
7 mins read
‘কালো’ মিতুর মৃত্যু ও মনোজগতের ফরসা-অন্ধকার
রা
আট বছর ধরে বিবাহিত, দুই সন্তানের মা মিতু অবশেষে মরতে পেরেছেন। তিনি নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলেছেন, নাকি তাঁর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই সুরাহা করার জন্য সাক্ষ্য দিতে মিতু আক্তার আর বেঁচে নেই। ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে তাঁকে যখন চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছে, তখন তাঁর শরীরের প্রায় পুরোটাই পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। (প্রথম আলো, ১ জুন ২০১৩)। মিতু আক্তারকে বার্ন ইউনিটে আনা সম্ভব হয়েছিল বলে পত্রিকায় সংবাদ হতে পেরেছে এই মৃত্যু। কত মিতু আক্তার যে এই একই কারণে খুন হন, কিংবা জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকেন, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। সংবাদপত্র পর্যন্ত এসব মৃত্যু বা নির্যাতনের খবর আসতে পারে না। সরাসরি আগুন লাগানো বা উদ্বুদ্ধ করার ঘটনা সংখ্যায় ঠিক কত, তা জানা না থাকলেও কালো রঙের কারণে মেয়েদের বিয়ে না হওয়া, উপযুক্ত পাত্র না পাওয়া, বিয়ের সময় অতিরিক্ত যৌতুক আদায় এবং বিয়ে হলেও কিছুদিনের মধ্যেই স্বামীর অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত আমাদের সমাজে। আর উঠতে-বসতে কটূক্তি করার মধ্য দিয়ে সেসব কালো ত্বকের নারীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা কোনো অপরাধের মধ্যেই ধর্তব্য মনে করা হয় না—শ্বশুরবাড়িতে তো বটেই, মা-বাবাও কালো রঙের মেয়েকে আপদজ্ঞান করেন।
২০০০ সালে আমি একটি ছোট গবেষণা করেছিলাম বাংলাদেশের চারটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক বছরের ‘পাত্র চাই/পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনগুলোর ওপর। গবেষণাটি প্রথম প্রকাশিত হয় যোগাযোগ পত্রিকায় এবং পরে গীতি আরা নাসরীন, মফিজুর রহমান ও সিতারা পারভীন সম্পাদিত গণমাধ্যম ও জনসমাজ বইটিতে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পাত্রী তিনি, যাঁর গায়ের রং ফরসা। গবেষণায় ব্যবহূত ৪৪৬টি বিজ্ঞাপনের ৪৯ দশমিক ৩২ শতাংশ ক্ষেত্রে পাত্রীর গুণ হিসেবে সরাসরি ফরসা রঙের উল্লেখ ছিল। এ ক্ষেত্রে ‘পাত্রী চাই ’ বিজ্ঞাপনের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ফরসা পাত্রী চাওয়া হয়েছে এবং ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপনের মধ্যে ৫০ দশমিক ৪৯ শতাংশ ক্ষেত্রে পাত্রীর গুণ হিসেবে পাত্রীপক্ষই নিজেদের মেয়ের ফরসা রঙের বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। মাত্র ১৩টি (২ শতাংশ) বিজ্ঞাপনে উজ্জ্বল শ্যামলা (নয়টি) ও শ্যামলা (চারটি) মেয়ের কথা বলা হয়েছে পাত্রীপক্ষের বিজ্ঞাপনে। পাত্রপক্ষের কোনো বিজ্ঞাপনে উজ্জ্বল শ্যামলা বা শ্যামলা পাত্রী চাওয়া হয়নি, কালো রঙের তো প্রশ্নই ওঠে না।
সবাই ফরসা মেয়ে চায়। কারণ, সাম্রাজ্যবাদী নান্দনিকতার প্রকোপে ফরসা মানে ভালো, আর কালো মানে খারাপ। নারীসমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও শোষিত অংশ হলো কালো নারী। সব দেশেই রাজনীতি, ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে কালো মেয়েরা অদৃশ্য অথচ দমন ও নিপীড়নের ক্ষেত্রে কালো মেয়েরা একবারে সামনে। মলয় রায় চৌধুরীর (১৯৯৭) মতে, ‘একটি পরিবার যেমন যেমন ধনী হতে থাকে, তেমন তেমন ফর্সা নারীর সংখ্যা বাড়ে। ফর্সা মানে অভিজাত। কালো মানে অনভিজাত। ফর্সা মানে আর্যদেবী। কালো মানে অসুরকন্যা।’ কালো মেয়েরা মেয়েলি নয়, এমন একটি ধারণা ইউরোপ চালু করতে চেয়েছে সাম্রাজ্যবাদের শুরু থেকে, যার দরুন সুন্দরী হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হিসেবে দেখা দিয়েছে ফরসা রং। কয়েক শ বছরের প্রচারে ব্যাপারটি এমন স্থায়ী হয়ে গেছে যে দেশে-দেশে এখন সিনেমা-টিভির অভিনেত্রী, বিজ্ঞাপনের মডেল, গল্পে-উপন্যাসে-কবিতায়-গানে ইউরোপীয় সৌন্দর্যের একমাত্রিক রূপটিকেই প্রচার ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
