Prose & Fiction - KG | Kaberi Gayen https://kaberigayen.com Tue, 15 Mar 2022 08:03:42 +0000 en-US hourly 1 https://wordpress.org/?v=6.5.3 https://kaberigayen.com/wp-content/uploads/2021/12/favicon_favicon-light.svg Prose & Fiction - KG | Kaberi Gayen https://kaberigayen.com 32 32 গ্রামের মহিলাদের কোন বন্ধু নেই https://kaberigayen.com/%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%a8-%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%a8-%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d/#respond Fri, 04 Mar 2022 10:42:49 +0000 https://kaberigayen.com/?p=7826 কোন সই নাই কা। বাড়ির বউ-ছেল্যার আবার সই থাকবে ক্যানরে ব্যাটা ? আমরা ওই রকম মাইয়্যা-ছেল্যা না। আমরা স্বামীর সাথে কথা ব্যুলি, তার বাদে শাউড়ি আছে, জাল আছে। কাম কুর‌্যাই দিশা নাই আবার প্যাটের কথা, না না বেটি আমরা তেমুন মাইয়্যা-ছেল্যা না। আমাগের ইজ্জত আছে।

The post গ্রামের মহিলাদের কোন বন্ধু নেই first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

 

The interests of rulers require that their subjects should be poor in spirit, and that should be no strong bond of friendship or society among them, which love, above all other motives, is likely to inspire, as our Athenian tyrants learned by experience; for the love of Aristogeiton and the consistency of Harmodius had a strength which undid their power.

 

-Plato, Symposium

মেমেয়েতে-মেয়েতে নিখাদ বন্ধুত্বের বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে ঠিক কী পরিমাণে আছে, মনে করতে পারি না। অগত্যা ঘুরে-ফিরে আবারও সেই রবীন্দ্রনাথে এসে থামে আমার মধ্যবিত্ত নাগরিক মন-“ওলো সই, আমারও ইচ্ছে করে তোদের মতো মনের কথা কই।” ছড়িয়ে দিয়ে পা দু’খানি এই সইরা কোণে বসে কানাকানি করেছিলেন বা কভু হেসে কভু কেঁদে মনের কথা বলেছিলেন যদিবা জানা যায় রবীন্দ্রনাথের জবানিতে কিন্তু তারা কি সই ছিলেন, না কি নেহাতই আত্মীয়-বান্ধব ছিলেন সেই তথ্য উদ্ধার আজ বুঝি আর সম্ভব না। আর সম্ভব হলেই বা কী, সে তো জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কথা। নজরুলের গানে ভালো করে বিনোদ বেণী বেঁধে দেবার আকুতি আছে সই-এর কাছে যেন প্রেমিক তার বিনুনীর ফাঁদে বাঁধা থাকে। এর বাইরে কিছু সই সম্পর্ক আমরা পাই বই কি, যেমন ‘চোখের বালি’, ‘গঙ্গা জল’, কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এই সম্পর্ক শুরু হয়েছে বিয়ে সূত্রে পাওয়া নতুন পরিচয়কে কেন্দ্র করেই। আর সম্পর্কের নামকরণগুলোও সার্থক বটে, বলিহারি বাংলা ভাষার রস, সইয়ে সইয়ে সম্পর্ক হলো ‘চোখের বালি’ আর জায়া ও পতি হলো ‘দম্পতি’, দ্বন্দ্ব সমাস।

বাংলার রূপকথায় বেকার রাজপুত্র-মন্ত্রীপুত্র-কোটালপুত্রের অক্ষয় বন্ধুত্ব, তাঁরা বনে যান, রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব শিকার করে চারদিক উজল করতে করতে ঘরে ফেরেন, জয় তাঁদের বন্ধুত্বের জয়। রাজকন্যাদের কোন বন্ধু নেই কেন দাসী ছাড়া ? আশ্চর্য, রাজকন্যা বা মহারানী¾কারোর কোন সই নেই, তাঁরা সদাই সচেষ্ট রাজপুত্র-মহারাজের মন জোগাতে আর বেচারী রাক্ষসী তো রাজপুত্রদের সাথে যুদ্ধে যুদ্ধেই নিঃস্ব, ক্লান্ত কিংবা মৃত। সই পাতানোর সময় কোথায় তাদের ? গল্প-উপন্যাসেও পুরুষে-পুরুষে বন্ধুত্ব বিস্তর, শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথ, মহিম-সুরেশ, মহেন্দ্র-বিহারীলাল, নিখিলেশ-সন্দ্বীপ, যোগেন্দ্র-রমেশ, গোরা-বিনয়, শচীন-শ্রীবিলাস…কিন্তু সেই অর্থে মেয়েদের মধ্যকার বন্ধুত্ব নিয়ে তেমন কালোত্তীর্ণ কাহিনী কি আছে আসলে? এক বঙ্কিমের Rajmohon’s Wife-এর রাজমোহনের স্ত্রী তথা মাতঙ্গিনীর সাথে কুলিন মেয়ে কনকের বন্ধুত্বকে বাদ দিলে সংশপ্তক-এ রাবেয়া আর রানুর মধ্যে বন্ধুত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু গোটা উপন্যাসে ক’বারই বা দেখা হয়েছে তাদের ? তাও তো সে যোগাযোগের মধ্যস্থতাকারী বালক মালু। এরকম বিচ্ছিন্ন এবং আরোপিত এক-আধটা কাহিনী বাদ দিলে মেয়েদের সত্যিকারের বন্ধুত্ব নিয়ে সাহিত্য কোথায় ? তাহলে কি মেয়েতে মেয়েতে বন্ধুত্ব কখনো ছিলোই না, না কি মেয়েরা বিয়ে সূত্রে পাওয়া সম্পর্ক কাঠামোতে এতই নিয়তি-নির্দিষ্টভাবে আবদ্ধ যে বন্ধুত্বের মতো অকেজো সম্পর্কের ভারে তাদের আর পীড়িত করতে চাননি কেউ। যে বয়সে দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের রাখাল আর রাজপুত্র পরস্পরের বন্ধুত্বটানে বটবৃক্ষের তলে সমবেত হন, রাখালপুত্র বাঁশি বাজান আর রাজপুত্র শোনেন সে বয়সে রাখালকন্যা হয়তো কয়েক সন্তানের মা হয়ে শাকচুন্নি-গেছোপেত্নির রূপ ধরে প্রায় শাশুড়ি হবার পথে, আর রাজকন্যা শত্র“পূরীতে ঘুমে অচেতন রাজপুত্রের দাক্ষিণ্যে উদ্ধার হবার আকাক্সক্ষায় অথবা রাজমহিষী হয়ে দুয়োরানী, ন’রানী, কনে রানীর সাথে সন্তান কামনায় সন্ন্যাসীর দেয়া শেকড় বাঁটছেন। শেকড় বাঁটা ভাগে পেলে ফুটফুটে রাজপুত্রের (রাজকন্যার নয়) মা হচ্ছেন, আর ভাগে না পেলে শিল-নোড়া ধোয়া জল খেয়ে বানর বা পেঁচা জন্ম দিয়ে রাজপ্রহরীর গলা ধাক্কায় ছিটকে পড়ছেন ছাইগাদার ওপারে। এইসব দিন পালটেছে নিশ্চয়ই। অন্তত শহরে। মেয়েরা এখন পড়ছেন, চাকরি করছেন, বন্ধুত্ব তাদের শুধু মেয়েদের সাথেই নয়, ধারণা করি ছেলেদের সাথেও। সেসব বন্ধুত্ব বিয়ের আগ পর্যন্তই বুঝি, খুব কম মেয়েই হয়তো সে সম্পর্ক বিয়ে পরবর্তী জীবনেও টেনে নিতে পারেন। ‘হয়তো’ বলছি সতর্কতা থেকে, যেহেতু কোন গবেষণা এ’বিষয়ে এখনো চোখে পড়েনি। তবুও জীবনের একটি পর্যায়ে তারা বন্ধুত্ব তো পাচ্ছেন ! কিন্তু এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে কি আমাদের গ্রামেও ? কত ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ড’ গ্রামকে ঘিরে, কতশত উন্নয়ন সংস্থার বিস্তার, নারীর ক্ষমতায়ন আর ক্ষুদ্রঋণ, দশক ওয়ারী উন্নয়ন সূচক…পরিবর্তন হয়েছে কিছুটা নিশ্চয়ই গ্রামের মহিলাদের, অন্তত ভাবতে ইচ্ছে করে। এই পরিবর্তনের পটভূমিতে কেমন সম্পর্ক কাঠামোতে বাঁধা আমাদের গ্রামের মেয়েরা ? কিংবা গ্রামে কি কোন মহিলা বাস করেন মা, ছেলের বউ, ননদ, জা, শাশুড়ি এসব সম্পর্কের বাইরে ? আছে কি কোন বিয়ে-নিরপেক্ষ সম্পর্ক ? বালিকার খোলস ছাড়তে না ছাড়তেই তো বিয়ে আর ভিনগাঁয়ে পারাপার, তারপর কেমন তাদের সম্পর্ক কাঠামো, তারই খানিকটা আভাস পাওয়ার একটি প্রয়াস হিসেবে দেখা যেতে পারে এই কাজটিকে। বলে নেয়া ভালো কেবল এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই গবেষণাটি করা হয়নি বরং Modelling the Influence of Communications on Fertility Behaviour of Women in Rural Bangladesh শীর্ষক আমার পিএইচডি গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে গ্রামের মহিলাদের সম্পর্ক কাঠামোর মুখোমুখি হই, উন্মোচিত হয় এক ‘জানা’ জগতের ‘অজানা’ কাহিনী, গ্রামের মহিলাদের কোন বন্ধু নেই।

 

গবেষণা পদ্ধতি

বাংলাদেশের ছয়টি বিভাগ থেকে ছয়টি গ্রাম বেছে নেয়া হয়েছে। গ্রামগুলো হলোঃ চৈতন্যপুর (রাজশাহী বিভাগ), বলাইনগর (ঢাকা বিভাগ), ব্রাহ্মণশাসন (সিলেট বিভাগ), জোবরা (চট্টগ্রাম বিভাগ), রায়ের কাঠি (বরিশাল বিভাগ), এবং পয়গ্রাম (খুলনা বিভাগ)। একটি গ্রাম বাড়তি নেয়া হয়েছে, যে গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী, ধর্মভিত্তিক সাংস্কৃতিক পার্থক্য কিছু আছে কী না দেখার জন্য। গ্রামটি হলো দিনাজপুর জেলার মহুগাঁও। এছাড়াও বন্ধু ও সহকর্মী শাতিল সিরাজ (সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) জয়পুর হাট জেলার আক্কেলপুর মিউনিসিপ্যালিটির পুরাতন বাজার মহল্লা থেকে পাইলট সার্ভে করে দিয়েছিলেন ৩০ জন মহিলার সাক্ষাতকার নিয়ে।

গ্রামের মহিলা (মেয়েরা যে কত বয়সে মহিলা হন আসলে !), যাঁদের বয়স ১৪ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে, এইসব মহিলাদের মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে অন্তত একজন মহিলার সাথে কথা বলা হয়েছে। ফলে যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ম্যাট্রিক্স যখন তৈরী করা হয়েছে, তখন প্রতিটি বাড়ির প্রতিনিধিত্বকারী অন্তত একজন সেখানে রয়েছেন।

যদিও মূল গবেষণায় রীতিমতো ছকে বাধা প্রশ্নপত্র ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তবে এই লেখায় গ্রামে থেকে গ্রামের মহিলাদের সাথে আলাপ, পর্যবেক্ষণ এবং মাঠ জার্ণালের টোকাও তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষ করে পাওয়া তথ্যের অর্থ নিরূপণের ক্ষেত্রে এবং ফলাফল ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আলাপ এবং টোকার বিস্তর সাহায্য নেয়া হয়েছে গুণগত ব্যাখ্যার জন্য।

আগস্ট ২০০২ থেকে জানুয়ারী ২০০৩ পর্যন্ত মাঠে কাজ করে মোট ৭২৪ জন মহিলার আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মূল গবেষণার প্রয়োজনে যদিও বিবাহিত মহিলাদেরই সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে নির্দিষ্টভাবে, তবে তথ্য সংগ্রহের শুরুতেই প্রথম গ্রাম অর্থাৎ রাজশাহী বিভাগের চাঁপাই নববাগঞ্জ জেলার ধাইনগর ইউনিয়নের চৈতন্যপুর গ্রামে কাজ করতে গিয়ে কয়েক বাড়ির তথ্য সংগ্রহ করতেই কৌতূহলী হয়ে পড়ি অবিবাহিত মেয়েদের অবস্থাটাও যাচাই করতে। শুরু হয় ডায়েরীতে নোট নেওয়ার পালা। ১৪ থেকে ৪৯ বৎসর বয়সী অবিবাহিত মেয়ের সংখ্যা খুব বেশী নেই। সাত গ্রাম মিলিয়ে সাকুল্যে ৩৭ জনকে জিজ্ঞেস করা সম্ভব হয়েছে।

এই কাজে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের বাইরে যে-কোন সামাজিক গবেষণার মতই কিছু ব্যক্তিগত প্রাথমিক তথ্য এবং আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও দৈনন্দিন খবরাখবর আদান-প্রদানের তথ্যও বিশ্লেষণ করা হয়েছে এসব মহিলার যোগাযোগ আবহ সম্পর্কে খানিকটা ধারণা নেয়ার জন্য।

তথ্য সংগ্রহের কাজে আমাকে সাহায্য করেছেন বিভিন্ন পেশার মোট ৪৩ জন, ৬ থেকে ৭ জন প্রতি এলাকায়। রাজশাহী বিভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক শাতিল সিরাজ শুভ আর ৬ জন ছাত্র তথ্য সংগ্রহকারী দলে কাজ করেছেন। পরে চৈতন্যপুর গ্রামের পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মী আনোয়ারা বেগম এবং গ্রাম্য দাই রাহেলা বেগম যুক্ত হয়ে পড়েন এই দলে। এছাড়াও টীমের সদস্য গণযোগোযোগ বিভাগের ছাত্র বেনাউল ইসলামের বাড়িতে থেকে এই গ্রামে কাজ করা হয়েছে ফলে বেনাউলের বোন, স্থানীয় কলেজছাত্রী নুরুন্নাহার কেয়া জুটে যান এই দলে। সিলেট বিভাগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের টীমে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা। বরিশাল বিভাগে কাজ করেছেন পিরোজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারের নেতৃত্বে পিরোজপুর সরকারী কলেজের দুজ’ন ছাত্রী, একজন শিক্ষক এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, স্থানীয় এনজিও সকলের জন্য করি’র কয়েকেজন কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর একজন সদস্য, একজন গৃহবধূ, এবং প্রাক্তন জমিদার ও বর্তমানে সমাজকর্মী গৌরাঙ্গ রায় চৌধুরী। খুলনা বিভাগের দলে ছিলেন মূলত পয়গ্রামের বাসিন্দারা¾ফুলতলা কলেজের বাংলার প্রভাষক, পত্রিকা হকার, প্রাক্তন ভধি, ফুলতলা কলেজের দু’জন ছাত্র, সরকারী বি.এল. কলেজের অনার্স ছাত্রী। ঢাকা বিভাগের টীমে কাজ করেছেন একেবারেই ভিন্ন ধরনের পেশার মানুষেরা¾নাগরপুর ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য, নাগরপুর আলিয়া মাদ্রাসার একজন শিক্ষক, দু’জন গৃহবধূ এবং একজন মৌমাছি পালক। মহুগ্রামে তথ্য সংগ্রহ করেছেন সৌমেন দাস আর রওনক ফেরদৌস স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিয়ে, তাঁরা ইতিমধ্যেই হাত পাকিয়েছেন চৈতন্যপুরে কাজ করে।

প্রথমত যেহেতু প্রত্যন্ত গ্রামে থাকার ভালো কোন ব্যবস্থা নেই এবং দ্বিতীয়ত যে গ্রামে কাজ করা হবে সেই গ্রামের কোন প্রতিপত্তিশালী বা সম্মানিত কারো বাড়িতে থেকে তাঁদের মাধ্যমে পরিচিত না হলে গ্রামে ঢুকে গ্রামের মহিলাদের সাথে কথা বলা যাবে না, এই দুই বিবেচনা থেকে যে-সব এলাকায় পরিচিতজন আছেন তাঁদের আতিথেয়তার উপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং বাংলাদেশে এখনো ‘অতিথি নারায়ণ সেবা’ চলে বলেই কোন অসুবিধা কোথাও হয়নি। রাজশাহীর চাঁপাই নবাবগঞ্জে বেনাউলদের বাড়ি অর্থৎ মেম্বার বাড়ি, বরিশালে পিরোজপুরের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার কুলদানন্দ রায়ের সরকারি বাসভবন, চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বন্ধু আতিকুর রহমানের ফ্ল্যাট, সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অবন্তী হারুনের মেসভবন, খুলনায় বন্ধু আনন্দময়ী মজুমদারের আত্মীয় বাগেরহাট পি.সি. কলেজের দুই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার ও মোহাম্মদ কায়কোবাদ-এর পয়গ্রামের বাড়ি আরণ্যক, আর ঢাকায় টাঙ্গাইল জেলার গয়াহাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন চেয়ারম্যানবাড়ি ছিলো আমার থাকার আর কাজ চালানোর অফিস। এঁরা শুধু আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাই করেননি বরং পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় মহিলাদের সাথে, জুটিয়ে দিয়েছেন তথ্য সংগ্রহকারী দলের সদস্যদের। কাজেই যাঁরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন আর যাঁরা সবকিছুর বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন, তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বরং বলে নেয়া ভালো এটি একটি যৌথ কাজ এবং এঁরা প্রত্যেকেই আমার সহলেখক।

 

কিছু প্রাথমিক তথ্য [যোগাযোগ আবহ]

 

মূল গবেষণায় যে মহিলাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে তাঁদের গড় বয়স ২৮ বছরের একটু বেশী। গড় বিয়ের বয়স সাড়ে পনের বছর, প্রথম বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন গড়ে সাড়ে সতের বছর বয়সে আর তাঁদের স্বামীরা গড়ে তাদের চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়, সাড়ে ৩৭ বছর। এসব মহিলারা এইসব গ্রামে বসবাস করছেন প্রায় সাড়ে বারো বছর ধরে। একেবারে পাকা হিসেব, সাড়ে পনের বছরে বিয়ে + সাড়ে বারো বছর ধরে স্বামীর গ্রামে বসবাস, কাজেই গড় বয়স ২৮ বৎসরের একটু বেশী। এসব মহিলাদের ৪২ শতাংশ কখনো স্কুলে যাননি, যাঁরা গিয়েছেন তাঁদের ১৫.৮ শতাংশ প্রাইমারী পার করেছেন, ২.৪ শতাংশ কলেজে গেছেন আর মাত্র ১.৪ শতাংশ ডিগ্রি পর্যায়ে পৌঁছুতে পেরেছেন। যদিও ৫৮ শতাংশ মহিলা স্কুলে গিয়েছেন জীবনের কোন একটা সময়ে কিন্তু শতকরা ৪৯ জন বাংলায় লেখা কোন চিঠি পড়তে বা লিখতে পারেন না। তাঁদের স্বামীদের বিদ্যা-বুদ্ধির দৌড়ও তেমন চমকপ্রদ নয়। গড়ে ৩২.২ জন কখনোই কোন স্কুলে যাননি অর্থাৎ স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে স্বামীরা স্ত্রীদের চেয়ে মাত্র ৯.৪ শতাংশ বেশী। এক দুর্মুখ তথ্য সংগ্রহকারী ফোড়ন কাটলেন যে মেয়েরা স্কুলে গেলে গম পায় সেজন্যই নাকি প্রাইমারিতে ছেলে-মেয়ের ব্যবধান তত বেশী নয়। কথাটা হয়তো সত্যি, প্রাইমারীর পরে মেয়েদের আর দেখা পাওয়া যায় না, বাড়তে থাকে ছেলে-মেয়ের স্কুল উপস্থিতির বৈষম্য। ৯২.৭ শতাংশ মহিলা নিজেদেরকে গৃহবধূ বলে দাবি করেছেন, ২.৮ শতাংশ কুটির শিল্প বা কারখানায় কাজ করেন। ২.৩ শতাংশ চাকুরী করছেন, ০.৭ শতাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত আর ১.৫ জন নিয়োজিত কাঁথা সেলাই, মাদুর তৈরী, তালপাতার হাতপাখা বানানো, ধনী লোকের বাড়িতে ঝি-গিরি, বা রাস্তা নির্মাণ কাজে দিনমজুরিতে। এঁদের স্বামীদের পেশা মূলত কৃষিকাজ, ৩৩.৮ শতাংশ, বেশীরভাগই অন্যের জমিতে দিনমজুরি করেন বা বর্গা খাটেন। এছাড়াও শতকরা ২৪.৪ জন ছোটখাটো ব্যবসা, ১৩ জন ড্রাইভিং, ১০.২ জন চাকুরী আর ১০.১ জন দিনমজুরের কাজ করেন। শতকরা ৪০ জন মহিলা এনজিও-র ক্ষুদ্র ঝণ প্রকল্পে জড়িত। যদিও এসব মহিলারা নানাধরনের কাজের মধ্য দিয়ে পরিবারের আয় বাড়াচ্ছেন কিন্তু তাঁরা নিজেরা মনে করেন না যে বাড়ির আয়ে তাঁদের কোন অংশভাগ আছে। এই মহিলাদের দৈনন্দিন খবরাখবর জানার মাধ্যম হলো প্রথমত তাঁদের স্বামীরা যাঁরা হাটে-বাজারে, অফিসে-মাঠে যান, তারপর “মাইনষের মুহে মুহে”। ৬৪ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন তাঁদের একাকী চলাচলের স্বাধীনতা নেই, যদিও মহুগাঁও-এর (হিন্দু গ্রাম) অবস্থা একটু ভিন্ন। শতকরা ৮৬.৪ জন মহিলা দাবী করেছেন যে তাঁরা নিজেরাই চলাচল করতে পারেন। শতকরা ৫৩ জন মহিলা জানিয়েছেন এমনকি ঘর-গেরস্থলির কাজ বা কী রান্না করবেন বা ছেলেমেয়েকে ভালোমন্দ কিছু কিনে দেবেন কী দেবেন না এ-জাতীয় কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই। সবধরনের সিদ্ধান্ত নেন প্রথমত তাঁদের স্বামীরা, তারপর শাশুড়ি, শ্বশুর বা শ্বশুর বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। গড়ে প্রত্যেকের বাচ্চা রয়েছে ২.৬৪ জন এবং প্রত্যেকেরই রয়েছে আরো ছেলের আকাক্সক্ষা, মেয়ের তুলনায় ছেলের আকাক্সক্ষা প্রায় তিনগুণ বেশি। এই আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে, কিংবা বলা ভালো এই যোগাযোগ আবহে মহিলাদের আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ কাঠামোর সুলুক-সন্ধান করা হয়েছে।

প্রশ্ন: পাঁচজন বন্ধুর নাম বলুন

প্রত্যেক মহিলাকে বলা হয়েছিল পাঁচজন মানুষের নাম বলতে যাঁদের সাথে তাঁরা নিয়মিত সুখ-দুঃখের কথা (পেটের কথা) বলেন, যাঁদের মতামত তাঁদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ এবং সবচেয়ে বড় কথা যাঁদেরকে তাঁরা বন্ধু/সই মনে করেন। তাঁরা পুরুষ বা মহিলা যে কেউ-ই হতে পারেন।

প্রত্যেক বন্ধুর জন্য আরো যে সহযোগী প্রশ্নগুলো করা হয়েছিলো সেগুলো হচ্ছেঃ

১. সম্পর্কের ধরণঃ বন্ধু □ সহকর্মী □ আত্মীয় □ মুরুব্বি □ অন্যান্য
২. কতদিন ধরে চেনেনঃ ৩ মাসের কম □ ৬ মাস -১ বছর □ ১-২ বছর □ ৩-৫ বছর □ ৫ বছরের বেশী □ অন্যান্য □
৩. কত ঘন ঘন দেখা হয়ঃ প্রত্যেকদিন □ সপ্তাহে অন্তত একবার □ মাসে অন্তত একবার □ অন্যান্য □
৪. যোগাযোগের মাধ্যমঃ মুখোমুখি □ চিঠি □ টেলিফোন □ অন্যান্য □
৫. কোথায় থাকেন এই বন্ধুঃ একই বাড়ি □ একই পাড়া □ একই গ্রাম □ একই শহর □ নিকটবর্তী গ্রাম/শহর □
অন্যান্য □
৬. দেখা করার জায়গাঃ কাজের স্থান □ একে অপরের বাড়ি যাই □ কোন সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠন □
বাড়ি □ অন্য কোন জায়গা □
৭. আপনার দৈনন্দিন সমস্যায় তথ্য পরামর্শের জন্য কি এর কাছে যান ?
কখনোই না □ মাঝেমধ্যে □ প্রায়ই □ সবসময় □
৮. বিভিন্ন ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কি এই ব্যক্তির কোন প্রভাব থাকে ?
কখনোই না □ মাঝেমধ্যে □ প্রায়ই □ সবসময় □

চৈতন্যপুরঃ ‘কোন সই নাই কা’

চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার ধাইনগর ইউনিয়নের চৈতন্যপুর গ্রাম। কৃষিই মুল জীবিকা। দুই ধরনের মানুষের বসবাস এই গ্রামে। এক যাঁরা প্রচুর জমির মালিক, টাকা খাটান আম আর আখের চাষে। এঁদের সংখ্যা কম। বাকীরা হলেন যাঁরা কামলা খাটেন এইসব আম আর আখের ক্ষেতে। রয়েছেন কিছু স্কুল শিক্ষক, ছোট দোকানদার, চাকুরে। মাদ্রাসা আর মসজিদ রয়েছে বেশ জোরেসোরে। কিছু এনজিও কাজকর্মও রয়েছে। মহানন্দা নদীর যে-পাড়ে চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহর, তার ঠিক অন্য পাড়ে এই গ্রাম। ছোট লঞ্চ বা বড় নৌকায় চাঁপাই নবাবগঞ্জের সাথে এই গ্রামের যোগাযোগ।
চৈতন্যপুরে প্রথম যে বাড়িটায় আমরা ঢুকেছি সেই বাড়ির গৃহকত্রী (৩৮) জানালেন সাফ কথা,

কোন সই নাই কা। বাড়ির বউ-ছেল্যার আবার সই থাকবে ক্যানরে ব্যাটা ? আমরা ওই রকম মাইয়্যা-ছেল্যা না। আমরা স্বামীর সাথে কথা ব্যুলি, তার বাদে শাউড়ি আছে, জাল আছে। কাম কুর‌্যাই দিশা নাই আবার প্যাটের কথা, না না বেটি আমরা তেমুন মাইয়্যা-ছেল্যা না। আমাগের ইজ্জত আছে।

ঠিকই, সবারই ইজ্জত আছে এই গ্রামে। মহানন্দা নদীর পাড়ে এই অপূর্ব সুন্দর গ্রাম, কেউ এমনকি নদীতে জল আনতে যাওয়ার কথাও স্বীকার করতে চান না। আল্লায় চাহে তো আমাদের বাড়ির পারাই টিপ কল আছে। নদীত যাত্যে হবে ক্যান্ ? আমাদের বিটি ছ্যালারা ঘোরাঘুরি কেহই ক্যরে না। স্বামী পছন্দ করে না ব্যাট্যা। এই গ্রামেই হিন্দুপাড়া হলো কামারপাড়া-অবশ্য বর্ধিষ্ণু কাজিবাড়ির লোকেরা দাবি করছেন পাড়ার নাম কাজিপাড়া, বেশ চাপা কলহও আছে এই নিয়ে। বেনাউলের বোন কেয়া কাজি বাড়িতে বসে জোর দিয়ে বললেন এটা কামারপাড়া আর কাজিবাড়ির বউ জোর দিয়ে জানালেন এটা কাজিপাড়া, নতুন সাইনবোর্ডও টাঙানো হয়ে গেছে। কামারপাড়ার অবিবাহিত মেয়ে, কলেজ ছাত্রী রমা (১৭) [প্রকৃত নাম নয়] জানালেন কোন সই নাই তার। কলেজে যান মাটির দিকে মুখ করে আবার ফিরে আসেন নতমুখে।

মা রে, মায়েট্যো যতক্ষণ বাহিরে থাকে কাটা হয়্যা থাকি রে মা। একটা বিয়া-থা দিতে পারত্যুক যুদি ! ঘরের বাহির হত্যে দেই না কো মা… রমার মা’র কুন্ঠিত উত্তর।

কলেজেও যায় রমা সপ্তাহে একবারের বেশী না। কেয়া-রও প্রায় একই অবস্থা। সবাই বিয়ের প্রহর গুনছে। কলেজের বাইরে রমা কাজ করে মা-কাকী-ঠাকুরমা’র সাথে, বাবা-কাকাকে জোগালও দেয়।

কাজি বাড়ির তিন বউই জানালেন তাদের কোন ‘সই নাই ক্যা’। তাহলে কি এই গ্রামের বউরা-মেয়েরা কোন কথাই বলেন না কারো সাথে ? অবশ্যই বলে। স্বামীর সাথে বলেন, শাশুড়ির সাথে বলেন, বলেন জা-ননদের সাথে। এক-এক বাড়ি-ভিত্তিক এক-এক পাড়া। আত্মীয়-স্বজনরাই আছেন চারপাশে। যাঁরা বিবাহিত বছরে এক-আধবার যান বাপের বাড়ি, ‘ব্যুনের সাথেই দেখা হয় না’, ছেলেবেলার সই-এর সাথে দেখা হওয়া তো অনেক দূরের কথা। ‘সইয়ের মুখ মনে নাই’ জানান আতোয়ারা বেগম। এই গ্রামের ৮৪ জন মহিলা যাদের কথা বলেছেন পেটের কথা বলার লোক হিসেবে তাদের ৭৮% জন হলেন জা, ১১% জন শাশুড়ি বা শাশুড়ি পদবাচ্য, বাকিরা ননদ বা বাড়ির উপর থাকা অন্য বউ-ঝি, কোন-না-কোন আত্মীয়। এঁদের সাথে দেখা হয় প্রতিদিন, বাড়িতেই দেখা হয়, মুখোমুখি দেখা হয়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা হয়, বিভিন্ন বিপদে-আপদে পরামর্শও চান কিন্তু এক শাশুড়ি ছাড়া এইসব জা-দের খুব প্রভাব আছে কোন বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে তেমন দাবি কেউই করেন না। সবার উপরে স্বামী।

মহানন্দা নদীর এক পাড়ে এই শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়িতে যেতে হলে নদী পার হতে হয় প্রায় সবাইকেই। তবুও তাঁরা সকাল-সন্ধ্যায় ছোট লঞ্চের পারাপার দেখেন, এই পারাপার দেখার জন্য তাঁদের এমনকি নদী পর্যন্ত যেতে হয় না, বাড়ি থেকেই দেখা যায়। তাঁদের স্বামীরা ঘরে ফেরেন মাগরেবের আজানের পর, মাছ নিয়ে, ফল নিয়ে, শাকসব্জি নিয়ে, চিপ্সের প্যাকেট আর কোকাকোলার বোতল নিয়ে, আরেকপারের খবর নিয়ে। আর তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েনঃ

“আপা, আইজ আর কথা বুলব না, সাইনঝ্যা হয়্যা গিলচে, কারুর সাথে কথা ব্যুলা পছন্দ করে না …”
“কে? কে আইস্যাছে ঘরে?” স্বামীদের জোরালো আওয়াজ, আমাদের অগত্যা ফিরে আসতেই হয়।

আর তাই শুক্রবার কোন ভালো দিন নয় এসব মহিলাদের সাথে কথা বলার জন্য, পুরুষরা সব বাড়িতে থাকেন জুম্মার নামাজের পর। তবুও এই গ্রামেরই পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী আকতারা খাতুন, শরীরে-মাথায় সৌদি চাদর জড়ানো আকতারা খাতুন, জানান তার বন্ধু আছে স্বামীর বাইরেও। তিনি তিনজন পুরুষ মানুষের কথা বলেন, এরা সবাই চাকুরি করেন তার সাথে। জানালেন তাঁর স্বামীর মন-মানসিকতা খুবই উঁচু দরের, সে কিছু মনে করে না। পাড়া-পড়শির খোঁটাকে আমলে আনেন না তিনি। জানালেন পাঁচ-দশ বছর আগেও গ্রামে পর্দার এত ‘কড়াক্কড়’ ছিলো না, ‘বউ-বিটিরা বাহির হত্যে পারত্যুক’, এই পরিবর্তন কেনো হচ্ছে তিনি নিজেও ঠিক জানেন না। এনজিও কার্যক্রম আছে গ্রামে কিন্তু ক্ষুদ্রঝণ বাড়ি বাড়ি এসে দিয়ে যাওয়া হয়, নিয়েও যাওয়া হয় বাড়ি থেকে কাজেই বউ-ঝিদের ‘ইজ্জত’ নষ্ট হয় না অন্য পাড়ায় গিয়ে।

রায়ের কাঠী: ‘মুই তো মুরুব্বি, মোরডে কেউ হাস-তামসাও করে না’

পিরোজপুর জেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটারের মতো দূরে রায়ের কাঠি গ্রাম। গ্রামের আয় মূলত কৃষি। তবে কিছু পারিবারিক ব্যবসার চলও রয়েছে, যেমন কুমারের কাজ, তাঁতের কাজ আর মাছ-ধরা কিংবা জাল-বোনা। গ্রামটা সমৃদ্ধশালীই বলা চলে, বিশাল জমিদার বাড়ি, ফসলের মাঠ, স্কুল, আবার গ্রামের অবস্থানও শহরের কান ঘেঁষে। তবে এই গ্রামের দুটো পরিষ্কার অংশ, একদিকে পুরানো গ্রাম লাল ইটের প্রাক্তন জমিদার বাড়ি, মাঠ, মন্দির আর এই স্থাপনা ঘিরে গরীব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসবাস, অন্যদিকে নতুন বসতি, মসজিদ, মাদ্রাসা, হলুদ-নীলের নক্সাকাটা নতুন দালান-বাড়ি, সম্পদশালী মুসলমান জনগোষ্ঠীর বসবাস। তবে মাঝামাঝি জায়গায় কিছু নতুন ছোটখাটো আয়ের মানুষের ছোটছোট নতুন ঘরও দেখা যায়।

হিন্দু অংশে কুমার পাড়ার মহিলারা বড় ব্যস্ত। তাঁতি পাড়ায় তেমন একটা কাজ নেই, অভাব। জেলে পাড়ায় মাছ ধরার কাজ ততটা নেই, স্বামীরা দাওয়ায় ঝিমুচ্ছেন কিন্তু মহিলাদের হাত থামে না, জাল বুনে চলেছেন, ওটাই আয়ের পথ।

মারে, তের বচ্ছইরগ্যা বিয়া হইছে মোর, হেই থেইক্যা জালই বুনি। বাড়ির বাহির বা হমু কহন আর সই-বা পাতামু কহন। সব জালেরা মিলাই তো কাম করি। মোরা মাগো পাড়ার বাহির হই না। মোগো জালেরা (জা) আছে, হাউড়ি আছে, মোগো সই পাতাইনার সোমায়ও নাই।

আরতি রানীর জাল-বোনা চলতেই থাকে। তবে বড় পূজায় (দুর্গা পূজায়) একবার বাপের বাড়ি প্রায় সবাই-ই যান, নিদেন পক্ষে জমিদার বাড়ি। জমিদার গিন্নি ভালো মানুষ, বিপদে-আপদে সাহায্য করেন, পরামর্শ দেন কিন্তু না, জিহ্বায় কামড় দেন কুমার পাড়ার সবিতা রানী, “উনি গুরুজন, উনার লগে পেডের কথা বলি না।”

মুসলমান অংশে ঢুকতে সাহায্য করলেন এক মেয়ে, মর্জিনা বেগম, বড়-বাড়ির বোন, বেচারির মনে শান্তি নেই, স্বামী তার নতুন বিয়ে করেছেন অথচ কোলে তার ফুটফুটে ছেলে। ভাইদের বাড়িতে থাকেন, ছেলে কোলে নিয়ে তার মাঠে-ঘাটে চলতে বাধা নেই। তবুও তার কোন সই নেই। এই বাড়ির বউরা বেশ পর্দানশীন। কেউ বাড়ির বাইরে যান না। বাড়ির বড়-বউ বি.এ. পাশ কিন্তু তার কোথাও যাওয়ার ‘হুকুম নাই’। বেশ কাতর গলায় জানালেনঃ

হ, আবার সই ! পুষ্করিণীতেই যাইতে পারি না, গোসলখানায় পানি দিয়া যায়, হেই পানিতে গোসল সারি। ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর মাইয়ারাও এই বাড়িতে ডোকতে পারে না। … লণ্ডন কি খুব সুন্দার ? … আর বউরা তো ছোড, মুই তো মুরুব্বি, মোরডে কেউ হাস-তামসাও করে না। … মোর ছবি তো তোলতে পারবেন না, মোর মাইয়্যার এউক্ক্যা ফডো তোলেন। দোয়া করবেন আপা য্যেন মোর মাইয়াউগ্য একদিন আমনের মতো অইতে পারে, দ্যাশ-বিদ্যাশ যাইতে পারে।

এরই মধ্যে শাশুড়ি ঢোকেন, ছবি তোলার আয়োজন দেখে নিজেও বসে যান ফটো সেশনে যদিও দিব্যি দিয়ে দেন ছবি যেনো কেউ না দেখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন বিত্তান্ত, কোথায় কোথায় যাওয়া হয়েছে আরো। জমিদার বাড়ির কথা শুনে মুখটা কালো হয়ে যায়। বড় বউ চোখ টিপে দেন যেনো আমার পরিচয় ফাঁস হয়ে না যায়, উঠে পড়ি, শাশুড়ি একটা ঠোঙায় কিছু আমলকি দিয়ে দেন।

সুলেখা বেগম [প্রকৃত নাম নয়] ট্রেনিংপ্রাপ্ত গ্রাম্য দাই। বয়স ৩৭। বিয়ে করেছেন ৬০ বছরের অবস্থাপন্ন এক লোককে। ঘরে সতীন আছে। সতীনের ছেলের বউরা তার বয়সী। তবে জমিজমা যেহেতু এখনো ভাগ হয়নি আর স্বামী যেহেতু তার ‘অঞ্চলে বান্ধা’ তিনি কারো তোয়াক্কা করেন না এবং হিন্দু-মুসলিম দুই পাড়াতেই তার যাতায়াত কিন্তু ঠিক নিশ্চিত নন তাঁর কোন সই আছে কি না যার সাথে তিনি মনের কথা বলেন।

প্রাক্তন জমিদার (যাঁরা ২৭ প্রজন্ম এই গ্রামে জমিদারি করেছেন এবং যাঁদের নামে এই গ্রামের নাম রায়ের কাঠি) গৌরাঙ্গ রায়ের স্ত্রী জানালেন তাঁর ‘বান্ধবী’ আছে, একই স্কুলে চাকরী করেন কিন্তু মনের কথা বলার কেউ নেই, এক স্বামী ছাড়া। ভাসুরপুত্রের বউ আছে বাড়িতে কিন্তু সে অনেক ছোট, কর্তব্যকর্মের বাইরে কোন আলাপ নেই।

এই গ্রামের ৯৮ জন মহিলার সম্পর্ক সূত্রের মধ্যে ৭৬% জা, ১২% শাশুড়ি-শাশুড়ি সম্পর্কিত, ৭.৬% বিধবা ননদ বা সতীন, ৩.২ % গ্রাম্য মুরুব্বি আর এক-আধজন বন্ধু-বান্ধব। ছেলে সন্তানের জন্য স্বামী যেনো অন্য বাড়িতে বিয়ে করে পর না হয়ে যায় শুধু সে-কারণেই এই গ্রামের দুই বোন এখন সতীন। আমেনা বেগম আপন ছোট বোন আরিফা বেগমকে বিয়ে দিয়েছেন স্বামীর সাথে। সুখ-দুঃখের কথা তারা বলেন বই কি !

