Kaberi Gayen

  • Academic
  • Researcher
  • Writer

Kaberi Gayen

  • Academic
  • Researcher
  • Writer

Kaberi Gayen is a Bengali academic, author, and social activist known for her outspoken views on the oppression of minorities and gender inequality in Bangladesh.

Wikipedia

কিছু কালোসিধে কথা বলতে চাই

12 mins read

ভে’বেছিলাম লিখবো না, কারণ লিখে খুব কিছু হয় যে সবসময় এমন দাবি করা যাচ্ছে না, এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফাহমিদা বা গণযোগাযোগ বিভাগের মেধাবী ছাত্রী সুতপা’র মৃত্যুকে কেন্দ্র করে লেখালেখি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে এ’সব লেখালেখি করে নিজে খানিকটা সান্ত্বনা পাওয়া যায় যে ছিলাম আমিও প্রতিবাদে, এর বাইরে খুব যে কাজ হয় তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবুও আজ লিখছি বা বলা ভালো যে না লিখে পারছি না এই অন্তর্গত তাড়না থেকে যে সত্যিই যখন আজ রুমানা দেশে ফিরেছেন তার ডান চোখের আলো ফিরে পাবার শেষ আশ্বাসটুকু ছাড়াই তখন ওই যে আমিও ছিলাম প্রতিবাদে কেবল সেই গোঁয়ার সান্ত্বনাটুকুর জন্যই হয়তো এই লেখা। ভেতরে কোথায় যেন একটা শুভবোধ কাজ করছিলো যে অন্তত এক চোখের আলো তার ফিরে আসবে। সেই শুভবোধের, আশার ক্ষীণ আলোটিও যখন শেষ হয়ে গেলো, তখন আমি সত্যিই কিছু কালোসিধে কথা বলতে চাই।

যে অন্ধত্ব এবং আপোষ কেড়ে নিয়েছে চোখের আলো
কথা খুব সহজ। রুমানা মঞ্জুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। কানাডার বৃটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষণারত। তার শিক্ষার্থীদের বয়ানে জানা যায় (বিভিন্ন ব্লগে, ফেসবুকে মন্তব্য থেকে) তিনি একজন জোরালো শিক্ষক। তার পারিবারিক অবস্থানও অত্যন্ত জোরালো, বাবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা। স্বামী সুদর্শন এবং বুয়েট থেকে পড়াশুনা করা। সহকর্মীরা দাবি করেছেন তার অমায়িক আচরণের কথা। কানাডা থেকে তার প্রতিবেশীরা একত্রিত হয়ে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছেন তার স্বামী’র শাস্তি দাবি করে এবং সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন রুমানাকে তাদের আড্ডায়-আসরে খুব বেশি পাওয়া যেত না কারণ তিনি ক্যাম্পাস থেকে ফিরে প্রতিদিন ফোন করতেন তার মেয়ে এবং স্বামীর সাথে কথা বলার জন্য। এভাবে শিক্ষিত স্বাবলম্বী শক্তিশালী অবস্থানের সংসারমুখী রুমানা মঞ্জুর সমাজের প্রতিষ্ঠিত ভালো মেয়ের এবং আদর্শ স্ত্রী’র সব তরিকা পূরণ করেছেন। কিন্তু তবুও তাকে স্বামীর হাতে নির্যাতিত বলে নির্যাতিত, একেবারে দু’টো চোখই খুইয়ে বসতে হয়েছে। তার নাক কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে সেই স্বামী, যাকে তিনি একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। প্রায় সব পত্রিকায় আরো যে খবরটি এসেছে তা হলো তিনি গত দশ বছর ধরেই কম-বেশি নির্যাতন সহ্য করে এসেছেন। এমনকি এবার আসার পরও না কি তার বেকার স্বামী, যিনি তার বাবার বাড়িতেই থাকেন, তাকে তিন দিন একটি ঘরে আটকে রেখেছেন। সবশেষে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে (২০ জুন, ২০১১) রুমানা মঞ্জুরের বাবা বলেছেন মেয়ের জীবন এবং তার পরিবারের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তারা শংকিত।

