Bangla - KG | Kaberi Gayen https://kaberigayen.com Thu, 17 Mar 2022 07:11:18 +0000 en-US hourly 1 https://wordpress.org/?v=6.5.2 https://kaberigayen.com/wp-content/uploads/2021/12/favicon_favicon-light.svg Bangla - KG | Kaberi Gayen https://kaberigayen.com 32 32 তিনি ‘টক-শো’তে! https://kaberigayen.com/%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%9f%e0%a6%95-%e0%a6%b6%e0%a7%8b%e0%a6%a4%e0%a7%87/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%9f%e0%a6%95-%e0%a6%b6%e0%a7%8b%e0%a6%a4%e0%a7%87/#respond Thu, 17 Mar 2022 07:11:18 +0000 https://kaberigayen.com/?p=8067 প্রত্যেক সমাজেই কিছু কিছু বিষয় থাকে, যেগুলো বিতর্কিত করতে নেই। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, নিরাপদে ঘরে ফেরার অধিকার, ন্যায়বিচার পাবার অধিকার– এসব নিয়ে বিতর্ক চলে না। এসব নিয়ে রাজনীতি করা অমানবিক। নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়া, কবি ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত মৃতদেহ শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠা অথচ এসব হত্যাকাণ্ডের সুরাহা না হওয়া– এগুলো হল বিচারহীন, জবাবদিহিতাহীন রাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রকাশ।

The post তিনি ‘টক-শো’তে! first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। অপাপবিদ্ধ মেধাবী স্বাপ্নিক কিশোর ত্বকী হত্যার সময় থেকে কিংবা তারও আগে থেকে বারে বারেই নানা অভিযোগের আঙুল উঠছে যার বা যার প্রভাব-বলয়ের দিকে এবং সবশেষে শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠা সাত মৃতদেহ নিয়ে যখন জীবন ও জনপদ তোলপাড় এবং আঙুল উঠছে একই ব্যক্তির প্রভাব-বলয়ের সংশ্লিষ্টতার দিকে, ফলে যার অন্ততপক্ষে জিজ্ঞাসাবাদে থাকবার কথা, তাকেই প্রায় সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেলের ‘টক-শো’তে দেখা গেল।

রীতিমতো প্রতিযোগিতা নানা চ্যানেলের। এক চ্যানেলে শেষ হলে অন্য চ্যানেলে। ফেসবুকে বন্ধু তালিকায় থাকার জন্য দেখতে পাই সে সব ‘টক-শো’র উপস্থাপকরা আগাম বিজ্ঞাপন দিয়েছেন তাদের স্ট্যাটাসে একদিন কিংবা একবেলা আগে থেকেই যে, সেই প্রভাবশালী ব্যক্তি কখন থাকবেন ‘টক-শো’তে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তার সাক্ষাৎকার উপস্থাপন করেছে যথাসম্ভব আকর্ষণীয় মোড়কে, অথচ যে উত্তেজনা থাকবার কথা, সেই উত্তেজনা তৈরির মতো কোনো ধার ছিল না সঞ্চালকদের পক্ষ থেকে। বরং প্রায়শই একক বক্তার নিজেকে সাফ-সুতরো প্রমাণের স্পেস হিসেবে ব্যবহারের আলামত দেখা গেছে এসব ‘টক-শো’তে।

দুর্মুখেরা অনেক কিছুই বলছেন। আমি সে সব গুজব হিসেবেই দেখি। সত্য-মিথ্যা-গুজব একাকার হয়ে গেছে যে সময়ে, সেই সময়ে আরও একটি গুজবের যোগ হিসেবেই এই রটনা দেখে স্বস্তি পেতে চাই, ভরসা রাখতে চাই গণমাধ্যমে।

তবে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ‘টক-শো’তে নারায়ণগঞ্জের অনেক দুঃখের হোতা হিসেবে যার বা যার প্রভাব-বলয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর বরাবরের, সেই শামীম ওসমানকেই ‘নায়ক’ হিসেবে উপস্থাপনের সচেতন বা অ-সচেতন চেষ্টার প্রক্রিয়াটি চোখ এড়ায় না। আমার এ লেখায় তাই অনুযোগটি গণমাধ্যমের প্রতি।

‘নায়ক’ হিসেবে উপস্থাপনের কথা বলছি এ কারণেই যে, এসব ‘টক-শো’তে কখনও-বা তিনি একক অতিথি, আর কখনও অন্য এক বা দুই বক্তার সঙ্গে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি যখন একক বক্তা, তখন দীর্ঘ সময় ধরে তিনি নিজেকে দায়মুক্ত ঘোষণা দিয়েছেন, কীভাবে তিনি সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ধরে রাখার একক চ্যাম্পিয়ন হিসেবে কাজ করেছেন তার দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন। ভাবছিলাম, কেন এসব বর্ণনার আদৌ প্রয়োজন হল ‘টক-শো’তে এসে!

যাই হোক, তার এসব বক্তব্য খণ্ডানোর মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ-প্রস্তুতির স্পষ্ট অভাব ছিল উপস্থাপকদের। না কি অনীহা?

আর যখন অন্য বক্তাদের সঙ্গে উপস্থিত হয়েছেন তখনও তিনি প্রয়োজনে উপস্থাপকদের ধমক দিয়ে নিজের কথা বলে গেছেন। অন্য বক্তারা খুব কমই মনোযোগ পেয়েছেন। তাই এসব আয়োজন হয়ে উঠেছে ‘ওয়ান ম্যান-শো’।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ৭ মে, ২০১৪ একাত্তর টেলিভিশনে প্রচারিত ‘একাত্তর সংযোগ’-এর এপিসোডটির কথা। নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম চেয়ারম্যান খুব কমই সুযোগ পেয়েছেন নিজের কথা বলার। অথচ সঞ্চালককে নানাভাবে চাপের মুখে রেখেছেন তিনি। একবার হুমকি দিলেন যে বিরতির পরে কোনো একটি প্রসঙ্গে তাকে বলতে দেওয়া না হলে তিনি উঠে চলে যাবেন।

এখানেই শেষ নয়, তিনি সকল দায় চাপাতে চেষ্টা করলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর উপরে। ন্যাক্কারজনকভাবে তিনি মেয়র আইভীর একটি ছবি দেখালেন যেখানে তাঁর পাশে দাঁড়ানো বেশ কয়েকজনের ভেতর থেকে এক ব্যক্তির সঙ্গে মেয়রকে জড়িয়ে কিছু অরুচিকর ইঙ্গিতও করলেন।

মেয়র আইভীর অনুপস্থিতিতেই তিনি এই সুযোগটি নিলেন। একজন নির্বাচিত জনপ্রিয় মেয়রের বিরুদ্ধে এহেন কদর্য ইঙ্গিতকে প্রশ্ন করলেন না সঞ্চালক। তিনি তুখোড় বক্তা। তার কথার তোড়ে অন্য কেউ কথা বলার সাহসই পাননি।

এই অনুষ্ঠানেই তিনি একটি রক্তমাখা শার্ট তারই কোনো ডেরা থেকে উদ্ধারের প্রসঙ্গটি নিজে থেকেই তুলে খুবই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘‘সেই রক্ত মুরগির, নাকি রং নাকি কেচাপ, কে জানে।’’

দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ হেন অমানবিক বক্তব্যের বিরুদ্ধেও সঞ্চালক কিছুই বললেন না।

আরেক চ্যানেলের দুর্ধর্ষ উপস্থাপক, যিনি গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রকে যেভাবে ধোলাই করেছিলেন গত মাসে কিছু হাওয়াই অভিযোগের ভিত্তিতে, সেই তুলনায় এককভাবে তার সঙ্গে কথা বলার সময় বাক্যের শুরুতে-মধ্যে-শেষে যেভাবে ‘ভাই, ভাই’ করলেন এবং যে সৌজন্য দেখিয়ে তাকে ছেড়ে দিলেন, তখন মনে হল ভয়ই কেবল শক্তিশালী এই সময়ে, কিংবা আপোস। না কি অন্য কিছু?

তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত নয়। কোনো সঞ্চালক যখন সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার দৃঢ়তা দেখাতে না পারেন, তখন চ্যালেঞ্জকারীর বক্তব্যই সত্য প্রমাণিত হয়। তিনি দায়মুক্ত হয়ে যান, তার শক্তি আরও বাড়ে। পুনরায় বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা, যাঁরা অভিযোগ করছেন; জিম্মি হয়ে যান ফের অসহায় মানুষেরা। তার আরও বেড়ে যাওয়া ক্ষমতার সামনে এরপর হয়তো কেউ অভিযোগ করতেও ভয় পাবেন।

এটিই শক্তিমানের মিথ তৈরির প্রক্রিয়া। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যদি তার সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে কোনো তথ্য-উপাত্ত সাংবাদিকদের হাতে নাই-ই থাকে, তবে এই ‘টক-শো’র আয়োজন কেন? তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই সেটি প্রমাণের জন্য? আর কিছু না হোক, কোনো এলাকার সংসদ সদস্য থাকাকালে তার এলাকার আইন-শৃংখলা রক্ষা এবং জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের দায় কেন তার উপরে বর্তাবে না, এই প্রশ্নও সঠিকভাবে উত্থাপিত হল না। অথচ তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে ঠিকই ব্যবহার করতে পারলেন, চ্যালেঞ্জ জানালেন।

তার বিরুদ্ধে দেশবাসীর যে তীব্র ক্ষোভ, সেই ক্ষোভ খানিকটা হলেও প্রশমিত হবার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হল এসব চ্যানেল। প্রশ্ন হল, কেন এমন হতে পারল?

প্রথমত, আমরা ধরে নিতে পারি, চ্যানেলগুলো সচেতনভাবে এই কাজ করেনি। আরেকটি ‘হট আইটেম’ হিসেবেই তারা এসব ‘টক-শো’র আয়োজন করেছে। সে ক্ষেত্রে হয়তো তাদের উদ্দেশ্য ছিল টিআরপি’র কাটতি। সবচেয়ে নির্দোষভাবে প্রচার করলেও এসব ‘টক-শো’র মাধ্যমে আসলে নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত সন্ত্রাস গৌণ হয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তার প্রভাব-বলয়ের নিজের পক্ষে সাফাই গাইবার উদ্দেশ্যটি সাধন করে দিয়েছে এসব মিডিয়া।

সন্ত্রাস এবং মিডিয়ার মধ্যে এই সখ্যের ভুরি ভুরি উদাহরণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখেছি. সারা পৃথিবীতেই, বড় বড় ম্যাগাজিনে। এই প্রক্রিয়াটি তাদের গৌরবান্বিত করারই প্রক্রিয়া আসলে, সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্তকে ‘নায়ক’ করার প্রক্রিয়া।

গণমাধ্যম সবসময় খুব নির্দোষভাবে এই কাজটি করে, এমন নয়। মনে পড়ে যায় নব্বইয়ের দশকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গোলাম ফারুক অভিকে যেভাবে ‘নায়ক’ বানানো হয়েছিল। তার কথা বলা, ইংরেজি জ্ঞান, দাঁড়ানোর স্টাইল, তার ভালো ছাত্রত্ব বিষয়ক প্রচারণার নিচে চাপা পড়ে যেত ক্যাম্পাসে সংঘটিত সন্ত্রাসের ভয়াবহতা, অনেক ছাত্রের লাশের ভার।

দ্বিতীয়ত, থাকতে পারে অন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মিডিয়ার পারষ্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক (symbiotic relationship) আজ আর কোনো নতুন আলোচনার বিষয় নয়। যেসব কারণে অনেক অভিযোগ সত্ত্বেও, এসব ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ থেকে, দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না, সেই একই কারণে তাদের ইমেজ সহনীয় করার দায়িত্ব নিতে হয় পৃষ্ঠপোষকতাদানকারী রাজনৈতিক শক্তির।

মিডিয়া ব্যবহার করেই সেই কাজটি সম্পন্ন করা হয়। কখনও এই কাজটি করা হয় মিডিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমেই, কখনও-বা চাপ প্রয়োগ করে। রাজনৈতিক বিবেচনায় রেজিস্ট্রেশন পাওয়া অনেক টেলিভিশন চ্যানেলই রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এমন কাজ করে থাকতে পারে, এমন সংশয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