পয়গ্রাম: ‘মহিলাগে সই থাকে নিকি, মেয়েগে থাকতি পারে’

খুলনা জেলার ফুলতলা ইউনিয়নের পয়গ্রাম। আর পাঁচটা গ্রামের মত হতে গিয়েও হতে পারেনি কয়েকজন মানুষের ওই গ্রামে অবস্থানের জন্য। গ্রামে ঢুকতেই প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের পৈতৃক বাড়ি, তাঁর ভাই সমাজকর্মী ইমদাদুল হক আনু থাকেন সে বাড়িতে। তারপরেই রয়েছে পি.সি. কলেজের সাবেক দুই অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার আর মোহাম্মদ কায়কোবাদ দম্পতির বাড়ি আরণ্যক। শুরুতে এটি ছিলো দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের ছোট একটা ঘরসহ গাছ-লতায় ঘেরা এক বাগান। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বলে পরিচয় দিয়ে আসলে খুব অল্পই বোঝানো যায়। এই বাড়িতে মুক্তি মজুমদার গড়ে তুলেছেন এক নীরব সাংস্কৃতিক আন্দোলন। গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন গান শেখে এখানে মুক্তি মজুমদারের কাছে, মহড়া নেয় কঠিন কঠিন সব রবীন্দ্র নাটকের। রীতিমত খাইয়ে-দাইয়ে, কখনোবা সন্দেশের প্রলোভন দিয়ে এ-সব ছেলেমেয়েকে দিয়ে অনুষ্ঠান করাচ্ছেন মুক্তি মজুমদার। যেসব ছেলেমেয়েরা ফুলতলার আঞ্চলিক টান ছাড়া কথা বলতে পারে না, পড়াশুনা শিখে উঠতে পারেনি এখনো তারাই দিব্যি ফাল্গুনী, তাসের দেশ, হ-য-ব-র-ল করছে। এখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা যেমন আছেন তেমনি আছেন পড়াশুনা তেমন-না-জানা মেয়েরাও। কিন্তু তারপরও এসব মেয়েরা কতটুকু বন্ধু আসলে পরস্পরের ? তানিয়া বি.এল. কলেজের ডিগ্রির ছাত্রী বা মুমু সমাজবিজ্ঞানে অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছেন তখন। তারা গান-বাজনা করছেন ঠিকই কিন্তু ঠিক নিশ্চিত নন তাদের সেই অর্থে কেউ বন্ধু আছে কী না। কারণ কোন কাজ ছাড়া নাকি তারা ঘর থেকে বের হন না। গানের মহড়াটুকু দিয়েই বাড়ি ফিরে যান। কাজ ছাড়া সময় কাটানোর উপলক্ষ্য তাঁরা পান না।

বংলাদেশের অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই পাড়ায় পাড়ায় বিভক্ত এই গ্রামঃ পাল পাড়া, ঋষি পাড়া, কুমার পাড়া, নিকেরী পাড়া, বরজীবী পাড়া, শালবন পাড়া, গাজী পাড়া, কাজী পাড়া। কাজী পাড়ায় যে কাজীরা থাকেন তারা সবাই একই পরিবারভুক্ত, খানা যদিও আলাদা। এই পাড়ার সব বউরাই পরস্পরের আত্মীয়, অবশ্যই বৈবাহিক সূত্রে। প্রতিদিন সকালে চোখ খুললেই পরস্পরের দেখা হয়, কাজের কথাও হয়, কিন্তু এরা পরস্পরের জা-ননদ-শাশুড়ি, কেমন যেনো এক চাপা টেনশন, ঠিক বন্ধু নয়। একই গল্প পাড়ায় পাড়ায়। পাল পাড়ার শোভা রানী পাল, যিনি তথ্য সংগ্রহকারী দলেরও একজন, একদিন বলে উঠলেন,

ওদ্দি, এই প্রশ্নডা বাদ দিলি ভালো হতো না ? মহিলাগে সই থাহে নিকি, মেয়েগে থাকতি পারে।

বিয়ে হয়ে গেলেই মেয়েরা মহিলা হয়ে যান, সই থাকাটা আর তখন ভালো কোন কাজ না। বি.এ.বি.টি.-পাশ এক ভদ্রমহিলা আসমা খাতুন, স্কুলে পড়ান, আমাদের কাজে খুবই সাহায্য করেছেন, বললেন,

বিয়ার পর নিজির বুনগির সাথেই ভালো যোগাযোগ নাই তো সই !

এই গ্রামে মোট ১৯৭ জন মহিলার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। তাঁরা যাদের সাথে নিয়মিত কথা বলেন, দেখা হয় বলে জানিয়েছেন তারা হলেন মূলত জা (৮১%)। এছাড়াও শাশুড়ি-ননদ-বিধবা ননদ-সতীন। এক শাশুড়ির কথার প্রভাব খানিকটা আছে তাদের জীবনে বাকি সবার প্রভাব বলতে গেলে নেই। স্বামীই সব। তবুও ধান শুকাতে দিয়ে, কাঁথা নাড়তে গিয়ে, বাচ্চার পেট খারাপ হলে এদের সাথেই দেখা হয়, কথা হয়।

 

জোবরা: ‘আঁরা বারের মাইয়াফোয়ার লগে খঁতা না খই।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বিখ্যাত গ্রাম জোবরা। গ্রামীণ ব্যাংক-খ্যাত জোবরা। বন্ধু আতিকুর রহমান যখন তথ্য সংগ্রহকারী দলের সাথে অর্থাৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানালেন যে জোবরা গ্রামকে বাছা হয়েছে কাজ করার জন্য, মনটা একটু দমেই গিয়েছিলো। ধরে নিয়েছিলাম এটা হবে একটা সাজানো গ্রাম, মহিলারা হবেন অনেক চৌকস, বন্ধু থাকবে তাদের অনেক যা হয়তো ঠিক বাংলাদেশের গ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করবে না। কিন্তু টীমের সদস্য মের্শেদুল ইসলাম (এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) আশ্বস্ত করেছিলেন, মিডিয়ায় যা দেখেন আর বাস্তবের মধ্যে অনেক ফারাক, হতাশ হবেন না ম্যাডাম, আর পাঁচটা গ্রামের সাথে এই গ্রামের খুব বেশী পার্থক্য নেই। এই গ্রামের দুই অংশ। বড় এক মাঠ মাঝে থেকে ভাগ করে দিয়েছে এই দুই অংশকে। একপাশে বৌদ্ধ পাড়া, আরেকদিকে মুসলিম বসতি। আমরা কাজ করেছি মুসলিম অংশে। অন্যান্য গ্রামের সাথে এই গ্রামের প্রথম যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা হলো বাড়িগুলো বেশ দূরে দুরে। কোন মহিলার কোন ছবি তোলা যায়নি এবং স্বামীর অনুমতি ছাড়া কথা বলতে কোন মহিলাই রাজী হননি। কাজেই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে যেনো তাঁরা স্বামীদের অনুমতি নিয়ে রাখতে পারেন। পাঁচ বাড়ির মহিলাদের সাক্ষাৎকার শেষ পর্যন্ত নেয়া সম্ভব হয়নি কারণ তাঁদের স্বামীরা বিদেশে থাকেন এবং সপ্তাহে মাত্র একদিন তারা ফোন করেন কাজেই কোন কারণে মনে না থাকলে অনুমতি নেয়া আর হয়ে ওঠেনি। আরো একটি বিষয়, বলা বেশ ঝুঁকিপূর্ণই, মোট ৯৮টি বাড়ির মহিলাদের সাথে আমরা কথা বলেছি কিন্তু তাঁদের একজনও দাবি করেননি যে তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য। তিনজন মহিলা ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের সাথে জড়িত কিন্তু সেগুলো স্থানীয় ইসলামিক এনজিও।
শুরুতে বন্ধু আছে কী না, প্রশ্নটাকে একধরনের অপমান হিসেবেই দেখেছেন মহিলারা। পরে টীমের সদস্য একই গ্রামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুনু বুঝিয়ে বলেছেন সই মানে যে বাইরে থেকে থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই, বাড়ির ভেতর যাদের সাথে তারা বেশী ‘মাতে’, ‘তারার’ নাম বললেই হবে। বাড়ির পর বাড়ি গিয়ে মনে হয়েছে বুঝি কেউ আগে থেকে শিখিয়ে দিয়েছেন সবাইকে একটা উত্তর আর পরীক্ষায় সেটি কমন পড়ে গেছেঃ

আঁরা বারের মাইয়াফোয়ার লগে খঁতা না খই…

অনেক বাড়ির স্বামীরাই যেহেতু বিদেশে চাকরী করেন কাজেই অর্থনৈতিক দিক থেকে এই মহিলারা বেশ সচ্ছল, ফলে অন্যান্য গ্রামের মত ভাসুর-দেবরদের পরিবারগুলোর সাথে সবসময় একসাথে থাকতে হয় না একই পাড়ায়। জা-দের সাথেও সম্পর্ক তাই নিত্যদিনকার নয়। তারপরও মুশকিল হলো যে-মহিলার স্বামী বিদেশ থাকেন তাকে আবার তক্কে তক্কে রাখেন অন্যান্য জা-রা। মহিলাকেও সমঝে চলতে হয়, নাহলে টেলিফোনে কোন বেফাঁস তথ্য দিয়ে দিলে তো আর রক্ষা নেই। এ-কারণেও মহিলারা একে অপরের কাছে মুখ খুলতে ভয় পান। শ্বাসরুদ্ধকর এই জীবনে খুব কম মহিলাই দুইজনের বেশী ‘পেটের-কথা-বলা’ মানুষের নাম করেছেন। তবুও যে ক’জনের নাম করা হয়েছে তারা সবাই-ই হয় জা, নয়তো শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় সম্পর্কের কেউ। অবিবাহিত মেয়েদের সমস্যা আরো প্রকট। আসমা, জমিলা, নূরজাহান তিন জনের মা-ই জানিয়েছেন তাঁদের মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র ভালো, কারো সাথে সই-য়ের সম্পর্ক নেই। বাড়ির বাইরে যেমন তারা যায় না তেমনি অন্য বাড়ির মেয়ের সাথে কথা বলে তার মেয়ে এমন অপবাদ নাকি যে দেবে তাদের জিহ্বা খসে যাবে। মেয়েদের বিয়ে দিতে পারলেই তারা মুক্তি পান। বলা দরকার আমরা এই অবিবাহিত মেয়েদের সাথে কথা বলার অনুমতি পাইনি।

ব্রাহ্মণ শাসন: ‘প্যাটর কী কতা কইতাম কার সাতে?’

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক পিছনেই ব্রাহ্মণশাসন গ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কর্মচারী এই গ্রামে থাকেন। অর্থনৈতিক অবস্থার বিচারে গ্রামটির দুটো পরিষ্কার ভাগ রয়েছে। গ্রামের প্রকৃত বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভালো। তাদের কারো রয়েছে আবাদী জমি, কেউ বা চাকরি করেন। কিন্তু কিছু গরীব মানুষ প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে উঠেছেন সেই এরশাদের গুচ্ছগ্রামে। এই অংশের পুরুষরা রিকশা চালান কিংবা দিন-মজুরের কাজ করেন আর মহিলারা বাসাবড়িতে কাজ করেন নয়তো রাস্তা নির্মাণ কাজে বা ইটের ভাটায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। সচ্ছল অংশের মহিলাদের সম্পর্ক অন্যান্য গ্রামের মহিলাদের মতই তাদের জা-শাশুড়ি-ননদদের সাথে কিন্তু গুচ্ছগ্রামের মহিলাদের সেই সুযোগও নেই। লাগোয়া ঘরের এইসব মহিলারা সবাই সবাইকে সন্দেহ করেন। পেটের কোন কথা তাদের নেই কারো কাছে বলার মত। স্বামী মারলে সবাই দেখে। স্বামী আরেক জায়গায় বিয়ে করলে হয় গুচ্ছগ্রাম ছেড়ে চলে যায় নয়তো সেই বউ নিয়ে ঘরে উঠলে মহিলাকে রাস্তায় নামতে হয়। জীবনের কোন বিষয়েই কোন গোপনীয়তা নেই কারো। গুচ্ছগ্রামের জুলেখা ইয়াসমিন সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন যে পেটের কথা সবাই দেখে, বলার কিছু নেই কারো সাথে।

সম্পর্ক-কাঠামোর একই গল্প পুনরাবৃত্ত হতে থাকে গ্রাম থেকে গ্রামে- টাঙ্গাইল জেলার গয়াহাটা ইউনিয়নের বলাই নগর কিংবা দিনাজপুরের বীরগঞ্জের মহুগাঁও কিংবা ছোট শহরের মহল্লা আক্কেলপুর-এ। বলাই নগর গ্রামের অনেক মহিলাই এনজিও হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর সাথে জড়িত আর একাকী চলতে পারার দাবীদার সবচেয়ে বেশী মহুগাঁও-এ। আর আক্কেলপুরের মহিলারা তো বলতে গেলে শহরেরই মহিলা। তাঁদের নাম ভিন্ন, ধর্ম ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন কিন্তু সম্পর্ক কাঠামো একই। বিয়ের পরে মেয়েদের জীবনে সই-এর উপযোগিতা থাকতে পারে, এই ধারণাও যেনো অনুপস্থিত। আর বিয়ের আগে মেয়েরা একটু বড় হতেই বাইরে যাওয়া নিষেধ, কথা বলা নিষেধ বাড়ির বাইরের কারো সাথে, কাজের বাইরে।

 

লক্ষণের গণ্ডি আসলে কতবড়?

দণ্ডকারণ্যে সীতাকে গণ্ডি এঁকে দিয়েছিলেন লক্ষণ। রামায়ণ অনুযায়ী সীতা সেই গণ্ডির বাইরে যাওয়ায় কী অনর্থই না ঘটেছিলো! রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের জন্য বাইরেটা কী ভয়ানক বোঝাতে মস্ত এক উপন্যাসই লিখে ফেলেছেন, ঘরে-বাইরে। মেয়েদেরকে বলেছেন তিনি সীমা স্বর্গের ইন্দ্রানী। প্রশ্ন হলো, এই সীমা স্বর্গের সীমা কতদূর ? লক্ষণের গণ্ডিই বা কত বড় ?

আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক কাঠামো উপস্থাপনের সফটওয়্যার প্রোগ্রাম ব্যবহার করে পয়গ্রামের যে প্যাটার্ণ (যাদের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ) পাওয়া গেছে সেটি লক্ষ করলেই বোঝা যাবে মহিলাদের সম্পর্ক কাঠামো কেমন। প্রত্যেকটি বৃত্ত যেমন একেকজন মহিলাকে নির্দেশ করছে তেমনি নির্দেশ করছে কত নম্বর বাড়ির মহিলা তিনি। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে কেবল পাশাপাশি/কাছাকাছি বাড়ির মহিলারাই্ সম্পর্কে আবদ্ধ। এই পাশাপাশি বাড়িগুলো হচ্ছে তাঁদের ভাসুর-দেবরদের বাড়ি, যেখানে থাকেন তাঁদের জা-শাশুড়ি-ননদ।

যদি অঙ্কের হিসেবে বলি তবে সবগুলো গ্রামে মহিলাদের গড় সম্পর্ক ৩.১১ জনের সাথে। এবং এই সম্পর্কসূত্রের ৭৮.২৭% তাদের জা।

এই সীমাবদ্ধ জীবন আর সীমিত সম্পর্কের কারণগুলো একই সাথে জটিল, বহুমাত্রিক এবং আন্তঃসম্পর্কিত। সম্পর্ক কাঠামো গড়ে ওঠার আখ্যানভাগ নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা না গেলে আমরা কতগুলো উপরিভাসা কারণের বন্দিশেই ঘোরাফেরা করবো। তাই মাঠের কাজের ফলাফলে উঠে আসা দৃশ্যমান সহজ কারণগুলো বিশ্লেষণ করা যেমন জরুরী, তেমনি বা আরো বেশী জরুরী এসব কারণের অর্ন্তনিহিত মতাদর্শিক এবং মনো-সামাজিক-আর্থনীতিক ভিত্তির দিকে ফিরে তাকানো। সামাজিক সংগঠন হিসেবে পরিবার এবং এই পরিবারের লৈঙ্গিক-সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ জরুরী, জরুরী বিশ্লেষণ করা ‘ঘর’ আর ‘বাইরে’র বর্তমান রুপকাঠামো, এর ঐতিহাসিক নির্মাণের সাপেক্ষে।

 

পয়গ্রামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দাবিদার মহিলাদের ক্লিক কাঠামো

 

নারীর ‘অপরায়ন’-এর ইতিবৃত্ত

‘জমিন’, পরিবার আর ব্যক্তিগত সম্পত্তির সরল-জটিল কোলাহল খালি চোখে যে কারণগুলো আমরা দেখি এই গবেষণায় সে-সবের মধ্যে অনিবার্য যে কারণ ছাপিয়ে উঠেছে আর সব কারণকে, সেটি হলো তাদের যোগাযোগ আবহ সীমিত, জমিন নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট তাদের বিচরণ ক্ষেত্র, কাজ কিংবা অবসরের। এই নির্দিষ্ট সীমিত জমিনের কারণগুলো আবার প্রায় মুখস্থ বলে দেয়া সম্ভব, অল্প বয়সে বিয়ে এবং বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির গৃহস্থালির কাজে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ, যে ‘কাজ’ আবার ‘কাজ’ হিসেবে স্বীকৃত নয় অর্থনৈতিক মানদণ্ডে অথচ সকাল থেকে রাত অবধি গৃহস্থালির কাজেই তাদের নিয়োজিত থাকতে হয়। গার্হস্থ্য পুনরাবৃত্ত শ্রমের নিগড়ে আবদ্ধ খুব কম মহিলারই সুযোগ থাকে সই জাতীয় ‘অপ্রয়োজনীয়’ মানবিক সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিংবা সময় দেয়ার যেমনটা বলেছেন রায়ের কাঠির অবিরত জাল বুনতে থাকা সবিতা রানী, “বাড়ির বাহির বা হমু কহন আর সই বা পাতামু কহন”। বাড়ির বাইরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ না থাকার কারণে মহিলাদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার ‘প্রয়োজন হয় না’ কিংবা নিন্দুকেরা হয়তো বলবেন ‘হুকুম’ হয় না। বাড়ির বাইরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ না থাকার কারণকে আবার প্রায়শই তাদের ‘অ-শিক্ষার’ সাথে সম্পর্কিত করে দেখা হয়। কিন্তু আমরা দেখেছি এসব মহিলাদের স্বামীদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও তেমন আহামরি ভিন্ন কিছু নয়। যেহেতু স্বামীদের কর্মজগত ‘ইতিহাস নির্দিষ্টভাবে’ বাইরের পৃথিবী তাই তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কোন প্রতিবন্ধক নয় বাইরের পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় সঞ্চরণের জন্য। মেয়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি আবার অনেক ক্ষেত্রেই দারিদ্র্যের পাশাপাশি ‘বিয়ের বয়স’ এবং ‘সম্ভাব্য উপযুক্ত বিয়ে’-এর সাথে সম্পর্কিত। একই আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মেয়েদের প্রাথমিক স্কুলে নিবন্ধীকরণ ছেলেদের সমান বা ক্ষেত্র বিশেষে বেশী হলেও মাধ্যমিকে যাওয়ার আগেই তারা ঝরে যায়। স্কুল দূরে হলে বেশ মোক্ষম একটা যুক্তি আপসেই দাঁড়িয়ে যায় যেমন আমরা দেখেছি চৈতন্যপুরে। গড় বিয়ের বয়স সাড়ে পনেরো হওয়ার আগেই তাই বিচ্ছেদ ঘটে স্কুলের সাথে, বাইরের পৃথিবীর সাথে, সই-দের সাথে। এই সময়টা হচ্ছে তাদের বিয়ের জন্য প্রস্তুতির সময়। এই প্রস্তুতিকালীন সময় আবার নিবিড়ভাবে যুক্ত ‘সতীত্ব নিশ্চিতকরণ’ প্রক্রিয়া এবং ‘নিরাপত্তা’র ধারণার সাথে, দু’টোই সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণ। আত্মীয় সম্পর্কের বাইরে এসব মেয়েদের অন্য কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে শুরুতেই, এমনকি কাউকে জানান না দিয়েই। বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের সূত্র হয়ে উঠতে পারতো গ্রামে গ্রামে পত্তন নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম। কিন্তু মাঠ অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে এমনকি ক্ষুদ্রঋণ বা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়িতে এসে ঋণ বা সাহায্য দিয়ে যায় অনেকক্ষেত্রেই। নারী থাকবে লোক চোখের আড়ালে¾‘দেশজ সংস্কৃতির’ এই প্রত্যাশার মতাদর্শ পরিষ্কারভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানেও পরিব্যপ্ত এবং স্বীকৃত হয়েছে, যেমনটা দেখেছেন ওয়ালেস ও অন্যান্য ১৯৮৭ (সূত্রঃ হোয়াইট ১৯৯২)। তাঁদের মতে “গ্রামীণ নারীকে বন্ধন-মুক্ত করার পক্ষে যুক্তি দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়¾সেটা ‘দার্শনিক আর সমাজ-সংস্কারকদের কাজ’।” ‘নারীর কাজ গৃহকেন্দ্রিক’ এই আধিপত্যশীল মতাদর্শকে ঘিরেই আবর্তিত বেশীরভাগ প্রকল্প কিংবা আবর্তিত ‘গৃহের আয় বৃদ্ধি’র সাথে নারীর সংযুক্তি জাতীয় উদ্যোগে যেমন হাঁস-মুরগি পালন, হস্তশিল্প। ফলে যারা ক্ষুদ্রঋণ বা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে জড়িত, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের কিছু ‘সাহায্য’ হলেও সামষ্টিকভাবে তাদের সীমাবদ্ধ জল আর সীমিত সবুজময় আঙ্গিনার বিস্তৃতি ঘটে না নতুন মানুষের সাথে মেশার কিংবা ভাব বিনিময়ের। বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে অবকাশ আর জমিন প্রয়োজন দুই-ই অনুপস্থিত, তাই বন্ধুত্ব তৈরী হয় না। তবে গ্রামীণ নারীর এই জমিন-এর নির্মাণ কোন আপাত নিরীহ সিদ্ধান্তের বিষয় নয় বরং বিয়ে, পরিবার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো জটিল বিষয়গুলোর ঐতিহাসিক বিকাশ এবং বর্তমান প্রেক্ষিতের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। নারী সত্ত্বার নির্মাণকে ঘিরে যে ‘অপরতা’র বলয়, তার বিচিত্র বিচ্ছুরণকে লক্ষ করতে হবে দর্শন ও ইতিহাসের প্রতিবেদনে।

গার্হস্থ্য শ্রমের সাথে নারীর যুক্ততা কীভাবে অনিবার্য হয়ে উঠেছে কিংবা নারীর অবস্থা, পরিস্থিতিগুলো কেন ‘অপর’ হয়ে উঠেছে এবং কীভাবেই বা এই ‘অপরায়ন’ ঐতিহাসিকভাবে স্থায়ীত্ব পেয়েছে¾এই প্রশ্নগুলো নারীবাদী পাঠের কেন্দ্রীয় বিষয়। নানা মত, নানা পাঠের ভেতর থেকে দু’টি প্রবল ধারা মোটা দাগে বের করে আনা সম্ভব [বলা বাহুল্য, নারী তার দৈহিক কারণেই গার্হস্থ্যধর্ম পালন করে, এই সনাতন সরল জৈবিক ব্যাখ্যাকে এখানে মোটেই আমলে নেয়া হচ্ছে না]। একটি ধারার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, “সব সময়ে, সর্বত্র বা সব পর্যায়েই নারী সামাজিকভাবে পুরুষের অধঃস্তন নয়।” এই ধারার প্রধান প্রবক্তা এঙ্গেলস (১৮৮৪-১৯৪২) তাঁর বইতে যুক্তি দেন যে, গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ যখন সভ্যতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে যা নারীর অধস্তনতার মূল কারণ এবং সমাজতন্ত্রের আগমনের সাথে সাথে পিতৃতন্ত্র পরাভূত হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাধারণ সামাজিক নিয়ম হচ্ছে নারী পুরুষের সম্পত্তির মত কাজ করে, সন্তান উৎপাদন ও তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মকানুন বজায় রাখে। এই প্রক্রিয়ার মূল দুটি প্রপঞ্চ ‘ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব’ ও ‘শ্রেণীভিত্তিক অসমতার সাথে নারীর ঐতিহাসিক অধস্তনতার সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে, যেখানে পারিবারিক কাজের সাথে বাইরের বা সামাজিক কাজের কোন পার্থক্য নেই সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে একধরনের সমতার সম্পর্ক বিদ্যমান, এমনকি নারী পুরুষের চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান ক্ষেত্র বিশেষে। এঙ্গেলস দেখান, এ ধরনের পরিস্থিতিতে উৎপাদনের উপায় ও উৎপাদনের উপর সমাজের সকলের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান, গার্হস্থ্য জীবন ও সামাজিক জীবনের কেন্দ্রে রয়েছে যৌথ গৃহস্থালি। তাই যে সমাজে বিনিময়ের জন্য উৎপাদনের প্রবণতা কম এবং যেখানে ব্যক্তিমালিকানা ও শ্রেণী অসমতার সৃষ্টি হয়নি সেখানে লিঙ্গীয় ভূমিকার পার্থক্য থাকলেও লিঙ্গীয় অসমতা কম এবং ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও তুলনামূলক যৌন অধিকার নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝে বিন্যস্ত। কিন্তু উদ্বৃত্ত বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব হয় এবং নারী সম্পদ, উৎপাদিত দ্রব্য ও তার নিজের উপর কর্তৃত্ব হারায়। যৌথ গৃহস্থালিগুলো ব্যক্তিগত এককে পরিণত হয়, প্রতিটি পরিবারে একেকজন পুরুষ প্রতিনিধি কর্তৃত্ব করেন। পরিবার হয়ে ওঠে নারীর শ্রমের ক্ষেত্র যা পর্যায়ক্রমে একটি বৃহৎ সামাজিক বা বাইরের জগতের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। এই বহির্বিশ্বের জগত আবার রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত¾আর এই সমাজ, রাষ্ট্র সব কিছুই হচ্ছে পুরুষের। সোজা কথায়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকাশে পিতৃতন্ত্রের সৃষ্টি হলো, উন্নত যন্ত্রের উদ্ভাবনের জন্য সামাজিক উৎপাদনে নারীর শ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমে গেলো। সামাজিক জীবনে উৎপাদনের অংশ হিসেবে বিচ্যুত হয়ে সে নিযুক্ত হলো গৃহস্থালির একঘেয়ে বাঁদীগিরিত্বে।

এঙ্গেলসের অর্থনৈতিক নিমিত্তবাদী ব্যাখ্যার বিপরীতে সক্রিয় সমালোচনাত্মক ধারাটির অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী হলেন ব্যুভোয়া (১৯৪৯-১৯৬৮)। তাঁর মতে, নারীজীবনের স্বর্ণযুগ কল্পনামাত্র, তা কখনোই ছিলোনা। সমগ্র ইতিহাসকে যাযাবর যুগ, কৃষির প্রথম যুগ, পিতৃতান্ত্রিক যুগ ও প্রাচীনকাল, খৃষ্টধর্ম ও মধ্যযুগ এবং ফরাসী বিপ্লবের পর থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত পাঁচটি বর্গে ভাগ করে তিনি দেখান চিরকালই পুরুষ প্রভু, মাঝে কিছুদিন [কৃষির প্রথম যুগ যা প্রায়শই মাতৃতান্ত্রিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত] শুদ্ধ জন্ম রহস্যের প্রভাবে সে নারীকে খানিকটা সুবিধা দিয়েছে, বসিয়েছে মাতা বা দেবীর আসনে, এই যুগেও নারীর অবস্থান মূলত গৃহকেন্দ্রিক বলেই মনে করেন ব্যুভোয়া। নারী ও শ্রমিককে এক পর্যায়ে ফেলা এবং সামাজিক উৎপাদনে অর্থনৈতিক মর্যাদা পেলে উভয়েরই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, এঙ্গেলসের এই মূল থিসিসের বিপরীতে তিনি বলেন শ্রমিক এক বিশেষ সমাজ ব্যবস্থার ফল কিন্তু সমাজের প্রথম যুগ থেকেই নারী ও পুরুষের সম্পর্ক নির্যাতিত ও নির্যাতনকারীর। বিষয়টি আরো ভালোভাবে বোঝা যায় যখন তিনি বলেন শ্রমিকের মধ্যে শ্রৈণী-বৈষম্য নিশ্চয়ই নেই কিন্তু নারীর মধ্যে শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। আবার সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপের ভূমিদাসদের মত প্রতিটি পরিবারের নারীর একদিকে যেমন সম্পত্তি রয়েছে (বিয়ের পরে স্বামীসূত্রে পাওয়া), অন্যদিকে সে নিজেও পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত। এইসব প্রশ্ন পরবর্তী নারীবাদী তত্ত্বেরও কেন্দ্রীয় ফোকাসে পরিণত হয় (দেখুন, কেলি ১৯৮৬)। তবে ব্যুভোয়া এঙ্গেলসের মতই মনে করেন যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি নারীর অপরায়নকে দৃঢ়তর করেছে। উভয়ের থিসিসেই [বলা ভালো উভয় ধারায়] একটি মূলগত ঐক্যের দিক হলো দুজনেই মনে করেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিয়ের বন্ধনকে দৃঢ় করেছে কারণ পুরুষ তখন চেয়েছে নিজের ঘর, সম্পত্তি ও তার ‘বৈধ’ উত্তরাধিকার। আগের যুগে বিয়ে বহির্ভূত যৌন অপরাধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিলো না কিন্তু এই যুগে নিয়ম হলো সতীত্ব নিয়মলঙ্ঘনকারীকে তার স্বামী হত্যা করতে পারবে এবং তার জন্য কোন শাস্তি হবে না। পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব থেকে আজ পর্যন্ত সকল সমাজে, কিছু ব্যতিক্রমসহ, এই ব্যবস্থাই কমবেশী বিদ্যমান। এক্ষেত্রে কেলি (১৯৮৬)-র বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণঃ “যেখানে ঘর আর বাইরের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন বিদ্যমান সেখানে লিঙ্গীয় অসমতার প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়, একই সাথে নারীর সতীত্ব এবং পতিতালয় চাওয়া হয়।” ভারতীয় যৌন বাস্তবতার অধ্যয়ন এ-ধরণের আলোচনায় পুরোপুরি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। যেমন বাৎসায়নের কামসূত্র পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায়, দাম্পত্য জীবনে নারী কখনো সমান মর্যাদা ভোগ করত না। বিবাহিত নারীরা অশিক্ষিত হওয়াতে স্বামীকে কখনো বুদ্ধিতে, সংবেদনায় সঙ্গী হিসেবে পেতো না। রাষ্ট্র চৌষট্টিকলায় নিপুণ বারাঙ্গনা বা জনপদবধূদের উৎসাহ যোগাত যাতে পুরুষেরা তাদের সাহচর্যে বৌদ্ধিক তৃষ্ণা মেটাতে পারে। এই সমাজে, প্রাক-আধুনিক যুগে, অন্তত দুই সহস্রাব্দ ধরে, যৌনতা-দাম্পত্য, স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে একই মনোভঙ্গি বজায় ছিলো। বিয়ে বহির্ভূত যৌনতা বিশেষভাবে স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদার পক্ষে হানিকর বলে বিবেচিত হলো না শুধু, যৌন নৈতিকতার ধারণাও এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলো, তৈরী হলো বিভিন্ন নীতিশাস্ত্র।

মহাভারতের শুরুতে আমরা দেখি কুন্তির ক্ষেত্রজ পুত্রদের অথচ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্থাৎ মহাভারতের শেষ পর্যায়ে গীতায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, ‘স্ত্রীষু দুষ্টাষু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ’। অর্থ, স্ত্রীদের অনৈতিক যৌন স্বেচ্ছাচারের ফলে বর্ণাশ্রম প্রথার দ্বারা অননুমোদিত সন্তানেরা জন্ম নেয়। অর্থাৎ সতীত্ব সংস্কারের শেকল পরানো শুরু হচ্ছে মাত্র আর তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। অধিপতি ব্রাহ্মণ্য সমাজে ‘বিশুদ্ধ’ আর্য উত্তরপুরুষের পরম্পরা রক্ষা সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পেয়েছে বলে সাহিত্য-সংস্কৃতি-স্মৃতি-পুরাণ জুড়ে নারীর অশুচিতা, অবিশ্বাস্যতা, অপূর্ণতা কীর্তিত হয়েছে। কঠোর হয়েছে সতীত্ব নিশ্চিতকরণের উপায়সমূহ। নারীর জমিন ক্রম সঙ্কুচিত হয়েছে।

উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের প্রথম ভাগ বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের উন্মেষকাল এবং এই শ্রেণী গঠনের সাথে শুরু হয় পরিবার, বিয়ে ব্যবস্থা, এবং নারী-পুরুষ সম্পর্কের আমূল পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। এর আগে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে পুরুষের একাধিক বিয়ে সব শ্রেণীতেই স্বাভাবিক ধরে নেয়া হতো। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের পর খুব দ্রুতই এক পতি পত্নি বিয়ে নৈতিকতা, সমতা আর প্রগতিশীলতার স্মারক হিসেবে মূর্ত হয়ে ওঠে এবং অচিরেই, আধা শতাব্দীরও কম সময়ে, সেটি হয়ে ওঠে সামাজিক রীতি। আপাত প্রগতিশীল এই বিয়ে কাঠামোতেও ‘নারী ঘরণী, তার ভূমিকা নৈতিক এবং আদর্শিক, নারী চৈতন্যের বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে যৌন শুচিতা’, যেমনটা দেখেছেন চৌধুরী এবং আহমেদ (২০০০ঃ ১৫৫)। তাঁরা যথার্থই দেখেছেন, ‘‘পুরুষের পরিচিতি এই পরিকাঠামোতে আর্থিক, তার কাজের জায়গা বহির্জাগতিক (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক) ; তার শুচিতার ব্যাপার নারীর মত সংকটের নয়। ঘর-বাহির পুনর্গঠনের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে সম্মানবোধ আর চরিত্র ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সেই চরিত্র চর্চার কেন্দ্রীয় জায়গা হলো নারী। নারীর শুচিতার নতুন নতুন উপাদান তৈরী হয় এই সময়। … পুরুষের আর্থিক ভূমিকা এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ের ক্ষেত্রে এত প্রকট, যা বিশ শতকের মজুরী অর্থনীতিতে বাঙ্গালী মুসলমানের অংশগ্রহণের আগে ছিলো না, যে চাকরী পাওয়ার সাথে ‘বউ পালতে’ পারার সামর্থ্য জড়িত হয়ে পড়ল। পৌরুষের ধারণার ভিত্তিই হচ্ছে স্বাধীন রোজগার, নির্ভরশীল বউ-বাচ্চার লালন-পালন।” বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের এই এক পতি পত্নি বিয়ে এবং ‘নারী’ ও ‘পুরুষ’ নির্মাণ ক্রমশ সঞ্চারিত হয়েছে সমাজের অন্য স্তরেও। সঞ্চারিত হয়েছে এর আনুসঙ্গিক ‘ঘর/বাহির’, ‘বিয়ে-করা/ বিয়ে-বসা’, ‘সংসার চালানো/সংসার-করা’র ধারণাগুলোও। অর্থাৎ নারীকে গার্হস্থ্য জমিনের সাথে একাকার করে দেখার বিষয়টি পরিবর্তিত তো হয়ই নি বরং সাহিত্যে, গণমাধ্যমে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, চর্চায়, আইনে সর্বত্র মোহময় রোমাণ্টিকতার প্রলেপসহ উপস্থাপন করা হয়েছে বা হচ্ছে এবং নারীর শিক্ষা, চাকরি, উপার্জন, সম্পর্ক সবই নির্ধারিত হয়েছে এই জমিনের প্রয়োজনে এবং এর সাথে সমন্বয় করে।

কাজেই ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভবের সাথে নারীর গার্হস্থ্য শ্রম, বিয়ে এবং বৈধ উত্তরাধিকারের প্রয়োজনে নারীর সতীত্ব শৃঙ্খলার উপরে জোরারোপ সংস্কৃতিভেদে কিছু তারতম্যসহ নারীর বর্তমান সীমিত গার্হস্থ্য জমিনের প্রেক্ষাপট রচনা করেছে এবং স্থায়ীত্ব দিয়েছে, যা আমরা দেখেছি বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে।

পুতুল তোমার জনম কিরূপ কে জানে
আলোক লতায় বাইন্ধা সুতা সে টানে

আসলে প্রশ্ন করার আর তেমন কিছু নেই মনে হয়। হাজার বছরের চাপিয়ে দেয়া সতীত্ব সংস্কারের শেকল এতো গভীরে প্রোথিত যে, সব মহিলাই নিজেকে সেই সংস্কারের মানদণ্ডে মহীয়সী দেখতে আর দেখাতে চান। সীতার অগ্নি পরীক্ষায় উত্তরণের গল্প ধর্ম নির্বিশেষে আজও সতীত্ব গৌরবের পরম নিদর্শন। সেই নারী বিয়ের জন্য ভালো যে অসূর্যস্পর্শা। জানা কথাই যে বিয়ের আগ পর্যন্ত পিতামাতা আগলে রাখেন, আটকে রাখেন মেয়েকে এই সার্টিফিকেটের আশায় যে তার মেয়ের শরীরে কোন ‘দোষ’ লাগেনি। পুরুষসঙ্গ তো দূরের কথা, বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের বাইরে কোন মেয়ের সাথেও তাদের মেয়ের কোন সম্পর্ক নেই। বেগম রোকেয়ার ‘অবরোধবাসিনী’ আর কতইবা পুরনো হয়েছে ! মেয়ে তো বিয়ে দেয়ার জন্যই কেবল পালাপোষা করা। সময় খারাপ। নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তা আছে। আর সেই মেয়ের যখন বিয়েই হয়ে গেলো সে তো তখন স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির যত বাধ্য, ততই ভালো ‘মহিলা’। বাড়ির আত্মীয় সম্পর্কের বাইরে কারো সাথে মেলামেশা মানে তো সেই একনিষ্ঠ আনুগত্যে অন্য বাতাস লাগা। কে না জানে ‘এরা যত বেশী জানে, তত কম মানে’। স্বামী চান না, শাশুড়ি চান না, সমাজ চায় না এই মেলামেশার মধ্য দিয়ে ওই নির্দিষ্ট বাড়ির নির্দিষ্ট মান্যতাসংস্কৃতির শান্ত পুকুরে এমনকি পলকা ঢেউও উঠুক। হাজার বছরের পাখিপড়া শিক্ষায় মেয়েরা এত পোক্তভাবে আয়ত্ত করেছেন এই শিক্ষা যে শিক্ষককে আর পাহারাও দিতে হয় না, তারা নিজেরাই বলেন সই থাকার মত খারাপ কাজের ধার তারা ধারেন না, ‘পাখির শিক্ষা এখন পুরা হইয়াছে’।

যারা ঘরের বাইরের কোন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত না (৯২.৭%) তাদের পক্ষে তো বাড়ি আর পাড়ার বাইরে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি গ্রামের যে মহিলারা চাকরি করছেন তাদেরও বান্ধবী নেই, বা থাকলেও ওই মহিলারাই সেই স্বীকৃতি দেন না জনসমক্ষে। কারণ গ্রামের মেয়েদের চাকরীতে যাওয়ার লড়াইটা এখনো সমাজ-সংসারকে এই বুঝ দেবার পর্যায়ে আছে যে সে নেহাত বাধ্য হয়ে, পরিবারের প্রয়োজনে ‘বাড়তি’ টাকা উপার্জনে বের হচ্ছে, কাজের বাইরে আর কোন সম্পর্ক তার নেই পৃথিবীর সাথে, তাই বান্ধবী যদি থেকেও থাকে সেই থাকাকে প্রকাশ করার সামর্থ্য সে অর্জন করেনি এখনো। এখনো সে নিজেকে এবং পারিপার্শ্বিক সবাইকে আশ্বস্তই করতে চায় যে সমাজ নির্দিষ্ট বিবাহিত সম্পর্কসমূহের বাইরে তার অন্য কোন জগত নেই। স্বামী-সংসারেরও এই আশ্বস্তিটুকু প্রয়োজন। মহিলাদের যে নিরঙ্কুশ আনুগত্যের উপরে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে, সেই আনুগত্যের লেশমাত্রও যে অন্য কোথাও ব্যয়িত হচ্ছে না সে-বিষয়ে আশ্বস্তির প্রয়োজন আছে বৈকি। তবু ধন্ধ আমার কিছুতেই দূর হচ্ছিলো না কেন এভাবে। শুরুতেই দেয়া ঝুসঢ়ড়ংরঁস-এ প্লেটোর উদ্ধৃতি যেন এক হঠাৎ আলোর ঝলকানি হিসেবে কাজ করেছে। এখানে বলা হয়েছে মালিকের স্বার্থে দাসদের মধ্যে যেন কোন বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। কারণ যে-কোন বন্ধুত্বের সম্পর্কে অন্যান্য উদ্দেশ্যের সাথে ভালোবাসারও উৎসারণ ঘটাতে পারে যা মালিক পক্ষের শক্তিকে ক্ষয় করে। সংসার সম্পর্ক কাঠামোর মালিক যখন স্বামী, আর স্ত্রী যখন দাস, এবং এটাই যখন নিয়ম, এবং এই নিয়মটাকে বহাল রাখাই যখন উদ্দেশ্য, তখন কেন যে মেয়েদের বন্ধুত্বকে সাহিত্যে বা জীবনে স্বীকার করা হয় না বা স্বীকৃতি দেয়া হয়না সেটা খানিকটা খোলসা হয় বৈকি!