সংবাদ সম্মেলনে রুমানা। মুস্তাফিজ মামুন, ২০১১।
স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসীর সহানুভূতি রুমানার সাথে। আমি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকর্মী হিসাবে ঘটনার শুরু থেকেই বেদনা এবং ক্ষুব্ধতার কোন তল পাচ্ছি না। একই অবস্থা প্রায় সবার। সবাই এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইছেন। আমিও চাই, এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাকে দেয়া হোক যেনো ভবিষ্যতে কেউ এমন করার আগে সম্ভাব্য শাস্তির ভয়াবহতা মনে করে হলেও উদ্যত হাত নামিয়ে ফেলে। এ’কথা সত্য এ’জাতীয় ঘটনা বাংলাদেশের অনেক ঘরেই ঘটে কিন্তু এই ঘটনাটি এতো আলোড়ন তুলেছে এ’কারণেই যে প্রায় অবিশ্বাস্য রকমের নিখুঁত অবস্থানের একজন নারীও কতখানি অসহায় হয়ে উঠতে পারেন মুহূর্তে এবং তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এমন একজন নারী কীভাবে দশবছর ধরে এই নির্যাতনকারীর সাথে ঘর করেছেন প্রশ্ন উঠছে সে বিষয়েও। এই ‘কীভাবে’র উত্তরটি খুঁজতে যাবার আগে আরো একটি প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখ করে রাখতে চাই। রুমানা নির্যাতিত হবার সাতদিন পরে ঘটনাটি গণমাধ্যমে আসতে পেরেছে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসিয়ালি অবগত হয়েছে। জানা যায়, পরিবার থেকেই বিষয়টি চেপে রাখার একটি ব্যাপার ছিলো।

ঘটনার অন্যদিকে, খবরটি গণমাধ্যমে আসার অনেক পরে আসামী গ্রেফতার হয়েছেন, সব মিলিয়ে তিনি প্রায় দশদিনের মত সময় পেয়েছেন নিজেকে গুছিয়ে নেবার। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেবার আগ পর্যন্ত পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি অথচ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছে। কারণ সম্ভবত নির্যাতক হাসান সাইদ জনৈক মন্ত্রীর ভাই। তার এই সামাজিক পরিচিতিটি গুরুত্ত্বপূর্ণ এ’কারণে যে এই অবস্থানের কারণে তিনি পালিয়ে থাকতে পেরেছেন অথচ গণমাধ্যমে তার বেকারত্ব থেকে শুরু করে নানা ধরনের অসহায় অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরে তার আচরণের প্রতি একধরনের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাও করেছেন। দ্বিতীয়ত, গ্রেফতার হবার পর সাইদ হাসান প্রথমেই চেষ্টা করেছেন নিকৃষ্টতম পদ্ধতি দিয়ে শুরু করতে আর তা হলো রুমানার সাথে এক ইরানী তরুণের ‘অবৈধ’ প্রেমের গল্প ফাঁদা, যা আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় প্রায় অব্যর্থ মহৌষধের কাজ করে। ফলে রাতারাতি আরেকটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেলো যারা সাইদের অসহায় দৃষ্টিশক্তিহীন কর্মক্ষেত্রে অসফল এবং প্রতারিত স্বামীর ইমেজের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলেন। যদিও পরে তিনি স্বীকার করেছেন এটি বানানো, তার স্ত্রীর এমন কোন সম্পর্ক নেই। মোটামুটি এই কাঠামোর ভেতর থেকে, পারিবারিক সহিংসতার এই ঘটনা থেকে কয়েকটি প্রবণতা বের করে আনতে চাই। এই প্রবণতাগুলো বের করে আনতে যে চলকগুলো ব্যবহার করা হবে তা হলো, নির্যাতক, নির্যাতিত, সমাজ এবং রাজনীতি।