দুঃখের বিষয়, কারণ যাই-ই হোক, নারায়ণগঞ্জে গুম-খুন-অপহরণ-হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ যার বা যার প্রভাব-বলয়ের বিরুদ্ধে বার বার করা হচ্ছে, তাকে জবাবদিহিতার আওতায় না এনে, তার ইমেজ সহনীয় করার এই কৌশল ফল দিতেও শুরু করেছে। এক ফ্লেক্সির দোকানে শুনছিলাম গতকাল, এক ক্রেতার উচ্চকণ্ঠ– ‘‘খালি তারে দোষ দিয়া কী লাভ? মেয়র কার পাশে দাঁড়ানো দেহেন নাই? সব মাছে গু খায়, দোষ খালি বোয়াল মাছের।’’

কাউন্টার ডিসকোর্স তৈরি হয়ে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তার প্রভাব-বলয়ের দোষ-স্খালন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জনপরিসরে। এই প্রক্রিয়া সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের জন্য বিএনপিকে দায়ী করার প্রক্রিয়ারই ধারাবাহিকতা।

জার্মান তাত্ত্বিক হেবারমাস যে জনপরিসর (public sphere)-এর কথা বলেছেন, আজকের দিনে পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা, মন্তব্য কলাম আর টেলিভিশন ‘টক-শো’গুলো সেই জনপরিসরের কাজ করছে। জনগণের মতামত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সমাজের চাহিদা সম্পর্কে রাষ্ট্রকে সজাগ রাখছে। কিন্তু সেই দায়িত্ব ভুলে রাষ্ট্রের বা সরকারের হয়ে জনগণের সম্মতি আদায় করে নেওয়ার আলথুজার কথিত ‘ইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস’ হিসেবে কাজ করা দেশের জন্য মারাত্মক হয়ে ওঠে কখনও কখনও।

প্রত্যেক সমাজেই কিছু কিছু বিষয় থাকে, যেগুলো বিতর্কিত করতে নেই। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, নিরাপদে ঘরে ফেরার অধিকার, ন্যায়বিচার পাবার অধিকার– এসব নিয়ে বিতর্ক চলে না। এসব নিয়ে রাজনীতি করা অমানবিক। নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়া, কবি ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত মৃতদেহ শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠা অথচ এসব হত্যাকাণ্ডের সুরাহা না হওয়া– এগুলো হল বিচারহীন, জবাবদিহিতাহীন রাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রকাশ।

এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যাদের বা যাদের প্রভাব-বলয়ের নাম উঠে আসে বারবার তাদের বিচারের আওতায় না আনা, বরং তাদের অপরাধ স্খালন করার যে কোনো উদ্যোগ মারাত্মক।

আজ যে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ, সেই নূর হোসেন ‘নির্দোষ, এমন কাজ সে করতে পারে না’ বলে তিনি ঘটনার খানিক পরেই বক্তব্য দিয়েছেন। কতটা কাছের হলে এমন দায়িত্ব নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন?

যে র‌্যাবের দিকে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আজ কিংবা পুলিশের ‘ইজ্জতের রশি’ দিয়ে বাধা মৃতদেহ যখন শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠে, তখনও, সে তো তারই সংসদীয় এলাকায়! ভৌগোলিক এবং ক্ষমতা-দুই অর্থেই। ধরে নিচ্ছি তিনি এসব কোনো ঘটনার সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট নন। কিন্তু তার সংসদীয় এলাকায় এমন ঘটনা বার বার ঘটার পরও কেনো তিনি সেসব ঘটনার দায়-দায়িত্ব এড়াতে চাইছেন?

যে ব্যক্তিকে এ সংক্রান্ত খবরের মধ্যে জিজ্ঞাসা করাই হতে পারে গণমাধ্যমের কাজ, তাকে ‘টক-শো’তে কেন এত গুরুত্ব দিয়ে নিয়ে আসা? এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার ক্ষমতাবান রাজনৈতিক অবস্থান নিঃসন্দেহে কিছু জবাবদিহিতা দাবি করে।

সেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ আইনি জিজ্ঞাসাবাদের অধীনে আনার জন্য জনমত তৈরির পরিবর্তে তাকে ‘টক-শো’তে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার সুযোগ করে দেবার এই ভয়ংকর প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে গণমাধ্যম সতর্ক হবে এবং দায়িত্বশীল আচরণ করবে, সেই প্রত্যাশা এখনও ধরে রাখছি।

The post তিনি ‘টক-শো’তে! first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%9f%e0%a6%95-%e0%a6%b6%e0%a7%8b%e0%a6%a4%e0%a7%87/feed/ 0
সাগর-রুনি-মেঘ প্রতিবেদন: মামুলি হলুদ ছাড়িয়ে কালো সাংবাদিকতায় https://kaberigayen.com/%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%b0-%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%98-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%a6%e0%a6%a8-%e0%a6%ae/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%b0-%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%98-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%a6%e0%a6%a8-%e0%a6%ae/#respond Thu, 17 Mar 2022 06:08:15 +0000 https://kaberigayen.com/?p=8064 কোন ঘটনার অপ্রধান দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত করার যে রাজনীতি সেই বিন্দুতে এসে এসব প্রতিবেদন আসলে কালো সাংবাদিকতার অন্তর্গত হয়ে যায়। কালো সাংবাদিকতার অন্তর্গত হয়ে যায় মেঘ-কে নিজেদের রিপোর্ট জমকালো করার উপায় এবং উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করাটা, তার শারীরিক-মানসিক নিরাপত্তার কথা একবারও চিন্তা না করাটা।

The post সাগর-রুনি-মেঘ প্রতিবেদন: মামুলি হলুদ ছাড়িয়ে কালো সাংবাদিকতায় first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী মাত্রেই জানেন, অন্তত বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের জানতেই হয় সিলেবাসের সুবাদে, প্রচারণা-প্রপাগান্ডা-গুজবের সাথে সংবাদের পার্থক্য। শ্লাঘা বোধ করি যে বেশিরভাগ গণমাধ্যমেই সাংবাদিকতার বর্তমান এবং সাবেক শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। বিশ্বাস করি যারা সাংবাদিকতার ক্লাশে পড়েন নি কিন্তু সাংবাদিকতা করেন তারা জানেন এই পার্থক্য। সাংবাদিকতার ক্লাশ করতে করতেই, কিংবা সাংবাদিকতা করতে করতেই তারা জেনে যান হলুদ সাংবাদিকতা সম্পর্কেও। জেনে যান কেনো হলুদ সাংবাদিকতা আদৌ সাংবাদিকতা নয়। কিন্তু এসব শ্লাঘা আর বিশ্বাসকে তছনছ করে মামুলি হলুদ সাংবাদিকতাকে ছাড়িয়ে কালো সাংবাদিকতার মহড়া দেখালেন আমাদের প্রায় সব জাতীয় দৈনিক এবং সম্প্রচার মাধ্যমের( দুই একটি ব্যতিক্রম বাদে) তারকা সাংবাদিকরা, তাদেরই দুই সহকর্মীর মৃত্যু-সংবাদ উপস্থাপন করতে গিয়ে।

খবর হিসাবে পুরনো হয়ে তথ্যে পরিণত হয়েছে যে, গত শনিবার নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের দুই সম্প্রচার মাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি এবং সাগর সরওয়ার। নিজ গৃহে। স্বভাবতই দেশজুড়ে এই খুনের সাথে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত বিচারের দাবীতে ব্যাপক বিক্ষোভ, মানব-বন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং অব্যাহত রয়েছে। এসব প্রতিবাদ এবং দাবীর সবচেয়ে সোচ্চার কন্ঠ খুবই ন্যায্য কারণে নিহত সাংবাদিক দম্পতির সতীর্থরা, গণমাধ্যমের সাথে জড়িতরা। তাদের দাবির সাথে একাত্মবোধ করেছেন সারা দেশের পেশাজীবি, সাধারণ মানুষ। এই তীব্র আলোড়নের ভেতরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৪ ঘন্টার মধ্যে খুনীদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দেন।

দুঃখের বিষয় সেই ৪৮ ঘন্টা পার হয়ে ১০০ ঘন্টা ছাড়িয়েছে, দোষী ব্যক্তিদের দেশবাসীর সামনে এখনো সোপর্দ করতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। অথচ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের আগেই সংবাদ শিরোনামে নিহত সাংবাদিক মেহেরুন রুনির কথিত ‘পরকীয়া’ সম্পর্ককে দায়ী করে সংবাদ ছাপাতে এবং প্রচার করতে শুরু করেছে। যেমন, ‘হত্যা রহস্যের কেন্দ্রে রুনি’ (দৈনিক সমকাল, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২), ‘হত্যার কারণ কি রুনি’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২), ‘খুনি নাগালে, তবুও অপেক্ষা!’(দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২)।

কোন কোন সংবাদপত্র আবার এই ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে ইঙ্গিত দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির নামের আদ্যাক্ষর প্রকাশ করে পুরো ঘটনাকে স্রেফ একটি গুজবের আবহে ঠেলে দিয়েছেন। (উদাহরণ, ভোরের কাগজ, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২)।

অন্যদিকে, একেবারে শুরুর দিন থেকেই গণমাধ্যমের সংবাদসূত্র হিসাবে প্রধান লক্ষ্যশেল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সাগর-রুনি দম্পতির পাঁচ বছরের ছেলে মাহিন সরওয়ার মেঘকে। প্রায় প্রতিটি সংবাদমাধ্যমেই ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক কীভাবে, কত কষ্ট করে মেঘ-এর সাথে দেখা করেছেন এবং তাকে কী কী প্রশ্ন করেছেন, সে কী উত্তর দিয়েছে। প্রতিটি ইলেকট্রনিক চ্যানেলে তুমুল প্রতিযোগিতা দেখা গেছে কে কতবেশী মেঘকে প্রশ্ন করতে পেরেছে।

মেঘ-এর এলোমেলো, অগোছালো উত্তরের বিপরীতে সাংবাদিকদের উৎসাহব্যঞ্জক অবিরত নির্দেশনামূলক প্রশ্ন, তুমি কী দেখলে? রক্ত? ওরা ক’জন ছিলো? ওদের হাতে কি ছুরি দেখেছো? ছুরি কি রক্তমাখা ছিলো? মেঘ-এর দ্বিধান্বিত চাহনি, অস্পষ্ট সাজুয্যহীন উত্তর, বিমর্ষ মুখ কিছুই তাদের উৎসাহ কমাতে পারেনি। অথচ গণমাধ্যমের না জানার কথা নয় যে একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে রেকর্ড না করলে মেঘ-এর এই ভাষ্য আদালতে গ্রহণ করা হবে না। অন্তত সাংবাদিকদের এই অ্যাডভেঞ্চারমূলকভাবে গৃহীত ভাষ্য আদালতে গ্রহণ করা হবে না।

এই মর্মান্তিক ঘটনাকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের এহেন অবস্থান থেকে দু’টি স্পষ্ট প্রবণতা চিহ্নিত করা যায়।

প্রথমত, যে কোন অপরাধমূলক ঘটনাকেই নারীর তথাকথিত ‘অবৈধ’ সম্পর্কের মোড়কে উপস্থাপনের সবচেয়ে সস্তা প্রবণতা। এমনকি সেই নারী যদি নিজেও নিহত হন। কিংবা তার চোখও যদি উপড়ে ফেলা হয় যেমনটা দেখেছি রুমানা মঞ্জুরের ক্ষেত্রে, তবুও তার রেহাই নেই। নারী তার নিজের মৃত্যুর জন্য বা নিজের চোখ উপড়ে নেবার জন্যও নিজেই দায়ি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এর আগে নারীর দুর্ভাগ্যের জন্য নারীর ‘পরকীয়া’ জাতীয় রসালো খবরের যোগানদাতা হতো কিছু সুড়সুড়ি দেয়া ট্যাবলয়েড। এবার ট্যাবলয়েডের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকতে চায়নি মূলধারার নামি সংবাদপত্রও। তাই প্রধান শিরোনাম করে এসব সুড়সুড়ি গাইলেন তারাও।