 

তথ্যসূত্রঃ


Beauvoir, S. de. (1949/1968). The Second Sex, translated in English by Pardhlay, H. M. Bantam Books, NY.

Engels, F. (1884/1942/1972). The Origin of Family, Private Property and State, translated in English by West, A. (1942), Pathfinder Press, NY.

Kelly, J. (1986) “The Social Relation of the Sexes: Methodological Implications of Women’s History”, in Women, History and Theory. The Essays of Joan Kelly, The University of Chicago Press, Chicago & London.

Plato. (360 B.C./1997) The Symposium, translated in English by Neham, A. and Woodruff, P. From Plato: Complete Works, Cooper, J. M. (ed.), 1997. pp. 457-506.

White, S. C. (1992). “Research on Women in Bangladesh”, Arguing with the Crocodile, Gender and Class in Bangladesh, University Press Limited, Dhaka.

চৌধুরী, মানস এবং আহমেদ, রেহনুমা। ২০০০। লিঙ্গ, শ্রেণী এবং অনুবাদের ক্ষমতাঃ বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত পরিবার ও বিয়ে, কর্তার সংসার, গুলরুখ, সায়দিয়া এবং চৌধুরী, মানস (সম্পাদিত)। পৃষ্ঠা ১৩৯-১৬৪। রুপান্তর প্রকাশন, ঢাকা।

 

The post গ্রামের মহিলাদের কোন বন্ধু নেই first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%a8-%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d/feed/ 0
ডাকিন https://kaberigayen.com/%e0%a6%a1%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%a8/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%a1%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%a8/#respond Fri, 25 Feb 2022 08:30:58 +0000 https://kaberigayen.com/?p=7392 -ছোয়ালডার না-ম ছেলো, না–ম ছেলো, হ হ মনে পড়িছে, রশীদ। রশীদ যিদিন আর না পাইরা চিঁচায় সবাইরি ক’লো, মানে জানালো আর কি, সেই দিনই কলেজ রো-র সবাই জানতি পারলো, মল্লিকা আসলে ডাকিন ছেলো। কানাঘুঁষা অবিশ্যি সব সোমায়ই হতো, এক্কারে সবাইর মুহি মুহি তয় ঠিক বুইঝা উঠতি পারতো না, মাগিডা ডাকিন ছেলো না বেবুস্যে ছেলো। আসলে...

The post ডাকিন first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
-ছোয়ালডার না-ম ছেলো, না–ম ছেলো, হ হ মনে পড়িছে, রশীদ। রশীদ যিদিন আর না পাইরা চিঁচায় সবাইরি ক’লো, মানে জানালো আর কি, সেই দিনই কলেজ রো-র সবাই জানতি পারলো, মল্লিকা আসলে ডাকিন ছেলো। কানাঘুঁষা অবিশ্যি সব সোমায়ই হতো, এক্কারে সবাইর মুহি মুহি তয় ঠিক বুইঝা উঠতি পারতো না, মাগিডা ডাকিন ছেলো না বেবুস্যে ছেলো। আসলে ও দুইডাই ছেলো। বুঝিছিস তো, সে ম্যালা দিনির কথা রে দাদা, সব তো পস্ট মোনেও নাই।

-কী যে কও না দিদিমা, ডাকিন আবার বেবুস্যে হয় ক্যাম্বায়? মানুষ কাছে যাতি ভয় পাতো না?

-ধুর বোকা। ভয় পাবে ক্যান? ও যে ডাকিন, তা মানুষ জানবে ক্যাম্বায়? ম্যালা তো বই পড়িছিস, জানিস না, ডাকিনরা আসল চেহারা লুকোয় রাখতি পারে? শোন্, তোর দাদু তহন বিএম কলেজে পোফেছারি করে। একদিন আইসা কলো, তাজ্জব ব্যাপার, এক আবিয়াইতা মাইয়্যা তাগো কলেজে পোফেছারি করতি আইছে। আমার তো বুঝিছিস খুব ভয় ধইরা গেলো। কইলকেতা থিকা আইছে। ভারি ছিরিমান ছেলো না। শামলা চেহারা। উচা-নাম্বাও বেশি ছেলো না। তয় কী জানি একটা ছেলো চেহারার মধ্যি। আমি দেহিছিলাম তোর দাদুর কলেজের এক বার্ষিক পোর্টসের সোমায়। কথা কতি পারতো ভালো, ভারি চটপইটা। মর্দ্দা কুদি আর কি! নীলা একখান শাড়ি পরিছিলো, সাদা বেলাউজ। বোঝার উপায় কি ও বেবুস্যে না ডাকিন…

-তয় এইসব সন্দ আলো কোহান দিয়া? ছাইভস্ম কানাঘুঁষাশুরুই বা করলো কেরা? খাইয়া কাম ছেলো না কারুর আর…

-ধে, তুই থামবি? গল্প শুনলি শোন্, না হলি কিন্তু…

-আচ্ছা, আচ্ছা কও। আর কথাই কবো না।

-বুঝিছিস, ডাকিন তো ডাকিনই। কদ্দিন আর নিজির আসল চেহারা চাইপা রাখতি পারে বুঝিস না? পেত্থম পেত্থম সব ছারেরাই, বুড়া-ধুরা সবাই যাতো ওর হাতে এক কাপ চা খাতি। কী সাহস, সবাই কতো। আমি গোপালগঞ্জির নটাখালীর মাইয়্যা, বরিশাল তো কতি গেলি বাড়ির পাশে। তোর দাদু আছে, তোর দুই মামা, তোর মা তহন সবে জন্মাইছে। তাও অন্য পোফেছাররা আসলি ঘরের মদ্দি সান্ধ্যায় যাতাম। আর ওই ডাকিন, সেই তহনকার দিনি সোন্ধ্যার পর সেই সব পোফেছারগো নিজির হাতে চা বানাইয়া খাওয়াতো। ঢলানি তো আছেই। তোর দাদুরও তো মোনে হয় ভীমরতি ধরিছিলো। বলাইর মা, শেফালির মা, শোভা-আভাগে মা সবাই তহন কানাঘুঁষা করতিছে ওর স্বভাব-চরিত্তি নিয়া, তোর দাদু কতো, না, মাইয়েডা খারাপ না। মাথা আছে। সুন্দর কথাবাত্তা কয়। হরি হরি! সবাইর মুহি এক কথা, সুন্দর কথাবাত্তা কয়। আমি তো কালীবাড়ি পাসসের সন্দেশ মানস করিছিলাম, খু-ব জাগ্রত মা কালী। আমার মোনের কথা শুনিছিলো।

তহন গোটা বিএম কলেজে দুইজন মাত্র মাইয়্যা পোফেছার। একজন শান্তিসুধা সেন। সনছকৃতির পোফেছার ছেলেন তিনি-নমস্য। দেবীর পানা চেহারা। কাঁচাপাকা চুলি চওড়া সিন্দুর। সাদা শাড়ি লাল পাইড়-দেখলিই ভক্তি করতি ইচ্ছা করে। বিএম কলেজ যাগে, সেই ব্রজমোহনের বুনঝি হয় বুঝি। যেমন বংশ, তেমনি চেহারা। গায়ের রোঙ কী, য্যানো দুধি-আলতা মিশানো। আলতা পায়ে থাকতো সব সোমায়। ছিকান্ত উকিলির ছেলের সাথে বিয়া হইছেলো। ওনার বেটাও ছেলো উকিল। কলেজের পাশেই ওনার বাড়ি। শান বান্ধানো পুকুর। পুকুরি সাদা-লাল শাপলা। সকালবেলায় উনি সিঁড়ির ঘাটে নিজির হাতে পূজার বাসন মাজতো, ফুল তোলতো, তারপর ছান সাইরা রাধাগোবিন্দির মন্দিরি পূজা দিয়া কলেজে আসতো। পাছে পাছে বাড়ির ঝি। ওইটুকুন পথও একা আসতো না কহনো। বংশীয় মহিলা তো! পড়ানোর সোমায় বাড়ির ঝি বারান্দায় বইসা থাকতো। কেলাসের শেষে কারুর সাথি ফালতু গল্প করা বা আড্ডা দেবার মানুষ ওনি ছেলো না। কলেজের সবাই তার পায়ের মিহি চাইয়া কথা কতো। ওনার কথা আলেদা। শুনিছি পাকা চুলে সিন্দুর পইরাই উনি দেহ রাখছে।

আর এই মলি­কা ছেলো সম্পুন্ন বেপরীত। বুঝিছিস তো, কাঁচা বয়েস, চব্বিশ-পঁচিশ হবে। বয়েসকালের কুত্তিডার চেহারাতেও মায়া থাহে ক্যামোন যানি এট্টা। আলগা চিকচিকা ভাব। তয় বেশি সাজনাকাজনা করতো না। ইংরাজি পড়াতো। কলেজের ছেলেছেমড়ারা ভিড় জমাতো কেলাসের বাইরেও মেলাদিন পজ্জন্ত—।

শুনিছি মেলা নাকি বড় বড় কথা কতো। ইংরাজ কবিগো কবিতার চাইতে বাঙ্গালি কবিগো অনেক কবিতাই নাকি ভালো, এইসবও কতো। তহন তো দুই-একজনমাইয়াও পড়তি আসতো কলেজে। মাইয়েরা আলেদা বসতো, ছেমড়ারা আলেদা। ওই ছিমড়ি কতো, আলেদা বসার দরকার কী, একসাথে বসো। নাচনা-কাচনাও নাকি জানতো। নাটক-ফাটক করারও চেষ্টা করিছিলো, তয় গাজ্জেনরা খুব খেপিছিলো দেইখা নাটক আর হয় নাই। যত খাতের ছেলো তার বেটাগে সাথে। কী দুচ্চিন্তাতেই না অল্প বয়সী বউবিটিরা থাকতো!

তয় অল্পদিনির মধ্যিই অন্য বেটারা সইরা পড়িছিলো। ক্যান বুঝিছ তো, বানারীপাড়ার এক ভারি ছিরিমান মেয়া ছেমড়া আলীগড় থিকা পাশ কইরা ওই কলেজেই ঢোকে। নিত্যি সোন্ধ্যায় ওই ছেমড়া ওই মাগীর বাড়ি যাতো। চা খাতো, গল্প করতো, মাঝেমধ্যি গানও হতো। কী ঘেন্নার কথা! পেত্থম পেত্থম মাগীর বিয়ার সোম্বন্ধ আসলি মাগী কতো, বিয়া করবো না। তা করবে ক্যান? বিয়ার আর কী দরকার ওর? আর ও কি এক ভাতারে থাকা মানুষ? সবাই জানতো, কলিকেতায় ওগো বড় বাড়ি, ভাইবুনরা বড় বড় শিক্ষিত। কিন্তু কেউরে তো আসতি শুনি নাই কোনোদিন । স-ব গল্প। আর কি জানি, থাকলিই বা আসপে কোন মুহি? বুনির কীর্ত্তি কি আর তাগে কানেও যাতো না?

পূজার ছুটি হতো তহন এক মাস। মাগী পোনার দিন বরিশালেই কাটাতো। আবার ছুটি ফুরানোর চার-পাঁচ দিন আগেই চইলা আসতো। কলেজ রো-তেই থাকতো। বাসার সামনে মেলা ফুলের গাছ লাগাইছলো। সোন্ধ্যার পরপর ওই মেয়া ছেমড়ার সাথে গরমের দিনি ফুলবাগানের মধ্যি বইসা ও চা খাতো। কান পাতা যাতো না ওই মাগীর কেচ্ছায়। বুঝিছিস তো, কেলাবে এইডাই ছেলো আলাচোনা।

তোর দাদুর কী দরদ! পেরায়ই কতো, আহা মাইয়েডা কী বোকা! মাইয়েডা! বুঝিছিস তো মাইয়েডা! ঠিক সোমায় বিয়া হলি তো কোমছে কোম পাঁচ ছোয়ালের মা হতো, দুধ ঝুইলা যাতো, সে হলো মাইয়েডা! হরি হরি! মানুষ তো সবই বোঝতো। মাঝেমদ্যি ছেমড়াডা ওর ঘর দিয়া ফেরার সোমায় ওই কেলাবে যাতো, টেবিলটিনিস না যানি কী খেলতি, হ টেবিলটিনিসই তো যদ্দূর মোনে করতি পারি। খেলার ছলাকলা নাকি ভালোই জানতো কিন্তু লোকে কতো শক্তি তো ঢাইলা আসতো মাগীর বান্ধে, তাই বেশীক্ষণ খেলতি পারতো না। সবাই টিটকিরি দেতো। কিন্তু হাগুন্তির আর লজ্জা কীসির, জানিস তো, যেতেক লজ্জা তো দেখুন্তির।

একবার অলো কী, সবাই মিলা ঠিক করলো ওগো হাতেনাতে ধরবে। ছাত্রছাত্রীগো কাছেও লজ্জায় মুখ দেহাতি পারে না অন্য পোফেছাররা। পাড়ার সবাই দেখলো সোন্ধ্যায় রশদি গেলো চা খাতি, তারপর দুইজন ঘরে ঢোকলো রাইত নয়টার সোমায়। সবাইর চোখ আছে, ছেমড়াডা বাইরও হয় নাই। রাত্তির দশটায় সবাই পাহারায় থাকলো। শুধু তিনজন মই নিয়া জানলার খড়খড়ি দিয়া দেখার চেষ্টা করলো। একজন দ্যাখলোও দুইজনরি। দরজায় ধাক্কা দিয়া দরজা খুইলা দ্যাহে মাগীডা বই পড়তিছে। ছেমড়াডা নাই। মেঝেতে মাগীর ঝি ঘুমাতিছে। বুঝিছিস তো? আমার শরীলডা এহনো কাটা দিয়া ওঠে। শোভা-আভাগে মা পেত্থম ব্যাপারডা ধরতি পারলো। ওনার বাবা ছেলো মস্ত গুণীন। উনি তার কাছ থিকা কিছু কিছু পাইছেলো। উনিই পেত্থম কলো, মাগীডা ডাকিন। সব বুঝতি পাইরা ছেমড়াডারে মিলাইয়া দেছে বা কিছু এট্টা বানায় ফেলিছে। ওই দিনির পর সবাই চোখ রাখলিও দরজায় ধাক্কা দিতি আর সাহস পালো না। নীল, তুই শুনলি অবাক হবি, এরপর থিকা শত চেষ্টা কইরাও কেউ আর দেখতি পারে নাই রশীদ কহন মাইয়েডার বাসায় ঢোহে। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার কী জানিস, ঘরে ঢোহা দেখতি না পারলিও ওর বারোয় যাওয়ার সোমায়মাঝেমদ্যিই লোকজন ওরে দেখতি পাতো।

একদিন হইছে কী, বলাইয়ের বাবা, সেও ইংরাজির পোফেছার, পরীক্ষার কী একটা কাজে গেইছে ওই মাগীর বাড়ি। রাত্তির এট্টু বেশিই। দরজার বাইরে দাঁড়াইয়া পষ্ট মর্দ্দা আর মাগীর ঝগড়া শোনছে। দরজার কড়া নাড়লি খানিক বাদে দ্যাহে কী, মাগীডা হাতে একখান রামদাও নিয়া দাঁড়াইয়া রইছে, চোখ দুইডা ভাঁটার মোতো জ্বলতিছে। মদ্দাডা নাই। উনি ভয়ে পড়িমরি দৌড়। একবার পেছনে তাকাইয়া দ্যাহে মাইয়েডা তারে ডাকতিছে, আসুন স্যার, বসুন সার, যাচ্ছেন কেনো সার-আর পেত্যেকটা কথার সাথে সাথে আগুন ঝরতিছে মুখ দিয়া। দেইখা ভয়ে দৌড়াতি দৌড়াতি নিজির বাড়ি গিয়া ধড়াম কইরা পইরা গেলো। মুহি গ্যাঁজলা। এই চেতন হয় আবার ফিট হয়। চেতন হয় ফিট হয়। এরই ভেতার খাওয়া, বাহ্যি-পায়খানা। তিন দিন পর বিষ্ণুপদ বাবুরি আর চেনা যায় না। উইঠা উনি দাঁড়াইলো ঠিকই কিন্তু বউয়ের শাড়ি পরলো, হাতে চুড়ি পরলো, সিন্দুরন’লো মাথায় আর বউয়ের পা জড়ায় কতি নাগলো, তুমি আমার মা, আমি তোমার অধম সন্তান মা, আমারে ক্ষমা করো। কত ডাক্তার, কবিরেজ-কিচ্ছুতি কিচ্ছু হলো না। কলিকেতা নিয়া গেলো। রোগডা ধরাই পড়লো না। সোনার সোংসারডা ছারখার হইয়া গেলো।

-কিন্তু দিদিমা, ওই দিনির ওই ঘটনার পর থিকা তো বিষ্ণুপদ বাবুর কোনো হুঁশই ছেলো না, তোমরা তয় ক্যামনে জানলা মর্দ্দা-মাগীর ঝগড়ার কথা, মুখ দিয়া আগুন বাইর হওয়ার কথা?

-তোর খালি অবিশ্বাস রে নীল। কয় পাতা ইংরাজি পইড়া খালি ভুল ধরিস, না? শোন্, বিষ্ণুপদ বাবু যতদিন কলেজ রো-র বাসায় ছেলো, এইসব কথাই মন্দিরা বাজায় বাজায় গা’তো। শেষে সমাধি হলি বউয়ির পা জড়ায় কতো, মা আমি পাপী, তোমার অধম সন্তান, আমারে ক্ষমা করো। জবা ফুল তুইলা মালা গাঁথতো, পেত্থম নিজি পরতো, তারপর সমাধির আগে আগে বউয়ের পায়ে দেতো। চন্দন বাইটা বউয়ের গায়ে ছেটাতো-কতো মানুষ যে দেখতি আসতো তার নিকেশ নাই। বেটাডার কলেজের চাকরি চইলা গেলো আট-নয় মাস পর। বিটিডা কুট্টি তিনডা ছোয়ালমাইয়া নইয়া নদীর ওইপারে কাউয়ার চরের দিকি চইলা গেলো। শুনিছি, যতদিন বাঁইচা ছেলো, পাল্টায় নাই। শোভা-আভারমা’রে দিয়া বলাইর মা একবার গোনাইছেলো। গোনার পর শোভা-আভাগোশবরি বাগানের সব কলা মইরা গেলো। শোভা-আভার মা আর কোনো দিন গোনতে বসে নাই ওই মাগীরে নিয়া ।

ওই মাগী কিন্তু এট্টুও ভয় পাতো না। বেবুস্যে তো, ঘরডা সাজায় রাহিছিলো সুন্দার। একবার বিলাত থিকা এক সায়েব আইছেলো। মাগী ওই সায়েবরেও নিজির বাসায় নেছে। সায়েব নিকি কয়, বিএম কলেজের সব পোফেছারগে ঘরের মধ্যি ওর ঘরই সবচাইয়া সাজানো আর সুন্দর। ডাকিনের ছলাকলার সাথে কি আর ভদ্রঘরের বউবিটিরা পারে? হরি হরি! কী সব দিন গেইছে রে নীল! তোর দাদুরি কিছু শুধালি এক ধমক দিয়া বসায় থোত, কতো, অত কথায় তোমার কাম কী? ওই মাইয়ের বি্রুদ্ধি মোটে কোনো কথা শুনতি পারতো না। চিন্তায় চিন্তায় খাতি পারতাম না। সেইবার গরমে বড়দা আইসা আমারে দেইখা চোমকায় গেলো, কলো, তোর এ কী চেহারা হইছে রে বুন্ডি? না পারি স’তি, না পারি ক’তি। শুধু চোহি জল। বড়দা আমারে নিয়া যাতি চালো বাড়ি কিন্তু আমি যাই নাই। বড়দাও সোম্ভাব শুনিছিলোকিছু, বেশি আর জোর করিছিলো না।

-রশীদ এইসব শোনতো না, বুঝতি পারতো না?

-বুন্ডিরে, পেত্থম পেত্থম কি আর জানতো! কথায় চটপইটা, গানবাজনা জানে, মইজা গেইছিলো। পরে বুঝিছিলো ঠিকই, কিন্তু বারুতি তো পারতো না। সেই সোমায় মোছলমানগে মধ্যি অতো শিক্ষিত ছোয়াল কোমই ছেলো। বংশ ভালো, বানারীপাড়ার খান বংশ। শুনি তো ইরান থিকা আইছিলো তাগো বাপ-ঠাকুর্দ্দা। ওয়াজেব আলী খানের পেত্থম প্কখের পেত্থম ছোওয়াল। তরমুজির ফালির নাহালি টুকটুকা গালের রোঙ। কত বিয়ার সোম্বন্ধ আসতো! কিন্তু ছোয়াল তো রাজি হয় না। ওর মা একবার আইছিলো। বাকের মিয়া ছেলো গে তোর দাদুর মুহুরী। বাকের মেয়ার পিসাতো বুন ছেলো রশীদির মা।ওই বাসায় অইসা নাকি খুব কান্দিছিলো ওর মা। কিন্তু ছোয়ালরে ফিরাতি পারে নাই। দুই-তিন জাগায় মেয়েপোক্ষের কাছে পাকা কথা দিয়াও ছোয়ালরে রাজি করাতি পারে নাই। মাইয়েডা ছেলো বদের বদ। কুলে তো কলঙ্ক দিছিসই, মুখ যহন পোড়ালিই, তহন আর বিয়া করতি আপত্তি কী? ছোয়ালডারে এমন ঘোরানিই ঘোরালো! ছাড়েও না, বিয়াও করে না। বিয়া করবি না তো একদিন না দেখলি চিঁচাইস ক্যান? নিজিও বিয়া করবে না, ছেমড়াডারে অন্য কোথাও বিয়া কইরা থিতু হতিও দেবে না।

রশীদ বন্ধু-বান্ধবগে কতো, মাগীডা ওর রক্ত শুইষা খাতিছে কিন্তু সব বুইঝাও কিছু কতি পারতো না মল্লিকারে। কায়লাস হইয়া গেইছেলো ছেমড়াডা। খাতো না, ঘুমাতো না। ডাইনের নিঃশ্বাসেও বিষ থাহে। ত-য় ভগবান যা করে মোঙ্গলের জন্যিই করে। ছোয়ালডা মেয়া হলিও বংশীয় ছেলো তো, ভগবান ওরে রোক্ষা করিছে। ওরা দুইজন যা করতো, মাগীডা সব সোমায় শাসাতো ছেমড়াডারে য্যানো সে’সব কথা ফাঁস না করে। ওর মোনে হয় ইচ্ছা ছেলো সারা জীবন এইভাবেই কাটানোর। ছেমড়াডা ওর মত মোতো চলারই চেষ্টা করতো, কিন্তু মানুষ তো, মাঝেমধ্যি অধৈর্য হইয়া পড়তো। পু্রুষ মানুষ, সে চাতো সোংসার করতি, থিতু হতি। তা চাবে না-ই বা ক্যান? কিসির অভাব তার? ফ্যা ফ্যা কইরা ঘোরা তো আর সারা জেবন চলতি পারে না। হাসপো না কান্দবো বুন্ডি, দিনির পর দিন পীরিত মাইরা নাকি কতো, বিয়া করলি ছোয়াল-মাইয়ার পরিচয় কী হবে? চলো, বিলাত যাই, এই দেশে থাকপো না। ঢ্যামনি কোহানকার। বুঝিছিস তো, বিয়া না করার ধান্দা আর কী!

ছেমড়াডা ছটফটাতো। আর এতো যে কলঙ্ক, তার মধ্যি মাথাডা ডুবায় দিয়া মলি­কা চাতো শুধু কোনোভাবে রশীদির আসা-যাওয়াডা গোপন রাখতি। গোপন আর কদ্দিন থাহে? রশীদরি সবাই বোঝাতো। কিন্তু বুন্ডি, মানুষ-মানুষির পিরিতি পড়লি সেই পিরিত ছোটানো গেলিও যাতি পারে, কিন্তু মুনিষ্যি যদি ডাকিনের পিরিতি পড়ে, তা ছোটানো সহজ কম্মো না, বুঝিছ মনি। তো একদিন রশীদ সোম্ভাব শুইয়া রইছে বা বইসা রইছে ডাকিনের ঘরে আর ডাকিন হাত রাখিছে রশীদির হাতে। রশীদ হঠাৎ বুঝতি পারলো ওর রক্ত শুষতিছে মলি­কা। এক ঝটকায় হাত সরায় নেলো। এরপর থিকা মাঝেমধ্যিই রশীদ টের পাতি লাগলো মল্লি­কা ওররক্ত শুইষা নেয়। ও তো আর ছুঁতি দেয় না মল্লিকারে। বুঝিছিস তো দাদা, এই য্যামোন আমি তোর হাত ধরিছি, তুই যদি দেখিস, আমি তোর হাত ধরার সাথে সাথে তোর সব রক্ত আমার দেহে চইলা আসতিছে আর তুই দুব্বল হইয়া পড়তিছিস, তুই কি ধরতি দিবি? দিবি না। কেউ দেয় না। রশীদও দেতো না। কিন্তু মাগীর তো রক্তের তেয়াস। রশীদরি ছোঁয়ার জন্যি ছটফটাতো। মায়াকান্না কান্দতো, নানা কথা কতো। শেষে রশীদ বেরক্ত হইয়া গেইছেলো। ভয়ও পাতো। আবার বহুদিনির অভ্যেস, না যাইয়াও থাকতি পারতো না। আবার গেলিই ভয় পাতো। সবাই সন্দ করতো ঠিকই কিন্তু রশীদই তো শুধু জানতো মলি­কার আসল পরিচয়। না পারতো প্রকাশ করতি, না পারতো সইরা আসতি।ছেমড়াডার মুহির দিকি আর চাওয়া যাতো না। ওর বাড়িঘরের সাথে যোগাযোগ কমতি থাকলো। যে দ্যাখতো, সেই-ই দুঃখ করতো। কিন্তু মাথার উপরে হরি আছে। হরি হরি, হরিচাঁন, গুরুচাঁন! হরিচাঁন গুরুচাঁন!

ত্যাসে হলো কী, অনেক দিন যাওয়া বন্ধ করলো রশীদ। যে মানুষ পেত্যেক সোন্ধ্যায় যাতো সেই মানুষ ওর পরিচয় পাতি পাতি যাওয়া পেরায় বাদই দেলো। মাগী তো জোঁকের নাহালি লাইগা রইছে পাছে, ওর তো রক্তের তেষ্ণা। নানা ছলাকলায় ভুলোয় রাজী করালো রশীদরি ওর ঘরে আসতি। যিদিন আসতি রাজি হলো, সেদিন আলো না, পরদিন না, তার পরদিন না, তার পরদিনও না। তারও দিন চার-পাঁচেক পরে যেই না আলো ছেমড়াডা, রক্তখাউকা বেবুস্যে মাগী ঝাঁপায় পড়লো ছেমড়াডার উপর। আঁচড়ায়, কামড়ায়, রক্ত বাইর কইরা গালি দিতি লাগলো আর রশীদ অবাক হইয়া দেখতি লাগলো, মলি­কার মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফ, দুইডা দাঁত মোটা মোটা বাড়তি লাগলো, বাড়তি বাড়তি মূলার মোতো সাইজ হলো, সেই দাঁতের গোড়ায় ওর শরীরির রক্ত। দেখতি পালো মলি­কার নোখগুলান বাড়তি বাড়তি হাইসা হলো, চোখগুলান গনগনা কয়লার ভাঁটা-রশীদ এমন চিঁচান দেলো, এমন কইরা ডাকলো সবাইরে! ‘কে কোথায় আছো দেইখা যাও, বাঁচাও আমারে, এইঘরে রাত্তিরে কী হয় দেইখা যাও, দেইখা যাও আমার জীবনডা কীভাবে শেষ হইয়া গেলো…’

সেই চিঁচানিতে আমরা সবাই দৌড়ায় গেলাম, সারা শহরের মানুষ জোমা হইয়া গেলো, বরিশাল, গৌরনদী, ফইরেদপুর, গোপালগঞ্জ হইয়া আমার মা ছেলো চেঁচানিকান্দিতে, সেইখানে পর্যন্ত— রশীদির চিঁচানি শোনা গেলো। হ রে দাদা, মা সত্যিই শুনিছিলো। বুন্ডি, তুই বিশ্বাস করবি না, নীল শাড়ি আর সাদা বেলাউজে পোর্টসের মাঠে যারে দেহিছিলাম, সে আর এই ডাকিন যে একই জন, ভাবাই যায় না। পাটকাঠি আর তুষ একসাথে ভালো কইরা জ্বললে যেমন গনগনাইয়া ওঠে আগুন, চোহে সেই আগুন। দাঁতগুলান বড় বড়, রক্ত ঝরতিছে। সবাই মিলা রশীদরি ধইরা নিয়া গেলো।

-আর মলি­কার কী অলো দিদিমা? কোনো বিচার আচার অলো না? কেউ কিছু কলো না ওরে?

-কী আর বিচার? ভগবানই ওর বিচার করবে। করবে কী, করিছেও। তয় সেই রাত্তিরি ভয়েই আর কেউ ধরলো না ওরে। শুধু ওর ফোঁস ফোঁস শব্দে শহরের কোনো বউঝিছোয়ালপোয়াল ঘুমাতি পারলো না। কিন্তু জানিস তো, ডাকিনরা যেতেদিন ধরা না পড়ে তেতোদিনই ওগো শক্তি। ধরা পড়লি ওগে শক্তি শেষ হইয়া যায়। মাঝরাত্তিরি ও তো দরজা আটকালো। ওর ঝি-ডা যে কোথায় গেলো, কেউ জানে না। শোভা-আভার মা সেই রাত্তিরিই ঘর বন্ধন করলো, য্যান নড়তি না পারে।

পরদিন বেহানবেলা ওর ঘরের সামনে সবাই বাহ্যি-পেচ্ছাপ কইরা আলো। তারপর সবাই ওর মাথার চুল কামালো, গোছরের মতো চুল, নামতি চায় না ক্ষুরি। ওমা কী নজ্জার কথা, আগের রাত্তিরের দাঁত কই? নোখ কই? রাত্তিরের সব দাঁত পইরা গেছে, নোখ উইঠা ঘাঁও, গোন্ধ আসতিছে গা দিয়া। সবাই ওরে দিয়া সেই বাহ্যি-পেচ্ছাপ চাটালো। অবাক কান্ড, ও নাকি সাক্ষরখানা চাইলের ভাত খাতো, সুগন্ধি চা খাতো, বিএম কলেজে যেসব নতুন ছোয়ালরা চাকরি করতি আসতো, তারা সবাই যাতো ওর ঘরে চা খাতি। অন্যেরা অবশ্যি কতো যে তোমরা যাইয়ে না ওর ঘরে। গাঁইথা ফেলবে। দেহো না আমাগো নেতা সুবিমল পোফেছাররেও সেদিন সবাইর সামনে অপদস্থ করলো? কেউবা কতো, সুবিমল ছার তো নিরীহ মানুষ নেতা হইলে কী হইছে, মৃগাঙ্কশেখর ছাররিই গাঁইথা ফেললো। তবুও ওইসব ছোয়ালরা মলি­কার ঘরে যাইয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা চা খাতো আর অড্ডা দেতো, আড্ডা দেতো আর সুগন্ধি চা খাতো। সেই মানুষ শুয়ারের মতো গঁৎ গঁৎ কইরা গু-মুত খালো। তয় বুন্ডি একটা কথা মনে হয়, ডাকিন হলিও মাগীডা সোম্ভাব রশীদরি ভালোবাসিছিলো। শোভা-আভার মা কইছলো, ওনরা তো পাশের বাড়ি থাকতো, রশীদও সোম্ভাব মল্লিকার উপার বেরক্ত হইয়া কিলডা-ঘুষিডা মাঝেমধ্যিই দেতো। তা দেবে না ক্যান? ওর মোতো মাগীরি মারির উপর রাখপে না তো কী? তয় কী জানিস, গু-মুত খাওয়ার সোমায় ডাকিনডা কইছিলো, আমি সব খাবো কিন্তু আমারে এইখানে থাকতি দিতি হবে।

আমরা সবাই রাজি হইছেলাম, পরে গু-মুত খাওয়া হলি আর সে’কথা রাখতি পারি নাই। তাই কি রাখা যায়, ক’? ও খাবে কী? আর নিশ্চিত ডাকিন জানার পর তো রাখা যায় না। নিজিগে চোহে দেহিছি, অবিশ্বাস করি ক্যাম্বায়? গড়াগড়ি দিয়া কান্দিছিলো, কিন্তু মায়া করলি তো চলবে না, ছোয়াল-মাইয়ে নিয়া আমাগো সোংসার। লাঠি দিয়া বারুতিই চইলা গেলো। কোনদিকি গেলো কেউ জানে না। কেউ কলো ও হাঁটলি ওর ছায়া দেহা যায়নি, আবার কেউ কেউ কলো ওর ছায়া নাকি পড়িছিলো। আমি অবিশ্যি দেহি নাই। তোর মা তহন ছোট। ওর খাওয়ার সোমায় হইয়া গেইছেলো। কিন্তু তুই কানতিছিস ক্যান রে নীল? একটা বেবুস্যে, ডাকিন মাগীর জন্যি তুই কান্দিস? কী বোকারে তুই! তুই কান্দিস ক্যান?

The post ডাকিন first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%a1%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%a8/feed/ 0
সেই ছোট্ট দু’টি পা https://kaberigayen.com/shei-chotto-duti-paa/ https://kaberigayen.com/shei-chotto-duti-paa/#respond Wed, 26 Jan 2022 13:41:56 +0000 https://kaberigayen.com/?p=6775 ছোড়দিরে দেখলি না রে, এই দৃশ্য দেখলি না। মা’র সাদা ধবধইবা পা দুইটাও কালো হইয়া গেলো আগুনে, পুইড়া কয়লা হইলো, আমি এই দৃশ্য আর দেখতে পারলাম না রে। বোকা মা-টা মইরাই গেলো...

The post সেই ছোট্ট দু’টি পা first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
এক

– ছোড়দিরে দেখলি না রে, এই দৃশ্য দেখলি না। মা’র সাদা ধবধইবা পা দুইটাও কালো হইয়া গেলো আগুনে, পুইড়া কয়লা হইলো, আমি এই দৃশ্য আর দেখতে পারলাম না রে। বোকা মা-টা মইরাই গেলো। সারাদিন কাজ করতো, গরমে-ঘামে আর রাগে মুখ লাল থমথমা হইয়া যাইতো তাও তো খালি সবকিছু পরিস্কার করতো। বোকার মতো কাজ করতে করতে মানুষটা মইরাই গেলো। এখন আর তোর আমার জন্মদিনে পায়াস রান্ধবে কেরা? বোন বাসায় আসো, তোমারে বুকে জড়াইয়া একটু শান্তি পাই সোনা। তোমার জন্য আচার বানাইয়া মা নাম লেইখা রাখছে, প্রথমে বাংলায়, তারপর ইংরেজীতে। তুমি দেখবা না? আসো, আইসা দেইখা যাও…

 

ফোনের ওপারে হেনার হাহাকার। অপ্রকৃতস্থ মনে হচেছ ওকে। মাথার ভেতরটা কেমন হালকা হয়ে যাচ্ছে চানুর, কোন ভার নেই। মা’র আক্ষেপ ঢাকায় কোন ফুল পাওয়া যায় না পূজার জন্য, টবে লাগানো তুলসি শুকিয়ে গেছে রোদে অথচ মাত্রই তো এখানে এখন মে’র শুরু। কেউ বলে ¯িপ্রং, কেউ বলে গার্ডনিং সিজন। চানু যে পাড়ায় থাকে সেখানে উঁচু উঁচু চেস্টনাট, ওক, কপার বীচ, সিকমোর আর এলমের সারা গায়ে নতুন পাতার চকমকি। জুনিপারের গাঢ় সবুজ কাঁটাঝাড় মালাকাইটের আগুনি নাচুনি হয়ে, সবুজ আলো হয়ে ঝুঁকে আছে ডগ ডেইজির প্রান্তরে। আর কোন এক প্রাচীন সন্ন্যাসিনী টেরিজার প্রাচীনতর আবাস আঙ্গিনা জুড়ে চেরি- সাদা, বেগুনি, বারগান্ডি, হালকা গোলাপি, কুসুম রঙা -বাহারি বাতাসে পাঁপড়ির পুরূ স্তর জমেছে আঙ্গিনায়, আঙ্গিনা যেখানে শেষ হয়ে আবাসিক এলাকার রাস্তায় মিশেছে সেই সে শিরোনামহীন গেটে, গেট পেরিয়ে রাস্তায়। বুকটা হু হু করে। সেই কোন ছোট বয়সে ঘোষ বাড়ি কিংবা বিমলাধাম থেকে মা’র পূজার জবা নিয়ে আসার পথে জলে নুয়ে থাকা হিজলের ডাল আর সেই ডালে বসে নুসরাতের সাথে হিজলের মালা গাঁথার স্মৃতি মনে করে বুকটা হু হু করে। হিজলের কালো ডাল ঝুঁকে পড়েছে যে পুকুরে সেই পুকুরের কালো জলে ফ্যাকাশে গোলাপি নাকি বাংগি রঙের হিজল ছড়িয়ে থাকে, হিজল কখনো জড়াজড়ি করে থাকে না জলে, আলাদা আলাদা আলতো ভাসে। নারকেল পাতার সুতা বের করে কিংবা শাপলার ডাঁটা থেকে বের করা চিকন সুতায় মালা গাঁথতে গিয়ে প্রতিদিন দেরি হয় স্কুলে। জোর প্রতিযোগিতা নুসরাতের সাথে, কার মালা কত বড় হয়। নয় বছর বয়সে নুসরাতের সাথে ছাড়াছাড়ি, চানুর বাবার বদলির চাকরি। অথচ এখনো নুসরাতের সাথে খেলার জন্য মনটা দেখো কেমন নির্লজ্জের মতো মুখিয়ে আছে। হেনা তখন ছোট, সব খেলায় দুধ-ভাত। মা-নুসরাত-হেনা-হিজল-পঞ্চমুখি জবা-কুসুমরঙা চেরির পাঁপড়ি- আহ, আবার ফোন। কে করে এতো ফোন?