নির্যাতক সাইদ এবং পুরুষতন্ত্র
শুরু করছি সাইদের ঘটনা থেকে। প্রথমত, সাইদ বুয়েটের পড়ালেখা শেষ না করা, বার বার ব্যবসায় ব্যর্থ, প্রায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, অসফল এবং হতাশ এক পুরুষ, যে নিজের অক্ষমতার জ্বালা মেটাতে চেয়েছে, তার বক্তব্য অনুযায়ী, রুমানাকে খুন করে। এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে সে সাফল্যের পরিচয় দিতে পেরেছে। প্রাণে মেরে ফেলতে না পারলেও কামড়ে রুমানার নাক তুলে নিয়ে এবং চোখ উপড়ে ফেলে সে একবার তার ‘পুরুষত্বের’ জানান দিতে পেরেছে। অর্থাৎ একজন সব অর্থে অসফল পুরুষ, সব অর্থে একজন সফল নারীকে (সাইদকে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের মত অসফল কাজটি করা ছাড়া) নিজের কব্জায় রাখার জন্য মেরে ফেলতে চেয়েছে। এই চাওয়ার বৈধতা হলো তার স্বামীত্ব। স্বামীত্ব হলো সেই প্রভুত্ব যা দিয়ে স্ত্রীকে মেরে ফেলার চিন্তা পর্যন্ত করা চলে এবং সেই চিন্তা ও কাজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করা সম্ভব।

এই ভয়াবহ অপরাধটি সংঘটিত করে সাইদ কিন্তু অনুতপ্ত হননি বরং দ্বিতীয় অপরাধটি করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তার স্ত্রী’র চরিত্রে কালি দিতে চেয়েছেন কল্পিত প্রেমিকের গল্প ফেঁদে। অর্থাৎ শারীরীকভাবে প্রায় খুন হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে তিনি তখন সামাজিকভাবে খুন করতে চেয়েছেন। নিজের অপরাধকে লঘু করার জন্য স্ত্রীকে খুন করতে এবং তার চরিত্র কলঙ্কিত করতে তিনি এতটুকু বিচলিতবোধ করেননি। এখানেও তার স্বামীত্ব তার অহম-কে তৃপ্ত করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কাজটি তিনি করতে পেরেছেন কারণ প্রতারিত স্বামীত্বের ইমেজ তৈরি করতে পারলে স্ত্রী’র বিরুদ্ধে যে-কোন অন্যায়কে আমাদের সমাজ এখনো বৈধতা দেয়, আইন না দিলেও। যেমন ’পতিতা’ প্রমাণ করতে পারলে যে কোন ধর্ষণ বা খুনের মামলা থেকে সামাজিকভাবে মুক্তি পাওয়া যায় । ইয়াসমীন হত্যা বা জেলের কাস্টডিতে থাকার সময় পুলিশের দ্বারা প্রথমে ধর্ষিত ও পরে খুন হয়ে যাওয়া সীমার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি কীভাবে তাদের পতিতা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। যেনো একজন পতিতাকে খুন করা জায়েজ। সাইদ সেই চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। (মানবজমিন, ২১ জুন ২০১১)।