দ্বিতীয়ত, চোখের পানি নামানো সাংবাদিকতার (tear jerker journalism) প্রতিযোগিতায় নামা। সাধারণত দুর্বল, ভগ্ন অস্তিত্বের প্রতি মূলত করুণা তৈরি করে নিজের বাণিজ্য হাসিল করাই এসব সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য, যার বলি হলো শিশু মেঘ। আমি নিশ্চিত, যদি মেঘ শিশু না হয়ে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ হতো, তাকে দিয়ে এতোবার এতোভাবে নির্দেশমূলক প্রশ্ন করে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো যেত না। মেঘ পাঁচ বছরের একজন শিশু, তাই সে অসহায়। সে একারণেও অসহায় যে সে সদ্য মা-বাবাহারা, যে মা-বাবা হয়তো তার চোখের সামনেই মারা গেছেন, অন্তত তাদের রক্তাক্ত মৃতদেহ সে দেখেছে। সে আরো অসহায় কারণ এসব ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো ঠেকাতে পারার মত হিতৈষী তার কেউ ছিলো না। এবং সে সবচেয়ে অসহায় কারণ তার মা-বাবার সহকর্মীরাই তার অসহায়ত্বকে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করেছে তার মানসিক-শারীরিক নিরাপত্তার কথা না ভেবেই।

নিজেদের কৃতকর্মের সাফাই গাইতে গিয়ে যখন একটি সম্প্রচার মাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের একজন বলেন যে আমাদের দেশের আবেগের ধরণ ভিন্ন, তারা শিশুটির কুশল জানতে চায় বলেই তাকে ক্যামেরার সামনে প্রশ্ন করা হয়েছে কিংবা যখন একটি চ্যানেল থেকে বলা হয় সে-ই হচ্ছে একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র তাই তাকে ক্যামেরার সামনে আনা হয়েছে, তখন এই সমস্ত মাধ্যমের সাংবাদিকতার মান এবং নৈতিকতাকে প্রশ্ন না করে উপায় থাকে না।

দুটি প্রবণতাই মারাত্মক। এ যেন হলুদ সাংবাদিকতাকে ছাড়িয়ে কালো সাংবাদিকতায় পা রাখা। হলুদ সাংবাদিকতায় সত্যের সাথে মিথ্যার প্রলেপ এবং অতিরঞ্জন থাকে। কিন্তু এবার যা হলো তা হচ্ছে খুনের ভয়াবহতাকে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করা হলো ভিত্তিহীন, মনগড়া, কাল্পনিক গল্প ফেঁদে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের আগেই সংবাদমাধ্যমগুলো গুজব ছড়িয়ে দিলো কোন তথ্যসূত্র উল্লেখ না করেই। সাংবাদিকতার সাথে ‘গুজবাদিকতা’র (গুজব+সাংবাদিকতা) পার্থক্য এখানেই। যদি এমন হতো যে সংবাদমাধ্যমগুলো নিজস্ব অনুসন্ধানী রিপোর্টের ভিত্তিতে এ জাতীয় সিদ্ধান্তে আসতো, সেটি সাদরেই গৃহীত হতো। কিন্তু এগুলো অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছিলো না, কারণ কোন তথ্যসূত্রের উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ফলে যা প্রকাশিত হচ্ছে তা নেহাত গুজব। এ জাতীয় গুজবের চর্চা তখনই করা হয়, যখন প্রকৃত ঘটনার প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করে তোলার প্রয়োজন হয়।

সন্দেহ করা অমূলক নয় যে তদন্ত প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্নখাতে ঠেলে দেবার জন্যই এসব গুজবের আমদানি ও প্রচার। মেহেরুন রুনির তথাকথিত ‘পরকীয়া’-র রসালো গল্পের নীচে ঢাকা পড়ে গেছে খুনীর প্রতি ক্রোধ। কোন নারীর ‘চরিত্রহীনতা’ প্রমাণ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের সেই সোনার কাঠি যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে সংঘটিত সকল অন্যায়ের বৈধতা দেয় আমাদের সমাজ। ফলে তার হত্যাকারীর অপরাধ গৌণ হয়ে তার ‘অনাচার’-ই মূল ডিসকোর্স হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ধরেও নেয়া যায় তর্কের খাতিরে যে রুনির বিয়ে বহির্ভূত কোন সম্পর্ক ছিলো, তা’হলেই বা কীভাবে খুনীর পরিচয়ের চেয়ে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকেই ফোকাস করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এই কেসের ক্ষেত্রে? দুঃখজনক হলো, আমরা এখন পর্যন্ত খুনিদের সম্পর্কে কোন তথ্য জানতে পারিনি, অথচ সবাই রুনির নামে বানানো কাহিনী জেনে গেছি। এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন দু’জন। অথচ রুনি এবং সাগর দুজনের মৃত্যুর জন্যই এসব গুজবের বিস্তার ঘটিয়ে দায়ী করা হচ্ছে খুনীকে নয়, বরং রুনিকে।

কোন ঘটনার অপ্রধান দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত করার যে রাজনীতি সেই বিন্দুতে এসে এসব প্রতিবেদন আসলে কালো সাংবাদিকতার অন্তর্গত হয়ে যায়। কালো সাংবাদিকতার অন্তর্গত হয়ে যায় মেঘ-কে নিজেদের রিপোর্ট জমকালো করার উপায় এবং উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করাটা, তার শারীরিক-মানসিক নিরাপত্তার কথা একবারও চিন্তা না করাটা।

সংবাদ-মাধ্যমের কাছ থেকে এই দায়িত্বহীন আচরণ দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত। সংবাদ-মাধ্যমের এই কালো সাংবাদিকতাকে তীব্র নিন্দা জানাই। তীব্র নিন্দা জানাই পাঁচ বছরের শিশু মেঘকে দফায় দফায় তথ্য সংগ্রহের নামে যে নির্লজ্জ নিপীড়ন করা হচ্ছে, সেই দায়িত্বহীন নির্মম আচরণের। অনুগ্রহ করে রুনির চরিত্র হননকারী গুজব বন্ধ করুন। শিশু মেঘকে তার মত করে বাঁচতে দিন। প্রকৃত খুনীরা যেনো কোনভাবেই রেহাই না পায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

আর চাই শিক্ষিত গণমাধ্যম, যে পরবর্তী মৃত্যুগুলোকে রোধ করতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু জানা কথা, গণমাধ্যমগুলো যেহেতু ব্যবসানির্ভর তাই মাঝে-মাঝেই এই কালো সাংবাদিকতা মাথা-চাড়া দিয়ে উঠবে যদি না মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ তৈরি করা যায়। মানুষের সেই সংঘবদ্ধ শক্তির জাগরণের কাছেই আমার যত প্রত্যাশা।

The post সাগর-রুনি-মেঘ প্রতিবেদন: মামুলি হলুদ ছাড়িয়ে কালো সাংবাদিকতায় first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%b0-%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%98-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%a6%e0%a6%a8-%e0%a6%ae/feed/ 0
আপনারা চুপ করে থাকবেন না, কিছু বলুন https://kaberigayen.com/%e0%a6%86%e0%a6%aa%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%9a%e0%a7%81%e0%a6%aa-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%95/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%86%e0%a6%aa%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%9a%e0%a7%81%e0%a6%aa-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%95/#respond Wed, 09 Mar 2022 06:32:21 +0000 https://kaberigayen.com/?p=7967 জানা কথা যে এই হত্যাকাণ্ডের অন্তহীন তদন্ত শুরু হবে এবং এই নির্বিবাদী শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডকে হয় ব্যক্তিগত কারণে বলে চালিয়ে দেওয়া হবে অথবা ধামাচাপা পড়বে। ফের রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখব অন্য কোনো শিক্ষক, লেখক বা শিল্পীকে। অব্যাহত খুন দেখতে দেখতে এসব হত্যাকাণ্ড আমাদের আর আলোড়িত করে না।

The post আপনারা চুপ করে থাকবেন না, কিছু বলুন first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

জও ফেব্রুয়ারি। আজও রয়েছে ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার বিস্তার। বইমেলার মাস এখনো শেষ হয়নি। এবং স্থানটি এ দেশের অহংকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই চত্বর। অল্প শীতের রাতে যুক্তিবাদী লেখক অভিজিৎ রায় প্রিয়তম সহযোদ্ধা ব্লগার বন্যাকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র কয়েক দিনে শেষতম বইয়ের কাটতি দেখে বড় খুশিমন নিয়ে ফিরছিলেন ঘরে। বইমেলা উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন দেশে মাত্র সেই দিন, ১৫ ফেব্রুয়ারি।

এবার প্রথম নয়। ফেব্রুয়ারি এলেই ঘাতকদের গাত্রদাহ শুরু হয়। কারণ, ফেব্রুয়ারি হলো সেই মাস, যে মাসে ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে ইংরেজি আর উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, গণপরিষদের সহসভাপতি মৌলানা তমিজুদ্দিন খানসহ সবাই তীব্র বিরোধিতা করে তাঁকে দেখে নেবেন বলে শাসিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের সূত্রপাত হয়েছিল তখনই, আসলে পাকিস্তান নামের ধারণায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল। সেই অপরাধে তাঁকে ছেলেসহ মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ। সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার-শফিকউদ্দিনকে ভাষার দাবিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ভাষা আন্দোলনে।

আর স্বাধীন বাংলাদেশে, এই ফেব্রুয়ারি মাসেই মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী, সাহসী বুদ্ধিজীবী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে আক্রমণ করা হয়েছিল চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে, ২০০৪ সালে, পরে তিনি জার্মানিতে মারা যান। তিনিও বইমেলা থেকে বেরিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই হত্যা করা হয়েছে ব্লগার রাজীব হায়দারকে। আর ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আরেক মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হলো বইমেলার মাত্র কয়েক গজ দূরে। এবারও কুপিয়ে, হুমায়ুন আজাদের মতো এবং ব্লগার রাজীবের মতো। একদিক থেকে এসব হত্যাকাণ্ড আসলে ভাষা আন্দোলনে যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, সেসব হত্যাকাণ্ডের চেয়েও অনেক বেশি নির্মম। অনেক বেশি লক্ষ্যাভিসারী, অনেক বেশি ভোঁতা অস্ত্রের ব্যবহারে। এসব অস্ত্র কি কিছু সাক্ষ্য দেয়? হত্যার ধরন কি কোনো প্রবণতাকে চিহ্নিত করে?

প্রশ্ন হলো, বারবার এমন ঘটতে পারছে কীভাবে? এই ফেব্রুয়ারিতেই? দেশ স্বাধীন হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাস যুদ্ধ করে, কিন্তু পাকিস্তান-মনস্তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি একটা বড় অংশের মানুষ। আর সেই মনস্তত্ত্বের বিপরীতে যাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল বলেন, তাঁরাও ক্রমেই এই মৃত্যু-উপত্যকাকে মেনে নিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, এই দেশ কি কেবল কিছু উগ্র ধর্মান্ধের, নাকি মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদেরও? এই দেশে কবিতা লেখার জন্য দেশান্তরি হতে হয়েছে কবি দাউদ হায়দার আর সত্য লেখার জন্য দেশান্তরি হতে হয়েছে তসলিমা নাসরিনকে। কিছু ব্লগ লেখার জন্য বুকে-পিঠে ছুরির আঘাত নিয়ে দেশান্তরি হতে হয়েছে ব্লগার অ্যাকটিভিস্ট আসিফ মহিউদ্দিনকে। ব্লগ লেখার জন্য ২০১৩ সালে জেলে যেতে হয়েছে সুব্রত শুভ, রাসেল পারভেজ আর মশিউর রহমানকে। ঘাতকের আক্রমণের শিকার হয়েছেন শামসুর রাহমান, সনৎ কুমার সাহা, আঘাত এসেছে এ দেশের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ওপর। ঘাতক হত্যা করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুস আর অধ্যাপক তাহেরকে। হত্যা করেছে সর্বশেষ বাউলসাধক অধ্যাপক শফিউল আলমকে। মাঝেমধ্যে ভাবি, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের নেতা কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল ওদুদ, কিংবা আহমদ শরীফ, বেগম রোকেয়া আজ বেঁচে থাকলে তাঁদেরও কি একই পরিণতি হতো? পাকিস্তান-মনস্তত্ত্ব থেকে কতটা এগোল দেশ তবে?