 

– মা তো জীবনে শান্তি পায় নাই চানু, এবার মা শান্তি পাবে। জানিস, সবাই বলছে দেইখা মনে হয় ঘুমাইয়া আছে। শান্ত মুখ, কোথাও একটু  কষ্টের ছোয়া নাই, মুখ দিয়া একটু কষ গড়ায় পড়ে নাই, শুধু চোখের কোণায় একফোঁটা জল। মা তো এইভাবেই যাইতে চাইছে। মা’র একটু থুতুও তো মোছতে হয় নাই। একবেলা একটু জ্বর হয় নাই। মারে স্নান করাইলাম, পরিস্কার সবকিছু। এতো সুন্দর যাওয়া আর দেখি নাইরে। জানিস মা না তার আঙটিটা খুইলা রাইখা গেছে, ঘরে পরা স্যান্ডেলজোড়া একটা পলিথিনে মোড়াইয়া খাটের নিচেই রাখা, রাত্তিরে পরা শাড়ি দিব্যি ভাঁজ দিয়া বাথরুমের র‌্যাকে রাখা যেনো কারো আবার পরিস্কার করতে না হয়। দুঃখ করিস না চানু, কান্দিস না, প্রার্থনা কর… বড়দি কল্যাণীর গলা বুঁজে আসে… বেশি কাঠ লাগে নাই, পাতলা শরীর, সূর্য ডোবার আগেই পোড়ানো শেষ হইয়া গেছে। মা দিগন্তে মিলাইয়া গেছে রে চানু…

 

মা তাহলে ছাই! নিজের শরীর ধরে ধরে দেখে চানু। মাত্র পরশু বিকেলেই তো কথা হলো, তেমন কোন দুশ্চিন্তা হয় না। জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখার এই বাজে অভ্যেসটা যে কবে কাটবে!। আর ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নেয়া যাক, মিসেস গার্ডনারকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছে চানু ভোর সাড়ে পাঁচটায়, সারারাত ঘুমায়নি সেজন্য। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই বড়দির ফোন, কত সব কথা মাথার চারদিকে, ‘মারে এখন নিয়া যাচ্ছি’…‘মা ছুটির কাছে চইলা গেছে’…‘চানু, কিছু একটু খেয়ে নাও’…। ঘুমের ঘাটতি চানুর বরাবরের, একটু ঘুমাতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যেতো কিন্তু না, তা তো হবার না! আরে চানু খাক না ঘুমাক তা নিয়ে পরামর্শ দিতে শাহানা ভাবিকে কে ফোন করতে বলেছে কানাডা থেকে? যত্তোসব! চানু অতল ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে, টিনের চালে বৃষ্টি নেমেছে, হেনাকে কোলে নিয়ে ছোটনদা দাঁড়ানো, বড়দি দুধ জ্বাল দিচ্ছে, হঠাৎই হেনার পা ঢুকে গেলো উথলে ওঠা দুধের হাঁড়িতে, কী হয়েছে, হয়েছে কী আজ চানুর?

 

– চানু, তুই কবে আসতে পারবি? ফেব্র“য়ারিতে আসা হবেনা? আ-চ্ছা…খুব মৃদু শোনায় আ-চ্ছা শব্দটা মা’র গলায় ফোনের ও-প্রান্ত থেকে। মার্চের শেষের দিকে আসফি? ততদিনি গরম পড়তি শুরু করবে, এই বাসায় জলছাদ নাই তো, খুব গরম। তা বাবুরা তো নড়বে না এই বাসা ছাইড়া, কী যে মধু পাইছে একেকজন এই বাসায় তা তানারাই কইতে পারবে।

 

– চানু, যা করতি ইচ্ছা করে করবি, যা খাইতে ইচ্ছা করবে খাবি, যেখানে যেখানে যাইতে ইচ্ছা করবে যাবা, জীবন কয়দিনির? এই সোমায় তো আর ফিরা পাবা না। অল্প বয়সে মোক্তারের বউ, নিশু-মিশুর মার শাড়ি দেইখা কী ইচ্ছা হইতো, মোনে হইতো, ইস্ যদি ওইরকম একটা শাড়ি পরতি পারতাম! এখন তো আমার কত শাড়ি আলমারি ভরতি। এইবার নিখিলির বাসায় গেলি নিখিলির আর শিখার যত বন্ধু-বান্ধব আছে, প্রত্যেকেই তো একখান একখান শাড়ি দেছে। কেরা পরে? তুমি তো বোকার হদ্দ, এর তার জন্যি কেনো, নিজির জন্যি কিচচু কেনো না। এতো বছর চাকরি করতিছো, একখান ভালো শাড়িও তো নাই তোমার। চানু আমার কথা শোনো, এবার ভালো দেইখা একটা ড্রেস কেনবা, কথা দেও আমারে। না হইলে কিন্তু আমি খুব রাগ করবো…

 

দুই

তবু ভিসা বাড়াতে যেতে হয়, টিকিট বুকিং দিয়ে অপেক্ষা করতে হয়, ডিপার্টমেন্টে কাজ বুঝিয়ে দিতে হয়, তারপর দিনরাত প্লেনে পার করে তবে দেশে ফেরা যায়।  এইযুগেও ঠিক সাতদিনের দিনই কেবল চানু পা রাখতে পারে দেশের মাটিতে, একবেলা আগে না। চানুর মা’র বড়  আক্ষেপ ছিলো -এই দেশের কোন মানুষ আর দেশে থাকপে না, সবাই বিদেশ যাইতে চায়। আমার তো একটুও ভালো লাগে না সবাইর এই বিদেশ যাওয়া। দেখ তোর নারায়ণ মামার সংসার, তার ছেলেমেয়েরাও শিক্ষিত, কেউ যে অশিক্ষিত তা তো কইতে পারবা না। মেয়েরাও সবাই বি.এ. পাশ করছে, সবাই চাকরি করতিছে, বিয়া করছে, নাতি-পুতি নিয়া নারায়ণের কী শান্তির সংসার। ভাবছিলাম তোমার বাবা রিটায়ার করলি বাবার যে সম্পত্তি পাইছি সেইখানে ঘর তোলবো, পুকুরডা কাটপো, দুইডা গাছ-গাছালি লাগাবো, তা না এই ঢাকা শহরে আইসা উঠিছি। পরের ঘর মুছতি মুছতিই আমার জীবন গেলো। এই তিনতালা ফ্ল্যাটেই চোখ বোজবো তারপর পোস্তগোলা শ্মশানে পোড়ায় দিলিই মিটা গেলো কোন চিন্তা নাই।

 

কথার সাথে সাথে মা’র হাতের মুদ্রাও এতো জীবন্ত! চানু পরিস্কার দেখে। সেই জলছাদহীন পরের তিনতলা ফ্ল্যাটেই মা’র আজীবন ধোয়া-মোছাশেষে চোখের কোণায় একফোঁটা জল। তারপর সেই পোস্তগোলা শ্মশান, ছয়-সাতজন শ্মশানযাত্রী, ঢাকা শহরে এর বেশী আর শ্মশানবন্ধু কীভাবে পাওয়া যাবে?

 

-চানু, আইজকা সকালে খুব গরম তো তাই বারান্দাডা মোছার পর বালতিতে যে জলটুক ছেলো সেই জলটুক বারান্দায় গড়াইয়া দিছি, এট্টুই জল ছেলো, জলটুক গিয়া পড়ছে নীচের সুপারি গাছের তলায় আর ওমনি রি রি কইরা আইসা ধরছে  বাড়িওয়ালার কাজের মাইয়া। সাথে সাথে বারান্দার জলটুক মুইছা নিছি। আবার বেল, এইবার আইছে বাড়িওয়ালার কাজের ছেলে। সব থাকতিও আমার অন্যের কথার তলে থাকতি হয়। আইজ আমার নিজের বাড়িতে থাকলি এই কথা কওয়ার সাহস পায় কেউ? তোর দিদিমা কয়, “আপন মাটি, দোমায় হাটি”। কিন্তু এই সংসারে আমার ইচ্ছার তো কোন মূল্য নাই। আমি আছি এই সংসারে খাটার জন্যি, খাইটা যাবো-তা এই সংসারের দাসি দুইজন, একজন এই বুড়ি দাসি আরেকজন হইলো দশ বছরের পুন্নি দাসি। তারে দিয়া তো আর কাজ হয়না, আর কইলে কী হবে ওই তো এট্টুদানা এট্টু মাইয়া, গরীবির মাইয়া তাই আইছে তোমাগো বাড়ি খাটতি…যান্ত্রিক গোলযোগে কেমন ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায় ফোনের ওপারে মা’র গলা।

 

সেই সুপারি গাছের পাশ কাটিয়ে, সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনতলার দরজায় চানু। দরজা খুলে যায়, মা দাঁড়িয়ে নেই সেখানে। দরজার পাশেই তুলসির টব। ছোটদা’র গায়ে ধরা । বুকটা ধক করে ওঠে। বারান্দায় পরিত্যক্ত কাঠের টেলিভিশন বাক্সের উপর একটা মাটির ভাঁড়, পাশেই তুলসির টব, সেখানে ধুপ-ধূনো দেয়ার ধূপদানি, দুটো আধ-জ্বলা ধুপকাঠি আর একটা আধাআধি পুড়ে যাওয়া মোম। ওই ভাঁড়ে মা’র ছাই হয়ে হয়ে যাওয়া শরীর, আর এক টুকরো হাঁড়, গঙ্গাঁয় দেয়া হবে বলে রাখা হয়েছে। হেনার যেদিন জন্ম, চানুর স্মৃতির জগত সেদিন থেকে শুরু, বিস্মরণের শুরু কি তবে ওই মাটির ভাঁড়ে? মাথাটা আবার হালকা হয়ে যাচ্ছে।

 

বাবা আসেন ধীর পায়ে, ভেঙ্গে যাওয়া শরীর আরো ভেঙ্গেছে কিন্তু গলার স্বর বরাবরের মতই জীবন্ত।

 

-তোমার মা পূণ্যবতী ছিলেন চানু মা। আমি এমন মৃত্যু দেখা তো দুরের কথা, কোনদিন শুনিও নাই। সারাদিন কাজ করছে, সন্ধ্যায় সন্ধ্যাবাতি দেছে, রাত বারোটা পর্যন্ত টেলিভিশান দেখছে, ভোরের আলো ফোটতে ফোটতে পরমাত্মার কাছে যাত্রা করছে। কেউরে এক মুহুর্তের  জন্য জ্বালায় নাই। জানো তো মা, ওইদিন ছিলো বুদ্ধ পূর্ণিমার সকাল।

 

বন্যার মা বলে, খালাম্মা বড় পূণ্যবতী । কী দিনে গেছেন গো, মিলাদুন্নবীর দিন গেছেন। মালতি বৌদি ঝর্ণা মাসির সাথে সিঁদুর বিনিময় করতে করতে ছলছলে চোখে বলে, মাসিমা সিঁদুর মাথায় নিয়ে দেহ রাখছে, বড় পূণ্যবতী গো, উপস্থিত সবাই সায় দেয় সে কথায়। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শি, বন্ধু-বান্ধব সবাই একে একে সাব্যস্ত করে তিনি পুণ্যবতী ছিলেন। সাক্ষাত প্রমাণও একে একে ভিড়তে থাকে, না কিনা তিনি সিঁথির সিঁদুর নিয়ে গেছেন, ভরা সংসার রেখে গেছেন, কাজ করতে করতে গেছেন, চলে যাবার মূহুর্তেও কাউকে ডাকেননি, আর দু’-দ’টো ধর্মীয় বিশ্বাসের পুণ্য দিনে গেছেন। গা জ্বলে যায়,  আজকের দিনেও এতোসব শিক্ষিত মানুষজন কীভাবে যে এইকথা অবলীলায় দুঃখি-দুঃখি মুখ করে বলতে পারে, আশ্চর্য!  বাবা মা’র চেয়ে অন্তত ঝাড়া বারো-চৌদ্দ বছরের বড়। বাকি সব কথার কোন মানে নেই চানুর কাছে- কাজ ছাড়া মাকে কে কবে দেখেছে? চানুর সবচে’ ছোটদাদা অপু একবার বলেছিলো, “ছোট বেলায় মারে দেইখা মাঝে মধ্যে মনে হইতো এতো রোগা আর এতো ফর্সা মানুষটা কেরা যে সারাদিন মুখ বুইজা কাজ করে আর ডাইন চোখের কোণায় একফোঁটা জল টলটল করে?” আর ভারহীন মা মশারির খাঁজে ঝুলন্ত আবিস্কৃত হয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত কে জেনেছিলো তার ডায়বেটিস? নিদেনপক্ষে অসুস্থ? পূণ্যবতী না ছাই, অহংকারী মহিলা, যেনো কেউ তার আপন ছিলো না। কী অহংকার! “ঠাকুর, হাত-পাও থাকতি থাকতি আমারে পার কইরো”, চোখ জ্বালা করে ওঠে চানুর। শুধু শ্রাদ্ধের দু’দিন আগের সন্ধ্যায় মা’র সকালে হাঁটার সঙ্গী পরিচয়ে মিসেস জেবুন্নেছা নামের এক বোরকা পরা বয়স্ক ভদ্রমহিলা ডুকরে কেঁদে উঠলে হেনা কেমন ভাবলেশহীন চোখে প্রণাম করে তাকে আর চানুর খটখটে লাল চোখ জলের ছোঁয়ায় আশ্বস্ত হতে থাকে…

 

 তিন

-ওয়েট, ওয়েট… ইওর মাম কুকড দ্যাট ডে ফর এভরি বডি অ্যাজ ইউজুয়াল মিনস? সো ইওর মাম ইউজড টু কুক ফর এভরি বডি? হাউ মেনি আর ইন ইওর ফ্যামিলি? এইট? ফানি! হোয়াই এইট ইন দ্য সেম ফ্যামিলি? এনি ওয়ে, য়্যূ ওয়ান্ট টু টেল মি দ্যাট ইয়োর মাম এট হার সিক্সটি ফাইভ ইউজড টু কুক ফর এইট পিপল এভরি ডে? ওয়েল, আই থিঙ্ক সি ডিড ইউ মাচ ফেভার লিভিং টিল  সিক্সটি ফাইভ… নো, নো, প্লিজ ডোন্ট টেল মি এবাউট কালচারাল নর্ম অর এনি থিং এলস। র‌্যাদার আই উড রিকোয়েস্ট য়্যূ টু স্টপ মোনিং, আই থিংক সি কুড ম্যানেজ টু গেট সাম রেস্ট এ্যাট লাস্ট অ্যান্ড য়্যূ স্যুড বি হ্যাপি অ্যাজ অ্যা বি-লা-ভ-ড ডটার, মিসেস গার্ডনার রাগে গড়গড় করে বলে যান, সো ইওর সো-কলড কালচারাল নর্ম অ্যান্ড ফ্যামিলি বন্ডেজ আর বিল্ট অন ইওর মাম’স আন-পেইড স্লেভারি! থ্যাঙ্কস যেসাস, আই ডোন্ট হ্যাভ সাচ না-ই-স অ্যা ফ্যামিলি বন্ডেজ। বিদ্রুপে বেগুনি হয়ে ওঠে মিসেস গার্ডনারের ফর্সা মুখ।

 

মাকে চানু রান্না করা থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় কাজ করতে দেখেই  অভ্যস্ত, এটা যে মহা অন্যায় কিছু তা তো কোনদিন মনে হয়নি! এমন না যে চানু অসচেতন, বরং একটু বেশিই সচেতন বুঝি। এমা গোল্ডম্যানের বিবাহ প্রসঙ্গে, এঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাস্ট্রের উদ্ভব থেকে শুরু করে নিদেনপক্ষে হালের বেল হুকস কিংবা ইরিগার-এর লেখালেখির সাথে কমবেশী জানাশোনা তো আছেই। ‘বিয়ের মধ্য দিয়ে কীভাবে একজন মেয়ের শ্রমের উপর পুরুষতন্ত্রের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বিস্তৃত হয়’ সে বিষয়ে স্টেজে দাঁড়িয়ে চাপাবাজির পাকামোও কম করেনি। সে তুলনায় মিসেস গার্ডনার তো কিছুই না, মৃত স্বামির পেনশনভোগী একজন অল্প শিক্ষিত বৃদ্ধ মহিলা মাত্র। তাহলে কি সিস্টেম? যখন দাস ব্যবস্থা চালু ছিল তখন কয়জনই বা ওই ব্যব¯থাকে অন্যায় ভেবেছে? ক্লিশেতম উদাহরণ। যেনো দাস ব্যবস্থা শেষ হয়ে গেছে! এই যে ছোট ছোট মেয়েরা বাসায় বাসায় কাজ করে নামমাত্র বেতনে কে অন্যায় দেখে এসবের মধ্যে? অন্যায় দেখা! খুন্তির ছ্যাকা দিয়ে দিশে পায় না! আর বুয়া চরিত্র আর তাদের ভাষা নিয়ে ক্যারিকেচার না থাকলে যেনো বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত রুচির সর্বোত্তম পরিণতি হুমায়ূন আহমেদের সোপগুলো জমে! ধ্যাত্তরি সব যুক্তি! কথা ভেসে আসে কোন আবছা অতীতের ঘরোয়া গল্প থেকে,

 

-তোর ছোটদা যে রাত্তিরি হইছে, পরদিন সকাল আটটায় তোর বাবা যাবে ট্যুরি। মোখলেস সাহেবও যাবে। তোর বাবা মোখলেস সাহেবের বাসায় গেছে একসাথে যাবে বইলা। মোখলেস সাহেব তখন খাইতে বসবে, তোর বাবার জন্যি অপেক্ষা করতিছে, ভাবছে আগের রাত্তিরে বাচ্চা হইছে কেরা বা নাস্তা বানাবে। তোর বাবা গেলি উনি কইলো, দেরী হইয়া গেছে আসেন আসেন, টেবিলে আসেন। তোর বাবা কইলো, “আমি তো গরম ভাত আর মাছের ঝোল খাইয়া আসছি, খাবো না”। শুইনা  মোখলেস সাহেবের বউ তো অবাক, “কাইল রাইতে  কল্যাণীর ভাই হইলো, ঘরে তো বয়স্ক কেউ নাই, কে রান্না করছে?” তোর বাবা কইলো, “কেন, নিখিলের মা-ই করছে।” শুইনা তো তাগো মাথায় হাত, “বলেন কী?”

 

– ও মা, কী কও? তুমি কেমনে রান্না করছো?

 

– হ, বিশ্বাস করে না। রাত্তির বেলা তোর ছোটদা হইছে, সকাল সাতটায় তোর বড়দি স্টোভ ধরাইয়া আমারে একটু জল গরম কইরা দেছে, সেই জলে সান কইরা চুলা ধরাইয়া মাছ-ভাত রাইন্ধা দিছি, পারবো না বললি তো হবেনা, পারতি হইছে…তাও তো তোমরা যে এতগুলান ভাই-বুন হইছো তা বইলা কি কোনদিন একটু ওষুধ-বিষুদ, ডাকতার-কবিরাজ কি ভালো পথ্য কিছু কি পাইছি? শুধু হেনা হওয়ার পর এক ফাইল মৃত সঞ্জীবনী সুধা আইনা দেছেলো, এই আমার একমাত্র ওষুধ এতোগুলা ছেলেমেয়ে হওয়ার মধ্যি।

 

-থাক মা থাক আর কওয়ার দরকার নাই, থামো, ভয় করে।

 

এ এক জ্বালা হয়েছে, উঠতে-বসতে-খেতে-শুতে-কাজে-অবসরে-অফিসে-বাজারে মিসেস গার্ডনারের শ্লেষ চামড়া ছুলে দেয়া জ্বলুনি দিচ্ছে। জ্বলুনি বেড়ে যাচেছ প্রতিদিন,  চানু ব্রোকেন ফ্যমিলির উদাহরণ টেনে পরিত্রাণ পেতে চাইছে, অথচ প্রকট হয়ে উঠছে মিসেস গার্ডনারের শ্লেষ, “ইওর সো কলড কালচারাল নর্ম অ্যান্ড ফ্যামিলি বন্ডেজ আর বিল্ট অন ইওর মাম’স আন-পেইড স্লেভারি”। ঠিকই, শেষের দিকে আর কুলাতে না পেরে  মা প্রায়ই বলতো- আমি এই শরীরি সত্যিই আর পারিনা। পুরুষ মানুষের রিটায়ারমেন্ট আছে, মেয়েমানুষের নাই। যতদিন বাঁচপো, সংসারের ঘানি আমার টানতিই হবে, বাঁচি আর মরি। …একজন ডাইবিটিসির রুগী আমি তা বইলা একদিনও তো বেলা তিনটার আগে দুুপুরির খাওয়া খাইতে পারিনা। সংসারে পুরুষ মানুষ আর মেয়ে মানুষের এই তো পার্থক্য-ভাবো তো এই সংসারে আমার  অসুখ যদি তোমার বাবার হইতো!

 

আচ্ছা, এদেশের মেয়েরা আর জীবনভর আন-পেইড স্লেভারি করতে চাইছে না বলেই কি পরিবার ক্ষয়ে যাচ্ছে? কিংবা এতটাই কি? একেবারে স্লেভারি! ছেলেমেয়ে সংসারের সাফল্যে কি মা’র আনন্দ ছিলো না? তার মূল্য কি কম? এরা বুঝবে কেমন করে? ডিপার্টমেন্ট থেকে বাসে চড়ে বাসায় ফিরছে চানু, পেন্টল্যান্ড পাহাড়ের গায়ে গোলাপি তুলোট মেঘ,  দূরও ছাই, মিসেস গার্ডনার কী বললো কীই-বা আসে যায়। কিন্তু মা কি কখনো আনন্দিতও ছিলো? শত চেষ্টা করেও মা’র কোন সুখি মুখ চানু মনে করতে পারে না।

 

-মা, পিকনিকে যাচ্ছে সবাই, আমিও যাইতে চাই। চানু তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে।

-তোমার বাবারে কইয়া দেখ, কী কয়…ভাতের ফ্যান ঝরাতে ঝরাতে মা নির্লিপ্ত উত্তর দেয়, হাতে ধরা ভাতের বড় হাঁড়ি।

-মা, আমার স্কুলের রিপোর্ট কার্ডে স্বা´র দিয়া দেও। আরেকদিনের কথা।

মা রিপোর্ট কার্ডে চোখ বুলিয়ে খুশি হয়ে ওঠে, আমি তো দিতি পারবো না তোমার বাবারে দিতি কও।

-ক্যান, বাবা ক্যান? তুমি দিতি পারো না?

-পারবো না ক্যান, কিন্তু দেখ না অভিভাবকের স্বাক্ষর চাইছে, তোমাগো অভিভাবক তো তোমাগো বাবা। কেমন রস-কষহীন গলা মা’র।

মা গো, মাথাটা কেমন হালকা হয়ে যাচ্ছে মা…

 

 

চার

-চানুদি, আপনি তো এভাবে পাগল হয়ে যাবেন। একা একা সারাক্ষণ মাসিমার কথা মনে করলে তো আপনি শান্ত হতে পারবেন না। আপনি না যুক্তিবাদি? সত্যি চানুদি, আপনার মতো মানুষ এইভাবে ভেঙ্গে পড়বে আমি কোনদিন কল্পনাও করি নাই। আসিফের কথা শেষ না হতেই আসিফের ভারতীয় বউ অন্ধ্রের মেয়ে উমা কুমপাট্টালা শুরু করে, ওয়েল চানুদি, হোয়াই ডোন্ট য়্যূ ডু সাম মেডিটেশন? ড্যু য়্যূ হ্যাভ এনি আইডিয়া অফ ওইজা বোর্ড? মিনিট দশেক ওইজা বোর্ডের কার্যকারিতা আর প্রয়োগ-পদ্ধতি বুঝিয়েই চলে উমা ফোনে আটলান্টিকের আরেকপার থেকে।

 

-কলপ্না, য়্যূ হুভারড দ্য করিডোর ফোর টাইমস ইন লাস্ট টেন মিনিটস। প্লিজ কন্ট্যাক্ট দ্য এক্সটেনশন নাম্বার গিভেন বিলো…আওয়ার ইউনিভার্সিটি কাউন্সিলিং সেন্টার ইজ ভেরি রিলায়েবল। ইফ এ্যানি প্রবলেম, প্লিজ ফিল ফ্রি টু গিভ মি অ্যা কল, লাভ-কার্স্টি।

 

-হোয়াট ডু য়্যূ থিঙ্ক অ্যাবাউট টেকিং সেভেরাল ডেজ অফ ফ্রম ওয়র্ক? য়্যূ লুক ভেরি ডিফরেন্ট দিজ ডেজ…প্রফেসর ইয়েন কথাটা পাড়ছেন থেকে থেকেই।

 

-উড য়্যূ প্লিজ থিঙ্ক অ্যাবাউট বিরিভমেন্ট থেরাপি? বিলিভ মি ইট উইল হেল্প। অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট সারাহ দেখা হলেই তাগাদা দিচ্ছে।

 

পাঁচ

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতেই এবার সিকমোর কিংবা মেপল ঝরছে। বাতাসে কেমন টান টান ভাব। টান টান ভাব সারা অবয়বে, আশ্বিন-কার্ত্তিকের দুপুরে ফুল কপি আর কৈ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে নরম রোদে ভরা বারান্দায় “রিদয় নামের সেই হৃদয়হীন ছেলেটি…” পড়ার সময়ে যে টান টান ভাব হতো শরীরে, ঠিক তেমন একটা মিহি আবহ চারপাশে, ধরা যায় আবার যায়না। কেমন যেনো একটা ঘ্রাণ, যেনো আলমারি থেকে গরম কাপড় বের করে মা রোদে দেবে শীঘ্রীই, ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে সারা বারান্দায়, বিকেলের রোদ কমজোরি হতে শুরু করার আগেই রেলিং থেকে মা তুলে নেবে লেপ, আচারের বোয়েমগুলো সারে সারে রোদ পোহাবে সারাদিন, সন্ধ্যা হবার আগেই মা চানু-হেনার চুল বেধে দেবে কষে, তারপর মুড়ি মাখা আর আদা-চা…। এইসব ছবির পাশাপাশি শব্দও ভেসে আসে বহু বহু দিনের ওপার থেকে, “হাউ’জ দ্যাট!”, পাড়ার ছেলেরা ক্্িরকেট খেলছে বড় মাঠে। দু’গ্র“পে খেলা হচেছ , কিশোর গ্র“প আর বড়দের গ্র“প। আরেকদিকে ছোট মাঠে খেলছে মেয়েরা-চানু, নুসরাত ওরফে নিশু, নিশুর ছোটবোন মিশু, হেনা (দুধ-ভাত), ঘোষ পাড়ার পল­বীদি, গাজী পাড়ার বিলকিস আপা আর সুমি আপা, দিনা আর রতœা-এরা খেলছে বৌ ছি, “ছি বুড়ি ছাইয়া, বাবুলের মাইয়া, ছি বুড়ি ছাইয়া, বাবুলের মাইয়া, ছি বুড়ি ছাইয়া, বাবুলের মাইয়া, বাবুলের মাইয়া, বাবুলের মাইয়া, মাইয়া, মাইয়া, মাইয়া…” সুমি আপার খুব দম চানু ছুটে পারে না, সুমি আপা বুড়ি বানিয়ে দেয়। মা কোথায় যাচেছ? বড় মাঠের পাশে ছোট মাঠ, ছোট মাঠের শেষে শুরু হয়েছে কোলা…মা নম্র ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে ছোট মাঠের কিনার ঘেঁষে ঘোষ পাড়ার দিকে, সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মা’র সাদা ধবধবে ছোট্ট কুন্ঠিত পা দুটো যেনো হেঁটে শেষ করতে পারছেনা ওইটুকুন দূরত্ব। চানু জানে মা হাঁটছে  ঘোষ পাড়ার দিকে, কিছু টাকা ধার করার জন্য, নাহলে পরদিন বাজার হবেনা। চানুর বাবার মনি অর্ডার এখনো এসে পৌঁছয়নি, পৌঁছে যাবে দু’একদিনের মধ্যেই অবশ্য। চানু ছুটে মা’র কাছে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়। মা চানু বা হেনাকে সাথে না নিয়ে কোথাও যায় না, কিন্তু চানু খেয়াল করেছে ঘোষ বাড়ির মাসিমা’র কাছে টাকা চাইতে গেলে মা একাই যায়, চানু শুধু একবার দেখে ফেলেছিলো শেফালিদের বাড়ি সন্ধ্যামালতির ফুটে ওঠা দেখতে গিয়ে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল তো, মা’র ভয় করবে না? দোতলার কাঠের রেলিং-এ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতেই চানু দেখে মাঠের সেই একই কিনার ঘেঁষে মা হেঁটে হেঁটে আসছে, কত সময় ধরে! মা’র মাথার কাপড় বাতাসে ফুলে ফুলে উঠছে, অনেকবার ধোয়ার কারনে পাতলা হয়ে গেছে শাড়িটা। আকাশভরা তাঁরা, সন্ধ্যাদির বলা ধাঁ ধাঁ “এক থাল সুপারি, গোনতে পারে কোন ব্যাপারী”র মতোই আকাশজোড়া। মা’র ছোট্ট পা দুটো কখন মাঠ থেকে আকাশে  উঠে গেলো আর কখনই বা ঘরে ঢোকার দরজার সিঁড়িতে রাখা বালতির জলের পাশে দাঁড়ালো! পা ধুয়ে মা হেঁটে আসছে কাঠের সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায়, হেরিকেনের অল্প আলোয় কাঠের পাটাতনে মা’র পা হাঁটছে এক রুম থেকে আরেক রুমে-জানালা বন্ধ করার জন্য, মা আবার সিঁড়ি ভেঙ্গে নামছে রাতের খাওয়ার আয়োজন করতে…কল্পনা, আর য়্যূ ওআম ইনাফ? মিসেস গার্ডনার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালে। কাম অন ডার্লিং, এ্যাট লিস্ট ট্রাই সাম টি, য়্যূ মাইট ফিল বেটার।

 

-তুই তহন খুব ছোট চানু, নিখিল কলেজে যায়, অখিল মেট্রিক দেবে, অন্যরা স্কুলি যায়, সব পিঠাপিঠি। বাড়িতে এক জামাই থাকে তোমার বাবার গ্যাতি ভাইয়ের জামাই, এক বোচ্ছরের উপর থাইকা চাকরি খোঁজে, আর অতিত-বতিতের তো কামাই নাই, যে  যেখান দিয়া আসে গ্যাঁট হইয়া বসে। একবার আইসা উঠলি পোনারো দিনির আগে যাওয়ার নাম কেউ করে না। আর তোমার বাবার অফিসের অফিসার, কেরানি, সমিতির লোকজন যে আসে তারেই ভাত খাওয়াইয়া দিতি হবে। বুকের ভেতার সব সোমায় তরাস থাকতো, এইডার পর এইডা করবো। তোমার বাবার মুখ দিয়া অর্ডার পড়ার দেরি হইতে পারে কিন্তু অর্ডার তামিল হইতে এক মিনিট দেরি হইতে পারবে না, কথা মুখ দিয়া পড়ার সাথে সাথে কইরা দিতি হবে। মানে লোকটা যা করিছে সারা জীবন, আমি দেইখা ঘর কইরা গেলাম। তহন শীতের দিন, সকালে তোরে রোদি শোয়ায় রাইখা রান্না ঘরে ঢোকতাম চুলা ঠেলতি, সে চুলা আইজকার মতো আধুনিক চুলা না, তহন গ্যাস হয় নাই, কাঠের চুলা, চুঙ্গা ফুয়াইয়া আগুন ধরাতি হয় আর তুই খুব ঠান্ডা ছিলি, রোদির ভেতার ওম পাইয়া ঘুমাইয়া থাকতি, সব কাজ সাইরা তো তোর কাছে আসফো। তোর দিদিমা আইসা তোরে দেইখা চমকাইয়া কয়, করিছিস কি? সোংসারের কাজ করবি দেইখা মাইয়াডার দিকি এট্টু নজর দিবি না? তোর মাইয়ার পাও তো পুইড়া গেছে। হইছে কী, তোরে রোদি শোয়ায় রাখতাম কাঁথা দিয়া ঢাইকা, তোর গা ঢাকা থাকতো কিন্তু পাও যে কাঁথার বাইরে থাকতো তা খেয়াল করার সোমায় ছেলো না, রোদি পুইড়া পা কালা হইয়া গেছে, এর মধ্যি তুই যে একটু লম্বা হইয়া গিছিস তাও আমার চোখি পড়ে নাই, এমনই সংসারের চাপ…

 

চানু ইদানিং বেশ হালকা বোধ করছে। শুরুর দিকের সেই দমবন্ধকরা ভার কেটে যাচ্ছে, চাইলেই চানু মা’র সাথে যোগাযোগ করতে পারে এখন । মা’র এতো কথা চানু এর আগে কখনো শোনেনি, সুযোগই ছিলো না। চানু ছিলো পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত আর মা ব্যস্ত সংসার নিয়ে। এমা আর ওলগা এর মধ্যে কয়েকবারই ছবি দেখতে নিয়ে যেতে চেয়েছে, চেয়েছে কোথাও ঘুরতে যেতে দূরে। আগে হলে খুশিই হতো কিন্তু এখন ঢের বেশি আনন্দ মা’র কথা শোনায়, যেনো এক ধরনের কথা বলাই, এ এক নতুন জগত। হয় মা’র কথা শুনে নয়তো যুক্তি সাজিয়ে দিব্যি সময় কেটে যায়। যুক্তি বলে এমন আর কী খারাপ ছিলো মা’র জীবন? একটা সময় খুব অভাব আর কষ্ট গেছে একথা ঠিক কিন্তু এই তো গড়পড়তা বাঙালি মায়েদের জীবন। বরং মা’র ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত, যে যেখানে আছে ভালোই আছে, দেশ-বিদেশও ঘুরেছে মা খানিকটা, মন্দ কী? অথচ যখন কথা হয় মা’র সাথে, যোগাযোগ হয়, তখন মা’র ক্লান্ত অনিশ্চিত মুখটাই ভেসে ওঠে, সেখানে প্রশান্তি নেই। কেনো যে! কিংবা কে জানে প্রশান্তি হয়তো ছিলো একসময়, চানুর মনে নেই, তারপর পাল্টে গেছে, “কূয়ার ব্যাঙরিও যদি খোঁচাও, খোঁচাতি থাকো, সেও একসোমায় না একসোময় ঘাও দেবে”, একথাও তো চানু মা’র কাছেই জেনেছে। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সে তিলোত্তমা, দুর্গেস নন্দিনী, কপাল কুন্ডলা আর রক্ত করবী পড়া জগত থেকে সটান বিয়ে আর সে বিয়ের প্রবল বাস্তবতায় ত্যক্ত মা তার ঠিক প্রশান্ত হবার মতো অবকাশ খুঁজে পায়নি বুঝি শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত- ঢাকার প্রায় সবকটা জাতীয় দৈনিকের পাতায় নিজস্ব পরিচয় আর ঠিকানাহীন, অস্পষ্ট ছবিসহ এক চিলতে মামুলি শোক সংবাদ হওয়া অবধি। চানু যুক্তি সাজায়।

 

-আমার বাবার সম্পত্তি ছেলো, খাইছি পরিছি কোনতার কোন অভাব ছেলো না কিন্তু কোনদিন তো হাত দিয়া ধরতি পারি নাই আর তার দরকারও হয় নাই। বিয়ার পর কোনদিন কি পারিছি কোনকিছু নিজির ইচ্ছামতো কিনতি বা তোমাগোই কিছু দিতি? আমার বাবা মরার আগে আমার বিয়ার জন্যি খাট বানাইয়া রাইখা গেছে কিন্তু সেই খাটেই কি ঘুমাইতে পারিছি কোনদিন? তোমার বাবা সেই খাট নিয়া তোলছে তার গ্রামের বাড়িতি। তার ভাইঝি-ভাইবেটাগো সম্বন্ধ আসে, ঘরে কোন ফার্ণিচার না থাকলি কেমন দেহায় আর এক এক কইরা সবাইর বিয়া হইতে হইতে যুদ্ধ আইসা পড়লো। তোমাগো গ্রামের বাড়ি পোড়ার সাথে সাথে ওই খাটও পুইড়া ছাই। এহন বাবার সম্পত্তি পাইছি ঠিকই, কিন্তু আইসা উঠিছি ঢাকা শহরে। আমরা তো আর ইন্ডিয়া যাবো না কোনদিন, মরি বাঁচি এই দেশেই থাকপো। যেদিন কেউ টান দিয়া নিয়া যাবে সম্পত্তি নিক, সেদিন দেখফো। এহন কেন পরের বাড়ি ঝাট দেবো? সোফার কভার ভরতে ভরতে মা বলে চলে, দ্যাখো আমরা তো চিরকাল বাইচা থাকপো না, একটা বাড়ি থাকলি তোমরা ভাই-বুনরা যে যেখানেই থাকো না কেন বৎসরে একবার হইলেও আসতা মা-বাবার ভিটায়, নিজিদির মধ্যি একটা দেখা-সাক্ষাত থাকতো, চাকরি-বাকরির বাইরেও একটা পরিচয় মানুষের লাগে, সবকিছু বাদ দেও মানুষের স্মৃতির মুল্যও কি কম? কিন্তু আমার কথা কেরা শোনবে, তোমরা সবাই ছুটতিছো, মা যেনো হঠাৎই প্রসঙ্গ পাল্টায়, এই যে ঢাকা শহরে এতো বছর আছি, এতো নাটক, কবিতা, গান, অনুষঠান এতো কিছু হইয়া যায়, আমার ছেলেমেয়েরা কি তা বইলা কোনদিন আমারে একবেলা কোথাও নিয়া গেছে? আমি হচ্ছি ঘর ঝাট দেবার কারবারি।

 

-যাই কও মা, তোমাগো অবস্থা আসলে আমাগো মতো কর্মজীবী মেয়েদের চেয়ে ভালোই ছেলো। তোমাগো কাজ ছেলো তো বাসায় আর আমরা কাজ করি ঘরে-বাইরে, সমান। আমাগো কোন বিশ্রাম নাই। ঢাকা শহরে বাইরাইলেই যে ধকল! চানুও প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে।

 

-ও কথা বইলো না চানু। আমার বাপ ছেলো না, ভাই ছেলো না । অল্প বয়সী বিধবা মায়ের ঘরে দুই মাইয়া। আরো সমস্যা বাবার ছেলো সম্পত্তি। তহন মাত্র পাকিস্থান হইছে, আমাগো আর লেখাপড়া হয় নাই। অল্প বয়সি বিয়া হইলো, সাধ-আহ্লাদ ওইখানেই শেষ। পরপর তোমরা নয়-দশজন ভাইবুন হইলা। তোমাগো হাতে তোমাগো জীবন, আর আমরা তো করিছি দাসীবিত্তি। বিয়ার একান্ন বছর পর আইজও তরকারির স্বাদ-গন্ধ একবেলা একটু ইদিক-ওইদিক হইলে সংসারে কুরুক্ষেত্র বাইধা যায়…যা সহ্য কইরা সংসার করিছি তা কি তোমরা করবা? তোমাগো সাথে আমাগো তুলনা হয় না। মা’র গলা ভার হয়ে ওঠে।

 

এই একটা বড় কষ্টের জায়গা মা’র, চানু জানে। স্কুলের পড়াশুনা হয়নি বলেই হয়তো পড়ার আগ্রহ শেষ হয়নি কোনদিন । চানু এখনই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে অথচ মা যে কেমন করে এই অভ্যাসটা টিকিয়ে রেখেছে আজীবন এক রাবণের চিতার মতো সংসারে, চানু ভেবে পায় না। এই তো সেদিনের কথা, সুনীলের প্রথম আলো পড়ে উচ্ছসিত মা বললো, যাই কও তিন বাড়ুজ্জির পর সুনীলই বাংলা সাহিত্যের সবচে বড় লেখক- সেই সময়, পূর্ব-পশ্চিম, প্রথম আলো কী সব লেখা একটার পর একটা। কেন মা, দেবেশ রায়ের তিস্তা পারের বিত্তান্তের চাইয়াও কি প্রথম আলো ভালো? মা আমতা আমতা করে বলে, আমি অত তুলনা করতি পারবো না তোমাগো মোতন কিন্তু গরীব-দুঃখীরি নিয়া উপন্যাস না লেখলিই যে সেই লেখা ছোট হইলো এ আমি মানবো না। দুঃখের নানা রকমফের আছে-পড় নাই “ জগত দুঃখময়, প্রিয়ের সাথে বিচ্ছেদ দুঃখ, অপ্রিয়ের সাথে মিলন দুঃখ”। মা বলে যায়, দেশ ভাগ হইলো, পূর্ব-পুরুষির ভিটামাটি ছাইড়া মানুষ দেশান্তরি হইলো, আইজও হচ্ছে, তারা কি কোনদিন সেই দুঃখ ভুলতি পারছে? অথচ মিলতি হইলো কার সাথে? কিনা পাকিস্থানের সাথে! সেই দুঃখির জের কি আইজও কাটাইতি পারছি আমরা?  এই যে তুমি বিদেশ দিয়া খাইয়া না খাইয়া প্রত্যেকদিন ফোন কর এ কি শুধু আমাগো সাথে কথা কওয়ার জন্যি না কি দেশরে মিনিটের জন্যি ভুলতি পারো না সেইজন্যি? লাখ-কোটি মানুষের জীবনের দুঃখরে উনি ধরিছেন। হাজার বিন্দুবাসিনীর বিসর্জনের উপর দাঁড়াইয়া আইজকা তোমরা হাঁটো। বাঙালির যে সময়রে যেভাবে উনি ধরিছেন এইডা নতুন তুমি স্বীকার কর আর নাই-ই কর…

