অন্যদিকে সরিয়ে সেই ধোঁয়ার মধ্যেই দিব্যি মাছ ভেজে তুলছে মা- মণীষা তো চানুর ভালো বন্ধু, গত বছর যখন এসেছিলো কী আনন্দেই না কেটেছে সে’সময়টা অথচ এবার এতো দুর্বিসহ বোঝা মনে হচ্ছে!

 

-বেগুন ভাজা, পটল ভাজা, করলা ভাজা, নাইরকেল দিয়া ছোলার ডাইল, মুগির ডাইল আর রুই মাছের মাথা দিয়া মুড়িঘণ্ট, ইলিশ মাছের মাথা আর কাটাকোটা দিয়া আলুর সাথে একটা তরকারী, ফুলকপি আর আলুর দোলমা, সরিষা ইলিশ, রুই মাছের কালিয়া, মুরগীর মাংস, আমড়ার চাটনি, সালাদ, পায়াস-এই মোট তেরো পদ হবে। মা হাতের কড়া গুনতে গুনতে বলে। কেউ একটা-দেড়টার আগে খাবে না কিন্তু তোমার বাবা তো বারোটা না বাজতিই আমারে ত্যক্ত কইরা তোলবে। বাজার আসলোই নয়টার পরে। এতোডি জিনিস কাটা-বাছা-রান্ধা তো মুখির কথা না। ঘরে একজন অতিত আসলি তোমার বাবা যেনো অন্য মানুষ হইয়া যায়! একটু যে সুস্থ মোতো রান্ধবো, অতিতগো সাথে যে দুইটা কুশল বিনিময় করবো তার তো উপায় নাই, ঘন ঘন তোমার বাবা আসতি থাকপে, চাখতি থাকপে, চোখ রাঙ্গাতি থাকপে, মানে শুরুতেই মনডা নষ্ট কইরা দেয় লোকটা…মানুষির বাসায় দেখি অতিত-বতিত আসার আগে স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যি একটা আলাপ-আলোচনা হয়, কিন্তু এ সংসারে তা কোনদিন পাবা না, শুধু হুকুম তামিল…

 

দোতলার কাঠের পাটাতনের ছোট্ট ফুকো দিয়ে চানু দেখে, “রশীদ সাহেব, চা তো হয় নাই, এই আর কি গরম জল… সে কি পিঠা আবার একটা রাইখা দেলেন ক্যান, খাওয়া যাচ্ছে না, না?”। ওদিকে ফ্যাকাসে-মুখ মা’র শিরা ওঠা হাত ঢলঢলে শাখা সেপটিপিনসহ ত্রস্ত রান্নাঘরে, মা গো! অচিন এক ঘ্রাণ আচছন্ন করতে থাকে চানুকে, মাথার ভেতর দপদপে লাল-নীলের ফুলকি, মা’র ফিকে স্বর ফিরে ফিরে আসে –

 

-আমার বড় সহ্য চানু। মানুষ একজন সৎমা’র ঘর করতি পারে না, আমি দুই-দুইজন সৎমা’র ঘর করিছি। তারপর বিয়ার পরে দোতালা দালান ছাইড়া নাইমা আসলাম কাঁচা মাটির ঘরে। দুইডা ভাত-কাপড়ের জন্যি তো কম যন্ত্রণা সহ্য করি নাই। নিখিল- অখিল-কল্যাণী জন্মানো পর্যন্ত তোর বাবার চোখের দিকি চাইতে পারি নাই কোনদিন। কেমন ভয় ভয় করতো। শ্বশুর বাড়ির লোকজন যে যন্ত্রণা দেছে! শুরুতে তোমার বাবার বেতন ছেলো মোটে নব্বই টাকা। রাস্তা দিয়া লোক ডাইকা আইনা খাওয়াইয়া তোমার বাবা নাম কিনিছে কিন্তু খাটতি তো হইছে আমার, উপাস দিতি হইলেও আমারই দিতি হইছে। কতোসময় গা-হাত-পা কাপতো, আবার যে দুইডা ভাত ফুটাইয়া খাবো, সে শক্তি থাকতো না দেহে। ঘরে বাজার ফেলাইয়া হুকুম হইছে কোন মাছের সাথে কোন তরকারী কী মসল­ায় রান্না হবে, তার কোন সকাল-রাত্রি নাই। সবকিছু সামলাইয়া ঘর করিছি, না কইরা আমাগো উপায় ছেলো না। মাথার উপর বাপ ছেলো না, ভাই ছেলো না, লেখাপড়া হয় নাই, ঘর করতি না পারলি সবাই ছি ছি করতো আমার মা’রে…