সমালোচনা করি রাষ্ট্রের একচোখা নীতির। আইসিটি অ্যাক্টের আওতায় মুক্তবুদ্ধির লেখক-ব্লগারদের লেখার জন্য তাঁদের ধরে নেওয়া হয়, জেলবন্দী করা হয় অথবা দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ যখন ঘাতকদের ব্লগে লেখা হয়, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে, তখন তাকে হত্যা করা হবে।’ তখন কিন্তু সেসব পোস্ট রাষ্ট্রের চোখে পড়ে না। দেশটি কি তবে কেবলই উগ্রবাদীদের?

বিবিসি নিউজ বাংলা, ২০২১
দুই.
‘বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়’
জ্ঞান স্থির থাকে না। জ্ঞানের উৎকর্ষের জন্য, প্রবহমানতার জন্য বরং বহু মত, বহু তর্কের কথাই বলেছেন সব মনীষী, সব দেশের সংস্কৃতিও বিকশিত হয় বহুত্বের চর্চার মধ্যে। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি জন্ম নিয়েছিল ‘একটি ফুলকে বাঁচানো’র শপথ নিয়ে। সেখানে ক্রমাগত বেড়েছে বিরুদ্ধ মতের বিপরীতে প্রবল সহিংসতা। আর প্রগতির দাবিদার যে রাজনৈতিক শক্তি এই অন্ধকার শক্তির বিপরীতে শক্ত অবস্থান নিতে পিছপা হয়, সেই শক্তি জানে না বা জানলেও মানতে রাজি নয় যে এই অন্ধকার শক্তি কোনো দিন তাদের সমর্থন করবে না।

হাসান আজিজুল হকের ওপর যখন ফতোয়া নেমে এসেছিল, তখন আমি এডিনবরায় পড়াশোনা করছি। অভিজিৎ রায় তখন প্রায়ই যোগাযোগ করতেন কী করা যায় স্যারের জন্য, সে বিষয়ে। যোগাযোগ শুরু করলেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে। আসিফ মহিউদ্দিনকে যখন দ্বিতীয়বার কোপানো হলো, তিনি লিখলেন। পাঠালেন যে দৈনিকে, সেখানে ছাপা হলো না। তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন যেন আমি অনুরোধ করি। অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে পত্রিকা লেখাটি ছাপানোর সাহস না করলে তিনি একটি জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টালে লেখাটি দেন। আমি অন্যের বিপদে তাঁর দাঁড়ানো খুব কাছ থেকে দেখেছি বলেই জানি, তিনি লেখায় আর কাজে একই রকম সৎ ছিলেন। তাঁর সব বক্তব্য কিংবা বলা ভালো, তাঁর সব প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে সব সময় একমত না হলেও যুক্তির প্রতি তাঁর অটল অভিনিবেশ, বিজ্ঞানমনস্কতা আর নিজের প্রতিশ্রুতির প্রতি সততা দেখে শ্রদ্ধা না করে পারিনি। তাঁর এই হত্যাকাণ্ড কিছুতেই মানতে পারছি না। বরং তাঁর এই হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশের পরাভবকে দেখছি।

আর ক্রমাগত পরাভব দেখছি মনুষ্যত্বের। যখন তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে কোপানো হচ্ছিল, তখনো টিএসসিতে অনেক মানুষের ভিড়, আশপাশেই পুলিশি প্রহরা থাকার কথা। কারণ, বইমেলায় অনেক নিরাপত্তাকর্মী কাজ করেছেন। এবং ছবিতে দেখেছি, যখন তাঁর স্ত্রী সারা শরীরে রক্ত নিয়ে সাহায্য চাইছেন, তখনো মানুষ জটলা করে দেখছে। জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আর জনগণের নির্বিকার তাকিয়ে থাকার দেশটাই যে আজ আমার দেশ, সে বিষয়ে কে আর সন্দেহ করবে? রাষ্ট্র যখন ক্রমাগত হত্যাকাণ্ডের ভেতর থেকে যেতে থাকে, তার নাগরিকেরাও যে তখন সেসব হত্যাকাণ্ডে গা-সওয়া হয়ে যায়, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, তখন ‘বোধনষ্টি’ ঘটে। কিন্তু তখন কি আর দেশটা দেশই থাকে?

তিন.
বিচার চাইতে এসেছি। লেখার উত্তর লেখা দিয়েই দিতে হবে, চাপাতির কোপে নয়। রাষ্ট্রকেই এই নিরাপত্তা দিতে হবে। অভিজিৎ রায়ের হত্যার কথা যখন ব্রেকিং নিউজে দেখছিলাম, তখন এতটাই হতভম্ব হয়ে যাই যে মনে হচ্ছিল, এই কোপ আমার প্রজন্মের সব মুক্তবুদ্ধির মানুষের ওপর নেমে এসেছে। হত্যাকারী যেই-ই হোক, তার-তাদের-তাদের খুনি মতাদর্শের বিচার চাই। মেনে নিতে নিতে মৃত্যু যে সবার কাঁধের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে, সেই সত্যকে জাতি হিসেবে আমরা মেনে নিয়ে নির্বিকার থাকছি, থেকেছি অনেক বছর। পাকিস্তান-মনস্তত্ত্বে নাড়া দিয়েছিল যে একুশে ফেব্রুয়ারি, সেই একুশের প্রথম কবিতার কাছে আবার আশ্রয় নিয়ে সরকারের কাছে, সব বিবেকবান মানুষের কাছে বলছি, অভিজিতের মৃত্যু কেবল কাঁদানোর জন্য নয় এবং আমি কাঁদতেও আসিনি। কেবল বিচার চাইতে এসেছি, সুনির্দিষ্ট বিচার। অভিজিৎ এই লেখা দেখবেন না, আমি এখনো ভাবতে পারছি না।

যাঁরা এই ঘটনায় ব্যথিত হয়েছেন, তাঁরা চুপ করে থাকবেন না, কিছু বলুন। মাসটি আজও ফেব্রুয়ারি এবং বিচারটি করতে হবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

ফিচার ছবিঃ চ্যানেল আই অনলাইন থেকে তৈরি করা।

The post আপনারা চুপ করে থাকবেন না, কিছু বলুন first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%86%e0%a6%aa%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%9a%e0%a7%81%e0%a6%aa-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%95/feed/ 0
আসুন, আমরা বরং চুপ করেই থাকি https://kaberigayen.com/%e0%a6%86%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%ae%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a6%82-%e0%a6%9a%e0%a7%81%e0%a6%aa-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%87-%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%95/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%86%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%ae%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a6%82-%e0%a6%9a%e0%a7%81%e0%a6%aa-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%87-%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%95/#respond Wed, 09 Mar 2022 05:42:09 +0000 https://kaberigayen.com/?p=7961 জানা কথা যে এই হত্যাকাণ্ডের অন্তহীন তদন্ত শুরু হবে এবং এই নির্বিবাদী শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডকে হয় ব্যক্তিগত কারণে বলে চালিয়ে দেওয়া হবে অথবা ধামাচাপা পড়বে। ফের রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখব অন্য কোনো শিক্ষক, লেখক বা শিল্পীকে। অব্যাহত খুন দেখতে দেখতে এসব হত্যাকাণ্ড আমাদের আর আলোড়িত করে না।

The post আসুন, আমরা বরং চুপ করেই থাকি first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

ত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে, মার্কিন প্রবাসী বিজ্ঞান-লেখক অভিজিৎ রায়কে বইমেলার প্রবেশপথে হত্যা করার রাতে প্রচণ্ড আকুতি নিয়ে লিখেছিলাম, ‘আপনারা চুপ করে থাকবেন না, কিছু বলুন।’ (প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। মানুষ প্রথম কিছুদিন রাস্তায় নেমেছিল, প্রতিবাদ জানিয়েছিল। খুব আশান্বিত হয়েছিলাম ‘নাস্তিক’ নামের সঙ্গে যে ট্যাবু যোগ করা আছে, সেই অচলায়তনে বুঝি ফাটল ধরেছে। মানুষ বুঝি দুঃখ পেয়েছে মানুষের মৃত্যুতে।

অভিজিৎ রায় নিজের কাজে বিখ্যাত ছিলেন, বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা পিতা অধ্যাপক অজয় রায়ের পুত্র, ছিলেন মার্কিন নাগরিক। কিছুদিন বেশ তদন্ত-তদন্ত রব পড়ে গেল। এফবিআই উড়ে এল। কিন্তু ছয়IJ মাস হতে চলল, তদন্তের কোনো ফল আমরা পাইনি। শুধু অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজ্ঞান-লেখক বন্যা আহমেদ, যিনি নিজেও সেই ভয়াল আক্রমণের শিকার, মাথায় কোপ, কাটা আঙুল আর প্রিয় মানুষের রক্তাক্ত দেহের স্মৃতি নিয়ে রয়টার্স-বিবিসি-ভলতেয়ার লেকচার—সব জায়গায় ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন অন্ধ অসির বিরুদ্ধে মসির যৌক্তিক লড়াইয়ের কথা। আশা জানাচ্ছেন, একদিন যুক্তির জয় হবে। অভিজিৎ রায়ের পিতা অধ্যাপক অজয় রায় বড় আশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্রীসম সম্বোধন করে পুত্রহত্যার বিচার চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে ফোনে সমবেদনা জানালেও সে খবর গণমাধ্যমে আসেনি। কেন আসেনি, সে উত্তরও আমরা পেয়েছি রয়টার্সকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর পুত্র এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতই নাজুক যে প্রকাশ্যে কিছু বলা তাঁর জন্য কঠিন।

অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফেসবুকে বেশ সরব ছিলেন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের এক মাসের মাথায়, ৩০ মার্চ, নিজের বাসার সামনেই তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। যে তিনজন হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছে, তাদের মধ্যে দুজনকে এলাকার মানুষ, মূলত দুজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন রক্তমাখা চাপাতিসহ ঘটনাস্থল থেকে। এরা দুজন হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র জিকরুল্লাহ এবং মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র আরিফুল ইসলাম। অপরজন আবু তাহের পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলামের স্বীকারোক্তি প্রকাশিত হয়েছিল সব গণমাধ্যমে। তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ীই ‘বড় ভাই’ নির্দেশনাদানকারী ‘মাসুম ভাই’য়ের নামেও মামলা করা হয়েছিল। আশা ছিল, ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি রক্তাক্ত চাপাতি হাতে যেহেতু ধরা গেছে জিকরুল্লাহ আর আরিফুল ইসলামকে এবং যেহেতু তারা হত্যার দায় স্বীকার করেছে ‘ইমানি’ দায়িত্ব পালনের কথা বলে, এবার নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। পাঁচ মাস হলো। তদন্ত এখন কোন পর্যায়ে আছে, ‘নির্দেশনাদানকারী হুজুর’ আসলে কে, এসব খুনির নেটওয়ার্ক কী—কিছুই আমরা জানি না।

ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার ১ মাস ১২ দিন পরে, ১২ মে, একইভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হলো বিজ্ঞান-লেখক ও মুক্তমনার ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে, সিলেট শহরের সুবিদবাজারের নূরানি আবাসিক এলাকার চৌরাস্তার মোড়ে। অনন্ত বিজয় দাশের বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন, তিন সপ্তাহ পরে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। সিআইডি ইদ্রিস আলী নামের এক স্থানীয় ফটোসাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছিল, তারপর কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না, দেশবাসী জানে না।