 

ছয়

চানুর বাবা বড় সন্তান বৎসল, ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছেন সমান যতেœ  – তোমাগো মা বড় ঘরের মেয়ে কিন্তু বিয়ার পর যখন দ্যাখলাম তোমার মা’র যে-কোন সামান্য প্রয়োজনেও আমার কাছে হাত পাততে হয় সেইদিনই ঠিক করছি, ঠাকুর আমার যদি কোনদিন মেয়ে হয় তা’হইলে তাগো সাফিসিয়েন্টলি প্রতিষিঠত না কইরা আমি বিয়া দেবো না। মনে আছে চানুর, মাস্টার্স পরীক্ষার ঠিক দু’দিন আগে বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। জ্ঞান ফিরলেই তার প্রথম কথা চানু যেনো কোন অবস্থাতেই পরীক্ষা বাদ না দেয়। আর প্রথম পরীক্ষা দিয়ে বাবার সাথে দেখা করতে গেলে বাবা এক ফাঁকে দুর্বল গলায় বললেন, আমাকে কিন্তু মা একটা কথা দিতে হবে, কী কথা বাবা? চানুর ভয় ভয় করে, বাবা বুঝি বিয়ের জন্য বলবেন। দুপুরের কড়া রোদে কেমন আবছা রেখা জানালার বাইরে-চোখ ধা ধা করে, পিজির ছয়তলা কড়িডোর সুনসান, ফ্যানের শব্দ দূরের কোন বারান্দায় মিলিয়ে যেতে থাকা চটির আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠছে, ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বাবা মাথা তোলেন একটু, মাস্টার্স ডিগ্রি কিছু না মা, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে, কথা দাও, বাবার চোখে জল। খাঁ খাঁ দুপুরের স্মৃতি আছে মা’র সাথেও, তুঁতেরঙা শাড়িতে মেটে পাড়, মা চুঙ্গা ফুকায়, কাঠ ভেজা, মা’র চোখ লাল, স্মৃতির গন্ধ যদি খাঁ খাঁ রোদে গাব ফুলের ঘ্রাণ স্মৃতির শব্দ তাহলে আবুল ফেরিওয়ালার ডাক-

 

-পুরানা কাপড়, ভাঙ্গা শিশি-বোতল, হাড়ি-কড়াই-গামলা-বালতি আছে গো আম্মা!  পুরানা কাপড়, ভাঙ্গা শিশি-বোতল, হাড়ি-কড়াই দিয়া নতুন হাড়ি-কড়াই-গামলা-বাটি লইয়া লন গো আম্মা! আছে পুরানা কাপড়, ভাঙ্গা শিশি-বোতল, হাড়ি-কড়াই-গামলা-বালতি আছে গো আম্মা! … দুপুর রোদে দাদারা স্কুলে, বাবা অফিসে, গলায়-ঘাড়ে পাউডার মাখানো ছোট্ট হেনা হাতকাটা নীল গেঞ্জি গায়ে ঘুমাচ্ছে। ফেরিওয়ালার সুরেলা ডাক ফিকে হয়ে পাড়া ছেড়ে যাবার আগে আগেই মা চানুকে বলে ফেরিওয়ালাকে ডেকে আনার জন্য।

 

– কী কও আবুল, এতোগুলান পুরানা কাপড় দেলাম, একটা ডেকচি দেলাম, একটা গামলা দেলাম তাও তোমার ওই ছোট্ট কড়াইডা কেনা যাবেনা? থাক থাক তুমি যাও। মা’র মুখটা কালো হয়ে যায়।

 

-আম্মা, মোর উপার রাগ হইলে কাম অইবে না, ওজনে না বনলে মুই কী হরমু? ওই ভাঙা শিশি-বোতলগুলান দেলেই তো ফাকডু সাইরগা যায়। আবুল ফেরিওয়ালা চানু-হেনা-বিলু-অপুর কটকটি খাওয়ার জন্য গুছিয়ে রাখা শিশি-বোতলগুলোর দিকে লোভী চোখ বাড়ায়।

 

-না, না, বলিছি তো কেনবো না, তুমি যাও।

 

-ও মা, দিয়া দেও না, কী সুন্দার কড়াইডা। চানু শিশি-বোতলগুলো এনে মা’র পাশে রাখে।

 

কড়াইটা নিয়ে মা পুরানো এক ট্রাংকের ভেতর ঢুকাতে ঢুকাতে চানুকে বলে, “খবরদার, তোমার বাবা আসলেই যেনো কইতে যাইও না, তুমি তো আবার খবরি, পেটে কোন কথা রাখতি পারো না। কয়দিন যাক, আমিই বলবো। কী কষ্ট কইরা যে ফুটা কড়াইয়ে রান্না করতি হয় সে শুধু আমি জানি, আটার পট্টি কি আর বেশিক্ষণ থাকে!…পুরুষ মানুষ তো রান্না খাবার পাইলেই হইলো, না পাইলে দাপট, কেমন কইরা কী হয় সেই খবর কেরা রাখে…” মা গজ গজ করতে করতে নীচে নেমে যায়।

 

এতদিন পরেও চানু বেশ মনে করতে পারে, বাসায় একজন অতিথি এলেই বাবার সে কী হাঁক-ডাক পড়ে যেতো, …এই কাপ কেন…?  আর মা সুজি রান্না শেষ করে প্লেটে গ্লাসগো বিস্কুট সাজাতে সাজাতে চুপিচুপি চানুকে বলতো বড়দির সাথে নিশু-মিশুদের বাসা থেকে কাপ-প্লেট ধার করতে যেতে। চানু অনেক ভেবেছে, কাপ-প্লেট না কিনতে পারার জন্য বাবাকে কোনভাবেই দোষ দিতে পারে না। সব ভাইবোন পড়াশুনা করছে তখন, অতি সৎ সরকারি চাকুরে বাবা । কালো একটা প্যান্ট আর কলারের কাছে পলেস্তারা খসে যাওয়া সাদা শার্ট পরে সপ্তাহে ছয়দিন অফিস করেন। অফিস শেষে ক্লান্তিতে মাথা নীচু করে কতটা পথ হেঁটে বাসায় ফিরেই সবার পড়াশুনার তদারকিতে বসে যান। কিন্তু বাবার তো জানাই ছিলো বাসায় কাপ-প্লেট নেই, তাহলে ? …“একের পিঠে দুই, চৌকি চেপে শুই, শান বাঁধানো ভূঁই, ইলশে মাগুর রুই, পোটলা বেধে থুই …কাঁদিস কেনো তুই?”…কোনদিন যদি চানু ছড়াটা ঠিকমতো মনে করতে পারে!

 

সাত

সামারে মণীষা এলো ওর মা-বাবাসহ, মাত্র দু’দিনের জন্যই। কী যে অসহ্য লাগে রান্না করতে! ওভেনে রান্না চাপাতে চাপাতে, খাবার টেবিলে সাজাতে সাজাতে মা’র জন্য বুকটা মুচড়ে ওঠে। তাতানো কড়াইতে মাছ ছাড়ছে মা, কেমন ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারদিক, চোখ অন্যদিকে সরিয়ে সেই ধোঁয়ার মধ্যেই দিব্যি মাছ ভেজে তুলছে মা- মণীষা তো চানুর ভালো বন্ধু, গত বছর যখন এসেছিলো কী আনন্দেই না কেটেছে সে’সময়টা অথচ এবার এতো দুর্বিসহ বোঝা মনে হচ্ছে!

 

-বেগুন ভাজা, পটল ভাজা, করলা ভাজা, নাইরকেল দিয়া ছোলার ডাইল, মুগির ডাইল আর রুই মাছের মাথা দিয়া মুড়িঘণ্ট, ইলিশ মাছের মাথা আর কাটাকোটা দিয়া আলুর সাথে একটা তরকারী, ফুলকপি আর আলুর দোলমা, সরিষা ইলিশ, রুই মাছের কালিয়া, মুরগীর মাংস, আমড়ার চাটনি, সালাদ, পায়াস-এই মোট তেরো পদ হবে। মা হাতের কড়া গুনতে গুনতে বলে। কেউ একটা-দেড়টার আগে খাবে না কিন্তু তোমার বাবা তো বারোটা না বাজতিই আমারে ত্যক্ত কইরা তোলবে। বাজার আসলোই নয়টার পরে। এতোডি জিনিস কাটা-বাছা-রান্ধা তো মুখির কথা না। ঘরে একজন অতিত আসলি তোমার বাবা যেনো অন্য মানুষ হইয়া যায়! একটু যে সুস্থ মোতো রান্ধবো, অতিতগো সাথে যে দুইটা কুশল বিনিময় করবো তার তো উপায় নাই, ঘন ঘন তোমার বাবা আসতি থাকপে, চাখতি থাকপে, চোখ রাঙ্গাতি থাকপে, মানে শুরুতেই মনডা নষ্ট কইরা দেয় লোকটা…মানুষির বাসায় দেখি অতিত-বতিত আসার আগে স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যি একটা আলাপ-আলোচনা হয়, কিন্তু এ সংসারে তা কোনদিন পাবা না, শুধু হুকুম তামিল…

 

দোতলার কাঠের পাটাতনের ছোট্ট ফুকো দিয়ে চানু দেখে, “রশীদ সাহেব, চা তো হয় নাই, এই আর কি গরম জল… সে কি পিঠা আবার একটা রাইখা দেলেন ক্যান, খাওয়া যাচ্ছে না, না?”। ওদিকে ফ্যাকাসে-মুখ মা’র শিরা ওঠা হাত ঢলঢলে শাখা সেপটিপিনসহ ত্রস্ত রান্নাঘরে, মা গো! অচিন এক ঘ্রাণ আচছন্ন করতে থাকে চানুকে, মাথার ভেতর দপদপে লাল-নীলের ফুলকি, মা’র ফিকে স্বর ফিরে ফিরে আসে –

 

-আমার বড় সহ্য চানু। মানুষ একজন সৎমা’র ঘর করতি পারে না, আমি দুই-দুইজন সৎমা’র ঘর করিছি। তারপর বিয়ার পরে দোতালা দালান ছাইড়া নাইমা আসলাম কাঁচা মাটির ঘরে। দুইডা ভাত-কাপড়ের জন্যি তো কম যন্ত্রণা সহ্য করি নাই। নিখিল- অখিল-কল্যাণী জন্মানো পর্যন্ত তোর বাবার চোখের দিকি চাইতে পারি নাই কোনদিন। কেমন ভয় ভয় করতো। শ্বশুর বাড়ির লোকজন যে যন্ত্রণা দেছে! শুরুতে তোমার বাবার বেতন ছেলো মোটে নব্বই টাকা। রাস্তা দিয়া লোক ডাইকা আইনা খাওয়াইয়া তোমার বাবা নাম কিনিছে কিন্তু খাটতি তো হইছে আমার, উপাস দিতি হইলেও আমারই দিতি হইছে। কতোসময় গা-হাত-পা কাপতো, আবার যে দুইডা ভাত ফুটাইয়া খাবো, সে শক্তি থাকতো না দেহে। ঘরে বাজার ফেলাইয়া হুকুম হইছে কোন মাছের সাথে কোন তরকারী কী মসল­ায় রান্না হবে, তার কোন সকাল-রাত্রি নাই। সবকিছু সামলাইয়া ঘর করিছি, না কইরা আমাগো উপায় ছেলো না। মাথার উপর বাপ ছেলো না, ভাই ছেলো না, লেখাপড়া হয় নাই, ঘর করতি না পারলি সবাই ছি ছি করতো আমার মা’রে…

 

আট

অক্টোবরের মাঝামাঝি পুরো দস্তুর শীত পড়ে গেছে। সকাল-বিকেল চানু যাওয়াআসা করছে পায়ের নীচে ঝরা পাতার বিছানা মাড়িয়ে, ইস দেশের পাতাকুড়ানি মেয়েদের যদি এখানে এনে ছেড়ে দেয়া যেতো! গত বছর চানু দেখেছে অক্টোবরের শেষ থেকে মাঝ নভেম্বর পর্যন্ত কয়েক দফায় মিউনিসিপ্যালিটির ঢাউস গাড়ি ততোধিক ঢাউস ব্রাশ চালিয়ে পাতা কুড়িয়ে পরিস্কার করেছে রাস্তা। সেদিন সারাদিন সূর্যের আলো ছিলো, মাঝ অক্টোবরের পরে এধরনের দিন খুব স্বাভাবিক না  এখানে।   একটু তাড়াতাড়িই বের হয়েছে চানু ডিপার্টমেন্ট থেকে । বাসার কাছাকাছি আসতেই  সূর্যের শেষ আলো কেমন শরীরটা ছুঁয়ে যায়, পায়ের নীচে মশ্ মশ্ পাতা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে  কোন কারণ ছাড়াই বুকটা মুচড়ে ওঠে- সেই কোন ছোটবেলায় চানু-হেনা গান শিখেছিলো, “…চাইলো রবি, শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে…”। চানু-হেনা হাত ধরাধরি করে রাঙ্গামাটির লেকের পাড় দিয়ে আর কোনদিনই হাঁটবে না বল-প্রিন্টের জামা পরে। কী আহ্লাদীই না ছিলো হেনাটা, কোন কারণে মন কষাকষি হলে চানু যদি ছোট্ট হেনাকে মরে যাওয়ার ভয় দেখাতো, একটুও না ঘাবড়ে দিব্যি চটপট উত্তর দিতো হেনা, “অসুবিধা নাই, আমি রোজ বেগুন গাছে জল দেবো, তা হইলেই তো আরেকটা ছোড়দি পাবো।” হেনা এখন মস্ত হয়েছে, এমনকি মা পর্যন্ত দিব্যি হেনাকে ছেড়ে এখন চলে যেতে পারে, পায়ের নীচে  পাতার শব্দ মশ্ মশ্…“একের পিঠে দুই, চৌকি চেপে শুই…”

 

-বিয়ার পরে প্রথম এক-দেড় বছর মা’র কাছেই থাকিছি, তারপর তোর বড়দা হওয়ার পর তোর বাবা আমাগো নিয়া গেছে বিনোদপুর, উঠাইছে এক সাউ কর্মকারের বাগান বাড়িতি। মাটির ঘর, চারিদিকি গাছ-গাছালি, আশে-পাশে দুই-একটা ঘর আর শিয়ালির উপদ্রব।  পাতা পইড়া পইড়া সারা পাড়া যেনো একটা পাতার বড় বিছানা। ওই যে দুই-একটা ঘর কইলাম, ওইসব ঘরের সবাই সন্ধ্যা না হইতেই খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ে । তোর বাবা সন্ধ্যায় যায় মেলা দূরির ক্লাবে। আমি নিখিলরি ঘুম পাড়াইয়া একটা গল্পের বই নিয়া পড়তি থাকি আর তোর বাবার জন্যি অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতি করতি ঘুমি চোখ জড়াইয়া আসে, আর কেউ একজন উঠান দিয়া হাটলিই মশ্ মশ্ শব্দ, মনে হয় মাথার উপার দিয়া হাইটা যাচ্ছে। শিয়ালির হুক্কা হুয়া, তোর দিদিমা নিখিলির সাথে খেলার জন্যি সাত আট বচছরের  দুলাল নামের একটা ছেলেরে দেছে আমার সাথে। বাচ্চা মানুষ সেও সন্ধ্যা না হইতেই খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ে। আমার ভয় করে, তোর দাদুর বাড়ি তো গমগমা, শহরির মধ্যি, কত মানুষ! কলের গান চলে… আর এই বাগানে কেউ একজন হাঁটলি মশ্ মশ্ শব্দ হয় আর আমি দুলালরে ডাকি, ও দুলাল। দুলাল দিব্যি ঘুমের মধ্যি কইয়া ওঠে, ভয় নাই দিদি, আমি আছি তো…তোর দিদিমা প্রথম যেবার আসলো, নির্জন বাগানির মধ্যি মাটির এই ঘর দেইখা তো তার ভয়েই কম্ম কাবার, কয় যে তোর এইখানে থাইকা কাম নাই। পরদিন নিজেই সব বান্ধা-ছান্দা কইরা নিয়া গেলো বাড়িতি …

 

-মা, আমি রোজ কত রাতে ঘরে ফিরি একলা একলা, পায়ের নিচে এই পাতাগুলান মচ্ মচ্ করে, একলা ঘরে ঢুকি, ঘরটা খুব ঠান্ডা হইয়া থাকে, কিন্তু মা,  আমার তো ভয় করে না, তোমার এতো ভয় ছেলো কেন? তুমি বোধহয় মা “বৈদ্যুতিক বাতি ভূতের ভয় তাড়িয়েছে” বইটা পড় নাই। চানু কথা চালিয়ে যায়।

 

সেই রাতে স্বপ্ন দেখে চানু, মা একটা পলেস্তারাহীন নতুন ইটে গাঁথা ছোট্ট  ঘরে দাঁড়ানো, যেনো সেই ঘরটা ঠিক মা’র মাপে বানানো বা মা যেনো একটা কংক্রিটের লাল-কালো ফ্রেমের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে, সিঁথিতে কোন সিঁদুর নেই, একটা রঙহীন শাড়ি পরা, চুলগুলো খোলা, মুখে সেই চেনা কষ্টের ছাপ।

 

-মা, তুমি ওইখানে দাঁড়ানো ক্যান? বাইরে আসো।

 

তবুও মা ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকে, চোখের পাতা নড়ছে কি না বোঝা যায় না। এটা যে একটা স্বপ্ন তা বুঝতে চানুর বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। পিপাসায় গলা শুকিয়ে গলা ব্যথা করছে। রাত সাড়ে তিনটা। তার মানে বাংলাদেশে এখন সবাই কাজে ব্য¯ত, ফোন করে লাভ নেই। এতোদিনে এই প্রথম চানু স্বপ্নে দেখলো মাকে। ড্রয়ার খুলে উদভ্রান্তের মতো মা’র চিঠি পড়তে থাকে, “… শরীর সওয়ায় কাজ করো, এতো তাড়াহুড়ার কিছু নেই- আগে তো জীবন; পড়াশুনা, ডিগ্রী সবই জীবনের জন্য। স্কলারশিপ শেষ হয়ে গেলে চিšতা করো না, টাকার দরকার হলে আমাকে জানিও, আমি পাঠাবো।” আরেক চিঠিতে লিখেছে, “ … দিনে অন্তত একবার ভাত রান্না করে খাবি, আমাদের বাঙালি শরীর, রুটি-মাখনে চলেনা।” আরেক চিঠিতে, “…চানু মা, জীবনটা একা কাটানো যায় না, একজন সঙ্গীর দরকার হয়। তুমি তো আর কারও অধীন হবে না, জীবনের চলার পথে যদি কাউকে পছন্দ হয় সে সাদা-কালো, বাঙ্গালী, আমেরিকান, ইংরেজ, জাপানী, চাইনিজ যাই হোক তাকে সঙ্গী করে নিও, বাসার কেউ বিরোধিতা করলে বলো মা’র অনুমতি আছে।” আর শেষ যে চিঠি সেখানে লেখা, “যেখানে যেখানে ঘোরার সুযোগ পাও ঘোরবা। আমরা যে যে জায়গায় যাই, যেসব মানুষের সাথে মিশি, যেসব দৃশ্য দেখি তাই-ই আমাদের জীবনের সঞ্চয়। যদি কোথাও একটা সুন্দর দৃশ্য দেখে মনে হয়, বা বেশ তো! ভগবান না করুক জীবনে যদি কোনদিন কষ্ট আসে কোন, যদি একা মনে হয় দেখবা তোমার দেখা ওই দৃশ্য তোমাকে বাঁচতে সাহায্য করবে। ভগবানের ইচছায় তুমি তো পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়ানোর সেই সামর্থ অর্জন করেছ, কয়জন মেয়ে তা অর্জন করতে পারে আকাংখা যতই থাক? কত ধনী ঘরের মেয়ের ধনী লোকের সাথেও যদি বিয়ে হয় কিন্তু নিজের ইচছা মতো ঘুরে বেড়ানোর সামর্থ আর হয় কই? …” আশ্চর্য, এই চিঠি প্রায় বছর খানেক আগের, কই সে’সময় পড়ে তো নিজের সামর্থহীনতার জন্য মা’র এই হাহাকার চোখে পড়েনি!

 

-হ চানু, অপু ঠিক ওইরকম একটা সমাধির নকশা করছে মা’র জন্যি। অপুরও খুব মন খারাপ এই নকশা করতি যাইয়া। হ রে, মা ওই শাড়িই পরা ছেলো আর কপালে কোন সিন্দুর ছেলো না। বড়দির গলায় দুপুর রোদে হাকালুকি হাওড়ের হাওয়া।

 

চানুর জ্বর বাড়ে হু হু করে । একশ চার পর্যন্ত চানু জানে। মা পাশে বসে, মাথায় হাত বুলায়, চোখে সেই বরাবরের উদাসীন দৃষ্টি কিন্তু মা তো এতো ভালো হাত বুলাতে পারে না! ভালো হাত বুলায় তো বাবা। আর তা ছাড়া মা’র হাত তো এতো নরমও না, বেশ খসখসে। এ তো সেই খসখসে হাত না! মা, তুমি মোটে কয় মাস কাজ কর নাই তাই তোমার হাত এতো নরম হইয়া গেছে! ও কি, চইলা যাচ্ছো ক্যান? না তো, মা তো পাশে বসে নেই, মা তো ওই ফ্রেমের মতো ছোট্ট ঘরটাতেই দাঁড়ানো, সিঁথিতে কোন সিঁদুর নেই, একটা রঙহীন শাড়ি পরা, চুলগুলো খোলা, মুখে সেই কষ্ট। হেনা যে বললো মা’র পা দুটো পুড়ে গেছে, কই? মা’র পা দেখার জন্য চানু তার ভারি মাথাটা উঁচু করে, কিন্তু কার্ত্তিকের জ্যোৎস্নায় দেখা সেই পা দুটো দেখতে পায় না। শুধু মাথাটা ঠক করে বাড়ি খায় খাটের বাজুতে। ভালো হইছে মা, তোমার পোড়া পা তো আমি দেখি নাই কোনদিন না কোনদিন আমি আবার দেকতি পারবো তুমি কার্ত্তিকের শিশির ভেজা মাঠ পারাইয়া হাইটা আসতিছো। জানো মা, বড়দার বাসায় না আবার শৌলা বেগুন হইছে। কিন্তু হইলে কী হবে, আমন চাইলের লাল ভাত তো আর পাওয়া যাবে না ওইদেশে। আর বড় দাদুও তো বাঁইচা নাই যে তোমারে লাল আমনের মিষ্টি ভাতে শৌলা বেগুন মাইখা খাওয়াবে।

 

ছোট্ট একটা মেয়ে, রংটা বড় চোখে লাগে, কটা চোখ, কটা লম্বা চুল আর বিষাদভরা মুখ। কোথায় যায়? বড় রান্নাঘরের পাশে শিউলি ফুলের স্তুপ থেকে মেয়েটা ফুল কুড়াচ্ছে। কয়টা ফুলই বা আর কোচড়ে তুলতে পারে? মা-বাপ মরা এই গোমড়ামুখো মেয়েটা যেনো আবার পুকুরে ডুবে না যায় সেজন্যই তো ওই বড় পুতুলটা ঘাটলার একেবারে শেষ সিঁড়িতে রাখা, নিঃসন্তান জেঠা জেঠি রেখেছে। মেয়েটা আস্তে আস্তে কোচড়ের ফুল সামলে নামছে সিঁড়ি বেয়ে, কিন্তু পুকুরে তো জল নেই ! খামকা পুতুল দেখে ভয় পাবে। “ও মা, খালি পায়ে আর নাইমো না…কাটা ফোটপে তো পায়, তোমার না ডায়বেটিস?” কেমন বিষন্ন চোখে, ভয়ে ভয়ে ঘুরে দাঁড়ালো মেয়েটা আর ওখানেই সেই ছোট্ট ফ্রেমের মতো ঘরে বন্দি হয়ে গেলো। এ কি করলো চানু, আবারো ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়া? ঘেমে নেয়ে উঠে বসে চানু- ওইটুকুই তো তার জগত, দালান, শিউলি গাছ আর পুকুর-সেই পুকুরেও তো বিছিয়ে দেয়া ভয় আবার সেও ভয় দেখালো কাঁটা ফোটার? তাহলে সে আর হাঁটবে কীভাবে? “কত দুঃখ দাও গো দয়াল, দুঃখ কে আর নেয়ার আছে…” মা’র গলায় শোনা একমাত্র গানটা জীবনে এই প্রথমবারের মতো গেয়ে ওঠে চানু, তবুও, না, মা তো ধূপবাতি হাতে নিয়ে নীচু গলায় এই গান গেয়ে রুমে রুমে ধোঁয়া দিতে যাচ্ছে না! সন্ধ্যা কি তা’হলে হয়নি এখনো! চানু গায়, “কত দুঃখ দাও গো দয়াল, দুঃখ কে আর নেয়ার আছে…”, একবার, দুইবার, বহুবার…“ও মা”, উঁচু গলায় ডাকে চানু, “ সন্ধ্যাবাতি দেবা না, আজান পড়ছে কোন সময়!” চানু গেয়েই চলে, “কত দুঃখ দাও গো দয়াল, দুঃখ কে আর নেয়ার আছে…”

 

নয়

-রিলাক্স, রিলাক্স কল্পনা…য়্যূ নিড টু কালেক্ট ইয়োরসেলফ, জাস্ট নিড টু টাইডি আপ ইয়োরসেলফ অ্যা বিট, প্লিজ ট্রাই টু কনসেনট্রেট, ওয়েল… ট্রাই টু কনসেনট্রেট টু ইওর মাম’স টাইনি ফিট দেন, সি ইজ কামিং ট্রুয়ার্ডস য়্যূ… সী… টা-ই-নি ফিট…

 

দশ

কাউন্সিলিং প্রতি সপ্তাহেই নিচ্ছে চানু আর হয়েও তো গেলো মেলা দিন। এমন না যে চানুর জগত থেমে গেছে, চানু সম্পূর্ণ সজাগ, এমনকি স্বপ্নের মধ্যেও বুঝি যুক্তি হারায় না। শুধু দুটো পরিস্কার জগত তৈরি হয়েছে, এক জগতে চানু প্রতিদিনকার ব্যস্ত চাকুরে আর অন্যদিকে সেই জগতের ভেতরেই তার মা’র জীবনের সাথে একাকার এক মেয়ে, চানু চলে তার মা-ও চলে, চানু এমন দৃশ্যও দেখতে পায় যা তার দেখার কথা না, জানার কথা না, এমনকি ঘটলেও ঘটেছে তার জন্মেরও আগে কিংবা হয়তো ঘটেইনি কখনো …হয়তো শুনেছে কোথাও কিংবা শোনেওনি.. যেমন ধরা যাক স্বপ্নে না কি জেগেই চানু প্রায়ই দেখে ইদানীং- কে যেনো তার মা’র রোগা মুখে হ্যারিকেনের গরম এক চিমনি চেপে ধরছে, কে ধরছে বোঝা যায় না-এই জাতীয় কোন ঘটনা সে কখনো শুনেছে বলেও মনে করতে পারেনা। ছবিটা আসে নিগেটিভের মতো, অনেকটা গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবিতে ভুতের নাচের দৃশ্যের মতো, চানু তখন কেমন ঘেমে দুর্বল হয়ে পড়ে, সেদিন মিটিঙে হাত থেকে কলমটা পড়ে গেলো তো চানু আর তুলতেই পারলো না, হাতে কোন সাড় নেই। মস্তিস্ক জুড়ে তখন শুধু গরম চিমনির ছ্যাকা, হয়তো মনোবিকারই, তবু সেই তাপ ওর চামড়ায়ও লাগে যে!

 

হোয়াই ইন নিগেটিভ? ভ্র“ কুঁচকান প্রফেসর ব্রাউন, ১২৩৭ নম্বর কেসটা জটিল হয়েই চলেছে।

 

গার্ডনিং সিজন ফিরে এসেছে বুঝি, আঙ্গিনা জুড়ে আবার চেরির পাপড়ি, সবুজ ঘাসে ডগ ডেইজি। ঘরের দরজা থেকে দ্রুত আঙ্গিনাটুকু পার হয়ে শিরোনামহীন গেট পেরিয়ে রাস্তায় নামে চানু। সেখানেও সারে সারে কুসুমরঙা চেরির আলোয়ান। চেরি দেখে হিজলের জন্য হু হু  করা মনটা আর নেই চানুর। এমনকি বিউটিশিয়ানরা পর্যন্ত বলে পোড়া চামড়ার দাগ না কি সহজে কাটেনা, আর চামড়া পোড়ার যন্ত্রণা? থাক সে প্রসঙ্গ…“যে জলে বাগদী ম’লো, আমায় যে যেতে হলো, চিড়ে দই খেতে হলো… তারপর কী মা?…” চানু আরো দ্রুত হাঁটে, বাস ধরার জন্য কেমন হন্যে মনে হচ্ছে ওকে।

The post সেই ছোট্ট দু’টি পা first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/shei-chotto-duti-paa/feed/ 0
ঠাকু’মার ঝুলির সেইসব বুড়ি, সুয়োরানী এবং রাক্ষসীরা https://kaberigayen.com/thakurmar-jhulir-sheishob-buri-shuyorani-ebong-rakkhoshira/ https://kaberigayen.com/thakurmar-jhulir-sheishob-buri-shuyorani-ebong-rakkhoshira/#respond Wed, 26 Jan 2022 14:18:28 +0000 https://kaberigayen.com/?p=6796 বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মায়ের সুর করে পড়া লক্ষীর পাঁচালী আর মঙ্গলবার সকালে মঙ্গল চণ্ডীর ব্রত-কথা চাল-কলা-নারকেলের প্রসাদের জন্যেও বটে আবার ধূপ-চন্দনের অলৌকিক আবহে মায়ের গলায় পড়া কাহিনীর জন্যও বটে বড় আকর্ষণের বিষয় ছিলো শৈশবে...

The post ঠাকু’মার ঝুলির সেইসব বুড়ি, সুয়োরানী এবং রাক্ষসীরা first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
গল্পের খোঁজে

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মায়ের সুর করে পড়া লক্ষীর পাঁচালী আর মঙ্গলবার সকালে মঙ্গল চণ্ডীর ব্রত-কথা চাল-কলা-নারকেলের প্রসাদের জন্যেও বটে আবার ধূপ-চন্দনের অলৌকিক আবহে মায়ের গলায় পড়া কাহিনীর জন্যও বটে বড় আকর্ষণের বিষয় ছিলো শৈশবে। খেলা যতই থাক না কেন বিশেষ করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লক্ষীর পাঁচালীর সময় মায়ের পাশে উপস্থিত হওয়া চাই-ই চাই। অ-লক্ষীস্বভাবা নারীদের কলহপরায়নতা, কর্মবিমুখতা, গৃহধর্মে অমনোযোগ, আলস্য-নিদ্রায় সতত কাল কাটানো, দেব-দ্বিজে ভক্তি না থাকা, যেখানে সেখানে যখন তখন যাওয়া-আসা করা এজাতীয় অসংখ্য ত্রুটির কারণে মর্ত্যবাসী দুঃখভোগ করে বিভিন্ন কাহিনীর মাধ্যমে এসব কারণ ব্যাখ্যা করে লক্ষীর ব্রতের কৃপায় কীভাবে এসব দুঃখ থেকে পরিবার-পরিজন এবং মর্ত্যবাসীকে পরিত্রাণ দেয়া সম্ভব তার কাব্যিক বয়ান অমৃতসমান মনে হতো। আর মঙ্গল চণ্ডীর ব্রত-কথায় কোনো না কোনো সুলক্ষণা, লক্ষীমন্ত, স্বামী-পরিত্যক্ত দুঃখী নারীর অশেষ দুঃখভোগ এবং শেষপর্যন্ত পাশবিক ধৈর্য, অমানবিক শ্রম এবং মঙ্গল চণ্ডীর ব্রতের কল্যাণে সতীনের কূটকৌশলের জাল ছিন্ন করে স্বামীর সাথে মিলিত হতে পারা, সতীনের জন্য যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করা (যে শাস্তি এই সুলক্ষণা, লক্ষীমন্ত রমণী এতকাল ভোগ করেছে তার চেয়েও কঠোর শাস্তি) এবং ধনে-জনে যশলাভে সুখে সংসার করতে পারার অনির্বাচনীয় আনন্দের অংশীদার হয়ে মনটা আনন্দে তৃপ্ত হয়ে উঠত। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে শিশুমনে অশেষ তৃপ্তির উদয় হবে সেই-ই তো স্বাভাবিক। শেষে প্রাসাদ তো রয়েছেই। কালে-ভদ্রে কোনো এক বিরল সন্ধ্যায় হয়ত মা লক্ষীর পাঁচালী পড়ার কিংবা কোনোদিন সকালে (বড়জোর একবার কি দুবার ঘটেছে এমনটা) মঙ্গলচণ্ডীর পাঁচালী পড়ার ভার তার বালিকা কন্যার উপরই ন্যস্ত করতেন। হয়তো পূজার আসন ফুলে-চন্দনে সুন্দর করে সাজানোর প্রশিক্ষণ দেবার জন্য, কিংবা পাঁচালী-পাঠের পূণ্যে কন্যাকেও শরিক করার জন্য কিংবা অন্য কোনো কাজে নিজের বস্ততার জন্য কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে। সেসব সন্ধ্যায় বা সকালে নিজেকে খুব কেজো মানুষ মনে হতো। একই কাহিনী। ভিন্ন ভিন্ন স্থানের ভিন্ন ভিন্ন নামের সতী-লক্ষীদের সতীনের চক্রান্তে অশেষ দুঃখভোগ এবং অবশেষে ইতর ধৈর্যে-শ্রমে এবং লক্ষীর কিংবা মা-চণ্ডীর করুণায় স্বামীর মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষমতালাভ। ধন-জন লাভ। এসব কাহিনীতে এদের স্বামীদের কর্ম কেবল খল স্ত্রী বা স্ত¿ীদের প্ররোচনায় লক্ষীমন্ত স্ত্রীকে নির্বাসন দেয়া এবং পরে লক্ষীর বা মা চণ্ডীর কৃপায় সেই লক্ষীমন্ত স্ত্রী নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে সক্ষম হলে খল স্ত্রী বা স্ত্রীদের শাস্তির বিধান করা। আদালতের বিচারকরা যেমনটা করে থাকেন। যেনো এসব দুঃখভোগের কোনো দায় তাদের নেই। এসব পাঁচালীর বয়ানে কোন নারী লক্ষীমন্ত? সেই নারীই লক্ষীমন্ত যার জীবনে কোনো বিশ্রাম, সুখভোগের কল্পনা থাকবে না, সূর্যোদয়ের আগে পরিবারের সকলের আগে ঘুম থেকে উঠে উঠোনে গোবর-ছড়া দিয়ে শুরু হবে তার কাজের দিন এবং দন্ডের তরেও বিশ্রাম না নিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে তার কাজ। এমনকি দাস-দাসীরও পরে খেতে যাবেন সতী-লক্ষী এবং বাড়ীর সকলে ঘুমিয়ে যাবার পর তিনি শয্যায় যাবেন এবং “সেবিবে তখন সতী স্বামীর চরণ।”

মা, আমি আর পাঁচালী পড়বো না। বুঝে কিংবা না-বুঝে, ধরেই নিতে হয় না-বুঝে, আট বছরের বালিকা আর কোনোও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লক্ষীর পাঁচালী কিংবা মঙ্গলবার সকালে মঙ্গল চণ্ডীর ব্রতকথা না পড়লেও দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুমার ঝুলি, ঠাকুরদার থলে অসীম আগ্রহে পড়েছে বহুকাল, গল্পের খোঁজে। বালিকা বয়স ছাড়িয়ে, কৈশোরে, তারুণ্যে। এখনকার মধ্যে তারুণ্যে। আসলে রূপকথার মোহ, শৈশবের মোহের-ছন্দের-স্বপ্নের যাদু সহজে ছাড়া যায় না, হয়তো কখনোই ছাড়া যায় না। শৈশবে গরম ভাত বেড়ে খেতে যাবার জন্য মায়ের ডাক যেমন ভোলা যায় না, শীতের সকালে বাবার চাদরের নীচে লিচুতলায় রোদ-পোহানোর স্মৃতি যেমন বিপদে-সঙ্কটে সম্পদ হয়ে আগলে রাখে তার একাকী মেয়েকে, ভোলা যায় না চৈত্রের প্রখর দুপুরে পুকুরে সাঁতার কাটার স্মৃতি ঠিক তেমনি কিংবা তার চেয়েও অনেক বেশি তীব্রতায় কিংবা জীবনের সাথে একাকার হয়ে থাকে আমাদের রূপকথার কাল। খুব অল্পই দিদিমার মুখে শুনেছি গল্প: একদেশে ছেলো এক রাজা আর তার ছেলো দুই রানীÑ সুয়োরানী আর দুয়োরানী। মনটা ছ্যাঁৎ করে উঠত। এখনই শুরু হবে সুয়োরানীর চক্রান্ত আর দুয়োরানীর দুঃখের কাল। গল্পে গ্রহণের কাল। কেনো? রাজার দুই রানী থাকার দরকার কী, এক রানী হলেই তো সমস্ত গোল মিটে যায়। কিন্তু না হলে যে রূপকথা হয় না। রাজা যখন, দুই রানী তো কোন ছার, সাত রানী থাকে!