 

আট

অক্টোবরের মাঝামাঝি পুরো দস্তুর শীত পড়ে গেছে। সকাল-বিকেল চানু যাওয়াআসা করছে পায়ের নীচে ঝরা পাতার বিছানা মাড়িয়ে, ইস দেশের পাতাকুড়ানি মেয়েদের যদি এখানে এনে ছেড়ে দেয়া যেতো! গত বছর চানু দেখেছে অক্টোবরের শেষ থেকে মাঝ নভেম্বর পর্যন্ত কয়েক দফায় মিউনিসিপ্যালিটির ঢাউস গাড়ি ততোধিক ঢাউস ব্রাশ চালিয়ে পাতা কুড়িয়ে পরিস্কার করেছে রাস্তা। সেদিন সারাদিন সূর্যের আলো ছিলো, মাঝ অক্টোবরের পরে এধরনের দিন খুব স্বাভাবিক না  এখানে।   একটু তাড়াতাড়িই বের হয়েছে চানু ডিপার্টমেন্ট থেকে । বাসার কাছাকাছি আসতেই  সূর্যের শেষ আলো কেমন শরীরটা ছুঁয়ে যায়, পায়ের নীচে মশ্ মশ্ পাতা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে  কোন কারণ ছাড়াই বুকটা মুচড়ে ওঠে- সেই কোন ছোটবেলায় চানু-হেনা গান শিখেছিলো, “…চাইলো রবি, শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে…”। চানু-হেনা হাত ধরাধরি করে রাঙ্গামাটির লেকের পাড় দিয়ে আর কোনদিনই হাঁটবে না বল-প্রিন্টের জামা পরে। কী আহ্লাদীই না ছিলো হেনাটা, কোন কারণে মন কষাকষি হলে চানু যদি ছোট্ট হেনাকে মরে যাওয়ার ভয় দেখাতো, একটুও না ঘাবড়ে দিব্যি চটপট উত্তর দিতো হেনা, “অসুবিধা নাই, আমি রোজ বেগুন গাছে জল দেবো, তা হইলেই তো আরেকটা ছোড়দি পাবো।” হেনা এখন মস্ত হয়েছে, এমনকি মা পর্যন্ত দিব্যি হেনাকে ছেড়ে এখন চলে যেতে পারে, পায়ের নীচে  পাতার শব্দ মশ্ মশ্…“একের পিঠে দুই, চৌকি চেপে শুই…”

 