আর ৭ আগস্ট, অনন্ত বিজয় হত্যার তিন মাসেরও কম সময়ে, দিনদুপুরে ঘরে ঢুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হলো ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লিখতেন তিনি ইস্টিশন ব্লগে, নিলয় নীল নামে। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় ছিলেন। বেশ কিছুদিন থেকেই তিনি হুমকি পেয়ে আসছিলেন। অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিয়ে ঘরে ফেরার পথে কয়েকজন তাঁকে অনুসরণ করছে বুঝতে পারেন। তিনি নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে আড়াই মাস আগে থানায় থানায় ঘুরেছেন জিডি করার জন্য, কিন্তু পুলিশ জিডি নেয়নি বরং দেশ ছাড়তে পরামর্শ দিয়েছে—এই কথা তিনি ফেসবুকে লিখে জানিয়েছেন ১৫ মে।

হত্যাকাণ্ডের চার ঘণ্টা পরে আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা, আনসার আল ইসলাম নামে গণমাধ্যমগুলোতে ই-মেইল পাঠিয়ে দায় স্বীকার করেছে। এই একই গ্রুপ অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করেছিল হত্যাকাণ্ডের দুই মাস পরে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট এনটিটিজ নামের একটি ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এই বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে। অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের পরে দায় স্বীকার করে বার্তা এসেছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ৮ নামের এক টুইটার থেকে, সেখানেই বলা ছিল আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার কাজ এটি। বার্তাটি ছিল, আলহামদুলিল্লাহ! আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আল-কায়েদা উপমহাদেশ শাখার ভাইয়েরা আরও এক ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারকে জাহান্নামে পাঠিয়েছে। ওয়াশিকুরের হত্যাকারীরা স্বীকার করেছে, তারা ব্লগ কী জানে না, ‘বড় ভাই’য়ের নির্দেশে ইসলামের দুশমনদের হত্যা করে ইমানি দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। বোঝা যায়, আল-কায়েদা পরিচয়টি ওজনদার, এই নাম থাকলে বিচারকাজ আগায় না।

প্রথম আলো, ২০১৫
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘসহ অনেকেই নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে বাংলাদেশ সরকারকে এসব হত্যাকাণ্ড শক্ত হাতে দমনের দাবি জানিয়েছে। এসব দাবি কিছুদিন চলবে। বেশ কিছু মানববন্ধন, কলাম লেখা এবং টক শো হবে। তারপর আমরা ভুলে যাব সব, পরের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আগে পর্যন্ত। অবস্থা এমন হয়েছে যে বাংলাদেশে এখন ‘ব্লগার’ শব্দকে সমার্থক করা হয়েছে ‘নাস্তিকতা’র সঙ্গে আর কাউকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিতে পারলে তাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে যেমন কাউকে ‘কমিউনিস্ট’ কিংবা ‘ভারতের চর’ বা ‘হিন্দু’ আখ্যা দিতে পারলে তার ওপর যেকোনো অত্যাচার জায়েজ ছিল।

আমরা ভুলে যাই, ব্লগারদের সঙ্গে নাস্তিকতার ট্যাগটি দেওয়া হয়েছিল শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য, যার প্রথম বলি হয়েছিলেন রাজীব হায়দার। রাজীবকে নাস্তিক-ব্লগার প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ম্রিয়মাণ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। আমরা এও ভুলে যাই, নাস্তিক-ব্লগার নাম দিয়ে যে আন্দোলনকে ম্রিয়মাণ করার চেষ্টা হয়েছে, সেই আন্দোলনের মূলে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি। ধারাবাহিক ব্লগার হত্যার মুখ্য অন্তর্নিহিত রাজনীতি নিঃসন্দেহে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করা, বিচারের দাবিতে সোচ্চার যাঁরা তাঁদের এক এক করে হত্যা করা এবং সমান্তরালে অবশ্যই রয়েছে মুক্তবুদ্ধির মানুষদের কাউকে বাঁচতে না দেওয়া।

ব্লগার হত্যাকাণ্ডের বিচারে সরকারের অপারগতা, নীরবতা অ্যাবসার্ড নাটকের মতো মনে হয়। রাজনীতিতে ধর্মের কার্ড আজ এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে গেছে যে মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপকের পুত্রশোকে প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনে সান্ত্বনা দেওয়ার কথাটিও গণমাধ্যমে চেপে যেতে হয়। বড় আজব সময় পার করছি আমরা। আনসারুল্লাহ বাহিনী তাদের ঘোষিত লক্ষ্য প্রতি মাসে একজনকে হত্যা করার পরিকল্পনা নির্বিঘ্নে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে আর সরকার, সব রাজনৈতিক দল এবং তথাকথিত প্রগতিশীল শক্তি সবাই চুপ করে দেখে যাচ্ছে। মিডিয়ার তত্ত্ব বলে, বীভৎস দৃশ্য দেখতে দেখতে মানুষের গা-সওয়া হয়ে যায়, স্বাভাবিক মনে হয়। নানাভাবে নারী নির্যাতন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমাগত নির্যাতন, পোশাকশ্রমিকদের পুড়ে মরা, পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মরা, পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা, বীভৎস কায়দায় শিশু হত্যা—এসবই আমাদের সহ্যসীমার আওতায় এসে গেছে।

মাথায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দেওয়া মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আমাদের অনেকের জীবনই তো চলে যাচ্ছে। সমস্যা আসলে তেমন কিছু ছিলও না। শুধু এক পরাবাস্তব কাহিনির মতো মাঝে মাঝে কিছু দৃশ্য অসার করে ফেলে। যখন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছিল কিংবা কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে হুমকি দেওয়া হয়েছিল অথবা দ্বিতীয়বার কাঁধে আঘাত করা হয়েছিল আসিফ মহিউদ্দিনকে, তখন অন্য অনেকের সঙ্গে অভিজিৎ রায়ও লিখেছেন, নানা মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হলে লিখেছেন ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ। ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হলে লিখেছেন অনন্ত বিজয়। অনন্ত বিজয় দাশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সরব ছিলেন নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, ফেরার পথে তিনি বুঝতে পেরেছেন আততায়ীর অনুসরণ। ৭ আগস্ট তাঁকেও খুন করা হলো। ঘাতকের অভয়ারণ্যে ফের যদি ভিন্নমতের কোনো মানুষকে ঘোষণামাফিক মেরে ফেলা হয় আগামী মাসে, শোক কিংবা প্রতিবাদ সমাবেশে যাওয়ার, নিদেনপক্ষে ফেসবুকে ঘটনার নিন্দা করার মতো মানুষও তো আর থাকছে না বিশেষ। তবু চলুন, আমরা বরং সব দেখেশুনে চুপ করেই থাকি।

The post আসুন, আমরা বরং চুপ করেই থাকি first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%86%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%ae%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a6%82-%e0%a6%9a%e0%a7%81%e0%a6%aa-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%87-%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%95/feed/ 0
তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজা আর সেই শিশুটি https://kaberigayen.com/%e0%a6%a4%e0%a6%a8%e0%a7%81-%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%b8%e0%a6%be-%e0%a6%86%e0%a6%ab%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%9c%e0%a6%be-%e0%a6%86%e0%a6%b0/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%a4%e0%a6%a8%e0%a7%81-%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%b8%e0%a6%be-%e0%a6%86%e0%a6%ab%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%9c%e0%a6%be-%e0%a6%86%e0%a6%b0/#respond Wed, 09 Mar 2022 03:55:13 +0000 https://kaberigayen.com/?p=7951 জানা কথা যে এই হত্যাকাণ্ডের অন্তহীন তদন্ত শুরু হবে এবং এই নির্বিবাদী শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডকে হয় ব্যক্তিগত কারণে বলে চালিয়ে দেওয়া হবে অথবা ধামাচাপা পড়বে। ফের রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখব অন্য কোনো শিক্ষক, লেখক বা শিল্পীকে। অব্যাহত খুন দেখতে দেখতে এসব হত্যাকাণ্ড আমাদের আর আলোড়িত করে না।

The post তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজা আর সেই শিশুটি first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

ণমাধ্যমে আলোচিত সাম্প্রতিকতম ঘটনা দিয়েই শুরু করছি। পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেছেন পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি ও তাঁর সহযোগী। ঘটনাটি ঘটেছে দিনাজপুরের এক ছোট শহর পার্বতীপুরে। গত সপ্তাহে শিশুটিকে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়, তখন তাকে দেখে আঁতকে ওঠেন কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা। শিশুটির গাল, গলা, হাত, পায়ে ধারালো অস্ত্রের দাগ। ঊরুতে সিগারেটের ছ্যাঁকা। মাথায় ক্ষত। অচেতন শিশুটিকে ঠিক কীভাবে চিকিৎসা দেবেন, ভেবে উঠতে পারছিলেন না চিকিৎসকেরা। মেয়েটি অচেতন, তবু শুনেছি বেঁচে আছে। কী আশ্চর্য তার বেঁচে থাকার শক্তি!

বেঁচে উঠছেন মাত্র কয়েক দিন আগে জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে অচেতন পড়ে থাকা খাদিজা আক্তার নার্গিস। পত্রিকার পাতাজুড়ে এসেছে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী খাদিজাকে কোপানোর খবর। সংবাদপত্র লিখেছে, ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে খাদিজাকে কুপিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক বদরুল আলম। বদরুল ছাত্রলীগের নেতা বলে এই দুঃসাহস করেছেন, নাকি এটি কেবলই একজন প্রেম-প্রত্যাখ্যাত যুবকের প্রতিহিংসা চরিতার্থতা—এসব নিয়ে যখন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় চলছে, তখন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনে ফিরছেন তিনি।
মিরপুর সাইক পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী আফসানা ফেরদৌস অবশ্য বাঁচতে পারেননি। পত্রিকায় পড়েছিলাম, পুলিশ হাসপাতাল এলাকার সিসি টিভি ফুটেজ জব্দ করেছে। এই ফুটেজের সূত্র ধরেই নাকি মামলাটির ফয়সালা করা যাবে। অথচ অভিযোগ রয়েছে, সন্দেহভাজন হিসেবে তেজগাঁও কলেজের ছাত্রলীগের যে নেতার নাম বলা হচ্ছে, তার পরিবার থেকে কখনো টেলিফোনে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, কখনো–বা অজানা ফোন থেকে ‘বাড়াবাড়ি না করা’র হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তারপর কী হলো, সেই উত্তর পাওয়ার আশা ক্ষীণ।

ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিসাকে স্কুলের সামনের পদচারী-সেতুতে যে যুবক ছুরিকাঘাত করেছে, তার দোকান থেকে রিসা পোশাক বানিয়েছিল। ছুরিকাঘাত করার তিন দিন পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিসার মৃত্যু হয়। প্রাণবন্ত এক কিশোরীকে কেউ চাইলেই বিরক্ত করতে পারে, এবং প্রত্যাখ্যাত হলে খুনও করতে পারে! পত্রিকায় পড়েছি, সন্দেহভাজন ওবায়েদকে ধরিয়ে দিয়েছেন এক মাংসবিক্রেতা।
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ সেনানিবাস এলাকায় পাওয়ার পরে দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ উঠেছিল, তাতে আশাবাদী হয়েছিলাম, এবার হয়তো কিছু একটা হবে। কিন্তু না, ধর্ষিত হয়েছিল নাকি হয়নি, তনুর মৃতদেহ থেকে এই আলামত পরীক্ষার চেষ্টা ছাড়া তেমন কোনো ফলাফল আজও পাওয়া যায়নি। সেনাবাহিনী আমাদের নিরাপত্তার প্রতীক। সেনা এলাকায় ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার বিচার হওয়াটা প্রতীকী অর্থেও ছিল অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত।

দুই.
গণমাধ্যমের তত্ত্ব বলে, কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি সেই বিষয় সম্পর্কে মানুষের সংবেদনশীলতাকে ভোঁতা বানিয়ে ফেলে। যেমন টেলিভিশনে যুদ্ধের ছবি দেখতে দেখতে যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের সংবেদনশীলতা আর কাজ করে না। এসব নির্যাতন দূরের কোনো বিষয় নয়। ঘরে ঘরে তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজা আর মেয়েশিশুরা রয়েছে। কাজেই অন্য যে কারণটি জোরালো বলে মনে হয় তা হলো, কোথাও সাহায্য নেই ধরে নিয়ে কেবল নিজের ঘরের মেয়েটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকেই সবার মনোযোগ নিবদ্ধ। রয়েছে শ্রেণি প্রশ্ন। এ ধরনের নির্যাতন প্রান্তিক নারী বা শিশুর ক্ষেত্রেই মূলত ঘটেছে এতকাল।

তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজাদের মতো মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের মেয়েদের ওপর সরাসরি আঘাত অপেক্ষাকৃত নতুন। প্রতিবাদ কেমন হলে কার্যকর হবে, সেটিও বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

তিন.
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল অন্তত দুই লাখ নারীর নির্যাতন অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে। যে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা হেঁটে চলে বেড়াই, নিশ্বাস নিই, কবিতা পড়ি, জাতীয় সংগীত গাই, সেই দেশের নির্মাণে এসব নারীর অংশীদারত্ব শুধু নয়, ভয়াবহ আত্মত্যাগ রয়েছে। পুরুষের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে। বাড়ি ফিরেছিলেন তাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। সম্মান পেয়েছেন, ক্ষমতা পেয়েছেন। সব মুক্তিযোদ্ধার প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত করা যায়নি সত্য, তবে তাঁদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত। কিন্তু যুদ্ধ শেষে নির্যাতনের শিকার নারীরা সম্মান পাননি। অনেকেই আত্মহত্যা করেছেন। হারিয়ে গেছেন। অনেকে ইতিহাসের আগুন বুকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন। অনেকের যুদ্ধ আজও শেষ হয়নি। আজ যখন সফলভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হচ্ছে এবং রায় কার্যকর হচ্ছে, সেই যুদ্ধাপরাধীদের ভয়াবহ নির্যাতন ইতিহাসের মধ্যে বারবারই নারী নির্যাতনের কথাটি অনিবার্য সাক্ষ্য হিসেবে উঠে আসছে। এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং নারীর আত্মত্যাগ আর নির্যাতনের ইতিহাসকে তাই আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা দেশে নারীর জন্য মুক্ত পরিসর আজও নির্মিত হলো না।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পোস্টারে মুদ্রিত হয়েছে, ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’। সেসব মুক্তিযোদ্ধা নারীর উত্তরসূরি মেয়েরা আজও নিরাপদ নয় স্কুলে যাওয়ার পথে, রাস্তায়, শিক্ষাঙ্গনে, পরিবারে, বর্ষবরণে টিএসসিতে, বইমেলায়, সিনেমা হলে, বাজারে, প্রেমিকের কাছে, সাইবার পরিসরে, সমতলে কিংবা পাহাড়ে। ধর্ষণ আর খুন যেন প্রতিকারহীন পরাভব হয়ে উঠছে যেকোনো নারীর জন্য, বিশেষভাবে মেয়েশিশুর জন্য।

প্রথম আলো, ২০১৬
চার.
প্রশ্ন হলো, সরকার কী করছে? রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে? সরকারি কার্যক্রম কি কেবল কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেই ঘটনার তদন্ত-আশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি মেয়েশিশুদের নিরাপত্তার জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে? সব ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। কিন্তু এটিই একমাত্র চাওয়া নয়। জীবন ও সম্ভাবনার এহেন অপমৃত্যুর পাশে কোনো শাস্তিই যথেষ্ট নয়। শাস্তির পাশাপাশি মেয়েদের জন্য জীবনের সব স্তরে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার কার্যকর সক্রিয়তা কাম্য। গ্রামের কত মেয়ের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায় শুধু স্কুলপথের নিরাপত্তাহীনতার জন্য! কত হাজারো মেয়ের বাল্যবিবাহ হয় শুধু এই নিরাপত্তাহীনতার ভীতি থেকে!
ছেলেশিশু বড় হয় আর তার বিচরণ-পরিধি বাড়তে থাকে, মেয়েশিশু বড় হয় আর তার নিরাপত্তাহীনতা ভয়ের চাদর হয়ে ঘিরে থাকে তাকে। মেয়েশিশুদের এই নিরাপত্তাহীনতায় বাঁচতে বাধ্য হওয়া তাদের মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। সরকার ও সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে মেয়েশিশুদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। মেয়েশিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের জীবন বিকাশের পূর্বশর্ত। তাদের অরক্ষিত রেখে কোনো উন্নয়ন সম্ভব বলে বিশ্বাস করি না। প্রয়োজনে জাতীয় কনভেনশন ডাকা হোক করণীয় নির্ধারণের জন্য। এই অবস্থার অবসান হতেই হবে।

তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজা আর সেই পাঁচ বছরের মেয়েটির ঘটনা এই দেশের ভয়াবহ নারী নির্যাতনের কয়েকটি প্রকাশিত উদাহরণমাত্র। এমন অসংখ্য মেয়েশিশুর নির্যাতন-অভিজ্ঞতা অপ্রকাশিত। অত্যন্ত ভারী হয়ে ওঠা এসব নির্যাতন-অভিজ্ঞতার ওপর এখন এ দেশের সব মেয়েশিশুর নির্বিঘ্নে চলাফেরার পরিবেশ নিশ্চিত হোক। এ এক যুদ্ধ—এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে দেশ কী ভাবছে, আদৌ ভাবছে কি না, সেই প্রশ্নে থমকে আছে আমাদের আগামী।

The post তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজা আর সেই শিশুটি first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%a4%e0%a6%a8%e0%a7%81-%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%b8%e0%a6%be-%e0%a6%86%e0%a6%ab%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%9c%e0%a6%be-%e0%a6%86%e0%a6%b0/feed/ 0
কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই! https://kaberigayen.com/%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%be%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%93-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%8b-%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%87/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%be%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%93-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%8b-%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%87/#respond Mon, 07 Mar 2022 07:21:59 +0000 https://kaberigayen.com/?p=7927 জানা কথা যে এই হত্যাকাণ্ডের অন্তহীন তদন্ত শুরু হবে এবং এই নির্বিবাদী শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডকে হয় ব্যক্তিগত কারণে বলে চালিয়ে দেওয়া হবে অথবা ধামাচাপা পড়বে। ফের রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখব অন্য কোনো শিক্ষক, লেখক বা শিল্পীকে। অব্যাহত খুন দেখতে দেখতে এসব হত্যাকাণ্ড আমাদের আর আলোড়িত করে না।

The post কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই! first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

রাষ্ট্রের আঙিনায় আরও এক শিক্ষকের ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী। বাসা থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে সংস্কৃতিমনা, ধীমান এই শিক্ষককে খুন করা হয়েছে ২২ এপ্রিল সকালে। সামাজিক মাধ্যমে যে ছবি পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে পরিষ্কার দেখছি আমরা রক্তস্তূপের মধ্যে পরিপাটি এক শিক্ষকের উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহ। পাশে ব্যাগ, পায়ে স্যান্ডেল জুতো তখনো অক্ষত।

কোনো উচ্চকিত রাজনৈতিক বক্তব্য তিনি দেননি কোনো দিন—সাক্ষ্য দিচ্ছেন তাঁর সহকর্মী, শিক্ষার্থী কিংবা যাঁরা তাঁকে চেনেন। পিএইচডি করেছেন কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের কবিতা নিয়ে। বাজাতেন সেতার। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি নয়; বরং পড়াশোনা, শিক্ষার্থীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক সৌভিক রেজার ফেসবুক নোটে পড়লাম, অধ্যাপক সিদ্দিকীর সঙ্গে তাঁর যতবার দেখা হয়েছে, তা মূলত লাইব্রেরিতে। সাহিত্যের যে ছোট কাগজটি সম্পাদনা করতেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভাগে, সেটির নাম কোমলগান্ধার। মনে করিয়ে দেয় আরেক বেদনার নাম। ঋত্বিক ঘটক। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারণে দেশভাগের বেদনা থেকে যিনি কোনো দিন নিজেকে বিযুক্ত করতে পারেননি। যে সাংস্কৃতিক সংগঠনটির উপদেষ্টা ছিলেন অধ্যাপক সিদ্দিকী, সেই সংগঠনের নাম ‘সুন্দরম’। নিজ গ্রাম বাগমারায় প্রতিষ্ঠা করেছেন গানের স্কুল। ক্লাসে তিনি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প থেকে উদাহরণ টানতেন বলে জানিয়েছেন তাঁর শিক্ষার্থীরা।

পণ্য হয়ে যাওয়া শিক্ষকতাকালে তিনি জীবন চালিয়েছেন কেবলই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনে, তাই চাকচিক্য ছিল না জীবনযাপনে। অথচ শিক্ষার্থীদের বিভাগেই ভালো চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের টাকায় কিনেছেন প্রজেক্টর। নিজে লিখতেন চলচ্চিত্র বিষয়ে। সুন্দরম-এর অনুষ্ঠানের ছবি তোলার জন্য নিজের টাকায় কিনেছেন ক্যামেরা। বিভাগের বিভিন্ন দিবস উদ্যাপন হতো তাঁর উদ্যোগে। আর যেতেন খেলার মাঠে বিভাগের ছেলেমেয়েরা খেলতে গেলে, যখন তাঁরা নিশ্চিত হারবেন জানতেন, তখনো। এই ওপর-চালাকির যুগে এমন একজন নির্লোভ মানুষের যে নাম হওয়ার কথা, তাঁর নামও তাই হয়েছিল শিক্ষার্থীদের কাছে ‘ম্যাড স্যার’। ডাকটা আদরের।

একজন আদর্শবাদী, শিক্ষার্থীবান্ধব, সংস্কৃতিমনস্ক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের এহেন খুনে দেশটাতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগার কথা। সেই ঝাঁকুনিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সরকার, সব রাজনৈতিক দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচণ্ড অভিঘাত হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দলের বিবৃতি চোখে পড়েনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনো প্রতিবাদ হয়নি। ২৪ এপ্রিল কিছু বামপন্থী ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে ‘রেজাউল করিম হত্যার বিচারপ্রার্থী নাগরিকবৃন্দ’ নামে শাহবাগে একটি প্রতিবাদী সমাবেশ হয়েছে। হাতে গোনা কিছু মানুষ এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন বহুদিন থেকে। তাঁদের সংখ্যাও প্রতিটি মৃত্যু এবং হুমকির পরে কমে যাচ্ছে। অনেকেই ভয় পেয়েছেন কাছের সহযোদ্ধাদের নির্মম মৃত্যুতে। দেশ ছেড়েছেন অনেকেই হুমকির মুখে। আরও অনেকে ছাড়ার প্রতীক্ষায়।

কোথাও কোনো কান্না নেই। ভয় আছে কেবল। প্রত্যেকেই শঙ্কিত নিজের জীবন নিয়ে। এ-জাতীয় ধারাবাহিক খুনের পরে, সেই সব খুনের কোনো কিনারা না হওয়ার কারণে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক রাষ্ট্রের বিচারহীনতার প্রতি চূড়ান্ত অনাস্থা জ্ঞাপন করে বলেছিলেন, পুত্র হত্যার বিচার তিনি চান না। তারপর নিহত অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী একই কথা বলেন। এই অনাস্থায় সরকারের কোনো বিকার দেখিনি।

অথচ বিচার তাঁরা চাইছেন না, চেয়ে লাভ নেই বলেই। যেহেতু অধ্যাপক সিদ্দিকী কোনো রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা নন, ব্লগার নন, ধর্ম বিষয়ে তাঁর কোনো ব্লগ আবিষ্কার করা যায়নি, তাই প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটানোর পরে সবাই বোঝার চেষ্টা করছেন এই হত্যাকাণ্ড কেন হলো। পুলিশের প্রাথমিক ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ‘সংস্কৃতিকর্মী’, তাই হয়তো কেউ তাঁকে খুন করে থাকবে। অনেকেই পুলিশের এই ভাষ্যে হাসলেও আমি এ কথাকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছি। তাঁর সঙ্গে কারও কোনো শত্রুতার কথা তাঁর পরিবার জানে না। তাহলে, তাঁর দোষের মধ্যে রইল রবীন্দ্রচর্চা, সেতারবাদন, কোমলগান্ধার আর ‘সুন্দরম’-এর সঙ্গে সম্পর্ক, গানের স্কুল বানানো। কী ভীষণ সব অপরাধ! যে দেশে ওলামা লীগ স্কুল-পাঠ্যবই থেকে অমুসলিম লেখকদের লেখা বাদ দেওয়ার জন্য বিনা বাধায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে, সেই দেশে রবীন্দ্রচর্চা, সেতার বাজানো, বাংলা ভাইয়ের বাগমারা গ্রামে গানের স্কুল বানানো—এসব অপরাধ বৈকি! এসব বিষয়কে অপরাধ গণ্য করে খুন করার অবস্থায় এক দিনে আসেনি দেশ।

অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, প্রথম আলো, ২০১৬
গত ১২ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন অধ্যাপক খুন হয়েছেন। ২০০৪ সালে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসের হত্যাকারীদের বিচারিক আদালতে ফাঁসির আদেশ হলেও, পরবর্তী ধাপে এ বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি আসামিদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। ২০০৬ সালে খুন হওয়া ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক তাহের আহমেদের মামলার অন্যতম মূল আসামি সালেহীন ‘বেনিফিট অব ডাউট’-এর সুবিধা নিয়ে বেকসুর খালাস হয়েছেন।

২০১৪ সালে অধ্যাপক শফিউল ইসলামের হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত কারণ বলা হলো। ব্যক্তিগত কারণে কাউকে হত্যা করা হলেও হত্যাকারীরা তো খুনিই বটে! সেসব হত্যাকারীর বিচারের কী ব্যবস্থা হলো? ২০১৫ সালে ব্লগার খুন হলেন চারজন, একজন প্রকাশক। এ মাসেই খুন হলেন আরেক ব্লগার নাজিমউদ্দিন। কিনারাহীন তদন্ত-প্রক্রিয়ার মধ্যে ক্ষমতার শীর্ষ মহল থেকে বলা হলো ‘ধর্মবিরোধী’ কোনো লেখার কারণে হত্যাকাণ্ডের দায় রাষ্ট্র নেবে না। ‘ধর্মবিরোধী’ শব্দবন্ধটি এতই ব্যাপক যে কোন আচরণকে ধর্মবিরোধী বলা হবে, সেই সংজ্ঞা কে নির্ধারণ করবে? সেতার বাজানো, রবীন্দ্রচর্চা, গানের স্কুল বানানো, চলচ্চিত্র দেখা—এসব কি ধর্মবিরোধী?

আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে দেখলাম পত্রিকায়। তাদের সংবাদসংস্থা ‘আমাক’ এর ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে:

‘বাংলাদেশের রাজশাহী শহরে দাওলাতুল ইসলামের সৈনিকগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে হত্যা করেন, সে নাস্তিকতাবাদের দিকে লোকদের আহ্বান করত।’ তাঁর সংস্কৃতিচর্চাই কি তবে ‘নাস্তিকতাবাদের দিকে লোকদের আহ্বান করা?’

 

জানা কথা যে এই হত্যাকাণ্ডের অন্তহীন তদন্ত শুরু হবে এবং এই নির্বিবাদী শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডকে হয় ব্যক্তিগত কারণে বলে চালিয়ে দেওয়া হবে অথবা ধামাচাপা পড়বে। ফের রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখব অন্য কোনো শিক্ষক, লেখক বা শিল্পীকে। অব্যাহত খুন দেখতে দেখতে এসব হত্যাকাণ্ড আমাদের আর আলোড়িত করে না। ব্লগার, প্রকাশক হত্যাকাণ্ডের পর চাপাতি কিন্তু ধাবমান হয়েছে শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মীদের দিকে। এ যে একাত্তরের মতোই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের আরেক নীলনকশা—সরকার ভোটের রাজনীতির কথা চিন্তা করে এই সত্যকে উপেক্ষা করে চলেছে।

তবে আমি সবচেয়ে বেশি বিচলিত এমন হত্যাকাণ্ডের পরেও দেশ নিস্তরঙ্গ বলে। অব্যাহত খুনকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি ক্ষমতাবান রাজনীতি তৈরি করেছে বটে, কিন্তু এই অন্যায় বুমেরাং হতে বাধ্য। সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু আমরা কোথায় যাব মেনে নিতে নিতে? নাজিমউদ্দিনের হত্যাকাণ্ডের সময় আমি International Sunbelt Social Network Conference 2016-এ যোগ দেওয়ার জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে ছিলাম। এবার জর্জ সিমেল পুরস্কার পেয়েছেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক গ্যারি রবিনস। তিনি তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তি বক্তৃতা করেছেন যোগাযোগের বহুতল বিশ্লেষণের ওপর। দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কীভাবে কিছু যুদ্ধংদেহী বিশ্বনেতা, সেই সব রাষ্ট্রের সমর কোম্পানি এবং ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্ব অভিলাষী সাধারণ মানুষ—এই তিন স্তরের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংঘটিত হতে পেরেছে। সেই থেকে আমি ভাবছি, ঠিক কত স্তরের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসব হত্যাকাণ্ড নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে চলেছে।

বিচার না চাওয়াটা সমাধান নয়। দীর্ঘদিন অস্বস্তিতে আছি, বেদনায় আছি, ক্ষুব্ধতায় আছি। সহজে স্বস্তি দিতে রাজি নই এসব খুনের দিকে চোখ বন্ধ করে রাখা সরকার এবং রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র এসব হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না। একজন প্রকৃত শিক্ষকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইছি রাষ্ট্রের কাছে। আমাদের অব্যাহত সম্মিলিত প্রতিবাদ রাষ্ট্রকে এসব হত্যাকাণ্ড বিষয়ে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করুক।

The post কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই! first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%be%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%93-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%8b-%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%87/feed/ 0
ধর্ষণ কি অপ্রতিরোধ্য? https://kaberigayen.com/%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%b7%e0%a6%a3-%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%85%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%be%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%b7%e0%a6%a3-%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%85%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%be%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af/#respond Sun, 06 Mar 2022 07:43:18 +0000 https://kaberigayen.com/?p=7913 ধর্ষণ অপ্রতিরোধ্য নয়, অপ্রতিরোধ্য হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের জাগরণ। এই জনপদে ধর্ষণ সব সময়েই ছিল, খবরে কম আসত। ধর্ষণের খবরগুলো প্রকাশিত হচ্ছে, এটি প্রথম প্রতিরোধ। ধর্ষিত নারী রুখে দাঁড়াচ্ছেন, এটি পরবর্তী প্রতিরোধ। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সোচ্চার হচ্ছেন, এটিই চূড়ান্ত প্রতিরোধ। ভেঙে যাচ্ছে ধর্ষণের অপ্রতিরোধ্যতার মিথ।

The post ধর্ষণ কি অপ্রতিরোধ্য? first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

বাংলা বর্ষবরণে টিএসসিতে নারী নির্যাতন ও মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের শিশু নির্যাতনের ঘটনা থেকে শুরু হয়ে মাস খানেক ধরে যেন ধর্ষণ-সংবাদের সুনামি চলছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বাসে-মিনিবাসে-ট্রাকে-স্কুলে-মাঠে-পাহাড়ে ধর্ষণ-সংবাদ পাচ্ছি। গত কয়েক দিনের কিছু সংবাদ শিরোনাম: ঠাকুরগাঁওয়ে তরুণীকে ধর্ষণের পরে হত্যা, কিশোরগঞ্জে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষিত, পিরোজপুরে ছেলের বউকে ধর্ষণের অভিযোগে শ্বশুরের বিরুদ্ধে মামলা, মিরপুরে পাঁচ বছরের এক স্কুলশিশুকে ধর্ষণের দায়ে শিক্ষকের যাবজ্জীবন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির পরে ছাত্রীকে জুতাপেটা, মসজিদে আরবি পড়তে গিয়ে ইমাম কর্তৃক ধর্ষিত তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। আদিবাসী নারী, প্রতিবন্ধী নারী, চার বছর বয়সী শিশু থেকে শুরু করে ৫৫ বছরের নারী, এমনকি মৃত শিশুও। এসব ধর্ষণ-সংবাদ, ধর্ষকদের ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারার ব্যর্থতা এবং নতুনতর ধর্ষণ-সংবাদের মধ্য দিয়ে সমাজে প্রচলিত ধর্ষণের অপ্রতিরোধ্যতার মিথটিই যেন শক্তিশালী হচ্ছে। আমি শুধু বুঝতে চেষ্টা করছি, ধর্ষণ কি সত্যিই অপ্রতিরোধ্য?

দুই.
ধর্ষণ বিষয়ে একাডেমিক পড়াশোনা করতে গিয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, ধর্ষণ জৈবিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক প্রশ্রয়ে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত পুরুষতান্ত্রিক সহিংস অপরাধ। ১৯৬৯ সালে ১৫৬টি সমাজে ধর্ষণপ্রবণতার ওপর গবেষণা করে নৃতাত্ত্বিক প্যাগি স্যান্ডি দেখান যে ধর্ষণ কোনো অবশ্যম্ভাবী বিষয় নয়, বরং তাঁর গবেষণাধীন ৪৭ শতাংশ সমাজে ধর্ষণ নেই। ধর্ষণমুক্ত মডেল সমাজ হিসেবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার আশান্তি, মবুতি পিগমি সমাজের উদাহরণ টেনেছেন। ধর্ষণমুক্ত সমাজে নারী-পুরুষ মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদাবান, অর্থনৈতিক সাম্য আছে, আছে সামাজিক স্থিরতা, যেখানে পুরুষের দৈহিক শক্তিকে অপরিহার্য মনে করার মিথ প্রচলিত নয়। আশান্তি সমাজে নারীরা প্রভাবশালী সদস্য, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে নারী পুরুষের মতোই সমানভাবে অংশ নেন। মবুতি সমাজের কোনো সদস্যই কারও ওপর প্রভুত্ব করে না, এমনকি জঙ্গলের ওপরেও না। নারীর সন্তানধারণ ও লালন করার ক্ষমতাকে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সম্মান। মূলত মাতৃতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণের ধারণাই অনুপস্থিত, যেমন সাম্প্রতিক সময়ে গারো নারী ধর্ষণের প্রতিবাদ সমাবেশে সঞ্জীব দ্রং জানিয়েছেন, গারো ভাষায় ধর্ষণ শব্দটি নেই।

পাশাপাশি ধর্ষণপ্রবণ সমাজের বৈশিষ্ট্য হলো সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়া, শৈশব থেকেই পুরুষদের উগ্র, প্রতিযোগী হতে শেখানো, জনপরিসরে বা ধর্মীয় বিষয়ে নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকা, নারীর বাস্তব-বুদ্ধি বিষয়ে পুরুষের প্রকাশ্য উপহাস, নারীর কাজকে অবমূল্যায়ন করা এবং এমনকি যৌন সম্পর্কে সম্মত না হলে জোর করাকেও পৌরুষ হিসেবে মহিমান্বিত করা। স্যান্ডি শেষ করেছেন এই বলে যে ধর্ষণ পুরুষ প্রকৃতির অনিবার্যতা নয়, তবে পুরুষ প্রকৃতির যে ইমেজ নির্মিত হয়েছে, তার ফলাফল। নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য করার এই ইমেজ প্রতিষ্ঠা করে সমাজ, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতাকাঠামো।

 

তিন.
নারীর প্রতি সংঘটিত যেকোনো যৌন নির্যাতনের জন্য নারীকেই দায়ী করা আমাদের সংস্কৃতিতে প্রোথিত। বর্ষবরণে টিএসসির ঘটনায় নারীর সাজগোজ ও পোশাককেই দায়ী করেছেন শফী হুজুর। প্রিপারেটরি স্কুলে প্রথম শ্রেণির ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের মুখে স্কুলের অন্যতম প্রভাবশালী কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ফুল থাকলে মৌমাছি আসবে।’ আর সবশেষ উদাহরণ দেখা গেল হলিক্রস বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ধর্ম বিষয়ের প্রশ্নপত্রে। বৈশাখী মেলাসহ বিভিন্ন মেলায় ‘গেঞ্জি ও জিনসের প্যান্ট’ পরে যাওয়ার জন্যই যে মেয়েরা নানা ধরনের অসুবিধায় পড়ে এবং এ বছর বৈশাখী মেলায় ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো এড়ানোর উপায় হিসেবে পোশাক পরিচ্ছদে শালীনতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে বৈশাখে সংঘটিত ঘটনার জন্য নারীর পোশাক পরিচ্ছদকেই দায়ী করা হলো।