পড়তে শিখে অবধি ঠাকুমার ঝুলি ছিল শয়নে-স্বপ্নে-জাগরণে কল্পলোকের প্রধান চাবি। বহুকাল।
‘বুদ্ধু আমার বাপ!
কী করেছি পাপ?
কোন পাপেতে ছেড়ে গেলি, দিয়ে মনস্তাপ?
শুকপঙ্খী নায়ের পাছে ময়ূরপঙ্খী যায়,
আমার বাছা থাকলে যেতিস মায়ের এই নায়।’
কিংবা
‘দুয়ারে দুয়ারে মঙ্গল ঘড়া
পাঁচ পল­ব ফুলের তোড়া;
আলপনা বিলিপনা, এয়োর ঝাঁক,
পাঠ-পিড়ী আসন ঘিরে, বেজে ওঠে শাঁখ।’

কী ছন্দ! কী ছন্দ! চারিদিকে ফুল-বৃষ্টি, চারিদিকে চন্দন বৃষ্টি; ফুল ফোটে, খৈ ছোটে, রাজপুরীর হাজার ঢোলে ‘ডুম-ডুম’ কাটা পড়িল। সেই ‘ডুম-ডুম’ কাটা কী শুধুই রাজপুরীর হাজার ঢোলে পড়ে? সে কি শোভা! রাজপুরীর চার-চত্বর দল্দল্ ঝল্ঝল্। আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় হুলুধ্বনি, রাজভাণ্ডারে ছড়াছড়ি; জনজনতার হুড়াহুড়ি, এতদিনের ঘুমন্ত রাজপুরী দাপে কাঁপে, আনন্দে তোলপাড়। সেই আনন্দ গায়ে মেয়ে স্কুলে যাওয়া। ছোট বোনকে সেই আনন্দের ভাগ দিয়ে পুলক অনুভব। নৌকা হইতে কুঁচ-বরণ কন্যা উত্তর করিলেন

‘কলাবতী রাজকন্যা মেঘ-বরণ কেশ,
তোমার পুত্র পাঠাইও কলাবতীর দেশ।
আনতে পারে মোতির ফুল ঢো-ল-ডগর,
সেই পুত্রের বাঁদী হয়ে আসব তোমার ঘর।’

তিন বুড়ির রাজ্য পেরিয়ে, রাঙ্গা নদীর জল কাটিয়ে কলাবতীর রাজকন্যার রাজ্য, সেখানে প্রকাণ্ড রাজপুরীর তে-তলায় মেঘ -বরণ চুল কুঁচ-বরণ কন্যা সোনার শুকের সাথে কথা কয়। সে রাজ্যে গাছের পাতায় ফল, গাছের পাতায় অজগর, সেখানে ঢোল-ডগরের ডাহিনে ঘা দিলে হাট-বাজার বসে, বাঁয়ে ঘা দিলে হাট-বাজার ভাঙ্গিয়া যায়। সেখানে এক একশ বচ্ছুরে বুড়ি বসে এক ছোট কাঁথা সেলাই করে। কী অসাধারণ! পাশ-গাদাতে সাত চাঁপা পারুল, গা-ময় সুঁচ রাজার রানী কাঞ্চনমালা এক ডুবে হয়ে যান দাসী আর হাতের কাঁকনে কেনা দাসী রানী, গজমোতির উজল আলোয় বসন্তের সাথে রাজকন্যার বিয়ে, নীল কমল আর লাল কমলের গল্প ‘আমার নাতি হোক তো চিবিয়ে খাক লোহার কড়াই’, ‘দুধ-সাগরের’ ঢেউয়ে লুকিয়ে থাকা এসব গল্প পড়ে পড়ে অজানা রাজ্যের অজানা রাজপুত্রের পাড়ি দেয়া সাত-সমুদ্র তেরো নদীর ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে, স্বপ্ন-কল্পনায় আলোড়িত হতে হতে, একদিন হঠাৎই বুঝি বিস্ময়ের সাথে আবি®কৃত হয় রূপকথার চেনা-অচেনা জমিনে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাধা পড়ে গেছে জীবনের স্বপ্ন-সাধ, গঠন করে ফেলেছে রাজকন্যা-মানস এবং বিস্ময় যুগপৎ যন্ত্রণার জন্ম দেয় যখন ক্রমাগত বেশি করে মনে হতে থাকে ঠাকুমার ঝুলি বাঙ্গালার রূপকথায় আমার জন্য স্বপ্নের-কল্পনার কিংবা আশার কোন দুয়ার খুব অল্পই খোলা আছে।

একি তবে রাজপুত্রদের জন্য রাজপুত্রদেরই কাহিনী?
‘ফিনিক ফোটা’ জ্যোৎস্নায় বাংলার ঠাকু’মা, দিদিমা, মায়েদের মুখের গল্পগুলোকেই অত্যন্ত বিশ্বস্ততায় বাঙালির নিজস্ব বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে-গীতিতে ধরেছেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। এমনই অভিমত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, বইটির ভূমিকায়। বইটি পড়তে পড়তে অভ্যস্ত হয়ে যাবার অনেক পরে খেয়াল হয় রবীন্দ্রনাথ আরো যা লেখেন,
“… এই যে আমাদের দেশের রূপকথা বহুযুগের বাঙালি-বালকের চিত্তক্ষেত্রের উপর দিয়া অশ্রান্ত বহিয়া কত বিপ্লব, কত রাজ্য পরিবর্তনের মাঝখান দিয়া অক্ষুন্ন চলিয়া আসিয়াছে, ইহার উৎস সমস্ত বাংলাদেশের মাতৃস্নেহের মধ্যে। … অতএব বাঙালির ছেলে যখন রূপকথা শোনে তখন কেবল যে গল্প শুনিয়া সুখী হয়, তাহা নহে সমস্ত বাংলাদেশের চিরন্তন স্নেহের সুরটি তাহার তরুণ চিত্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া, তাহাকে যেমন বাংলার রয়ে রসাইয়া লয়।’’

চোখ পড়ে বইটির উৎসর্গপত্রে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার যা লিখেছেন তার প্রতি

নীল আকাশে সূয্যিমামা ঝলক দিয়েছে,
সবুজ মাঠে নতুন পাতা গজিয়ে উঠেছে,
পালিয়ে ছিল সোনার টিয়ে ফিরে এসেছে;
ক্ষীর নদীটির পারে খোকন হাসতে লেগেছে,
হাসতে লেগেছে রে খোকন নাচতে লেগেছে,
মায়ের কোলে চাঁদের হাট ভেঙ্গে পড়েছে।
লাল টুক টুক সোনার হাতে কে নিয়েছে তুলি’
ছেঁড়া নাতা পুরোণ কাঁথার
ঠাকুমার ঝুলি।

খুব পরিষ্কার এ বই বাঙালির ছেলের জন্য, বাঙালির খোকার জন্য তাদের মা-ঠাকুমা-দিদিমাদের হয়ে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। কথা উঠতে পারে ‘বাঙালির ছেলে’ শব্দটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিংবা ‘খোকন’ শব্দটি ব্যবহার করে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুদার আসলে শিশুদের নির্বিশেষে বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু সে কথা মানা শক্ত কারণ যে বয়সে বাঙালির ছেলে তখন মা-ঠাকুমা-দিদিমাদের কাছে রূপকথা শোনে এবং তার তরুণ চিত্ত বাংলার রসে রাঙিয়ে নেয় সেই বয়সে বাঙালির মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে যাবার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য এই মা-ঠাকুমা-দিদিমারাই সুক্তো রান্নায় কী কী ফোঁড়ন দিতে হবে তা শেখানোর জন্য গলদঘর্ম হয়ে পড়েন। শব্দের ব্যবহারে অনেক কিছুই আসে যায়, আসলে সমস্তটাই আসে যায়, তবুও তর্কের খাতিরে সে কথা যদিবা মেনেও নেই হোঁচট খেতেই হয় যদি নয়ন মেলে দেখি এসব গল্পের বিষয়বস্তু।

আপাতদৃষ্টিতে এক কিরণমালার কাহিনী বাদ দিলে সব কাহিনীই আসলে রাজপুত্রের কাহিনী। রাজপুত্রদের কাহিনী। বন্দিনী রাজকন্যারা রাজপুত্রদের অসীম গুণাবলী, অপরিমেয় তেজ এবং অশেষ স্বপ্ন বাস্তবায়নের এবং তা প্রকাশের উপলক্ষ মাত্র। রানীরা চক্রান্তকারী অথবা চক্রান্তের শিকার অশুভ শক্তি অথবা অসহায় অস্তিত্ব। এরা গৃহের নারী। বাকী রইল যেসব নারী, তারা রাক্ষসী। হয় রাক্ষসী-পুরীতে তাদের রাজত্ব, যেখানে রাজকন্যারা বন্দী অথবা ছদ্মবেশে মানুষের রাজপুরীতে রানী হিসেবে তাদের অধিষ্ঠান। রাজপুত্র, রাজ্যের মানুষ, পশু-পাখি খেয়ে ধ্বংস করাই যাদের উদ্দেশ্য। এসব চক্রান্তকারী রানী এবং রাক্ষসীদের স্বরূপ উন্মোচন করে অসহায় রানী এবং বন্দী ও ঘুমন্ত রাজকন্যাদের মুক্ত করার যাবতীয় নায়কোচিত কাজের বিবরণই তো এসব কাহিনীর বিষয়বস্তু। যেসব রানী চরিত্র সক্রিয়, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই অশুভ শক্তির প্রতীক। বাকীরা সহানুভূতি কাড়ে, সম্ভ্রম জাগায় না। যদিও বলছি রাজকন্যা কিরণমালা এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম তবুও একসময় আমরা দেখতে পাই কীভাবে কিরণমালার সক্রিয়তা আসলে সমগ্রিক পুরুষপরিমণ্ডলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারই হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

তার অর্থ কি তাহলে এই যে, বাংলার ঠাকুমা, দিদিমা, মায়েরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কেবল তাদের রাজপুত্রদেরই শৌর্যের কথা বলেছেন, ভেবেছেন? বলেছেন তাদের রাজপুত্রদের নিয়ে নিজেদের স্বপ্নের কথা? তাদের বাস্তব জগতে অশুভ শক্তি কি কেবলই নারী? গোটা ঠাকুমার ঝুলিতে একজনও পুরুষ কেনো নেই অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে? কোন সে পরিস্থিতি যেখানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাংলার ঠাকুমা, দিদিমা, মায়েরা তাদের স্বপ্নের-কল্পনার-আশার-উদ্ধারের প্রতিনিধি হিসেবে কেবল তাদের রাজপুত্রদেরই ভেবেছেন? এবং দাঁড় করিয়েছেন অশুভের প্রতীক হিসেবে অন্য নারীর বিপরীতে? এই প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হওয়া যেমন জরুরি তেমিন জরুরি প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি এবং প্রাথমিক কাজ হলো এসব রূপকথা আদৌ এ জাতীয় প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য প্রাসঙ্গিক কী-না, সেটি খুঁজে দেখা।

বুড়িদের রাজত্ব
দুধের সাগর, রূপ-তরাসী এবং চ্যাং-ব্যাং-এই তিনটি পর্বে মোট ১৪টি গল্প নিয়ে ঠাকুমার ঝুলি। দুধের সাগর-এর প্রথম গল্প অর্থাৎ এই বইটির প্রথম গল্প কলাবতীর রাজকন্যা। রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-ছন্দের বিচারে, কাহিনীর বৈচিত্র্যে সেরা গল্প হয়তো এটি, আমার বিবেচনায়। গল্পের শুরুই হচ্ছে এক যে রাজা। রাজার সাত রানী। যে রাজার সাত রানী সে রাজার যে মস্ত-বড় রাজ্য, প্রকাণ্ড রাজবাড়ী, হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, ভাণ্ডারে মাণিক, কুঠরীভরা মোহর, মন্ত্রী, অমাত্য, সিপাই, লস্করে রাজপুরী গমগম করবে এতো অবধারিত। কারণ এসবই যদি না থাকবে তো রাজার সাত রানী হবে কেমন করে? কিন্তু রাজার মনে সুখ নাই। কারণ এক রানীরও সন্তান নাই। ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ এক নয়, দুই নয় সাত রানী পোষেন যে রাজা তার একটিও সন্তান না থাকলে মনে যে সুখ থাকবে না এও তো বাহুল্য কথা। এত প্রকান্ড রাজ্যের রানীরা কিন্তু সকলেই রান্না করা, জল তোলা, কুটনো-কাটা, মশলা করার মত অ-রানী সুলভ কাজ করেন। সন্তান না হওয়ার শাস্তি কি? কারণ এ বইয়ের অন্য কোনো রূপকথায় রানীরা শাস্তি-প্রাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ জাতীয় হীন কাজ করেন না। সন্ন্যাসীর দেয়া শেকড় বাটা খেয়ে পাঁচ রানীর সোনার চাঁদ ছেলে হলো। আর শিল-নোড়া-ধোয়া জল খেয়ে ন-রানী আর ছোট রানীর হলো পেঁচা (ভুতুম) আর বানর (বুদ্ধু)। সোনার চাঁদ ছেলে হওয়া পাঁচ রানীকে জয়ডঙ্কা দিয়ে ঘরে তোলা হলো আর ন-রানী চিড়িয়াখানার বাঁদী এবং ছোট রানী হলেন ঘুঁটে কুড়ানী দাসী। অর্থাৎ রানীদের অবস্থান নির্বাচিত হলো তাদের সন্তানদের সাপেক্ষে। যেমনটা হয় আর কী! আর তাই কাহিনীর শেষে বুদ্ধু-ভুতুমের কৃতিত্বে তাদের মায়েরা আবার স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হন রাজপূরীতে।

‘হাটের সওদা ঢোল-ডগরে, গাছের পাতে ফল
তিন বুড়ির রাজ্য ছেড়ে রাঙ্গা নদীর জল’ এরও ওপারে কলাবতীর পুরের রাজকন্যা অর্থাৎ এ রূপকথার রাজকন্যা স্বাধীন কিন্তু তিনি বিজিত হতে চান, হতে চান বীর-ভোগ্যা। তার নিজেরই কথায়:

“আনতে পারে মোতির ফুল ঢো-ল-ডগর,
সেই পুত্রের বাঁদী হয়ে আসব তোমার ঘর।”

কীভাবে বোঝা গেল রাজকন্যা স্বাধীন ছিলেন? রূপার বৈঠা, হীরের হালের শুকপঙ্খী নাও ভাসিয়ে রাজকন্যা একা বেরিয়েছেন দেশ-বিদেশ ঘুরতে, সঙ্গী তার সোনার শুক। স্বাধীন বৈ কী। কিংবা বুদ্ধুর প্রশ্ন “রাজকন্যা, এখন তুমি কা’র?” এর উত্তরে রাজকন্যার বয়ানেও বোঝা যায়, “আগে ছিলাম বাপের-মায়ের, তা’র পরে ছিলাম আমার, এখন তোমার।” এই তা’র পরে ছিলাম আমার পর্বে রাজকন্যা স্বাধীন, রূপার বৈঠা, হীরার হালের শুকপঙ্খী নাও ভাসিযেছেন স্বাধীন রাজকন্যা। স্বাধীন রাজকন্যা বুদ্ধুকে বিয়ে করে নিজের রাজ্যপট ছেড়ে বুদ্ধুর বাঁদী হয়ে (রাজকন্যা বলিলেন, “এখন তুমি যাহা বলিবে, তাহাই করিব।”) চললেন বুদ্ধুর রাজ্যে।

এ কাহিনীতে তিন বুড়ির রাজ্যের হদিস পাই আমরা। অর্থাৎ তিন বুড়ি ক্ষমতাবান এবং অবধারিতভাবে তারা রাক্ষসী। কেননা “তাহাদিগে দিয়া তিন বুড়ি তিন সন্ধ্যা জল খাইয়া, নাক ডাকাইয়া ঘুমাইয়া পড়িল।” হদিস পাই পাতালপুরী তথা কলাবতীর পুরের নির্জন রাজ্যের এক একশ বচ্ছুরে বুড়ির যে কী-না বসে একটি ছোট কাঁথা সেলাই করছে। এই বুড়িও গল্পে অশুভ শক্তির প্রতীক, যাকে পরাস্ত করে তার ছোট কাঁথাটি নিয়ে নেয়া হয়েছে। ছোট কাঁথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এ কারণে যে কাঁথাটি বুড়ি বুদ্ধুর দিকে ছুঁড়ে মারতেই “হাজার হাজার সিপাই আসিয়া বুদ্ধুকে বাঁধিয়া-ছাঁদিয়া রাজপুরীর মধ্যে লইয়া গেল।” তাহলে এই কাঁথাটি কি বুড়ির শক্তির, ক্ষমতার প্রতীক যা দিয়ে বুড়ি তার রাজ্য শাসন করে, প্রজাকূল তার হুকুম তামিল করে? কলাবতীর রাজকন্যার সাথে বুড়ির সম্পর্কটাই বা কী, এই একশ বচ্ছুরে বুড়ি কি কলাবতীর রাজকন্যারই পূর্ব নারী কোন এক? এসব প্রসঙ্গের উত্তর নেই এ গল্পে। যেমন নেই বুড়ির কাঁথাটি কীভাবে পেল বুদ্ধু। কোন যুদ্ধ, কোন কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল কাঁথাটি হস্তগত করার জন্য? অথচ কাহিনীর শেষে আমরা বুদ্ধুকে দিব্যি বুড়ির সেই কাঁথাটি নিয়ে যেতে দেখি। এই কলাবতীর পুরও সম্ভবত একটি নারী-প্রধান রাজ্য। এখানে দু’টি চরিত্রকে আমরা দেখতে পাই। ছোট কাঁথা সেলাইকারী একশ বচ্ছুরে বুড়ি এবং কলাবতীর রাজকন্যা। অথচ সে রাজ্যে হাজার-হাজার সেপাই আছে, ঢোল-ডগরের নিয়ন্ত্রণে প্রকাণ্ড হাট বসে। অন্য সময় এদের দেখা যায় না। বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এ যেমন দিনের বেলা রাস্তা-ঘাটে পুরুষদের দেখা যায় না। কিংবা হতে কি পারে নারী-প্রধান রাজ্য বলে পুরুষতান্ত্রিক রূপকথাকারের কাছে এ রাজ্যের পুরুষ এবং রাজত্বের অন্য সকল উপাদানকে অদৃশ্যমান মনে হচ্ছে? কিংবা এ রাজ্যের অন্য সকলের উপস্থিতি তাৎপর্যের দিক থেকে এতই অকিঞ্চিৎকর যে বুড়ি এবং রাজকন্যার তুলনায় তাদের উপস্থিতি মূর্ত নয়? তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে তাহলো এ রূপকথার নায়ক ছদ্মবেশী রাজকুমার বুদ্ধু এবং সহযোগী নায়ক অপর ছদ্মবেশী রাজকুমার ভুতুম। এদের বীরত্ব ও কৃতিত্বে তাদের অসহায়, রাজপুরী থেকে নির্বাসিত রানীমায়েরা পুনরায় রাজপুরীতে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। এদেরই বীরত্ব ও কৃতিত্বে মুগ্ধ রাজা “পাঁচ রানীর আর পাঁচ রাজপুত্রের ঘরের উপরে কাঁটা দিয়া, মাটি দিয়া, বুজাইয়া দিলেন।” ন’রানী, ছোট নারী আর তাদের সন্তানদের উপর এতগুলো বছর অন্যায় অবিচারের জন্য রাজা শাস্তি পাওয়া দূরে থাক, নিন্দিতও হলেন না, অশুভ শক্তি হিসেবেও বিবেচিত হলেন না। বরং পুনরায় দণ্ড দিলেন অন্যসব রানী আর রাজপুত্রদের। কারণ তার কোনো ক্ষতি নেই কোনো ব্যবস্থাতেই। একপক্ষকে তাড়িয়ে দিলেন তো অন্যপক্ষ রইল কাছে। কোনো সম্পর্কই কিছু নয় রাজার কাছে। ক্ষমতাবানের অন্যায় ভুল হিসেবেই বিবেচিত মাত্র ভবিষ্যৎ দুই ক্ষমতাধারী বুদ্ধু ও ভুতুমের কাছে। অন্যদিকে রাজত্বধারী তিন বুড়ি এবং জ্ঞানের-অভিজ্ঞতার-ক্ষমতার কাঁথা সেলাইকারী একশ বচ্ছুরে বুড়িকে পরাজিত করে অর্থাৎ স্বাধীন ও সক্রিয় তিন নারীকে অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে, তাদের পরাস্ত করে স্বাধীন কলাবতীর রাজকন্যাকে (… তারপর ছিলাম আমার …) “উদ্ধার” (?) করলো তারা। শ্রীয়ুত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বঙ্গীয় শব্দকোষের ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী বৃদ্ধ শব্দের একটি অর্থ জ্ঞানী। তাহলে এই বৃদ্ধা বা বুড়িরা ছিলেন জ্ঞানী নারী। জ্ঞানী নারী তো বটেই কারণ তারা রাজ্য শাসন করতেন। যেহেতু তারা জ্ঞানী, নারী এবং স্বাধীনভাবে রাজ্য চালান, অশুভ শক্তির প্রতীক তো হবেনই। এইসব স্বাধীন, জ্ঞানী নারীদের পরাজিত করে তারা সাথে নিয়ে গেল এসব স্বাধীন বুড়ির সমস্ত হাতিয়ার হাটের সওদার ঢোল-ডগর, কাঁথা আর কৌটা।

“রাজকন্যা রাজকন্যা, ঘুমে আছ কি?
বরে নিতে ঢোল-ডগর নিয়ে এসেছি।”

ঢোল-ডগর এনেই কেবল রাজকন্যাকে বরণ করা যায় কারণ এই “ঢোল-ডগরের ডাহিনে ঘা দিলে হাট-বাজার বসে, বাঁয়ে ঘা দিলে হাট-বাজার ভাঙ্গিয়া যায়।” হাট-বাজারের ক্ষমতা অর্থাৎ অর্থের ক্ষমতা যার হাতে সেই-ই পারে রাজকন্যাকে বরণ করতে। কাহিনীতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অন্যান্য রাজপুত্ররা এবং তাদের মায়েরা বারবার জিজ্ঞেস করেছে, “রাজকন্যা, এখন তুমি কার?” রাজকন্যা প্রতিবারই নিঃসংশয়ে উত্তর করেছে, “ঢোল-ডগর যার।” অর্থাৎ বাজার নিয়ন্ত্রণ তথা বিত্ত যার হাতে। এই ঢোল-ডগর রাজকন্যারই ছিল। কারণ এই ঢোল-ডগর কলাবতীর রাজকন্যারই সোনার শুকের কাছ থেকে বুদ্ধুর হাতে এসেছে। কীভাবে এলো তার কোনো বিশদ বর্ণনা নেই কিন্তু রাজকন্যা বুদ্ধুর হাতে বিজিত হলেন বলেই যে বুদ্ধু ঢোল-ডগরের মালিকানা পেল এটা পরিষ্কার। নারীর সম্পত্তির অধিকার তো স্বামীরই বটে! কাহিনী অনুযায়ী, বুদ্ধু রাজকন্যার মাথা থেকে মোতির ফুল নেয়ার পর অর্থাৎ তাকে জয় করার পর সোনার শুক ঢোলে কাঠি দিলে হাট-বাজার বসা এবং ভাঙ্গার বিষয়টি দেখে বুদ্ধু ঢোলটি বাজাতে শুরু করে। তাছাড়াও কোনো রাজত্বের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তখনই ভিনদেশী রাজপুত্রের হাতে যাওয়া সম্ভব যখন সে রাজ্যের পতন ঘটেছে ওই ভিনদেশী রাজপুত্রের হাতে। অবশ্য কলাবতীর রাজকন্যা, কাহিনী অনুযায়ী, কি বিজিত হতেই চেয়েছিলেন? অন্যান্য বুড়িদের মত অশুভ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হতে না হয় যেন, সে কারণেই কি? কার উপর কার বিজয়গাঁথা রচনা করলেন আমাদের ঠাকুমা, দিদিমা, আর মায়েরা আর সে কাহিনী অবিরাম গেয়েও চললেন তারাই?

সোনার কাঠি, রূপার কাঠি আর ঘুমন্ত রাজকন্যা

দ্বিতীয় গল্প ঘুমন্ত পুরী। এটি নেহাতই এক রাজপুত্রের গল্প। যে রাজপুত্র ঘুমন্ত রাজকন্যার (রাজকন্যারা বুঝি ঘুমিয়েই থাকেন? কেন?) শিয়রের সোনার কাঠি আর পায়ের কাছের রূপার কাঠি বদল করে জাগিয়েছেন ঘুমন্ত রাজকন্যা এবং রাজপুরীকে। উপহার পেয়েছেন রাজকন্যা আর রাজত্ব। রাজপুত্রের এই নিরঙ্কুশ বিজয়শৌর্যে অন্য কারো অংশীদারিত্ব নেই এবং রাজকন্যা আর রাজত্ব লাভের আকাক্সক্ষা চিরতরে বাঙালি রাজপুত্র-মানসে অমোচনীয় কালিতে খোঁদাই করে গেছে যেসব কাহিনী এ রূপকথাটি সেগুলোরই একটি। কলিম খান হয়তো ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ রীতি অনুযায়ী বলবেন ঘুমন্ত রাজকন্যারা অচেতন কর্মী জনগণ এবং রাজপুত্র উদ্যোমী পরিচালক যে অচেতন কর্মীদের জাগিয়ে রাজত্বরূপ ফললাভ করেছে। তাহলেও কিন্তু অচেতন কর্মী জনগণ হিসেবে রাজকন্যাই প্রতিকায়িত এবং রাজপুত্র উদ্যোমী পরিচালক হিসেবে।

সুয়োরানী বনাম দুয়োরানী কিংবা নারীর বিরুদ্ধে নারী?

আগেই যেমনটা বলেছি বেশিরভাগ রূপকথাতেই রাজ্যের সকল অনিষ্টের মূলে কোনো ডাইনী-স্বভাবা নারী এবং তাদের সকল অপকর্মের শিকার অসহায় নারীকূল। নারীর বিরুদ্ধে নারী। নারীর হিংসা-কপটতা-হিংস্রতার বলি আরেক নারী। যেন নারীর দুর্ভাগ্যের অন্য কোনো কারণ থাকেইনি কখনো। পুরুষ এসেছে অসহায় নারীকে উদ্ধারের জন্য।

কাঁকনমালা-কাঞ্চনমালা গল্পে অশুভ সত্ত¡া কাঁকনমালা। অসহায়, করুণা উদ্রেককারী চরিত্র কাঞ্চনমালা। নিজের গুণে নয়, সুঁচ-রাজার রাখাল বন্ধুর কৌশল ও প্রচেষ্টায় কাঞ্চনমালা উদ্ধার পান। যে রাজার প্রতিজ্ঞাভঙ্গের কারণে এত ঝামেলা, তিনি উদ্ধার পেলেও কাঁকনমালাকে মরে যেতে হয়, তার প্রায়শ্চিত্ত করার উপায় রাখা হয় না। কারণ সে অশুভ শক্তি। সাত ভাই চম্পা গল্পে যথারীতি রাজার সাত রাণী। বড়রাণীরা খুব খারাপ, তাদের দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না। ছোটরাণী খুব শান্ত। এজন্য রাজা ছোটরাণীকে সকলের চাইতে বেশি ভালবাসিতেন। আজও শান্ত মেয়ে, যে সকল কথা মেনে চলে, সেই-ই তো ভালবাসার পাত্রী। ছেলেমেয়ে না হওয়ার কারণে এই রাজাও খুব দুঃখিত। অবশেষে রাজার মনে আনন্দের বন্যা বইল কারণ “ছোটরাণীর ছেলে হইবে”। কীভাবে জানা গেল ছেলেই হবে? সন্তান হওয়া মানেই ছেলে হওয়া? তাই বলি শব্দের ব্যবহারে অনেক কিছুই আসে যায়। বড়রাণীরা হিংসায় জ্বলিয়া মরিতে লাগিল। একেই রাজা ছোটরাণীকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন, তাই ছেলে হবার সম্ভাবনায় রাজা সকলের মধ্যে বিলানোর জন্য রাজভাণ্ডার খুলে দিয়েছেন, খুবই পরিস্কার যে সন্তান হবার পর অন্যরাণীদের পাত্তাও থাকবে না কারণ রাণীদের মর্যাদা নির্ণিত হয় পুত্রসন্তান জন্ম দেয়ার কৃতিত্বের উপর কাজেই অন্য রাণীরা হিংসায় জ্বলবে, এটা কি খুব দোষের? রাণীদের এই হিংসার পিছনে রাজার এতগুলো বিয়ে এবং ছোটরাণীর প্রতি পক্ষপাতকে কখনো দায়ী করা কিন্তু হয় না। যাই হোক বড়রাণীদের চক্রান্তে সাতপুত্র-এককন্যা জন্মদানকারী ছোটরাণী ‘ব্যাঙের ছানা ইঁদুরের ছানা’ জন্ম দেয়ার অপরাধে রাজার এত প্রিয় ছোটরাণী রাজপুরী থেকে নির্বাসিত হলেন। পুত্র জন্ম দিতে না পারার শাস্তি।

শান্ত ছোটরাণী ভালবাসার পাত্রী, পুত্র জন্ম দিতে অক্ষম ছোটরাণী বিতাড়িত।

রাজার প্রতি আমাদের কোনো ক্ষুব্ধতার বোধ পর্যন্ত তৈরি হয় না। যত রাগ এবং ঘৃণা সঞ্চিত হয় বড় রাণীদের উপর। ছাইগাঁদার কাছে পুঁতে রাখা সাত চম্পা-পুত্র ও পারুল-কন্যার বুদ্ধিতে বড়রাণীদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হলে “রাজা তখনই বড়রাণীদিগে হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়া পুঁতিয়া ফেলিতে আজ্ঞা দিয়া, সাত-রাজপুত্র, পারুল মেয়ে আর ছোটরাণীকে লইয়া রাজপুরীতে গেলেন।” রাজা আগে বিতাড়ন করেছিলেন ছোটরাণীকে এখন করলেন বড়রাণীদের। কোনো না কোনো রাণী কিন্তু রয়েই গেলেন রাজার কাছে, সব সময়ই। রাজার কীসের অভাব? রাজার ক্ষমতা রাণীদের বিতাড়নে, রাণীদের দৌড় অন্য রাণীদের পিছনে ফেলে রাজার কাছে গৃহীত হবার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া পর্যন্ত, কার ভাগ্যে কখন শিঁকে ছিড়বে তার অদৃষ্টনির্ভর প্রতীক্ষায়। বড়রাণীদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে রাজার চোখ ফোটানোতে সাত-রাজপুত্র ও পারুল মেয়ের ভূমিকা সমানই ছিল তবুও গল্পটার নাম কিন্তু সাত ভাই চম্পা।

শীত বসন্ত গল্পে সুয়োরাণীর চক্রান্তে “দুঃখিনী দুয়োরাণী টিয়া হইয়া টি-টি করিতে করিতে উড়িয়া গেল।” রাজা দুয়োরাণীর জন্য দুঃখিত হওয়া তো দূরের কথা খোঁজ পর্যন্ত করলেন না। বরং সেই সুয়োরাণী সতীনপুত্রদের রক্ত দিয়ে স্নান করতে চাইলে ‘অমনি রাজা জল­াদকে ডাকিয়া আজ্ঞা দিলেন, “শীত-বসন্তকে কাটিয়া রাণীকে রক্ত আনিয়া দাও।” কী ভয়ঙ্কর! সতীন পুত্রের রক্তে স্নান করতে চেয়ে সুয়োরাণী যতখানি অপরাধ করেছে, আপন সন্তান শীত-বসন্তকে কেটে রাণীকে রক্ত এনে দেবার আদেশ কি সে অপরাধের চেয়ে অনেক বেশি বিভৎস নয়? জল­াদের মনে যে মমতা আছে সে মমতা রাজার মনে নেই আপন সন্তানের জন্য। কারণ ক্ষমতাবানের কাছে স্নেহ-মমতা-ন্যায়-অন্যায়বোধের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, নিজস্ব স্বার্থবোধ, শ্রেয়বোধই একমাত্র চালিকাশক্তি। তবুও রাজা অশুভ বা অনিষ্টকারী সত্ত¡া নন! এজন্য তাকে কোথাও জবাবদিহি পর্যন্ত করতে হয় না। এই পাশবিক আদেশ প্রদানের জন্য রাজাকে ঘৃণা করার আবহ তৈরির কোনো চেষ্টা এ গল্পে নেই। আর একজন রূপবতী রাজকন্যা আছেন কাহিনীটিতে যিনি শুধুই সাজগোজ করেন। সাজগোজ করেন এবং সোনার টিয়াকে জিজ্ঞাসা করেন, “সোনার টিয়া, বল তো আমার আর কি চাই?” সাজগোজের জন্যই সোনার টিয়ার পরামর্শে সয়ম্বর সভায় বায়না ধরেন গজমোতির হারের। একটু লক্ষ্য করলে দেয়া যাবে, রূপকথাগুলোতে অরাক্ষসী রাজকন্যাদের চরিত্র অত্যন্ত অপরিণত, আশা-আকাক্সক্ষাগুলো হাস্যকর। কিছুতেই যেন ব্যক্তি হয়ে ওঠে না। অথচ তাদের আবদার মিটাতে অন্যদের প্রাণান্তকর অবস্থা। “গজমোতির আলোতে দেশ উজল করিতে করিতে বসন্ত রূপবতী রাজকন্যার দেশে আসিলেন।” গজমোতি হচ্ছে সম্পদসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সে সম্পদ অর্জনের জন্য অবশ্য প্রয়োজন বীরত্ব। শীত-বসন্তের সেই বিপুল সম্পদ এবং বীরত্বের কাছেই কেবল রাজকন্যা বিক্রিত হতে পারেন। শীত-বসন্তের কৃতিত্বে তাদের মার জীবনের অমানিশা শেষ হয়। হিংসুটে সুয়োরাণী পাপের প্রায়শ্চিত্ত-স্বরূপ মরে গেছে ইতিমধ্যে। রাজা শীত-বসন্তকে কেটে সুয়োরাণীর জন্য রক্ত নিয়ে আসার আদেশ প্রদানকারী হওয়া সত্তে¡ও যেহেতু কোনো অশুভ শক্তির প্রতিনিধি নন তাই “সকল শুনিয়া বনবাস ছাড়িয়া রাজা আসিয়া শীত-বসন্তকে বুকে লইলেন।” কী আনন্দ!

কিরণমালা একমাত্র ব্যতিক্রমী গল্প যেখানে রাজকন্যা কিরণমালা সক্রিয়। কাহিনীতে সঙ্কটের শুরু যথারীতি রাণীর আপন বড় দুই বোনের হিংসা ও চক্রান্তের মধ্য দিয়ে। তিন তিন বার রাণী সন্তান-সম্ভবা হলে তিনবারই হিংসুক দুই বোন রাজাকে কুকুর ছানা, বিড়াল ছানা এবং কাঠের পুতুল দেখালে রাজ্যের লোকের মন্তব্য “এ অলক্ষণে” রাণী কখখনো মনিষ্যি নয় গো, মনিষ্যি নয়Ñ নিশ্চয় ‘‘পেতœী কি ডাকিনী” শুনে রাজা রাণীকে রাজ্যের বের করে দিলেন। হিংসুক বড়বোনদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলো। প্রশ্ন আসে প্রায় প্রতি গল্পেই কেন রাজারা তাদের সন্তানদের জন্মের এজাতীয় উদ্ভট তথ্যে বিশ্বাস করেন কোনো বিবেচনা ছাড়াই? তাহলে এসব গল্প কোন সময়কে ধারণ করে? তবুও, শুরুটা গতানুগতিক হলেও, এটি হচ্ছে একমাত্র গল্প যেখানে নায়িকা সক্রিয়। একসময় অবশ্য আমরা এই সক্রিয়তার অন্য ব্যাখ্যাও খুঁজে পাবো। মায়া পাহাড়ে মায়ার ডাকে অরুণ, বরুণ দুই ভাই হারিয়ে যাওয়ার পর কিরণমালা মায়া পাহাড়ের উদ্দেশ্যে বের হলেন। মায়া পাহাড়ও কি একটি নারীপ্রধান রাজ্য? না-হলে লক্ষ লক্ষ রাজপুত্র কেনো সেখানে পাথর হয়ে থাকবে? মায়া পাহাড়ের দেশে অরুণ, বরুণ পৌঁছানোর পর যে বর্ণনাটা আমরা পাই একটু খেয়াল করে দেখা যাক,
“অমনি চারিদিকে বাজনা বাজে, অপ্সরী নাচে, পিছন হইতে ডাকের উপর ডাক ‘রাজপুত্র! রাজপুত্র! ফিরে চাও! ফিরে চাও! কথা শোনো!’
অপ্সরী নাচে বোঝা গেলো। কিন্তু কে ডাকে বোঝা গেলো না। ডাকে যে অপ্সরীই সেটা জানা যায় কিরণমালা যখন গেলেন মায়া পাহাড়ে। কোনো মায়ার ডাকেই কিরণমালা পিছন ফেরেন না। অনেকেই ভয় দেখায় বটে, পিঠের উপর বাজনাও বাজে কিন্তু ডাকে অপ্সরী। অপ্সরা নাচে, “রাজপুত্র, এখনো শোন!” আবার কিরণমালা যে কোনো ডাকেই পিছন ফেরেন না, এই দৃঢ় চিত্ততার ক্ষেত্রেও এখানে একটি ফাঁক ধরিয়ে দেয়া আছে। মায়া পাহাড়ে পৌঁছানোর পর অরূন, বরূণ এবং কিরণমালা তিনজনের চারিদিকেই দৈত্য, দানো, বাঘ, ভালুক, সাপ, হাতি, সিংহ, মোষ, ভূত-পেতœী ঘিরে ধরেছে এবং পিছন থেকে ডাকের উপর ডাক দিয়েছে “রাজপুত্র, রাজপুত্র, এখনো শোন!” অরূণ, বরূণ রাজপুত্র তাই পিছন ফিরে তাকিয়ে পাথর হয়ে গেছেন। কিন্তু রাজপুত্রের পোষাক পরে থাকা সত্তে¡ও “কিরণমালা তো রাজপুত্র নন, কিরণমালা কোনোদিকে ফিরে চাহিলেন না।” যাইহোক কিরণমালা নিঝুম মায়া পাহাড়ের পাথর হয়ে যাওয়া সকল রাজপুত্রকে মুক্তি দিয়েছেন যদিও সেই পাহাড় থেকে উপড়ে এনেছেন রূপার গাছ, সোনার ফল ধরা হীরার গাছের ডাল, নিয়ে এসেছেন সোনার ঝারি এবং সোনার পাখি অর্থাৎ যা কিছু সম্পদ মায়াপাহাড়ের। এ কাহিনীতে কিরণমালাই মূল এবং সক্রিয় চরিত্র। একমাত্র ব্যতিক্রমী রূপকথা। তবুও এ কাহিনীতেও নারীর বিরুদ্ধে নারী। মায়া পাহাড়, অর্থাৎ অন্য একটি নারীপ্রধান রাজ্যের পতন ঘটালেন রাজকন্যা কিরণমালা। মায়ার পাহাড়? আজও নারী ছলনাময়ী, রহস্যময়ী, মায়ায় ঘেরা এসব তো অতি সাধারণভাবে, সব সময়ে উচ্চারিত কথাগুলোর একটি। অরূণ-বরূণ-কিরণের কল্যাণে নির্বাসিত রাণী মিলিত হতে পেরেছেন স্বামী-পুত্রের সাথে এবং ফিরে আসতে পেরেছেন রাজপূরীতে। এ কাহিনীতে আর একটি উলে­খযোগ্য দিক হলো রাণীর প্রতি অবিচারের জন্য না হলেও নির্বুদ্ধিতার জন্য রাজা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। অরূণ-বরূণ-কিরণমালার প্রাসাদে নিমন্ত্রণ খেতে এসে মোহরের পায়েস, মোতির পিঠা, মুক্তোর মিঠাই, মণির মোন্ডা এসব মানুষ কেমন করে খাবে প্রশ্ন করলে সোনার সুখপাখী পাল্টা প্রশ্ন করেছে রাজাকে, “মানুষের কি কুকুর-ছানা হয়?” রূপকথায় যুক্তির প্রসঙ্গ। কাহিনী শেষে অরূণ-বরূণ-কিরণমালার দুই হিংসুটে মাসির বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলা হলো। ইউরোপে ডাইনী হত্যার বিবরণ পাওয়া যায়। হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলা কি ডাইনী হত্যার এদেশীয় সংস্করণ যার কোনো রেকর্ড কিংবা পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই?

সেইসব রাক্ষসীদের পুর
ঠাকুমার ঝুলির রূপ-তরাসী পর্বের সব কটি গল্পে রাজপুত্র এবং রাক্ষসীদের সরাসরি বিরোধের প্রসঙ্গ এসেছে। এবং এই পর্বের রূপকথাগুলো শুরু হওয়ার আগে একটি বড় কবিতায় এক বা দুই লাইনে প্রতিটি গল্পের পরিচয় দেয়া আছে। সেই কবিতারই প্রথম দুই লাইন হলো:

রূপ দেখতে তরাস লাগে, বলতে করে ভয়
কেমন করে রাক্ষসীরা মানুষ হয়ে রয়!

এই পর্বের গল্পগুলোয় আমরা সরাসরি রাক্ষসীদের যেমন দেখি, তেমনি দেখি কোনো রাজার রাজপুরীতে রাণীর ছদ্মবেশে থাকা রাক্ষসীদের। ক্রমে যাদের স্বরূপ উন্মোচিত হবে বলে পাঠক অপেক্ষা করতে থাকেন।

রাক্ষসী-পুত্র অজিত এবং মানবী-পুত্র কুসুমের যৌথ উদ্যোগে রাক্ষসী-রাণী (অজিতের মা), রাক্ষসী-রাণীর সকল রাক্ষস-রাক্ষসী মেরে ফেলার অসম্ভব বর্ণিল কাহিনী নীলকমল আর লালকমল। ছন্দ আর ভাষার অপরূপ কারুকাজ, কাহিনীর ব্যপ্তি এবং বৈচিত্র শৈশব কিংবা কৈশার মানসে অপরূপ রূপকল্প তৈরি করে।

“নীলকমলের আগে লালকমল জাগে
আর জাগে তরোয়াল,
দপ্ দপ্ করে ঘিয়ের দীপ জাগে
কার এসেছে কাল?”