-বিয়ার পরে প্রথম এক-দেড় বছর মা’র কাছেই থাকিছি, তারপর তোর বড়দা হওয়ার পর তোর বাবা আমাগো নিয়া গেছে বিনোদপুর, উঠাইছে এক সাউ কর্মকারের বাগান বাড়িতি। মাটির ঘর, চারিদিকি গাছ-গাছালি, আশে-পাশে দুই-একটা ঘর আর শিয়ালির উপদ্রব।  পাতা পইড়া পইড়া সারা পাড়া যেনো একটা পাতার বড় বিছানা। ওই যে দুই-একটা ঘর কইলাম, ওইসব ঘরের সবাই সন্ধ্যা না হইতেই খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ে । তোর বাবা সন্ধ্যায় যায় মেলা দূরির ক্লাবে। আমি নিখিলরি ঘুম পাড়াইয়া একটা গল্পের বই নিয়া পড়তি থাকি আর তোর বাবার জন্যি অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতি করতি ঘুমি চোখ জড়াইয়া আসে, আর কেউ একজন উঠান দিয়া হাটলিই মশ্ মশ্ শব্দ, মনে হয় মাথার উপার দিয়া হাইটা যাচ্ছে। শিয়ালির হুক্কা হুয়া, তোর দিদিমা নিখিলির সাথে খেলার জন্যি সাত আট বচছরের  দুলাল নামের একটা ছেলেরে দেছে আমার সাথে। বাচ্চা মানুষ সেও সন্ধ্যা না হইতেই খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ে। আমার ভয় করে, তোর দাদুর বাড়ি তো গমগমা, শহরির মধ্যি, কত মানুষ! কলের গান চলে… আর এই বাগানে কেউ একজন হাঁটলি মশ্ মশ্ শব্দ হয় আর আমি দুলালরে ডাকি, ও দুলাল। দুলাল দিব্যি ঘুমের মধ্যি কইয়া ওঠে, ভয় নাই দিদি, আমি আছি তো…তোর দিদিমা প্রথম যেবার আসলো, নির্জন বাগানির মধ্যি মাটির এই ঘর দেইখা তো তার ভয়েই কম্ম কাবার, কয় যে তোর এইখানে থাইকা কাম নাই। পরদিন নিজেই সব বান্ধা-ছান্দা কইরা নিয়া গেলো বাড়িতি …

 

-মা, আমি রোজ কত রাতে ঘরে ফিরি একলা একলা, পায়ের নিচে এই পাতাগুলান মচ্ মচ্ করে, একলা ঘরে ঢুকি, ঘরটা খুব ঠান্ডা হইয়া থাকে, কিন্তু মা,  আমার তো ভয় করে না, তোমার এতো ভয় ছেলো কেন? তুমি বোধহয় মা “বৈদ্যুতিক বাতি ভূতের ভয় তাড়িয়েছে” বইটা পড় নাই। চানু কথা চালিয়ে যায়।

 

সেই রাতে স্বপ্ন দেখে চানু, মা একটা পলেস্তারাহীন নতুন ইটে গাঁথা ছোট্ট  ঘরে দাঁড়ানো, যেনো সেই ঘরটা ঠিক মা’র মাপে বানানো বা মা যেনো একটা কংক্রিটের লাল-কালো ফ্রেমের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে, সিঁথিতে কোন সিঁদুর নেই, একটা রঙহীন শাড়ি পরা, চুলগুলো খোলা, মুখে সেই চেনা কষ্টের ছাপ।

 

-মা, তুমি ওইখানে দাঁড়ানো ক্যান? বাইরে আসো।

 