নির্যাতিত রুমানা এবং তার পরিবার
রুমানার দুই চোখের আলো নিভে গেছে। ক্ষতবিক্ষত নাক এবং মুখমন্ডল নিয়ে তিনি ধুকছেন হাসপাতালে। রুমানার প্রতি সহানুভূতি ও শুভকামনার সাথে সাথে একটি প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠছে, কেনো তিনি এতো দিন ধরে এই নির্যাতন সহ্য করেছেন? তার পর্যায়ের এক নারীর তো এমন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কথা না। ধর্ম এবং আইন-দুই-ই বৈধতা দিয়েছে অসহনীয় বিবাহিত সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলার। যেহেতু এই প্রশ্ন করার অবস্থায় রুমানা নেই তাই ধারণা করে নিতে হচ্ছে, হয়তো সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখার ভালোমানুষী চেষ্টা যা ভালাবাসা থেকেই উৎসারিত বা সন্তানের মুখ চেয়ে থেকে যাওয়া বা সামাজিক দৃশ্য-অদৃশ্য চাপের কাছে নতি-স্বীকার। হয়তো সবগুলোই সত্য। শেষ অনুমিতিটিই প্রবল হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় নির্যাতনের সাতদিন পর্যস্ত এই ঘটনাটি অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স লাউঞ্জের মূখ্য আলোচনার বিষয় হলেও অফিসিয়ালি সেটা পরিবার থেকে জানানো হয়নি। না বিশ্ববিদ্যালয়কে, না গণমাধ্যমকে। আমরা এখনো জানিনা, সাইদের পক্ষ থেকে কী ধরণের চাপ ছিলো কিন্তু যদি ধরেও নেই সাইদের পক্ষ থেকে প্রবল কোন চাপ ছিলো কিন্তু তাই বলে হত্যাচেষ্টার পুলিশকেস করা হবে না সাতদিন পর্যন্ত, এ কেমন কথা? তা’হলে কি পরিবার তখন পর্যন্ত ঘটনাটি চেপেই রাখতে চাইছিলো? নির্যাতিত রুমানা এবং তার পরিবারও পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন-কাঠামোকে টিকিয়ে রাখছেন।

সামাজিক অনুভব কাঠামো
আপাতঃদৃষ্টিতে রুমানাকে এইমতো সম্পর্কের রেশ এতো দীর্ঘদিন বয়ে নেবার জন্য দায়ী করাই যায় কিন্তু একটু খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে তার সন্তানের নিরাপত্তা এবং পিতৃপরিবারের সম্মানের কথা ভেবে তিনি সরে যেতে পারেন নি। পরিবারও তাকে উৎসাহিত করতে পারেনি সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে। সুতপার ক্ষেত্রেও দেখেছিলাম তার মৃত্যুর পর তার ভাইবোনেরা বলেছেন সুতপাকে তার স্বামী প্রায়্ই মারধোর করত। তখনও আমার প্রশ্ন ছিলো যে আদরের বোনকে হারিয়ে তারা পাগল-প্রায়, সেই বোনের দিনের পর দিন নির্যাতনের কাহিনী শুনেও তারা কেন বোনকে ওই বিয়ে থেকে সরিয়ে আনেন নি। সুতপার ক্ষেত্রে পরিবারকেই দায়ী করতে হয় কারণ সুতপা তখনও ছাত্রী, অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করেন নি। রুমানার ক্ষেত্রে তো তা নয়, কিস্তু সত্য হলো রুমানা সরে আসতে পারেন নি। আমরা যে সামাজিক অনুভব কাঠামোর মধ্যে বসবাস করি সেখানে দৃশ্য-অদৃশ্য এতো চাপ থাকে যা অতিক্রম করার জন্য তথাকথিত ‘ভালো মেয়ে’ বা ‘ভালো স্ত্রী’র ইমেজটিকে পরিত্যাগ করার মত মানসিক দৃঢ়তা না থাকলে এই নিপীড়নের সাথেই বসবাস করতে হয়। আমাদের রুপকথা থেকে শুরু করে কাব্যে, সাহিত্যে, পুঁথি-পাঁচালিতে, প্রবাদে, পুরাণে, ধর্মে, ইতিহাসে, উপন্যাসে, গানে, নাটকে, চলচ্চিত্রে ভালো নারীত্বের যে ‘গুণী অথচ দুর্বল’ এবং পুরুষের প্রতি নির্ভরশীল, যা পিতা পুরুষ থেকে স্বামী পুরুষে হস্তান্তরের প্রক্রিয়ামাত্র, তকমাটা এঁটে দেয়া হয়েছে রুমানারা হয়ে উঠেছেন সেই ভালো নারীত্বের প্রতিনিধিত্বকারী অসহায় শিকার। আর তাই তিনি যখন আক্রান্ত তখনও দেখি একদল পত্রিকা চায় তাকে পৃথিবীতে অসম্ভবপ্রায় নিষ্কলুষ চরিত্রের (যেমন তিনি মৃদুভাষী, পাঁচবেলা নামাজ পড়েন, মাথায় কাপড় দিয়ে কানাডার প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করেন, কানাডার প্রতিবেশীরা তাকে চেনেন তার মিষ্টি ব্যবহার এবং ভালো রান্নার জন্য ইত্যাদি) করে উপস্থাপন করতে, আরেকদল পত্রিকা চায় তার কথিত প্রেমের কাহিনী চাউর করে সাইদের অপরাধের ভার লাঘব করতে। দুই ক্ষেত্রেই রুমানার প্রতি কতটা সহানুভূতি থাকবে তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয় তথাকথিত ভালোমেয়ের সার্টিফিকেট সাপেক্ষে। এবং সাইদ নাক থেতলে, চোখ তুলে না নেয়া পর্যন্ত রুমানার এই বিয়ে-সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার বৈধতা তৈরি হয় না।