কে-না উদ্দীপ্ত হয় এই সাহসে? রাক্ষক-খোক্কসদের বিরুদ্ধে লালকমল-নীলকমলের বীরত্বের কাহিনী এদেশের বৃটিশবিরোধী সংগ্রাম, পাকিস্তানের আইয়ূব-ইয়াহিয়া-বিরোধী আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে নানা গল্প, উপন্যাস, কবিতা এবং নাটকে। উপনিবেশিক শক্তির প্রতীক হিসেবে রাক্ষস-খোক্কস এবং এদেশের সংগ্রামী জনতার বিজয়ী-বীরের প্রতীক হিসেবে লালকমল-নীলকমলের উপমা বারেবারেই ব্যবহৃত হয়েছে। এই দুই রাজপুত্রের অসম্ভব বীরত্ব ও অসাধারণ কৌশল আমাদের এতই মুগ্ধ করে যে ঘরে ঘরে লালকমল আর নীলকমলের জন্ম সম্ভবত প্রতিটি বাঙালি মানসের আকাক্সক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। রাজপুত্রের জন্য আকাক্সক্ষা। যেমন এক সময়ে ক্ষুদিরামের জন্য হয়েছিল। কাহিনীর এই দিকটির ব্যবহার আমাদের এতই মোহাবিষ্ট করে রাখে যে এর অন্যদিকগুলোতে আমরা দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করি না। জোড়া রাজকন্যা ইলাবতী লীলাবতীর উপস্থিতি এ কাহিনীতে আসে এক লাইনে নীলকমল আর লালকমলের বীরত্বের অর্ধেক উপঢৌকন হিসেবে। বাকী অর্ধেকটা হলো রাজত্ব। রূপকথাগুলোতে রাজপুত্রদের বীরত্বের উপহার হিসেবে রাজকন্যা আর অর্ধেক বা পূর্ণ রাজত্বের বিষয়টি এমনভাবে একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় যে দু’টি যেন একই বস্তু, সমদামের। এই রূপকথায় রাক্ষক-খোক্কস রাজত্বের প্রধান আয়ী-রাক্ষসী যার অধীনে আই রাক্ষস, কাই রাক্ষস, রাক্ষস-খোক্কসদের দঙ্গল। আয়ী-রাক্ষসী রাক্ষস-খোক্কস রাজত্বের প্রধান, এক বিশাল রাজত্ব চালাচ্ছে অন্যদিকে তার কন্যা রাক্ষসীরাণী অজিতের মা অন্য রাজত্ব উজার করে দিচ্ছে। অবশ্যই ছদ্মবেশে। অর্থাৎ রাক্ষস-খোক্কস রাজত্বের প্রধান দুই চরিত্র দুই নারী। তারা অশুভ শক্তির অধিশ্বর। তাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছে রাজপুত্ররা আরামকাটী-বিরামকাটী আর জীয়নকাটী-মরণকাটীর সাহায্যে। স্বয়ং পুত্র দাঁড়িয়েছে মায়ের বিরুদ্ধে। এবং দাঁড়িয়েছে বলেই এই রাক্ষসপুরী, আয়ী-রাক্ষসী, মা-রাক্ষসী, রাক্ষসক‚ল, খোক্কসকূল ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। যেমন বিভীষণ রাবণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই লঙ্কাপুরীর পতন সম্ভব হয়েছিল। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে আমরা ধন্য ধন্য করছি রাজপুত্রদের, তারা ধন্যবাদ পাওয়ারই যোগ্য বটে কিন্তু মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি নিরন্তর হয়রান করে তোলে, এই যে হাজার হাজার রাক্ষস-খোক্কস এবং তাদের রাণী, রাণী-কন্যাকে মেরে ফেলা হলো এটাও কি বিপরীত একটি জেনোসাইড নয়? রাক্ষসী-রাণী খেয়ে খেয়ে রাজত্ব উজাড় করে ফেলছিল, অত্যন্ত অন্যায়। আমরা ভয় পেয়েছি, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে চেয়েছি। অথচ গোটা রাক্ষস-রাজত্ব সংহার হয়ে গেলে আমরা কিন্তু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। গোটা রাক্ষস-রাজত্ব সংহার করে ফেলার মধ্যে কোন অন্যায় থাকতে পারে আমরা স্বপ্নেও ভাবি না। ভাবার কথাও না। ভাবনা আসতে পারে এমন কোনো ফাঁক রেখে তো লেখা হয় নি এসব রূপকথা। রাক্ষসদের বিরুদ্ধে আমাদের (?) রাজপুত্ররা বিজয়ী হয়েছেন। সম্ভবত বিজয়ীর ডিসকোর্স বিজিতের ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। রাক্ষস নিধনের প্রচলিত ব্যাখ্যাটিও খুবই গ্রহণযোগ্য। সকল অশুভ শক্তির বিনাশের মাধ্যমে সত্য-সুন্দর ও শুভের প্রতিষ্ঠা। এ যুক্তির বিরোধিতা করি সে জোর কই? শুখু একটা প্রশ্ন তবুও থেকে থেকেই উত্যক্ত করে, সকল রাক্ষস-রাজত্বের প্রধানই কোনো একজন নারী? তাহলে কি নারী-শাসিত রাজত্ব মাত্রই পুরুষতান্ত্রিক রূপকথাকারের কাছে রাক্ষস-পুরী? ক্ষমতা, কর্তৃত্ব কিংবা বিশেষ কৌশল আয়ত্বে আছে যেসব নারীর তারাই রাক্ষসী নয় তো?

ডালিম কুমার গল্পের কথাই ধরা যাক। রাক্ষসী-রাণী (এখানেও রাক্ষসী রাণী ছদ্মবেশে) যেই দেখলেন ডালিম কুমার তার সাতপুত্রের সাথে দেশ-ভ্রমণে বের হয়েছে অমনি সে সতীন পুত্র যেন পাশাবতীর রাজকন্যাকে পরাস্ত করে তার পাশা নিয়ে না আসতে পারে, পারে যেন তার পুত্র সেজন্য কৌটা খলে সূতাশঙ্খ সাপকে লিখন দিয়ে পাঠলো।

“যাও ওরে সূতাশঙ্খ, বাতাসে করি ভর,
যম-যমুনার রাজ্য-শেষে পাশাবতীর ঘর!
এই লিখন দিও নিয়া পাশাবতীর ঠাঁই,
সাত ছেলের তরে আমার সাত কন্যা চাই।
রিপু অরি যায়, সূতা, চিবিয়ে খাবে তারে,
সতীনের পুত যেন পাশা আনতে নারে।”

অর্থাৎ লিখন বা বার্তা লেখার ক্ষমতা রাণীর আছে, আছে সেই বার্তা বহন করার জন্য অনুগত বাহক এবং সে বার্তা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্ক। তাই রাক্ষসী-রাণীর হুকুম পাওয়ামাত্র লিখন নিয়ে, সূতাশঙ্খ, বাতাসে ভর দিয়া গাছের উপর দিয়া-দিয়া চলিল। পক্ষীরাজও রাক্ষসীর হাতের পুতুল। রাক্ষসী-রাণী আবার যেই মন্ত্র পড়ল,

“পক্ষীরাজ, পক্ষীরাজ, উঠে চলে যা,
পাশাবতীর রাজ্যে গিয়ে ঘাস জল খা।”

অমনি মন্ত্র-পড়া পক্ষীরাজ একেবারে পাশাবতীর পুরে গিয়ে উপস্থিত। অর্থাৎ সাপ, পক্ষীরাজ বা প্রকৃতির অন্যান্য জীবের সাথে এই রাক্ষসী-রাণীর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বনে-জঙ্গলে বিভিন্ন প্রাণীকূলের মধ্যে যেমন আন্তঃনির্ভরতার সম্পর্ক থেকে যায়। এই পাশাবতীর পুরও সম্ভবত একটি নারীপ্রধান রাজ্য কারণ “পাশাবতীর পুরে পাশাবতী দুয়ারে নিশান উড়াইয়া ঘর-কুঠুরী সাজাইয়া, বসিয়া আছে। যে আসিয়া পাশা খেলিয়া হারাইতে পারিবে, আপনি, আপনার ছয় বোন নিয়া তাহাকে বরণ করিবে। …” ধারণা করা যায় পাশাবতীর নামেই এই রাজ্যের নাম পাশাবতীর পুর। এবং কাহিনী অনুযায়ী পাশাবতী ও তার ছয় বোন রাক্ষসী কারণ তাদের পাশা খেলার পণ হলো:

“যে জিনে সে মালা পায়,
হারিলে মোদের পেটে যায়!”

কোনো রাজপুত্রই তাদের সাথে পাশা খেলায় জিততে পারে না। এই রাজকন্যার সাথে রাক্ষসী-রাণীরও সম্পর্ক রয়েছে কারণ রাক্ষসী-রাণীর সাত পুত্রের সাথে পাশা খেলার আগে পাশাবতী কোন লিখন আছে কী-না জানতে চায়। সেই লিখন! এই পাশা খেলার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমার কাছে। হতে পারে এই পাশা হচ্ছে এই রাজত্বের সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং পাশা খেলা হচ্ছে কোনো যুদ্ধের প্রতীক। এই পাশা খেলায় হার-জিতের বিষয়টি আসলে রাজপুত্রদের সাথে রাজকন্যা পাশাবতীর যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের প্রতীকী উপস্থাপন। দেখা যাচ্ছে বরাবরই রাজপুত্ররা এই পাশা খেলায় হেরে যাচ্ছে এবং পাশাবতী ও তার ছয় বোন সেসব রাজপুত্র ও তাদের ঘোড়াসহ ভক্ষ্যযোগ্য সকল কিছু খেয়ে ফেলছে। অর্থাৎ এমনকি হতে পারে যে রাজপুত্র যারাই এসেছে এই সাত বোনকে হারিয়ে এ রাজ্য জয় করতে তারা সকলেই হেরেছে আর যুদ্ধে যারা হারে তারা তো বিজয়ী কর্তৃক গ্রাসিতই হয়? তাদের চিহ্ন আর পাওয়া যায় না? যেমন রাজপুত্র ডালিম কুমারের হাতে শেষ পর্যন্ত পাশাবতী যখন হেরে যায় তখন কিন্তু রাজপুত্রের সাথে আমরাও দেখি “সাত পাশাবতী সাত কেঁচো হইয়া মরিয়া রহিয়াছে।” ঠাকুমা’র ঝুলি-র এ পর্যন্ত যে গল্পগুলো দেখেছি সেখানে রাক্ষসী সবাই বুড়ি, বিগত-যৌবনা এবং তাদের আয়ত্বে অনেক ক্ষমতা। কারণ অনুমান করা যায় হয়তো। একদিক থেকে দেখতে গেলে সমাজে বিগত-যৌবনা, বৃদ্ধা নারীরা অসম্মানের পাত্র, যৌন-মূল্য হারিয়ে ফেলার কারণে, কাজেই তাদের উপস্থিতি উপেক্ষণীয়, আলোচনার অযোগ্য। কিন্তু যেসব নারী নিজগুণে এবং জ্ঞানে অনেক ক্ষমতার অধিকারী কিংবা শাসন করছেন নিজের ক্ষমতা বলয় তাদের অগ্রহ্য করা চলে না। তাদের পরাস্ত করতে হয়। পরাস্ত করার জন্য, যুদ্ধ ঘোষণার জন্য তাদের জ্ঞান, ক্ষমতা ও দক্ষতাকে অ-মানবিক, রাক্ষসীর বলে প্রতিষ্ঠিত করা বোধহয় প্রয়োজন হয়। আর একথাও ঠিক অনেক গুণ, দক্ষতা অর্জনের জন্য মানুষকে দীর্ঘ সময় সাধনা করতে হয়। দীর্ঘ সাধনার পর অন্যের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকারী যোগ্যতা অর্জন করতে তাকে বৃদ্ধই হতে হয়। আবার ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী বুড়ি অর্থাৎ জ্ঞানী নারীরা পুরুষতান্ত্রিক একচেটিয়া কর্তৃত্ব-ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। হয়তো এই উভয়বিধ কারণেই কোনো রাজ্যের প্রধান ক্ষমতার অধিকারী রাক্ষসীরা সবাই বুড়িÑ তিন বুড়ির রাজ্য, ছোট কাঁথা সেলাইকারী একশ বচ্ছুরে বুড়ি, রাক্ষস-খোক্কস রাজত্বের আয়ী-রাক্ষসী। কিংবা জ্ঞানী নারী মাত্রই রাক্ষসী। কিন্তু ডালিম কুমার গল্পটিতে পাশাবতী এবং তার ছয় বোন বুড়ি নয়। সুন্দরী-তরুণী। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত কোনো পুরুষের গলায় মালা দেয় নি। এবং স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করছে, যেখানে কোনো রাজপুত্রই এই রাজ্যকে জয় করতে পারছে না। হয়তো তাদের এই স্পর্ধাই তাদের রাক্ষসী অভিধায় প্রতিষ্ঠিত করেছে? আজও সমাজে “বিয়ের বয়স পার হয়ে যাওয়া” নারীকে অহরহই কি রাক্ষসী বা এ জাতীয় অভিধায় অভিহিত হতে দেখি না আমরা?

পাতালপুরীর রাজকন্যা মণিমালা। এই পাতালপুরী হচ্ছে সাপের পুরী। মণিমালা যদি এই পাতালপুরীরই রাজকন্যা হন তাহলে তিনি কিন্তু এই সাপেদেরই কন্যা। তাছাড়া আমরা তো এও জানি নাগ বা সাপ ভারতবর্ষেরই একটি জনগোষ্ঠীর নৃতাত্তি¡ক ঠিকুজি। কোসাম্বা তাঁর অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি বইতে দেখিয়েছেন মাতৃগোত্র এবং পিতৃগোত্র নিয়ে টানাপোড়েনের যুগসন্ধির সময়টাতে বিভিন্ন উপজাতিকে সাধারণভাবে নাগ বলে অভিহিত করা হতো। এবং এদের সামাজিক সংগঠন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল মাতৃপ্রধান। সে যাই হোক, সাপের পুরীর সাপেরা মণিমালার অন্তত কোনো ক্ষতি করে নি। মণিমালা সেখানে রাজকন্যা। যেহেতু সাপের পুরীর সম্পদ সাত-রাজার ধন অজগরের ফণীর মণি রাজপুত্র-মন্ত্রীপুত্রের করতলগত করা সম্ভব হয়েছে অজগরের পক্ষ থেকে বিনা উস্কানিতে কাজেই রাজকন্যাও তাদের হবেন এতে আর আশ্চর্য কী? সাপপুরীকে পরাস্ত করে “মণির আলো মণির বাতি, ঢাক ঢোলে হাজার কাটী, রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র, মণিমালা আর রাজকন্যাকে লইয়া অপনদেশে চলিয়া গেলেন!” অন্যের সম্পদ লুণ্ঠনের এই আগাগোড়া ইতিবৃত্ত বর্ণনার চমকে হয়ে উঠেছে আমাদের প্রিয় রূপকথা। আগেও দেখেছি রাজকন্যারা সম্পদের কাছে বিক্রিত হন। হতে পারে লুণ্ঠক রাজপুত্র সেই সম্পদ তারই রাজত্ব থেকে লুণ্ঠণ করেছেন। এই সম্পদ আর শক্তির কাছে নতজানু যে রাজকন্যা সে রাজবধু হয়ে লুন্ঠণকারী রাজপুত্রের সাথে নিজ দেশের সম্পদ নিয়ে চলে যান, তার রাজকন্যা ইমেজ অটুট থাকে। আর যিনি বিরোধিতা করেন এই লুণ্ঠন এবং পরাধীন হবার চক্রান্তের, তিনি রাক্ষসী। মাত্রই বলেছি সম্পদ যার কাছে, অরাক্ষসী রাজকন্যারা তার কাছেই বিক্রিত হন। তাই বাজারের নিয়ন্ত্রণকারী ঢোল-ডগর যখন বানরের হাতে, রাজপুত্রের প্রত্যাশায় বসে থাকা রাজকন্যা কলাবতী বানরকেই স্বামীর পদে বরণ করে নেন। যতদিন সাত-রাজার ধন অজগরের ফণীর মণি সাপের পুরীর সম্পদ ততদিন রাজকন্যা সাপের পুরীতেই বহাল তবিয়তে রয়েছেন। মণিই যখন রাজপুত্রের হাতে তখন তিনিও রাজপুত্রের। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য মণিমালার নির্বুদ্ধিতায় কিংবা পেঁচোর মা ‘বুড়ি’র (ঠাকুমার ঝুলির ১৮৪ পৃষ্ঠায় বুড়ির ছবিটা একবার দেখে নেয়া যেতে পারে। কী কুৎসিত করেই না আঁকা হয়েছে! ‘বুড়ো হাবড়া মেয়ে মানুষ’, যেন এক রাক্ষসী। পবনের নাও চালানোর কৌশল আয়ত্বে আছে বলেই কি? “হুর্ট হর্ট পবনের না’, মণিমালার দেশে যা” বলে মন্ত্র পড়লেই পবনের না’ মণিমালার দেশে চলে যায় বলে?) কুশলতায় কিছুদিনের জন্য যখন অজগরের মণিটি বুড়ির হাতে তখন পেঁচোর সাথে পেঁচোদের রাজত্বের রাজকন্যার বিয়ে হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। আসলে বিয়েও হয় কারণ তখন তো কেউ জানে না, যে-পেঁচো রাজকন্যাকে বিয়ে করলো সে আসলে ছদ্মবেশী মন্ত্রীপুত্র, ‘বুড়ো হাবড়া মেয়ে মানুষ’ পেঁচোর মায়ের কাছ থেকে মণিটি হাতিয়ে নেয়ার জন্য পেঁচোর রূপ ধারণ করেছেন! কিন্তু বাজারের নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ঢোল-ডগর, রাজ্য-শাসনের হাতিয়ার ছোট কাঁথা, পাশাবতীর পাশা, মণিমালার মণি কোনোটাই প্রকৃতপক্ষে বানর, পেঁচা, পেঁচোর মা দরিদ্র বুড়ির মত সাধারণের নিয়ন্ত্রণে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তাই আমরা দেখি বানর, পেঁচা আসলে ছদ্মবেশী রাজকুমার, পেঁচোর সাজ ধরে পেঁচোর মা দরিদ্র বুড়ির কাছ থেকে অজগরের মণি আত্মসাৎ করে রাজকন্যাকে বিয়ে করে যে-পেঁচো সে আসলে মন্ত্রীপুত্র। এ তথ্য বাসর ঘরে ফাঁস হলে রাজকন্যার মত আমরাও আশ্বস্ত হই আর বেচারী পেঁচোর মা বুড়ি ‘মাথা খুঁড়িয়া’ মরে। আমরা দ্বিতীয়বার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। রাজপুত্র মণিমালা, পাতালপুরীর সকল সম্পদ এবং সাতরাজার ধনের সমতুল্য মণি নিয়ে নিজ দেশে চলে যাবার পর “পাতালপুরীর সাপের রাজ্যের সকল সাপ বাতাস হইয়া উড়িয়া গেল।” গণহত্যা, ধ্বংস আর লুণ্ঠনের কী ভয়ঙ্কর চিত্র অথবা আমরা একবারের জন্য দীর্ঘশ্বাসটুকু পর্যন্ত ফেলতে প্ররোচিত হই না।
সোনার কাটী রূপার কাটী গল্পেও রাজপুত্র বনের মধ্যে রাক্ষসীর রোষের শিকার হলেন। রাক্ষসী খেয়ে ফেলেছে তার তিন বন্ধু মন্ত্রীপুত্র, সওদাগরপুত্র ও কোটালপুত্র এবং তাদের ঘোড়াদের। শুধু রাজপুত্রকেই খেতে পারে নি। এই রাক্ষসী রাজপুত্রকে খাওয়ার জন্য সুন্দরী নারীর বেশ ধরে রাজপুত্রকে তাড়াতে তাড়াতে যে রাজ্যে নিয়ে এসেছে সেই রাজ্যের রাজার রাণী হয়ে রাজপুরীতে প্রবেশ করে। এবং নিরন্তর চেষ্টা চালাতে থাকে রাজপুত্রকে খাওয়ার। যদিও আপন বুদ্ধিমত্তা এবং গাছ, মাছ, গৃহস্থ-বৌয়ের সাহায্যে রাজপুত্র প্রতিবারই রাক্ষসী-রাণীর হাত থেকে রেহাই পেয়ে যান। এই রাক্ষসী-রাণীরও কিন্তু রয়েছে নিজস্ব রাক্ষস-রাজত্ব, সেই রাজত্বের প্রধান, রাক্ষসী-রাণীর মা, একজন আয়ী-রাক্ষসী অর্থাৎ বুড়ি অর্থাৎ জ্ঞানী রাক্ষসী। অর্থাৎ সেই রাজত্বের প্রধান একজন নারী। কিংবা বলা যায় যেহেতু ওই রাজত্বের প্রধান একজন নারী, তাই তিনিই রাক্ষসী। সূত্র অনুযায়ী তিনি রাক্ষসী এবং বুড়ি। এই বুড়ি রাক্ষসী এবং তার বাহিনী এক রাজ্য বিজয় করে সকলকে খেয়ে ফেলেছেন কিন্তু শত্র“র শেষ এক রাজকন্যাকে স্নেহে প্রতিপালন করছেন। শত্র“র শেষ রাখার কোনো নির্বুদ্ধিতা কোনো রাজপুত্রই কখনো দেখান নি। সোনার কাটী, রূপার কাটী বদল করে রাজপুত্র প্রথমে রাজকন্যাকে জাগিয়েছেন এবং পরে এই রাজকন্যাই আয়ী-রাক্ষসীর কাছ থেকে স্নেহের প্রশ্রয়ের সুযোগে জেনে নিয়েছেন রাক্ষস-রাজত্বের সকল মৃত্যু-কবচ, জেনে নিয়েছেন রাজপুত্রের পিছু নেয়া আয়ী-রাক্ষসীর মেয়ে রাক্ষসী-রাণীর মরণ-বানের হদিস। আয়ী-রাক্ষসীর কথা থেকে বোঝা যায়, তাদের রাজত্ব এবং জীবন অত্যন্ত সুরক্ষিত। “… এ পিত্থিমির মোঁদের কিঁচ্ছুতে মঁরণ নাঁই। …” মানবপুত্রীকে আয়ী-রাক্ষসী শুধু যে অপত্য স্নেহে লালন করেছেন তাই-ই নয়, তার ছলনায় ভুলে তাকে আশ্বস্ত করার জন্য তাদের সবার প্রাণ-ভোমরার গুপ্ত খবরও বাতলে দিয়েছেন। পুকুরের ফটিক-স্তম্ভের ভেতর সেই রাজ্যের, রাজ্যের অধিবাসীদের রাজ্য-ও-জীবনব্যবস্থা সংরক্ষনের মাস্টার-প্ল্যান যা জানতে পারলেই কেবল সেই রাজত্ব এবং সেই রাজ্যের অধিবাসীদের ধ্বংস করা যায়। এই মাস্টার-প্ল্যান আবার জানা সম্ভব কেবল ভিতরের মানুষের কাছ থেকেই। রাজকন্যা আয়ী-রাক্ষসীর প্রিয় বিশ্বস্ত মানুষ বলেই তাকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে এই রাজত্বের সকল অধিবাসীর জীবন ও সম্পদ সংরক্ষণের গোপন মাস্টার-প্ল্যান উদ্ঘাটনের দুর্লভ কাজটি সম্পাদনে। রাজকন্যার কাছ থেকে সেই মাস্টার-প্ল্যান জানার পর রাজপুত্র কিন্তু এক মুহুর্ত দেরী করেন নি। রাজপুত্র নিঃশ্বাস বন্ধ করে তালগাছে উঠে তালপত্র খাঁড়া পেড়েছেন, তারপর পুকুরে নেমে স্ফটিকস্তম্ভ ভেঙ্গে সাতফণা সাপের গলা কেটে ফেলেছেন এক ফোঁটা রক্তও মাটিতে পড়তে না দিয়ে। আয়ী-রাক্ষসীসহ রাক্ষস-রাজত্বের সকল রাক্ষসের মুন্ডু খসে পড়ে গেলো। তারপর হাসন চাঁপা নাটন কাটী, চিরণ দাঁতের চিকন পাটি এবং শুক পাখী নিয়ে রাক্ষসী-রাণীর রাজত্বে গিয়ে শুক পাখীর গলা ছিঁড়ে তাকেও মেরে ফেলেছেন রাজপুত্র। এবং এভাবে তার বীরত্ব, কুশলতা এবং নৈপুণ্যের চমৎকারিত্বে “পৃথিবীতে যত রাক্ষস জন্মের মত ধ্বংস হইয়া গেল।” কী ভয়ঙ্কর! ঠাকুমার ঝুলির একের পর এক গল্পগুলোতে আর কোনো সুয়োরাণী-দুয়োরাণী, রাজপুত্র-রাজকন্যা এবং রাক্ষসীর গল্প নেই। সম্ভবত এ কারণে যে সকল সুয়োরাণীকে হেঁটে কাঁটা, উপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলার কাজ সুসম্পন্ন হয়ে গেছে, তিন বুড়ি, একশ বচ্ছুরে বুড়িসহ সকল বুড়িদের অর্থাৎ জ্ঞানী নারীদের পরাস্ত করে তাদের ক্ষমতা-কর্তৃত্ব এবং সম্পদ লুট করার কাজ শেষ হয়ে গেছে। অবাধ্য-রাণীদের সকল রাজত্ব ধ্বংস করে পৃথিবীর সকল রাক্ষসকে জন্মের মত নিশ্চিহ্ন করার কাজটি সম্পাদিত হয়ে পৃথিবীতে রাজপুত্রদের রাজত্ব কায়েম হয়ে গেছে।

কলাবতীর পুর, তিন বুড়ির রাজ্য, পাশাবতীর পুর, নীলকমলের আয়ীমার রাজ্য, পাতালপুরীর সাপেদের রাজ্য, সোনার কাটী-রূপার কাটীর রাক্ষসী-রাণীর রাজ্যসহ সকল নারীপ্রধান রাজ্য ততদিনে পরাস্ত, লুণ্ঠিত হয়েছে। নারীপ্রধান রাজ্যগুলোর সকল ক্ষমতা ও সম্পদ স্তুপীকৃত হয়েছে রাজপুত্রদের রাজত্বে। নারীপ্রধান রাজত্বের যেসব কন্যা এই নতুন ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছেন তারা বেঁচে গেছেন, রাণীর (নাকি দাসীর?) জীবন-যাপন করছেন। যারা মানেন নি তারা নিহত হয়েছেন। রাজপুত্রদের নতুন পুরীতে, নতুন ব্যবস্থায় রচিত এবং গীত হচ্ছে তাদেরই বিজয়গাঁথা। গাইছেন হার-মানা, বশ্যতা স্বীকারকারী নারীরা। যারা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশ ও উপাদান হয়ে পড়েছেন ইতিমধ্যে। যেমন বলছেন হালের ইকোফেমিনিস্টগণ: কেবল যে পুরুষই নারীকে অবদমিত করেছে, অমর্যাদা-অপমান করেছে তা নয়। সমস্ত পুরুষ-পরিমণ্ডল গ্রহণ করেছে নিয়ন্ত্রকের বা শাসকের ভূমিকা, আর নিয়ন্ত্রিত দমিত ও শাসিত হচ্ছে সমগ্র স্ত্রী-পরিমণ্ডলটাই। তারা এও বলেছেন যে, ওই স্ত্রীপরিমন্ডলের মধ্যে শুধুমাত্র যে নারীই এমন নয়, আছে নিম্নবগীয় মানুষ, অর্ধসভ্য বর্বর, জীবজন্তু, জড়প্রকৃতি, বন, নদী, পাহাড়, সমুদ্র সব্বাই।

ইকোফেমিনিস্টদের এই ব্যাখ্যায় এসে একটা গুরুতর ধন্দের মীমাংসার ইঙ্গিত বুঝি পাওয়া যায়। ঠাকু’মার ঝুলিতে রাক্ষসীদের চেহারার যে বর্ণনা বা ছবি দেয়া আছে, বারবারই মনে হয়েছে এরা কারা? কোন নরগোষ্ঠীকে কল্পনা করে আঁকা হয়েছে এসব ছবি? কখনো মনে হয়েছে রাক্ষসীদের অন্তর্গত বিকটত্ব বোঝানোর জন্য বুঝি এমন ছবি আঁকা হয়েছে। হতেই পারে এটি একটি সম্ভাব্য কারণ। আবার এমনও হতে পারে এরা ভারতবর্ষের নিম্নবর্গীয় মানুষ, কালো, অন্ত্যজ। আর্য-নান্দনিকতাবোধ যাদেরকে রাক্ষস বা বিকট হিসেবে দেখিয়েছে। রামায়ণেও আমরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে রাক্ষস হিসেবেই চিহ্নিত হতে দেখি। তাড়কা রাক্ষসীর কথা এক্ষেত্রে উলে­খ করা যেতে পারে। আজকের দিনে এসে সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষকরা যেমনটা বলছেন অরণ্যচারী আদিবাসী কোনো জনগোষ্ঠীর মাতৃতান্ত্রিক প্রধান হচ্ছেন তাড়কা রাক্ষসী। মুনিদের সাথে তাদের যুদ্ধের কারণ হচ্ছে এসব মুনিরা জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করেছিলেন। অন্যদিকে অরণ্য ছিলো এসব সমাজের বেঁচে থাকার রসদ জোগানোর উৎস। তাড়কাদের সমাজটা তখনও সংগ্রহজীবী। তাড়কা যে কারণে রাক্ষসী, হতে পারে সেই একই ধরনের কারণে রূপকথার এই নারী চরিত্রগুলোও রাক্ষসী। আজও অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী, যাদেরকে তথাকথিত সভ্যসমাজ নিম্নবর্গীয়, অর্ধসভ্য বর্বর মনে করে তাদের মধ্যে এখনও মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। প্রচলিত রয়েছে সংগ্রহজীবীতা। আমাদের দেশে মধুপুরের গড়ে গারো জনগোষ্ঠী বন থেকে যে সামান্য পাতা, পড়ে থাকা বৃক্ষের ডাল বা মধু সংগ্রহ করে সেই বিষয়টিকেই আমরা বাঙালিরা রঙ চড়িয়ে বন নিধনের দায়ে তাদের অভিযুক্ত করি অথচ একটা সত্য আমরা মাথায় রাখি না নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই গারো জনগোষ্ঠী কখনো বন ধ্বংস করবে না। এখনো সংগ্রহজীবীতা তাদের সমাজে বেঁচে থাকার অন্যতম উপায়। অদ্ভূত আরও একটি সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে। রূপতরাসী পর্বের গল্পগুলোতে সরাসরি রাক্ষসীদের উপস্থিতি দেখতে পাই। এসব রাক্ষস-রাজত্বের প্রদান, আয়ী-রাক্ষসীসহ সকলেই প্রতিদিন সকালে যায় খাদ্যের সংগ্রহে। তাহলে কি এসব রাক্ষসী সেইসব অরণ্যচারী সংগ্রহজীবী মাতৃতান্ত্রিক সমাজের মায়েরা? যাদের সাথে নিরেট বস্তুগত প্রয়োজনেই যুদ্ধ বেধেছে রাজপুত্র তথা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্যোমী পুরুষদের?

কেমন করে রাক্ষসীরা মানুষ হয়ে রয়!
কখনোবা দেখা যাচ্ছে অপূর্ব সুন্দরী রাক্ষসী রাণী হয়ে অবস্থান করছেন কোনো রাজার পুরীতে, কিংবা নিজ রাজত্বে পাশা খেলছেন। বোঝার জো-টি নেই যে সে রাক্ষসী। অথচ ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে তার রাক্ষসী পরিচয়। আচারে, বাহ্যিক চেহারায়। হতে কি পারে শুধু নিম্নবর্গীয় নারীরাই নয় উচ্চশ্রেণীর স্বাধীনচেতা নারী, নারী-রাজ্যের প্রধান বিপুল ক্ষমতার অধিকারী অবিবাহিত নারী (যেমন পাশাবতী এবং তার ছয় বোন) যাদেরকে সহজেই, আপসেই বশ করে সম্পত্তিসহ নিজ রাজ্যে নিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে হয়েছে অথচ সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় নি তাদের ক্ষেত্রেই সুন্দরী নারীর ক্রমে রাক্ষসী পরিচয় প্রকাশিত হবার রূপকটি ব্যবহৃত হয়েছে? আমার মনে হয় এসব গল্প সমগ্র পুরুষ-পরিমন্ডলের সমগ্র স্ত্রী-পরিমন্ডলের উপর নিয়ন্ত্রণ বা শাসন প্রতিষ্ঠার কাহিনী। তাই জীব-জন্তু, জড়প্রকৃতি, বন, নদী, পাহাড় কোনো কিছুর প্রতিই রাজপুত্রদের মমতা দেখা যায় না। আজকের ইকোফেমিনিস্টরা যেমনটা বলছেন যে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসন এবং বিস্তার প্রকৃতি-পরিবেশকে খুব সামান্যই বিবেচনায় নিয়েছে। অবলীলায় বুদ্ধু পাতায় পাতায় ফল যে গাছে তার গোড়ায় জড়ানো অজগরকে কেটে গাছের সমস্ত ফল পেড়ে নেয়, বুড়ির কাঁথা-ঢোল-ডগর-কৌটা সব লোপাট করে নিয়ে যায়। রাজপুত্র বসন্ত গজমোতি নেবার জন্য পাহাড়ের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে গজমোতির উপর পড়ার সাথে সাথে “ক্ষীর সাগর শুকাইয়া গেল, পদ্মের বন লুকাইয়া গেল”, তবুও বসন্ত গজমোতি নিয়ে গেলো। কিরণমালা মায়া পাহাড় থেকে উপরে নিয়ে এলেন রূপার গাছ, সোনার ফল ধরা হীরার গাছ, সোনার পাখী, মায়া পাহাড়ের মুক্তাঝরণা-জলের ঝারী, পাহাড় রিক্ত হয়ে গেলো। লালকমল আর নীলকমল খোক্কস রাজত্বের সকল খোক্কস এবং রাক্ষস রাজত্বের সকল রাক্ষসকে হত্যা করলো। ডালিমকুমার চূর্ণ করেছেন কড়ির পাহাড়, চূর্ণ করেছেন হাড়ের পাহাড়, রক্তের তরঙ্গ, রক্তের ঢেউ উঠেছে, কেটে ফেলেছেন সূতাশঙ্খ সাপ, নিহত হয়েছেন সাত পাশাবতী, ফেঁটে চৌচির হয়েছে রাজপুরীর তালগাছ। পাতালকন্যা মণিমালা-য় স্রেফ অজগরের মণির লোভে কাল অজগরকে কেটে ফেলা থেকে শুরু করে পাতালপুরীর সাপের রাজ্যের সকল সাপকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। সোনার কাটী-রূপার কাটীতে চিরদিনের মত নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে রাক্ষস-প্রজাতিকে। রাজপুত্রদের প্রতিটি বিজয়ের সাথে সাথে ধ্বংস হয়েছে অরণ্য, নদী, প্রান্তর, পাহাড়, জীব-জন্তু, বিভিন্ন মানবপ্রজাতি, বিভিন্ন বসতি। ধ্বংস হয়েছে জীববৈচিত্র্য। হত্যা আর ধ্বংসের নিষ্ঠুরতার উপর গড়ে উঠেছে বুধকুমার-রূপকুমার-ডালিমকুমার-লালকমল-নীলকমলদের বিজয়-কাহিনী, বাঙালির রূপকথা ঠাকুমার ঝুলি। রাক্ষসীরা কীভাবে মানুষ হয়ে রয়, সে বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। আসলে ওরা তো মানুষ। মানুষ হয়ে রইবে কেনো?

তবে কি আমারই পরাভব-গাঁথায় মানস সাজাই?

মানস গড়ে তোলা হয়েছে নিজেকে বন্দিনী রাজকন্যা হিসেবে ভাবতে। স্বপ্নের রাজকুমার আসবে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, ময়ূরপঙ্খীর নায়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর জল ছাড়িয়ে উদ্ধার করতে। পাঁচালীতে বড় সরাসরি কথা ছিলো, বালিকা-মন বিদ্রোহ করতে পেরেছে। রূপকথার জগত বর্ণিল, স্বপ্নের ছবি আঁকা, শৈশবের নিবিড় মমতা মাখা। মানুষ কখনোই আর শৈশবে ফিরে যেতে পারে না বলেই হয়তো শৈশবের অনুষঙ্গ, শৈশবের স্মৃতি-স্বপ্ন-সাধ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে পারে না। শৈশবে মস্তিষ্কে গেঁথে দেয়া পুরুষপরিমন্ডলের এই সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ছন্দে-ভাষায় গ্রথিত এসব রূপময় জগতের কাহিনী থেকে নিজেকে পরিত্রাণ দেয়া যায় না বলেই হয়তো বারবার পড়ি আমরই পরাভবের, অবমাননার রূপকল্প। ঘুরে মরি এ জগতের চারিধারে অথচ মনে হয় এখানে আমাকে দারুণ বঞ্চনা করা হয়েছে। দুই দিক থেকেই এ আমার পরাভবগাঁথা। যদি আমি রাজকন্যা তবে আমি বন্দিনী, আমাকে উদ্ধার করে নতুন বন্দীশালায় সোনার নুপুর কিংবা সোনার শেকল পরান রাজপুত্র। যদি আমি বুড়ি কিংবা রাক্ষসী, আমার জ্ঞান, স্বাধীনতা, আমার রাজত্ব ধ্বংস করে আমাকে নির্ব্বংশ করেছেন রাজপুত্ররা। রূপ-রস-ছন্দে-কল্পনায় বিকল্প কাহিনী নির্মাণের এবং শ্রবণের জন্য বড় আর্তি বোধ করি অন্তরে।

ভারতের অনেক অঞ্চলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিলো তথ্য হিসেবে এ অতি পুরণো। কিন্তু সে-বিষয়ের উপর স্পষ্ট ইতিহাসের বড় অভাব, ইউরোপের ইতিহাসে যেমন একটা স্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যায় এ অঞ্চলের ইতিহাসে বড় ধরনের এক বিচ্ছিন্নতায়, অস্পষ্টাতায় আছি আমরা। কলিম খান যাকে বলেন ইতিহাসের সাথে এক পর্যায়ে এসে আত্মবিচ্ছেদ ঘটেছে আমাদের। ভারতবর্ষের সামাজিক ইতিহাসের বিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনায় ঘুরে ফিরে বিভিন্ন বৈদিক সাহিত্য, উপনিষদ, পুরাণ, বিভিন্ন কিংবদন্তীর বিশ্লেষণকে সাক্ষ্য হিসেবে দেখা হয়। যেমন প্রাচীন ভারতে মাতৃপ্রাধান্য: কিংবদন্তীর পুনর্বিচার গ্রন্থে সুজিৎ চৌধুরী দেখিয়েছেন বৃহদারণ্য উপনিষদের একেবারে শেষ অধ্যায়ে একই সঙ্গে ছত্রিশজন উপনিষদকারের তালিকা পাওয়া যাচ্ছে যারা সকলেই মাতৃপদবীধারী। তিনি দেখিয়েছেন সাতবাহন যুগে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে মাতৃগোত্রধারীদের ব্যাপক সামাজিক সংগঠন মহিমান্বিতরূপে বিরাজমান ছিলো। এসব তথ্য থেকে তিনি দুটি প্রশ্ন তুলেছেন। প্রথমত, সুদূর অতীতে কি উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত একটি বিস্তৃত মাতৃগোত্রধারী সমাজের অস্তিত্ব ছিলো? সাতবাহনরা কি সেই ধারারই লুপ্তপ্রায় অবশেষ? দ্বিতীয়ত, বৈদিক গোত্রপিতা বলে যারা পরবর্তী যুগে যারা স্বীকৃত, তাঁরা কি মূলত মাতৃগোত্রেরই ধারক ছিলেন? অর্থাৎ গোত্রমাতারা কি পিতৃতান্ত্রিকতার পরবর্তী প্রবাহের চাপে গোত্রপিতায় রূপান্তরিত হয়েছেন? বলা বাহুল্য, সামাজিক এই পালাবদল একদিনে হয় নি, অবলীলায় অনায়াসেও হয় নি। মেরলিন স্টোন তাঁর প্যারাডাইজ পেপারস গ্রন্থে দেখিয়েছেন, মিশর ও পশ্চিম এশিয়ায় এই পালাবদল সংঘাত, দ্ব›দ্ব, রক্তপাত ও নিপীড়নের কী বিভৎস পটভূমি তৈরি করেছিল!