তবুও মা ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকে, চোখের পাতা নড়ছে কি না বোঝা যায় না। এটা যে একটা স্বপ্ন তা বুঝতে চানুর বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। পিপাসায় গলা শুকিয়ে গলা ব্যথা করছে। রাত সাড়ে তিনটা। তার মানে বাংলাদেশে এখন সবাই কাজে ব্য¯ত, ফোন করে লাভ নেই। এতোদিনে এই প্রথম চানু স্বপ্নে দেখলো মাকে। ড্রয়ার খুলে উদভ্রান্তের মতো মা’র চিঠি পড়তে থাকে, “… শরীর সওয়ায় কাজ করো, এতো তাড়াহুড়ার কিছু নেই- আগে তো জীবন; পড়াশুনা, ডিগ্রী সবই জীবনের জন্য। স্কলারশিপ শেষ হয়ে গেলে চিšতা করো না, টাকার দরকার হলে আমাকে জানিও, আমি পাঠাবো।” আরেক চিঠিতে লিখেছে, “ … দিনে অন্তত একবার ভাত রান্না করে খাবি, আমাদের বাঙালি শরীর, রুটি-মাখনে চলেনা।” আরেক চিঠিতে, “…চানু মা, জীবনটা একা কাটানো যায় না, একজন সঙ্গীর দরকার হয়। তুমি তো আর কারও অধীন হবে না, জীবনের চলার পথে যদি কাউকে পছন্দ হয় সে সাদা-কালো, বাঙ্গালী, আমেরিকান, ইংরেজ, জাপানী, চাইনিজ যাই হোক তাকে সঙ্গী করে নিও, বাসার কেউ বিরোধিতা করলে বলো মা’র অনুমতি আছে।” আর শেষ যে চিঠি সেখানে লেখা, “যেখানে যেখানে ঘোরার সুযোগ পাও ঘোরবা। আমরা যে যে জায়গায় যাই, যেসব মানুষের সাথে মিশি, যেসব দৃশ্য দেখি তাই-ই আমাদের জীবনের সঞ্চয়। যদি কোথাও একটা সুন্দর দৃশ্য দেখে মনে হয়, বা বেশ তো! ভগবান না করুক জীবনে যদি কোনদিন কষ্ট আসে কোন, যদি একা মনে হয় দেখবা তোমার দেখা ওই দৃশ্য তোমাকে বাঁচতে সাহায্য করবে। ভগবানের ইচছায় তুমি তো পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়ানোর সেই সামর্থ অর্জন করেছ, কয়জন মেয়ে তা অর্জন করতে পারে আকাংখা যতই থাক? কত ধনী ঘরের মেয়ের ধনী লোকের সাথেও যদি বিয়ে হয় কিন্তু নিজের ইচছা মতো ঘুরে বেড়ানোর সামর্থ আর হয় কই? …” আশ্চর্য, এই চিঠি প্রায় বছর খানেক আগের, কই সে’সময় পড়ে তো নিজের সামর্থহীনতার জন্য মা’র এই হাহাকার চোখে পড়েনি!

 

-হ চানু, অপু ঠিক ওইরকম একটা সমাধির নকশা করছে মা’র জন্যি। অপুরও খুব মন খারাপ এই নকশা করতি যাইয়া। হ রে, মা ওই শাড়িই পরা ছেলো আর কপালে কোন সিন্দুর ছেলো না। বড়দির গলায় দুপুর রোদে হাকালুকি হাওড়ের হাওয়া।

 

চানুর জ্বর বাড়ে হু হু করে । একশ চার পর্যন্ত চানু জানে। মা পাশে বসে, মাথায় হাত বুলায়, চোখে সেই বরাবরের উদাসীন দৃষ্টি কিন্তু মা তো এতো ভালো হাত বুলাতে পারে না! ভালো হাত বুলায় তো বাবা। আর তা ছাড়া মা’র হাত তো এতো নরমও না, বেশ খসখসে। এ তো সেই খসখসে হাত না! মা, তুমি মোটে কয় মাস কাজ কর নাই তাই তোমার হাত এতো নরম হইয়া গেছে! ও কি, চইলা যাচ্ছো ক্যান? না তো, মা তো পাশে বসে নেই, মা তো ওই ফ্রেমের মতো ছোট্ট ঘরটাতেই দাঁড়ানো, সিঁথিতে কোন সিঁদুর নেই, একটা রঙহীন শাড়ি পরা, চুলগুলো খোলা, মুখে সেই কষ্ট। হেনা যে বললো মা’র পা দুটো পুড়ে গেছে, কই? মা’র পা দেখার জন্য চানু তার ভারি মাথাটা উঁচু করে, কিন্তু কার্ত্তিকের জ্যোৎস্নায় দেখা সেই পা দুটো দেখতে পায় না। শুধু মাথাটা ঠক করে বাড়ি খায় খাটের বাজুতে। ভালো হইছে মা, তোমার পোড়া পা তো আমি দেখি নাই কোনদিন না কোনদিন আমি আবার দেকতি পারবো তুমি কার্ত্তিকের শিশির ভেজা মাঠ পারাইয়া হাইটা আসতিছো। জানো মা, বড়দার বাসায় না আবার শৌলা বেগুন হইছে। কিন্তু হইলে কী হবে, আমন চাইলের লাল ভাত তো আর পাওয়া যাবে না ওইদেশে। আর বড় দাদুও তো বাঁইচা নাই যে তোমারে লাল আমনের মিষ্টি ভাতে শৌলা বেগুন মাইখা খাওয়াবে।