তা’হলে প্রশ্নটা হলো, যদি রুমানার সত্যিই অন্য কোন পুরুষের সাথে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে উঠতো, তা’হলেও সাইদ এই অত্যাচারের অধিকারী কি না বা রুমানার উপর চালানো এই ভয়াবহ অত্যাচারের প্রতিবাদে আমরা দাঁড়াবো কি না। প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো, না। সাইদ বড়জোর বিয়ে-বিচ্ছেদের নোটিশ দেবার অধিকারী। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো, অবশ্যই। একজন নির্যতিত মানুষের পাশে সমর্থন নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য তার চারিত্রিক সনদ হাতে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সামাজিক অনুভব কাঠামোতে এই সত্যটিকে নিয়ে আসার জন্য সচেতন মেয়েদের যেমন এগিয়ে আসতে হবে তেমনি সচেতন রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রয়োজন রয়েছে।

কেন এটিও রাজনৈতিক লড়াই
কেন কোন মেয়ে নির্যাতিত হয়েও বিবাহিত সম্পর্কে টিকে থাকতে চায় বা মেয়েকে নির্যাতিত জেনেও তার পরিবার সেই সংসারটি টিকিয়ে রাখতেই মদদ দেয়? এই লৈঙ্গিক সংস্কৃতিটি বুঝতে হবে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রীয় সম্পর্কের সাপেক্ষে। স্বামীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আসা মানে তার আর নিজের কোন জায়গা না থাকা। নারী বঞ্চিত তার উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে। মেয়েটির পরিবারে ফিরে আসা মানে ভাইয়ের সম্পত্তিতে অংশভাগ নেয়া। বাবার বা ভাইয়ের পরিবার মেয়ে-জামাই-নাতি এলে তাকে মুরগী জবাই করে খাওয়াতে আগ্রহী কিন্তু মেয়েকে সেই সম্পত্তির অংশভাগ দিতে আগ্রহী নয় পিতা বা ভাই নামের পুরুষতন্ত্র। আগ্রহী নয় তার এবং তার সন্তানের দেখভাল করার দায়িত্ব নিতে। অথচ মেয়েকে গুনী হিসাবে তৈরি করলেও তাকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলেনি পরিবার এবং সমাজ। বিয়ের সময় খুব বড় শিক্ষিত পরিবারেও বলতে শুনেছি, ‘আমার মেয়ে শুধু কলেজে যায় আর বাসায় আসে। আমরাই সাথে করে নিয়ে যাই আবার নিয়ে আসি। ও পথ-ঘাটও চেনে না।’ কাজেই স্বামীর সংসার থেকে ফিরে আসা মানে স্নেহময় পিতা কিংবা ভাইয়ের উপর নির্ভরশীলতা। বিয়ে দেবার মধ্য দিয়ে পিতৃপরিবার এই দায় থেকে এক ধরনের মুক্তি নিয়ে নেয়, ফলে নতুন করে সেই দায় নিতে রাজী থাকে না। দ্বিতীয়ত, সন্তানের অভিভাবকত্ব। বাংলাদেশে বিয়ে, বিয়েবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং সম্পদে অধিকারের মত বিষয়গুলো চলে পারিবারিক আইনের কাঠামোতে। নারীর অধিকার কেবল সন্তানের জন্মদান এবং লালন-পালনে, নারী তার সন্তানের বৈধ অভিভাবক নয়, অভিভাবক সন্তানের পিতা । সেদিক থেকেও নারী অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সন্তানের মুখ চেয়েও তাই নারীকে নিপীড়ক স্বামীর সংসার করে যেতে হয়। কাজেই রাষ্ট্র যতদিন এই বৈষম্যমূলক আইনগুলো পরিবর্তন না করবে বা রাষ্ট্রকে বাধ্য না করানো যাবে, যা আসলে ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কার, ততোদিন পর্যন্ত ধর্মের নামে, সমাজের নামে, লোকলজ্জার নামে নারীর বিরুদ্ধে এই সহিংসতা থেকে মুক্তি আশা করা দুঃসাধ্য। একটি নিরাপদ রাষ্ট্র যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নিরাপদ, যেখানে লিমনও নিরাপদ, নারী সাংসদ কবরীও নিরাপদ, সেই রাষ্ট্রে তো সন্তানের নিরাপত্তার জন্য রুমানাদের কারো উপর নির্ভর করতে হবে না। পুরুষের উপর নারীর এই নির্ভরশীলতার অন্তর্গত রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করতে হলে যে পাল্টা রাজনীতি প্রয়োজন, সেই রাজনীতিতে সামিল হওয়া চাই।