আমাদের দেশও সেই বহুজাতিক প্রচেষ্টায় পিছিয়ে নেই। অথচ আমাদের এ অঞ্চলের ধ্রুপদি নারী-সৌন্দর্য নির্মাণে কালো রং বাঁধা হয়নি। দ্রৌপদী কালো, শর্মিষ্ঠা কালো, ভ্রমর কালো, কপিলা কালো, ঠাকুরঝি কালো, নবিতুন কালো, কালো সোজন বাদিয়ার ঘাট-এ গদাই নমুর কালো মেয়ে দুলী। বাঙালি কবি ‘কালো মেয়ের পায়ের নিচে আলোর নাচন’ দেখার জন্য জগৎবাসীকে ডেকেছেন। আজ মিডিয়ার দৌলতে নারীস্বভাব, নারীচরিত্র বাঁধা পড়েছে ইউরোপীয় সংজ্ঞায়। কালো মেয়েদের বেলায় সৌন্দর্যের সংজ্ঞা গোটা অবয়ব থেকে সরিয়ে নিয়ে প্রয়োগ করা হয় চামড়ার ওপরে। তাই দেখা যায়, রং ফরসা করার নানা ওষুধ আর প্রসাধনসামগ্রীর ঢালাও কারবার চালাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। সামাজিক চাপে কালো মেয়ের ব্যক্তিত্ব খণ্ডিত হচ্ছে আর সব পরিমণ্ডলে ফরসা মেয়ের চাহিদা পাকাপোক্ত হচ্ছে। সাঁওতাল নারীদেরও দেখা যাচ্ছে এসব প্রসাধনী কিনতে, অর্থাৎ আদিবাসী নান্দনিকতাও আক্রান্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের মেয়েরা, নৃতাত্ত্বিক কারণেই যাঁদের সবার ফরসা হওয়ার কথা নয়, সামাজিক ফরসা রঙের চাহিদা এবং বহুজাতিক রং ফরসাকারী পণ্যের বিজ্ঞাপন ও জোগানের কারণে লাইন দিচ্ছেন প্রসাধনীর দোকানে। প্রাচ্যের ঘাড়ে পাশ্চাত্য তার মূল্যবোধ এভাবে চাপিয়ে রাখছে দুই উদ্দেশ্যে। প্রথমত, মনোজগতে ফরসা রঙের আধিপত্য বজায় রাখা এবং সেই শ্রেষ্ঠত্বকে পুঁজি করে বাজার বিকশিত করা। সঙ্গে যোগ দিয়েছে সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও রেডিও। এসব গণমাধ্যমের স্থান ও সময় কিনে নিচ্ছে বহুজাতিক করপোরেশনের বিজ্ঞাপন। সম্ভব করে তুলেছে সৌন্দর্যের নতুন মডেল, নতুন স্টেরিওটাইপ তৈরি করে সাধারণ মেয়েদের সেই মডেল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নির্মাণ। এই আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি এবং তার সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে সারা পৃথিবীর বিলিয়ন ডলার সৌন্দর্য ইন্ডাস্ট্রি। ঐশ্বরিয়া রাই, সুস্মিতা সেনসহ ভারতীয় নারীরা পর পর কয়েক বছর বিশ্বসুন্দরী খেতার অর্জনের পর এবং তাঁদের ফরসা ত্বকের সঙ্গে এসব রং ফরসাকারী পণ্যের ব্র্যান্ড যুক্ত করার মাধ্যমে এই উপমহাদেশের সাধারণ নারীদের ভেতর আকাঙ্ক্ষার বিস্তার সহজ হয়েছে; যদিও রং ফরসাকারী পণ্যের বাজার সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে প্রায় দুই বিলিয়ন ব্যবহারকারীর হদিস পাওয়া যাচ্ছে। পুরুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত নারী মানেই ফরসা নারীর চাহিদা পাকাপোক্ত করা হয়েছে।
গণমাধ্যম যেমন সমাজের প্রচলিত চাহিদাকে জিইয়ে রাখতে ও শক্তিশালী করতে পারে, তেমনি নতুন মতও নির্মাণ করতে পারে। বিজ্ঞাপন, নাটক, চলচ্চিত্র, গল্প-কবিতা ও রূপকথায় কেবল ফরসা নারীর যে মিথ তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে, যা ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের সবখানে এবং সেই আকাঙ্ক্ষায় পুড়ে যাচ্ছে অসংখ্য মিতু আক্তারের জীবন। সময় এসেছে সেসব বর্ণবাদী, অনৈতিক নির্মাণ বন্ধ করার। রং ফরসাকারী পণ্যের বিজ্ঞাপন তৈরি ও প্রচার বন্ধ করার অনুরোধ করি। পাশাপাশি ফরসা নয়—এমন চরিত্রের ইতিবাচক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ফরসা রঙের আধিপত্য ভেঙে ফেলা সম্ভব। ফরসা রঙের যে চাহিদা গণমাধ্যম তৈরি করেছে, গণমাধ্যমই পারে বিকল্প নির্মাণ করতে। আমাদের মনোজগতে যে ফরসা-অন্ধকার, তাকে সমূলে উৎপাটন না করতে পারলে নির্যাতনকারীদের গ্রেপ্তার করে মিতু আক্তারদের খুন ঠেকানো যাবে না। কালো ত্বকের অধিকারীকে রং ফরসা করার উপদেশ দেওয়া তাঁর ত্বককে ঘৃণা করার প্ররোচনা, যা মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন। যদি বর্ণবাদ ঘৃণ্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়, তবে আমাদের দেশে নয় কেন?
Your Opinion