 

ছোট্ট একটা মেয়ে, রংটা বড় চোখে লাগে, কটা চোখ, কটা লম্বা চুল আর বিষাদভরা মুখ। কোথায় যায়? বড় রান্নাঘরের পাশে শিউলি ফুলের স্তুপ থেকে মেয়েটা ফুল কুড়াচ্ছে। কয়টা ফুলই বা আর কোচড়ে তুলতে পারে? মা-বাপ মরা এই গোমড়ামুখো মেয়েটা যেনো আবার পুকুরে ডুবে না যায় সেজন্যই তো ওই বড় পুতুলটা ঘাটলার একেবারে শেষ সিঁড়িতে রাখা, নিঃসন্তান জেঠা জেঠি রেখেছে। মেয়েটা আস্তে আস্তে কোচড়ের ফুল সামলে নামছে সিঁড়ি বেয়ে, কিন্তু পুকুরে তো জল নেই ! খামকা পুতুল দেখে ভয় পাবে। “ও মা, খালি পায়ে আর নাইমো না…কাটা ফোটপে তো পায়, তোমার না ডায়বেটিস?” কেমন বিষন্ন চোখে, ভয়ে ভয়ে ঘুরে দাঁড়ালো মেয়েটা আর ওখানেই সেই ছোট্ট ফ্রেমের মতো ঘরে বন্দি হয়ে গেলো। এ কি করলো চানু, আবারো ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়া? ঘেমে নেয়ে উঠে বসে চানু- ওইটুকুই তো তার জগত, দালান, শিউলি গাছ আর পুকুর-সেই পুকুরেও তো বিছিয়ে দেয়া ভয় আবার সেও ভয় দেখালো কাঁটা ফোটার? তাহলে সে আর হাঁটবে কীভাবে? “কত দুঃখ দাও গো দয়াল, দুঃখ কে আর নেয়ার আছে…” মা’র গলায় শোনা একমাত্র গানটা জীবনে এই প্রথমবারের মতো গেয়ে ওঠে চানু, তবুও, না, মা তো ধূপবাতি হাতে নিয়ে নীচু গলায় এই গান গেয়ে রুমে রুমে ধোঁয়া দিতে যাচ্ছে না! সন্ধ্যা কি তা’হলে হয়নি এখনো! চানু গায়, “কত দুঃখ দাও গো দয়াল, দুঃখ কে আর নেয়ার আছে…”, একবার, দুইবার, বহুবার…“ও মা”, উঁচু গলায় ডাকে চানু, “ সন্ধ্যাবাতি দেবা না, আজান পড়ছে কোন সময়!” চানু গেয়েই চলে, “কত দুঃখ দাও গো দয়াল, দুঃখ কে আর নেয়ার আছে…”

 

নয়

-রিলাক্স, রিলাক্স কল্পনা…য়্যূ নিড টু কালেক্ট ইয়োরসেলফ, জাস্ট নিড টু টাইডি আপ ইয়োরসেলফ অ্যা বিট, প্লিজ ট্রাই টু কনসেনট্রেট, ওয়েল… ট্রাই টু কনসেনট্রেট টু ইওর মাম’স টাইনি ফিট দেন, সি ইজ কামিং ট্রুয়ার্ডস য়্যূ… সী… টা-ই-নি ফিট…

 