যে ‘ভালো মেয়ে’র সনদ কিনতে হয় নিজের সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে, নিজের অঙ্গহানি নয়তো জীবন দিয়ে, মেয়েদের সময় এসেছে পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া এসব ভালো মেয়ের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে মানুষ হিসাবে নিজের দাবি নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার। যে কোন দামে বিয়ে টিকিয়ে রাখার বিপরীতে নারীর বিয়ে-নিরপেক্ষ মানবিক অবস্থানটি প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। অন্তত নিজের চোখদু’টি তো রক্ষা করতে পারা চাই, নয়তো কীসের জীবন? তবে সমাজের প্রচলিত অনুভব কাঠামো এবং রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়ানো খুব সুখের হবে না, হয়নি কখনো তবু মানুষের চলার বেগেই পায়ের তলায় রাস্তা জাগে। আবেদন-নিবেদনের উন্নয়ন মডেল থেকে বের হয়ে জীবনের দায়িত্ব নেবার রাজনীতিটি বুঝে নেবার এইটাই মাহেন্দ্রক্ষণ। যে সামষ্টিক অন্ধত্ব এবং আপোষ রুমানার চোখের আলো কেড়ে নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোন বিকল্প নেই।

Rumana Monzur Now by Avrinder Dhillon, 2020

বিডিনিউজ২৪, ২১ জুন , ২০১১

Your Opinion

Hello! Thanks for your time. I love to hear your perspectives, please do not hesitate to write back to me.

Got something to say?

    Follow the chariot
    of thoughts.

    Since I write sporadically and publish them here and there (sometimes only in here…), please subscribe to get updates!

      In Progress

      TBA

      Voluptas sed necessitatibus repellendus molestiae molestiae tenetur necessitatibus molestiae et aliquid occaecati et aperiam in soluta rem et ducimus deserunt atque quo repellendus consequatur nemo ratione voluptatem omnis omnis earum in explicabo porro quibusdam rerum sit aliquam ex quia necessitatibus consequatur cupiditate quo voluptas iure id ut reprehenderit amet quod quo qui non eius repudiandae omnis animi voluptates quis nobis saepe et ad consequuntur tenetur molestiae blanditiis nisi quae iste ipsa rerum hic quas.