ইতিহাসের কোন কালপর্বে বাংলার কোন অঞ্চলে কোন ধরনের যুদ্ধ বা কী কী পরিস্থিতিতে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখা সম্ভব না-হলেও একটা কাঠামো থাকা প্রয়োজন আমাদের সামনে। হয়তো ইতিহাস খুঁড়লেই পাওয়া যাবে শত ঝর্ণার জল, সেই জলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে রূপকথার কাহিনীগুলো, অবয়ব পাবে। এদেশের সামাজিক ইতিহাসের বিবর্তন সম্পর্কে ব্যাপক এবং সচেতন সেই গবেষণাটি শুরু করা প্রয়োজন শুধু নয়, আশু কর্তব্য।

গবেষণা না-করে, পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই এ জাতীয় লেখার সাহস করে বসা গর্হিত, সেটুকু বোধ আমার আছে। তবে প্রতিটি টেক্সটই নিজেও কিছু ধারণা দেয় বা বলা নিরাপদ যে এই টেক্সটগুলো আমার অনুধাবনের জগতে অর্বাচিন কিছু প্রশ্ন, কিছু ধারণার জন্ম দিয়েছে। অকপটে সে কথাগুলোই লিখলাম। আমি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি। সেটা সম্ভবও নয় নিবিড় গবেষণা, পূর্বাপর নিদ্ পাঠ ছাড়া। একজন নারী হিসেবে আমার মানসগঠনে পাঁচালী, রূপকথা এসবের প্রভাব এবং সেখান থেকে এসব বিষয়ে আমার একান্ত নিজস্ব কিছু উপলব্ধি হিসেবে লেখাটিকে দেখলে আমার প্রতি সুবিচার করা হবে। যেসব সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনা করলাম সেগুলো ছাড়াও কেউ যদি আমার চিন্তা-পদ্ধতির ফাঁকগুলো ধরিয়ে দেন, কৃতজ্ঞ হবো। যেকোনো সমালোচনা, যত কঠিনই হোক, আমার এ বিষয়ের পঠন-পাঠন, জানা-বোঝা-আত্মীকরণের পরিসরকে সমৃদ্ধ করবে। আমি মনে করি উত্থাপিত প্রসঙ্গগুলো রূপকথার কাহিনী বলে পাশ কাটিয়ে চলা যায় বটে, তবে তা হবে, অন্তত মেয়েদের ক্ষেত্রে, আত্মবিস্মৃতি ইতিহাসের উপর আরো একপোঁচ ধুলো জমতে দেবার সচেতন বা অসচেতন প্রশ্রয়। কোনো টেক্সটই কি শেষ পর্যন্ত তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে ভিন্ন কিছু? এমন কি হতে পারে যে আমাদের মা-দিদিমা-ঠাকু’মারাই তাঁদের পরাভব-গাঁথার সংকেত রেখে গেছেন উত্তর প্রজন্মের কাছে, গল্পের ছলে, সেসব সংকেত উন্মোচনের জন্য?

The post ঠাকু’মার ঝুলির সেইসব বুড়ি, সুয়োরানী এবং রাক্ষসীরা first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/thakurmar-jhulir-sheishob-buri-shuyorani-ebong-rakkhoshira/feed/ 0
হীরা বেগম https://kaberigayen.com/hira-begum/ Wed, 26 Jan 2022 14:11:12 +0000 https://kaberigayen.com/?p=6787 আর সেবার বসন্তের মাঝামাঝিতেই সেই তীব্র গরমে আমের গুটিগুলো পুষ্ট হতে পারেনি তেমন। কতক ঝরে পড়েছিল কাজলা, বিনোদপুর, মেহেরচণ্ডী, শিরোইল আর বালিয়াপুকুরের ধুলোওড়া বালি-বালি মাটির উপরে, কতক গাছে গাছে ঝলসে গিয়েছিল...

The post হীরা বেগম first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
আর সেবার বসন্তের মাঝামাঝিতেই সেই তীব্র গরমে আমের গুটিগুলো পুষ্ট হতে পারেনি তেমন। কতক ঝরে পড়েছিল কাজলা, বিনোদপুর, মেহেরচণ্ডী, শিরোইল আর বালিয়াপুকুরের ধুলোওড়া বালি-বালি মাটির উপরে, কতক গাছে গাছে ঝলসে গিয়েছিল। ঝলসে যাওয়া সেসব গুটি গাছের ডালেই দিব্যি কালো হয়ে কেমন বেগুনপোড়া রূপ নিয়ে লটকে ছিল। সে এমন গরম, সকাল বোঝা যেত না। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলত, রাজশাহীতে শুধু দুপুর আর রাত আছে, কোনো সকাল কিংবা বিকেল নেই। ভোরের আলো ধুলো-ধূসর আম, কাঁঠাল আর লিচুর প্রায় শুকিয়ে আসা পাতা ভেদ করে ঘরের কার্নিশ ছুঁতে না ছুঁতেই আর আলো থাকত না, তাতানো আগুন হয়ে যেত। হুড়োহুড়ি পড়ে যেত দরজা-জানালা বন্ধ করার। এটা যে শুধু সেবারই হয়েছিল রাজশাহীতে বিষয়টা নিশ্চয়ই এমন না, তবে সেবারের তীব্রতা আর বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল বোধ করি। মাছ মরে মরে ভেসে উঠেছিল পুকুরে নদীতে। অনেক মাছের গায়ে ঘা। দুপুরে নেহাত জরুরি কাজ ছাড়া কেই-বা বের হতে চায়? রিকশাওয়ালাদের মুখে গামছা আর সাইকেল আরোহীদের সাদা কাপড়ে বাঁধা মুখ দেখে সৌদি আরবীয়দের পোশাক ডিজাইনের অনন্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকে না। দুপুরে, খাঁ খাঁ দুপুরে, মাঝে মাঝে মিউনিসিপ্যালিটির বৈদ্যুতিক তারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাকদের অলস কা-কা ডাকা দুপুরে, মিউনিসিপ্যালিটির শানবাঁধানো পুকুরে ঘামাচি-ওঠা কালো কুচকুচে গায়ে সাদা খড়খড়ি ওঠা শিশুদের জলের মধ্যে হল­া করা দুপুরে এসব কালো কালো হাড়-জিরজিরে শিশুদের মায়েদের বড় ব্যস্ততা। গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ার অনিবার্য সম্পর্ক কলস কাঁখে এদের দাঁড় করায় রাস্তার পাশের কলতলায়। ইলেকট্রিসিটি নেই তো রিজার্ভ ট্যাংক থেকে জল তোলার ব্যবস্থা নেই। জল তুলে দিতে হয় কাজের বাড়ির তিনতলা, দোতলা কখনোবা চারতলায়। এ এক জ্বালা  ‘শালার মামুগের বউ-বিটিগুলান সব আইলসে হয়্যা গিলচে’ মামানীদের হাঁড়ির খবর এই জল তোলার ফাঁকে ফাঁকে তলায়-তলায়, এবাড়ি-ওবাড়ি দ্রুতই পৌঁছে যায়।

 

তো এহেন দুপুরেও নাহারকে বের হতে হয়েছে, তিন্নিদের বাড়ি পাহারা দিতে হবে রাত আটটা পর্যন্ত। খালাম্মার উৎকণ্ঠা মেশানো অনুরোধ না হলে নাকি ঘরের জানালা-দরজাসুদ্ধ চুরি হয়ে যাবে নতুন বুয়ার কল্যাণে। দিন-তিনেক আগে বুয়াকে দুই টুকরা মাছের পোঁটলাসহ হাতেনাতে ধরা হয়েছে কিন্তু সময় খারাপ, তিন্নি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, আর চোর হলেও বুয়ার কাজ নাকি ভালো। কাজেই উপযুক্ত আরেকজন না পেয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া এই দুঃসময়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, খালাম্মা সতর্ক করে দিয়েছেন। বুয়া যদিও বেশি কথা বলে না; কিন্তু কয়েক দিন ধরে তার আচরণ সন্দেহজনক, প্রায়ই আপনমনে কথা বলে, এমনকি ‘সাধ না মিটিল, আশা না পূরিল’ গানও করে যখন-তখন। খালাম্মার পরামর্শ, ‘বেতাল দেখলে কইষা ধমক দেবা বিটিরে আর মোটে চোখের আড়াল করবা না।’ রিকশা শিরোইল পার হয়ে বালিয়াপুকুরের দিকে ঘুরতে গিয়ে ব্রেক কষে দাঁড়ায় ঢোপকলের সামনের জটলায়, সারি সারি কলস-বালতি-গামলা আর কোলাহল। শুভ্র বলে এই ঢোপকলগুলো দেখলে তার মন খারাপ হয়ে যায়, মনে হয়, কলগুলো খুললেই অতীত থেকে মানুষ বেরিয়ে আসবে অথবা তারা আসে, কাজটাজ শেষ করে আবার ঢোপকলে ঢুকে যায় চুপিচুপি। কী যে সব কথা! সত্যি নাহারও কিন্তু কোনোদিন এই ঢোপকল থেকে কাউকে জল নিতে দেখেনি, কলস-বালতিই দেখেছে আশপাশে। বলতে গেলে আজই প্রথম কলস-বালতি-গামলার পাশাপাশি উৎকণ্ঠিত মহিলাদের প্রবল উপস্থিতি চোখে পড়ল। অন্তত জনাদশেক মহিলা জড়ো হয়েছে জল নেওয়ার জন্য, কার আগে কে কলস-বালতি এগিয়ে দেবে এ নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা; এই প্রতিযোগিতায় কোনো পুরুষ নেই, তবে হাড়গিলে চেহারার এক পুরুষ আগায় দুটো পাতাসহ হাতখানেক লম্বা এক বাঁশের কঞ্চি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরিচালনা করছে গোটা জল নেওয়া মহাকর্ম, ‘কামালের মা, ঠ্যসা হয়্যা খাড়া আছো ক্যান, সরাও, বালতি সরাও ব্যুলছি…।’

 

বুয়া আর নাহার একসঙ্গেই ঘরে ঢোকে, বুয়া দরজায় অপেক্ষা করছিল। ঘরে ঢুকেই, নাহার লক্ষ করে, বেশ পরিপাটি করে বুয়া দুটো গামলায় জল নেয়, বঁটিটা সুন্দর করে ধুয়ে একটা ছালা কয়েক ভাঁজ করে তার ওপর বসে নিবিষ্ট মনে একটা চিচিঙা তুলে নেয় সবজির ঝুড়ি থেকে। দেখে দুর্ধর্ষ চোর বলে মানা শক্ত, কিন্তু চোখে চোখেই যখন রাখতে হবে অন্তত নামটা তো জানা যাক, বুয়া ডাকটা আদরের অথচ ব্যবহারের ফেরে মনে হয় যেন এক আলাদা জীব!

 

আমার নাম? অচ্চনা…(জিভ কেটে) হীরা বেগম। ক্যান যে আজ-কাইল এত ভুল হয়!

ভুল শুধরে নেবার তাগিদেই কি না, ফ্যাকাসে মুখে হীরা বেগম কোমর অবধি তার পিঠ-ছাওয়া কালো ভেজা চুল দ্রুত ঢেকে নেয় শাড়ির আঁচলে। লিকলিকে সাদা দুই হাতে দুই-দুই চার গাছা বিবর্ণ প্লাস্টিকের চুড়ি শব্দহীন দুলতে থাকে চিচিঙার ত্বক ছাড়ানোর দ্রুত নিপুণতায়। লিকলিকে হাত-পা, কোটর থেকে প্রায় বেরিয়ে আসা বড় বড় চোখের গাল ভাঙা হীরা বেগমের চুল বিস্ময়কর, আঁচলের নিচ দিয়ে চুলের আগা প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই। যেন-বা চুলের স্বাস্থ্য অটুট রাখতেই স্বাস্থ্যহীন হয়েছে গোটা অবয়ব।

 

আমি হিন্দু ছেলাম তো ফিসফিসিয়ে বলে হীরা বেগম, আমার আগের নাম ছেলো অচ্চনা।

কী বলা উচিত এ ধরনের পরিস্থিতিতে, বুঝে উঠতে না পারার জন্যই হোক কিংবা আদৌ এ কথার কোনো তাৎপর্য আছে কি না, সে মীমাংসায় পৌঁছাতে না পারার জন্যই হোক, নাহার চুপ। চিচিঙার ত্বক ছাড়ানো শেষ হলে হীরা বেগম মনোযোগী হয় চিচিঙা কুচানোতে। মাথার ওপর ফ্যানের ক্রমাগত ঘ্যাঁচোর-ঘ্যাঁচোর-ঘ্যাঁচ, ঘ্যাঁচোর-ঘ্যাঁচোর-ঘ্যাঁচ শব্দ বিদ্যুতের অবস্থিতি জানান দিচ্ছে এই কত, বাতাস দিতে হবে, এমন দিব্যি তো কেউ দেয়নি, নাহার বেশ আমোদ বোধ করে, গরমে কেমন ঘুম ঘুম অবশ অবশ লাগে।

 

সাতপাড়, জলির পাড়, বেন্নাবাড়ির নাম শোনছেন? জলির পাড়ে যে গিজ্জা, তারই কোলের ’পার ছেলো আমাগো বাড়ি। নোমোগো বাড়ি সব। বিলের ’পার বিল, বষ্যাকালে চান্দার বিল, বাইগ্ঘার বিল হইতো সমুদ্দরো তয় ঠাউম্মা’র কাছে শুনছি সমুদ্দরে নাইল নাই, কচুরি নাই, কচুরি ফুল নাই। আমাগো বিলগুলানে যে কতো পদের নাইল ছেলো, তা’ গুইনা সারা যাইতো না। সাদা নাইল, বেগুনি নাইল, হইলদা নাইল, সাদা-বেগুনি-হইলদা ছিটা দেওয়া নাইল, তা বাদে নাল নাইল, নিলা নিলা নাইল, পেউচা নাইল, সন্ধি নাইল, সারা বিল নাইলে নাইলে পুন্নিমা হইয়া থাকত। নাইল খাইছেন তো খালা? খাইছেন খাইছেন, হাপলা কইলেই চেনবেন নে। আষার-ছেরাবন মাসে পেট মোটা মোটা সব পুঠি মাছ, কালা কালা চোক, পুঠি মাছ দিয়া মা নাইল রান্ধতো কাচা নংকা আর এট্টু রান্ধুনী সোমবার দিয়া কী তার স্বাদ!

 

হীরা বেগমের চোখ চকচক করে নাইলের সৌন্দর্যে, নাকি নাইলের স্বাদে বোঝা মুশকিল, হতে পারে দু কারণেই। নাহারের ঝটিতি মনে পড়ে একটা বিজ্ঞাপনের স্লোগান, জীবন বাঁচাতে, জীবন সাজাতে স্কয়ার। স্কয়ার কী? আশ্চর্য, কেন মনে পড়ল এই বিজ্ঞাপন? ‘বাতাসের চেয়ে দ্রুতগামী কে?’, ধর্মের এই প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠিরের জবাব যদি ‘মন’ না হতো তাহলেও কি সবাই জানত বাতাসের চেয়ে দ্রুতগামী আসলে মানুষের মন? ধ্যাত, কী সব চিন্তা! গরমে ধরেছে নির্ঘাত। ভালো কথা, সন্ধ্যাকে মহাভারতটা ফেরত দিতে হবে।

 

আমার কুট্টি বুন্ডি নক্ষি? মা পাতে নাইলের তরকারি দেলেই কইতো, ‘আরেট্টু দ্যাও’, মা হাতা দিয়া ওর পাতে দেতে দেতে কইতো, ‘আরেট্টু আরেট্টু কইরো না, আমার তো সবার পাতেই ইট্টু ইট্টু দেয়া নাগবে, না কী!’ মা’র কী দোষ! আমরা তিন বুন, তিন ভাই। বাবার এট্টা ছোট্ট দোহান, দাদারা স্কুলে যাইতো, আমোও যাইতাম। আমার দিদি সরস্বতীর বিয়া হইছেলো এক দোজবরের সাথে, বেটা ভারি বদ ছেলো, খালি মারতো দিদিরে। দিদির সতিন, সতিনের বড় মাইয়া অমলা পেরায় দিদিরই বয়াসী, সবাই দিদিরে ভারি কষ্ট দেছে, খাইতে দেতো না ঠিক সোমায়মতো, খালি কাম করাইতো। বেশি মাইর খাইলে দিদি তার দুই মাইয়া নইয়া আমাগো বাড়ি আইসা হত্তা দিয়া পরতো, তাগো সব খরচ দেতো কেরা? বাবা-ই তো। দিদিরও কোপাল, দিদির বড় মাইয়া সরোজিনীর পর যে গরভো হইছেলো সেইডা ছোয়াল ছেলো। কিন্তু পেরায় ভরা পেটে কাটি কাটি হাত-পা নইয়া দিদি ঘরের ডোয়া নেপার সময় মাথা ঘুইরা ফিট পড়লো উঠোনে, রোক্ত কী বাবা! বাবা আর বড়দ্দা খবর পাইয়াই নইয়া গেলো জলিরপাড় মিশনের হাসপাতালে, দিদি বাঁচলো কিন্তু ওর পেটের ছোয়ালডা মইরা গেছেলো। দিদির কী কান্দা, দিদির চাইয়াও বেশি কান্দছেলো মা। তো যা কচ্ছিলাম, সেই দুই মাইয়া নইয়া দিদি পেরায় সোমায়ই আমাগো বাড়িতে থাহে তহন। মানুষ কয়জন হয় তা হইলে? তিন আর তিন ছয়, মা-বাবা দুইজন আটজন আর দুই বুনঝিÑদশ জন। দশ মুখ ছাই দিয়া ভরাও তো কঠিন মা’র পোক্ষে। আমি মা-রে দোষ দেতে পারবো না। আমার সেই ছোট্ট বুন্ডি নক্ষী কলো মরছে বিলে নাইল তোলতে যাইয়াই। সে খুব দুক্ষের খালাÑ

 

পুরো এক গামলা চিচিঙা কাটা শেষ করে সরিষার তেল হাতে মাখে হীরা বেগম কলার থোর কাটার প্রস্তুতি নেবার জন্য।

 

হইছে কী, নক্ষী গেইছে নাইল তোলতে, বিলের ধার ঘেঁইষা হেলেঞ্চা শাক, মালঞ্চ শাক, কমলি শাক কুট্টি মানুষ কাদায় পা হড়কাইয়া দামের ভেতার পইড়া গেছে…তা অসুবিধা ছেলো না, ও সাতার জানতো আর আমরা জলে কত ছোঁয়াছুঁয়ি, পলাপলি খেলছি! কিন্তু, আমাগো মাইজা জেঠার ছোট ছোয়াল নেতাইদা? সিনি তহন কোচ দিয়া মাছ ধরতিছেলো, নক্ষী দামের ভেতার পড়ছে যে দেহে নাই, কুট্টি এট্টু দেহ তো। তয় নেতাইদার হুঁশও এট্টু কোমই ছেলো। নেতাইদা যহন কোচ মারতিছে নক্ষী তহন মুখ উঁচা কইরা দাম দিয়া ওঠতে নেছে, কোচ গিয়া পড়ছে ওর কচি মুহে, রোক্তে নাল হইয়া গেছেলো সব জল… সাত বচ্ছরের বুন্ডি আমার দ্যাড় দিন এক রাইত তামাইত কষ্ট পাইছে, পরের রাইতে সোম্ভাব একটু চেতন আইছেলো, শেষ চেতন, কয়, ‘মা, তোর রান্ধা নাইলের চাইয়াও কলো বেশি স্বাদ নাইলের ঢ্যাপে।’ খালা, …বেশ খানিকটা সময় নিয়ে আস্তে আস্তে বলে হীরা বেগম, নক্ষীর খরচেও নাইল রান্ধা হইছেলো, নোমোরা তো আর রুই মাছ দেতে পারে না খরচে, নাইল, কচুর ঘোণ্ট এইসব দিয়াই পদ বাড়াইতে হয়

 

মমতায় ভরে ওঠে হীরা বেগমের প্রতিটা শব্দ, আলাদা আলাদা শব্দগুলো যেন একাকার হয়ে নামহারা এক ভরা বিলের পাশে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঘুরতে থাকে, আর গরমে পোড়া রুক্ষ বালিয়া পুকুরের এক চারতলা ফ্ল্যাটের নিচতলা যেনবা এক ছলছলে কালচে সবুজ বিল, এতদিন পরেও।

 

তবুও কলো আমরা গেরস্তই ছেলাম পোড়াপুড়ির বছর তামাইত। আমাগো গ্রামের কয়েক নোমো ঘর খিষ্টান হইতে শুরু করলেও আমাগো তেতো কষ্ট ছেলো না। আমার বড়দ্দাও তেতোদিনে স্কুলের ফাহে ফাহে বাবার সাথে দোহানে বসে। তয় পোড়াপুড়ির বোচ্ছরডা যদি না আসতো!

বড়, খুব বড় একটা দীর্ঘশ্ব^াস ছাড়ে হীরা বেগম। ফ্যানের ঘ্যাঁচোর-ঘ্যাঁচোর-ঘ্যাঁচ শব্দ সে দীর্ঘশ্ব^াসকে দীর্ঘতর করে তোলে।

 

মেলেটারিগো মেলা আকোরোশ ছেলো আমাগো এলাকার ওপর, সব তো নোমোগো গেরাম। মুজিবরের বাড়িও তো আমাগো ওইদিহে, কোটালীপাড়া, বেশি দূরে না। দিনে দুইবার মিছিল হয়, ‘ভুট্টার গুদে নাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। আমার বয়স তহন, মিথ্যা কবো না, প্রায় বারো বচ্ছর, তিন-চাইর বার রক্ত হইয়া গেছে। সবাই পলাচ্ছে সেই সোমায়, সারা রাইত চিড়া কোটে আর অন্ধকার থাকতি থাকতি সেই চিঁড়ার পোঁটলা নইয়া গেরাম ছাড়ে বডার পাছ করবার নাইগা। বাবার কোনো উজ্জাগ নাই, মাও চিড়া কোটতে চায়, বাবা কয়, ‘থামো দেহি, কোথায় যাবো?’। তো যেদিন ফুলবাড়ী, কদমবাড়ী আগুন দেলো, সেইদিন সবাই পাটক্ষেতে গলা তামাইত জলে সোমস্ত দিন ডুইবা থাকলাম আর পরদিন বেহানে আমরাও মেলা করলাম। না সাথে কোনো চিড়া, না কোনো গুড়, এহাবারে খালি হাতে শুধু আমরা কয়ডা প্রাণী। রওনা করার আগে আরেক খ্যাচ বাধলো মাইজাদ্দারে আর পাওয়া যায় না, খোজ, খোজ, খোজ… কিন্তু পাবো ক্যাম্বায়? মাইজাদ্দা তহন নাইনে পড়ে। সে তো মাঝরাইতেই জয় বাংলায় যোগ দেতে হাইডা গেছে বেন্নাবাড়ী, কলিগ্রাম, সাতপাড় আর আমাগো গেরামে একযোগাইলা যারা ছেলো তাগো সাথে। সে যে কী দিন গেইছে খালা, খয়রামারি ক্যাম্পে মা মাইজাদ্দা আর বুন্ডি নক্ষীর কথা মনে কইরা কান্দতে কান্দতে কেমন ঝিম মাইরা বইসা থাকতো সোমাস্ত দিন, আর রাইতের কালে পা চাবানিতে চেচাইতো। আরাক সোমস্যা ছেলো রিলিফের ছাতু মোটে খাইতে চাইতো না মা। তহন আমরা মাছ-ভাত পাবো কোহানে? ক্যাম্বায় ক্যাম্বায় মোনে নাই এট্টা শলক শেকছেলাম, মানে ওইপারের নোকজন কইতো, ‘জয় বাংলার নোক/গোল­া গোল­া চোক/ভাতের বেলায় যেমন তেমন মাছের বেলায় নোভ।’ কথা খাটি খালা, মা’রে দোষ দিয়া কী হবে, ছাতু খাইতে খাইতে মুহে চরা পইরা গেছেলো। মাছ তো দূরের কথা, এট্টু ভাতের নাইগা পরানডা খটখটাইতো। তা স্বাধীনের তিন-চাইর দিন আগে মা আর চেচালো না এক রাইতে, পরদিন বেহানবেলা বড়দ্দা শলায় আগুন ধরাইয়া মার মুহে এট্টু ধরলো আর ক্যাম্পের নোকজোন চাটাইয়ে মুড়াইয়া মারে নইয়া গেলো কারেন্টের শোশানে।

 

কলার সাদা থোর কুচি কুচি করে হীরা বেগম গামলার জলে ফেলছে আর সে জল কালো কুচকুচে হয়ে যাচ্ছে নিমিষেই। জলের চেয়েও কালো উঠছে তার হাত, সরিষার তেল বুঝি আসলে ততটা কাজের না। যাক, রক্তশূন্যতায় ভোগা তিন্নির জন্য এ থোর ভালোই উপকারে আসবে মনে হচ্ছে, ভাবে নাহার, কিছু একটা ভাবার জন্যই বোধ করি। হীরা বেগমের গল্পে মজে যাচ্ছে কি?

 

দেশে ফিরা আমরা খালি পোড়া মাটিটুকই পাইলাম খালা, দোকান-ঘর-বাড়ি কিচ্ছুই নাই। বাবা আর বড়দ্দা গেলো ভ্যান টানতে, ছোটদ্দা গেলো জোন খাটার কামে। মাইজাদ্দার খোজ কেঊ ঠিকমতো দেতে পারলো না। আমলিগের সোলতান কাহা কইলো স্বাধীনের মাস-দুই আগে শেষ তারে দেখছে কুমার নদী পার হইতে ছেকান্দার কমান্ডারসমেত আরো কয়জোনের সাথে, খুব কাবু দেহাচ্ছেলো। আর ধীরেনদা, খিতিশদা, চিত্তদা, মিণালকা মানে একযোগাইলা যারা জয় বাংলায় গেছালো তাগো মধ্যি যারা ফেরতে পারছে, ওনরা সবাই কইলো স্বাধীনের তিন-চাইর দিন আগে সোমাদ্দার বিরিজের সামনাসামনি নরাইয়ে মরছে মাইজাদ্দা, কিন্তু তার দেহের কী হইছে সঠিক জানে না। বাবা কয়দিন নামে নামে খুইজা ছাড়ান দেলো, খালি এট্টা ছোট্ট কাগজের জয় বাংলার পোতাকা গুইজা থোলো আমাগো নতুন তোলা ঘরের পাটকাঠির বেড়ায়। বাবা তহনো বুড়া হইছেলো না, তেবুও ভ্যান টানার কামে সবাই বড়দ্দারে চায়, বাবারে না। বাবার আয় কোমতেই থাকলো, আর বচ্ছর ঘোনাইতেই বড়দ্দা মাঝিবাড়ির এক গাউছা পেতি আশানতারে বিয়া কইরা ঘরে তোললো তা সোংসার আনন্দময়, যার মোনে যা নয়।

কী কবো, ভাই-বৌয়ের অভাবের সোংসারে মা-খাকি আবিয়াইতা নোনোদ আমি, শতাক দোষ আমার…টেকতে পারলাম না, সে ম্যালা কথা। একদিন অসহ্য নাগায় পলাইয়া গিয়া ওঠলাম গোপালগঞ্জে, সুধির বাবুর যাত্রাদলে। আমাগো ওইদিহে গেরামের ’পার গেরাম নোমো মাইয়ারা তহন যাত্রাদলে নাম লেহাতিছে অভাবে। বয়াস আমার তেরো পারাইছে তেতোদিনে কিন্তু হইলে কী হবে, বুক মুক কিচ্ছু আমার তেমন ওঠছেলো না। তা কাজ পাইলাম কিন্তু যাত্রা পালায় না, জায়গা হইলো নাচনার দলে। যাত্রা-পালা শুরু হওয়ার আগে, তা বাদে ছিনের ভেতার ভেতার নাচ হইতো। ভারি সুন্দার সুন্দার গানের সাথে নাচ শিহোয়ছেলো। পূর্ব দিগন্তে, সূর্য উঠেছে রোক্ত নাল, রোক্ত নাল, রোক্ত নাল; আর একটা গান ছেলো মোরা একটি ফুলরে বাচাবো বলে যুদ্ধ করিÑ আরও অনেক গান ছেলো তয় এই দুইডাই বেশি ভালো ঠ্যাকতাম। দ্যাহেন খালা, দ্যাহেন, এহনো আমার নোমা খাড়া হইয়া ওঠে, দ্যাহেন আমার হাত। বোঝছেন খালা, নাল পাইড়া সবুজ শাড়ি আর পন্চ নাগাইনা নাল ব্লাউজ পইরা, সাজনা-কাজনা নিয়া যহন নাচতাম, কী যে ভালো ঠ্যাকতো! নাচের মাস্টার হীরালাল বাবু শিহোয়ছেলেন যহন তিনবার রোক্ত নাল, রোক্ত নাল, রোক্ত নাল গাওয়া হবে, এইটারে কয় তেহাই। তেহাইয়ের সোমায় শাড়ির আচল উচা কইরা পোতাকার মোতো দোলাইতে হবে। আমরা বারোজন মাইয়া তাই করতাম, ওডেনচ্ হাততালি দেতো আর আমার নিজেরে মোনে হইতো রানী আর মোরা একটি ফুলরে বাচাবো বলে যুদ্ধ করি তেহাইয়ের সোমায় মাঝেমধ্যি দেকতাম, এহাবারে পরিষ্কার দেকতাম খালা মিথ্যা না, বুঝি মাইজাদ্দার হাতে নাডাই আর আমার হাতে গুরি, নাল আর সবুজ রোঙের। গান হইতো ফুল বাচাইনার আর আমি দেকতাম অগঘরান-পৌষ মাসে ধান কাটা হইয়া গেলে যে খালি ভুঁই য্যান সেইহানে আমরা দুই ভাই-বুন। মাইজাদ্দা কচ্ছে, ‘আরেট্টু যা বুন্ডি, হইলো না আরেট্টু যা, বুন্ডি আমার ভা-লো, এইবার র্ধ মাথার উপার, আরেট্টু উচা কর, এইবার ছাড়্, ছাড়্’, ‘দেখ দেখ, আমাগো জয় বাংলার পোতাকা কতো উপারে ওঠছে, সবা-ই-র উপারে জয় বাংলার পোতাকা’।

 

কাটলেন তো হাত! আর গল্পের দরকার নাই, কাজ করেন।

এইটুক কাটায় কিছু হয় না খালা, আমাগো জয় বাংলার সুতায় মাঞ্জা দেতাম ক্যাম্বায় জানেন? আটা জ্বাল দিয়া আঠা বানাইতাম, ফের কাচ বাইটা মিহি কইরা সেই গুড়া মিশাইতাম ওই আঠার সাথে, সেইয়া দিয়া সুতায় মাঞ্জা দেয়ার সোমায় কতবার হাত কাটছে, হাত কাটার সেই শুরু, তয় সেইডা ছেলো সুহের হাত কাটা…

ট্যাপের নিচে আঙুল পেতে হীরা বেগম বাঁ হাত বাড়ায় রান্নাঘরের নোংরা ন্যাকড়ার দিকে।

আরে করেন কী, পাগল নাকি! দাঁড়ান, দাঁড়ান।

নাহার ছোটে ডেটলের খোঁজে, পেয়েও যায় তিন্নির বাথরুমে।

খালা কি মুনসুর মেয়া নি হি! হি-হি, রোক্ত নাল, রোক্ত নাল, রোক্ত নাল; কেমন নাল দ্যাহেন

হীরা বেগম হাসিতে কুটি-কুটি, বাঁ হাত দিয়ে খানিকটা বাটা হলুদ রাখে নোংরা ন্যাকড়াটার উপরে আর চোখের পলকে সেটা জড়িয়ে ফেলে ডান হাতের কাটা তর্জনীতে, চমৎকার একটা গিঁটও দিয়ে ফেলে।

রাগ হইয়েন না, খালা…

স্টোভ ধরাতে ধরাতে আবারও হাসে হীরা বেগম।

এত হাসির কী হলো? স্পষ্ট বিরক্তি নাহারের গলায়।

মুনসুর মেয়ার কথা মনে হইলো, হি-হি…হইছে কী, যাত্রাদলে পাট না দেলেও খাওয়া দেতো ভালো, মিথ্যা কবো না। আট-নোয় মাস না হইতেই শোরীর যেনো ফাইটা পড়তে নাগলো, দুফারবেলায় তো সুধীর কাহার পা টেপতামই, মাঝে মধ্যে রাইতের কালেও ডাক পড়ে তহন হাত-পা টেপার কামে, শুধু হাত-পাই টেপতাম, কিন্তু মধুবালাদি মানে আমাগো পাটির নাইকা মোটে সোহ্য করতে পারতো না, আমারে সে তহন অশৈল্যি ঠেহে। আগে আমি তার চুলেও সিতি-পাটি কইরা দেতাম দুফারবেলায় মাঝেমধ্যে, কিন্তু এহন সে আমারে মোটে দেকতেই পারে না। দলের মেন নাইকা যদি আমাগো মোতন নাচনীগো খারাপ চোহে দেহে, তা হইলে তার কোনো জায়গা নাই দলে। সবাই খা-লি দোষ ধরে, এক মুনসুর মেয়া ছাড়া। মুনসুর মেয়া ভিনদেশি অবস্থাপন্ন ঘরের ছোয়াল, যাত্রা করার শখ দেইখা দলে নাম নেহাইছে কিন্তু সেও পাট পায় না। সুধীর কা’ কয়, ‘মুনসুর, যাত্রা-পালা সবাইর জন্যি না, ঘরের ছেলে ঘরে যাও।’ মাঝেমধ্যে কয়, ‘তোমার মোতলবটা কী, কও তো মুনসুর মিয়া?’ কিন্তু সে কথা কেউ কানে নইলে তো! আমারে মাঝে-মধ্যি এডা-ওডা কিনা দেয় গোপনে। এরি ভেতার একদিন ক্যাম্বায় ক্যাম্বায় মোনে নাই, খবর পাইলাম বাবার অসুক। সুধির কা’রে ধইরা তিন দিনের ছুটি নেলাম আর নেলাম কুড়ি টেকা। মধুমতী নদীতে তহনো নন্চ চলে, দুই হালি কোমলা কিনা বাড়ি গেলাম। গ্রামের বউ-ঝি সবাই ঝাকাইয়া আসলো, কত কী যে বাত্তা নইলো, কেউ কেউ গান গাইতে ক’লো, যেনোবা আমি এক আজাব জীব, অচ্চনা না। বাবারে এট্টু খুশিই মনে হইলো খালা কিন্তু এট্টা জিনিস লোক্ষ করলাম, বাবা কলো, আমার নেয়া কোমলা খাইলো না। তা আমি তেতো এট্টা আমল দেলাম না। আশানতার তহন গরভো, এহন-তহন অবস্থা, বেশি এট্টা কথাবার্তা ক’লো না কিন্তু দোক্ষ-যগ্য শুরু হইলো দুফার শেষে বড়দ্দা ভাত খাওয়ার নাইগা বাসায় ফেরলে। বড়দ্দার সাফ কথা, ‘বুন হও আর যেই হও, কোনো যাত্রাদলের মাগীর গেরস্ত ঘরে জায়গা হবে না।’ কান্দাকাটি, মান-অভিমেন মেলাই হইলো কিন্তু চইলা আমার আসাই নাগলো, পেছন পেছন কতদূর তামাইত আসলো সুচিত্রা, কল্পনা, চোঞ্চলা, কোমলা… আমার সই কল্পনা আর চোঞ্চলা খুব কান্দছেলো, আমি কান্দি নাই…

 

চোখ ছলছল হয়ে ওঠে হীরা বেগমের। কোনো কথা খুঁজে পায় না নাহার বরং হীরা বেগম কেমন কাটা হাত নিয়েই কলার থোর কুচিয়ে চলে অবিরাম, তা-ই অশেষ কৌত‚হলে লক্ষ করে।

 

ফিরা আসলাম দলে সেই রাইতেই, কেউ খুশি হইছে মোনে হইলো না। খালি মুনসুর মেয়া পরদিন বিহালে দুইডা বিলাতি গাব নইয়া আইসা দেলো আমারে গোপনে। দুই দিন বাদে দুফারবেলায় সুধীর কাহা ডাইকা পাঠাইলো পা টেপতে। দলে তহন দেশোপ্রেমিক নবাব সেরাজ-উদ-দুলা পালার কাজ শুরু অবে। কাহা কইলো, পরদিন আমি কেমন পড়তি পারি দেইখা আমারে পাট দেবে, মধুদি করবে আলেয়া আর আমারে দেবে সিরাজের বউয়ের পাট, যদি পড়তি পারি ঠিক মোতোন। আমার খুশি দেহে কেরা, চোহে জল আসলো, কাহার পায়ে সেবা দিয়া বাইরাইতেই মধুদি তার হাতে যে সুপারি কাটার যাতি ছেলো সেইডা ছুইরা মারলো আমার মুহের পারা। ভাইগ্য ভালো, যাতি খালি কোপালের এক পাশে এট্টু কাইটা বেধলো গিয়া বাশের বেড়ায়, রোক্ত বেশি পড়ে নাই কিন্তু ভয়ে পেরায় বেবোধ হইয়া গেছালাম। সেই সোমায় কোথা দিয়া জানি না মুনসুর মেয়া এক মুঠ গান্দা ফুলির পাতা নইয়া আইসা হাতের তাউলায় ডইলা রস বানাইয়া ধরলো আমার কাটা কোপালে। কোপাল আমার কোপাল রে, কাটা কোপাল, হি-হি, আর সেই দিনই ভোর রাইতে মুনসুর মেয়ার হাত ধইরা যাত্রাদল ছাড়লাম। ও খালা, সৌষ্যার তেলের বোতলডা এট্টু দ্যান না, হাত-হোত আঠা আঠা হইয়া গেছে আবার…গরম কড়াইতে শুকনা মরিচ আর কালিজিরার ফোড়ন দিতে দিতে বলে হীরা বেগম ।

 

মুনসুর মেয়া আমারে নইয়া আসলো পরদিন নোগরবাড়ী, তা বেলা তহন প্রায় দেড়ডা-দুইডা তো হবেই। সারি সারি ভাতের দোহান নোগরবাড়ী ফেরিঘাটে। ঝাল ঝাল নাল ইলিশ মাছের ঝোল দিয়া ভাত খাওয়াইলো পেট চুক্তি আর তা’ বাদে নিয়া গেলো এক পীরের থানে। ওইহানেই আমার নতুন নাম হইলো হীরা বেগম। একখান নাল মালা শাড়ি কেনলো আর কেনলো একটা বোরকা। সেই মালা শাড়ি পইরা আর বোরকা গায়ে দিয়া ভাদ্র মাসের পেচপেচা গরমে সেদ্ধ হইতে হইতে পেথ্থম রিক্সা, পরে ভ্যান আর শেষে পায়ে মাইল-দুয়েক হাইডা, দুই মাইলের এট্টু কোম-বেশিও হইতে পারে, গেরামে যহন ঢোকলাম তহন রাইত আটটার মোতো হবে সোম্ভাব। সে যে কী যাত্রাপালা খালা! তার আগের বউ সুফিয়া কান্দতে কান্দতে ফিট পরলো, পরীর নাহাইল ফুটফুইটা দুইডা মাইয়া সোলেকা আর জোলেকা বোরকা সরাইয়া সরাইয়া আমারে নিরেকখন করতে নাগলো পিদ্দুম উচা কইরা; আর আমার শাউড়ি বিলেপ জোড়লো। সেই ফিট আর বিলেপের ভেতারেই পরদিন আমাগো দুতি বিয়া হইলো। শরিক-শারা

The post হীরা বেগম first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>