দশ

কাউন্সিলিং প্রতি সপ্তাহেই নিচ্ছে চানু আর হয়েও তো গেলো মেলা দিন। এমন না যে চানুর জগত থেমে গেছে, চানু সম্পূর্ণ সজাগ, এমনকি স্বপ্নের মধ্যেও বুঝি যুক্তি হারায় না। শুধু দুটো পরিস্কার জগত তৈরি হয়েছে, এক জগতে চানু প্রতিদিনকার ব্যস্ত চাকুরে আর অন্যদিকে সেই জগতের ভেতরেই তার মা’র জীবনের সাথে একাকার এক মেয়ে, চানু চলে তার মা-ও চলে, চানু এমন দৃশ্যও দেখতে পায় যা তার দেখার কথা না, জানার কথা না, এমনকি ঘটলেও ঘটেছে তার জন্মেরও আগে কিংবা হয়তো ঘটেইনি কখনো …হয়তো শুনেছে কোথাও কিংবা শোনেওনি.. যেমন ধরা যাক স্বপ্নে না কি জেগেই চানু প্রায়ই দেখে ইদানীং- কে যেনো তার মা’র রোগা মুখে হ্যারিকেনের গরম এক চিমনি চেপে ধরছে, কে ধরছে বোঝা যায় না-এই জাতীয় কোন ঘটনা সে কখনো শুনেছে বলেও মনে করতে পারেনা। ছবিটা আসে নিগেটিভের মতো, অনেকটা গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবিতে ভুতের নাচের দৃশ্যের মতো, চানু তখন কেমন ঘেমে দুর্বল হয়ে পড়ে, সেদিন মিটিঙে হাত থেকে কলমটা পড়ে গেলো তো চানু আর তুলতেই পারলো না, হাতে কোন সাড় নেই। মস্তিস্ক জুড়ে তখন শুধু গরম চিমনির ছ্যাকা, হয়তো মনোবিকারই, তবু সেই তাপ ওর চামড়ায়ও লাগে যে!

 

হোয়াই ইন নিগেটিভ? ভ্র“ কুঁচকান প্রফেসর ব্রাউন, ১২৩৭ নম্বর কেসটা জটিল হয়েই চলেছে।

 

গার্ডনিং সিজন ফিরে এসেছে বুঝি, আঙ্গিনা জুড়ে আবার চেরির পাপড়ি, সবুজ ঘাসে ডগ ডেইজি। ঘরের দরজা থেকে দ্রুত আঙ্গিনাটুকু পার হয়ে শিরোনামহীন গেট পেরিয়ে রাস্তায় নামে চানু। সেখানেও সারে সারে কুসুমরঙা চেরির আলোয়ান। চেরি দেখে হিজলের জন্য হু হু  করা মনটা আর নেই চানুর। এমনকি বিউটিশিয়ানরা পর্যন্ত বলে পোড়া চামড়ার দাগ না কি সহজে কাটেনা, আর চামড়া পোড়ার যন্ত্রণা? থাক সে প্রসঙ্গ…“যে জলে বাগদী ম’লো, আমায় যে যেতে হলো, চিড়ে দই খেতে হলো… তারপর কী মা?…” চানু আরো দ্রুত হাঁটে, বাস ধরার জন্য কেমন হন্যে মনে হচ্ছে ওকে।

এডিনবরা, ২৭ অক্টোবর ২০০৪-৩ মে ২০০৫

Your Opinion

Hello! Thanks for your time. I love to hear your perspectives, please do not hesitate to write back to me.

Got something to say?

    Follow the chariot
    of thoughts.

    Since I write sporadically and publish them here and there (sometimes only in here…), please subscribe to get updates!

      In Progress

      TBA

      Voluptas sed necessitatibus repellendus molestiae molestiae tenetur necessitatibus molestiae et aliquid occaecati et aperiam in soluta rem et ducimus deserunt atque quo repellendus consequatur nemo ratione voluptatem omnis omnis earum in explicabo porro quibusdam rerum sit aliquam ex quia necessitatibus consequatur cupiditate quo voluptas iure id ut reprehenderit amet quod quo qui non eius repudiandae omnis animi voluptates quis nobis saepe et ad consequuntur tenetur molestiae blanditiis nisi quae iste ipsa rerum hic quas.

      error: Content is protected.