আমাদের রোমান্টিকতার ধারণা তৈরি হয়েছে অনিচ্ছুক নারীর পেছনে পুরুষের জোরপূর্বক অনুসরণের দৃশ্যসহ ‘চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে’–জাতীয় গানের মাধ্যমে। গ্রামের মাতবরসমাজ ধর্ষিতকেই দোররা মারার বিধান চালু রাখে বলে ১৪ বছরের ধর্ষিত হেনাকে গ্রাম্য সালিসের দোররায় মরে যেতে হয়। ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতাকে বিয়ে দেওয়াকে সামাজিক সমাধান মনে করা হয়। আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনী শুধু যে যৌন নির্যাতন বন্ধে ব্যর্থ হয় এমন নয়, বরং তাদের নির্যাতকের ভূমিকায় দেখার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। ইয়াসমিনকে পুলিশ ধর্ষণ ও হত্যা করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল, জেলের নিরাপত্তাবেষ্টনীতে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল সীমাকে, এবারের টিএসসির ঘটনায় পুলিশের সব পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া এবং গুরুত্ব লঘু করার সব উদ্যোগ নিয়েছেন। যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের, বিশেষ করে ইসমত জাহানকে, নির্মমভাবে পিটিয়েছে এবং সবশেষে পুলিশের আইজি বর্ষবরণে টিএসসির যৌন নির্যাতনকে তিন-চারটি ছেলের ‘দুষ্টামি’ বলেছেন।

চার.
আমাদের রাজনীতি, সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থা ধর্ষককে সুরক্ষা দেওয়ার সংস্কৃতি লালন করে চলেছে। অর্থনৈতিক বণ্টনসহ নারীর প্রতি নানা অবিচারের কাঠামো যে ব্যবস্থায় নিহিত, সেখানে ধর্ষণ অনিবার্য। এই সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ করা সম্ভব না হলে এক-আধটি বিচার নামের প্রহসন দিয়ে এই সর্বমাত্রিক যৌন সহিংসতাকে দমন করা যাবে না। ধর্ষণ কেউ সাক্ষী রেখে করে না, ফলে সামাজিক নিন্দার বাধা অতিক্রম করে কেউ ধর্ষণের বিচার চাইলেই বর্তমান বিচারকাঠামোতে ন্যায্য বিচার পাওয়া সম্ভব না–ও হতে পারে। প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ।

ছাত্রদের প্রতিরোধ জারি ছিল বলেই টিএসসির ঘটনাটিকে সম্পূর্ণভাবে চেপে যাওয়া সম্ভব হয়নি পুলিশের পক্ষে, সম্ভব হয়নি প্রিপারেটরি স্কুলের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া। প্রতিরোধ ছিল বলেই গারো নারীকে ধর্ষণকারীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রদের বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রতিরোধের কারণেই হলি ক্রস স্কুল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে দুঃখ প্রকাশ করতে। গারো মেয়েটির ঘুরে দাঁড়ানোও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। যে দুজনকে ধরা গেছে এবং নিজেরা অপরাধ স্বীকার করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
প্রতিরোধ চলুক ধর্ষণ আইনে যেসব ফাঁক রয়েছে, সেসব সংশোধনের জন্য। প্রতিরোধ হোক শিক্ষা কার্যক্রমের যেখানেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ধারণা বহাল রয়েছে, সেসব পাল্টে দেওয়ার। সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ধর্ষণ বিষয়ে ‘নারীর সর্বস্ব হারানো’র পুরুষতান্ত্রিক মিথটিকে পাল্টে ‘ধর্ষকের রক্ষা নাই’ মর্মে বিকল্প মিথ নির্মাণের মধ্য দিয়েই ধর্ষণকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এই প্রতিরোধে রাষ্ট্রের কোনো এজেন্সি বিরোধিতা করলে পাল্টা আঘাত সেখানেও হোক।

ধর্ষণ অপ্রতিরোধ্য নয়, অপ্রতিরোধ্য হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের জাগরণ। এই জনপদে ধর্ষণ সব সময়েই ছিল, খবরে কম আসত। ধর্ষণের খবরগুলো প্রকাশিত হচ্ছে, এটি প্রথম প্রতিরোধ। ধর্ষিত নারী রুখে দাঁড়াচ্ছেন, এটি পরবর্তী প্রতিরোধ। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সোচ্চার হচ্ছেন, এটিই চূড়ান্ত প্রতিরোধ। ভেঙে যাচ্ছে ধর্ষণের অপ্রতিরোধ্যতার মিথ।

 

ফিচার ছবিঃ কাউন্সেলিং টুডে ও ইকুয়ালিটি নাউ হতে তৈরি করা হয়েছে

The post ধর্ষণ কি অপ্রতিরোধ্য? first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%b7%e0%a6%a3-%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%85%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%be%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af/feed/ 0
‘তোমার পতাকা যারে দাও…’ https://kaberigayen.com/%e0%a6%a4%e0%a7%8b%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%be-%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%93/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%a4%e0%a7%8b%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%be-%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%93/#respond Tue, 15 Mar 2022 09:27:27 +0000 https://kaberigayen.com/?p=8054 প্রার্থনারত মানুষকেই আমরা সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় ধরে নেই, তিনি যে ধর্মেরই হোন; উপাসনা শেষে উঠে আসা মানুষ কখনো সহিংস হতে পারেন না। সেই শান্তিপ্রিয় উপাসনাকারী মানুষদের ইমেজকেই ব্যবহার করা হলো এদেশের মূল প্রতীকগুলোকে আঘাত করার জন্য। করলেন তারা যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে এসেছেন বরাবর। ১৯৭১ সালেও মসজিদের ইমাম রক্ষা পাননি এই শক্তির কাছে। অথচ একটু ঘুরে দাঁড়ালেই এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা জাতীয় পতাকার বিপরীতে তাঁদের দাঁড় করিয়ে দেবার এই রাজনৈতিক কূটচালের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠবেন বলে আমার বিশ্বাস। ফের এমন কোন উদ্যোগ তারা নিজেরাই প্রতিহত করবেন। ইসলামসহ সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ রুপটি এই বাংলা থেকেই বিশ্ববাসী সবচেয়ে পরিপূর্ণভাবে অনুভব করা সম্ভব বলে মনে করি, কারণ সব ধর্মের সহমর্মিতার নির্যাস সংহত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়।

The post ‘তোমার পতাকা যারে দাও…’ first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

যু’দ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায়ে সংক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্ম শাহবাগে আন্দোলন করে যাচ্ছেন আজ এক মাস কুড়ি দিন হলো । তাদের দাবি প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। খানিক আগেই শাহবাগের মঞ্চ মশাল মিছিল করেছে ২৫ মার্চ কালো রাতের স্মরণে। মোম জ্বালিয়েছে তারা শহীদ মিনারে, জগন্নাথ হলে- আলোর স্মরণে আঁধার কাটার শপথে। গত পঞ্চাশ দিনের আন্দোলনে লাখো মানুষের সমাবেশ শাহবাগ পার হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে, দেশ ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে, যেখানেই আছেন বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাভাষী মানুষ। গণজাগরণের এমন নজির পৃথিবীতে বিরল। দিন-রাত নারী-পুরুষের ঐক্যবদ্ধ সমাবেশ যে এতো সুশৃঙ্খল, এতো প্রাণময়, এতো আশা জাগানিয়া হতে পারে, চোখের সামনে এই উদাহরণটি তৈরী না হলে জানা হতো না। এই সমাবেশ থেকে কখনোই একটি ঢিল ছোঁড়ার অভিযোগ ওঠেনি, লাখো নারী-পুরুষের সমাবেশে একটি ইভটিজিং-এর অঘটন ঘটেনি। বিশ্ব গণমাধ্যম শুরুতে এই জাগরণকে উপেক্ষা করলেও একেবারে নিশ্চুপ থাকতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস, এমনকি আল জাজিরা পর্যন্ত এই অভূতপূর্ব জাগরণের পক্ষেই রিপোর্ট করেছে।

প্রজন্ম চত্ত্বরের তরুণরা আন্দোলন করে যাচ্ছেন অহিংস পথে। তারা দেখিয়েছেন বিপুল জনসমূদ্রের তিন মিনিট নীরবতায় কেমন প্রতিবাদী মহাকাল তৈরি করা যায়, লাখো-কোটি মানুষের একটি একটি মোমের শিখা কীভাবে সমর্থন-সহমর্মিতার আকাশ-গঙ্গা তৈরি করতে পারে দেশ জুড়ে, বেলুনে বেঁধে প্রিয়তম স্বজনের উদ্দেশ্যে উড়িয়ে দেয়া চিঠিগুলো কীভাবে হয়ে উঠতে পারে ৪২ বছর বুকে চেপে রাখা গভীর বেদনা প্রকাশের উপায়। দেখিয়েছেন তারা একটির পর একটি মহাসমাবেশ থেকে কীভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কর্মসূচী দেয়া যায়। যখন তারা হারিয়েছেন সহযোদ্ধা রাজীব কিংবা শ্লোগানরত অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া শান্তকে, তখনো তারা সহিংস হয়ে ওঠেননি মূহুর্তের জন্য। শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন বিপুলতর উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। এমনকি জাতীয় পতাকা পুড়িয়েছে যারা, ভেঙ্গেছে শহীদ মিনার, আগুন ধরিয়েছে জনতার মঞ্চে, এই তরুণ প্রজন্ম তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার পরিবর্তে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে করেছেন পতাকার সমাবেশ। ২১ ফেব্রুয়ারি বধ্যভূমির কাছেই চা-এর স্টলে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম একেবারেই খেটে খাওয়া এক মানুষের ইতিহাস বর্ণনা। তিনি বলছিলেন, ‘ভয়ের কিছু নাই। পাকিস্তানি সেনারাই পারে নাই ৭১ সালে…।’ এমন সব মানুষের সামষ্টিক যুদ্ধ-স্মৃতিই তরুণ প্রজন্মের শক্তি। সারা দেশটিই হয়ে উঠেছে যুদ্ধ-স্মৃতি বিনিময়ের জন-পরিসর, হেবারমাসের ভাষায় ‘পাবলিক স্ফিয়ার’। এই শক্তিতেই, সুশৃঙ্খল অথচ প্রত্যয়ী মিছিলকেই জামাতের ডাকা হরতালগুলো প্রতিহত করার মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছেন তরুণ প্রজন্ম । দাবি আদায়ের এমন শান্তিপূর্ণ গণজাগরণ দেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদি করে। কারণ এই দেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিলো ‘একটি ফুলকে বাঁচানো’র জন্য।

কোন ঘটনাকে বোঝার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত উপায় হলো বিপরীত ঘটনার সাপেক্ষে তাকে বিচার করা। সারাদেশে লাখো মানুষের সমাবেশ থেকে শ্লোগান, কবিতা, গান, নাটক, লেখায় যে প্রতিবাদ, তার বিপরীত শক্তিকে দেখলাম অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়তে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-ভিত্তি যদি হয় ভাষা আন্দোলন, তার প্রতীক শহীদ মিনারকে আঘাত করা হলো সিলেটে। ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকারের পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্রথম শহীদ মিনার ভেঙ্গেছিলো। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় শহীদ মিনার ভাঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার সহযোগীরা ১৯৭১ সালে। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের সময় সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলা হয়। আর সিলেটে জঙ্গি মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাংচুর করা হলো গত ২২ ফেব্রুয়ারি। শহীদ মিনারের প্রতি কাদের ক্ষোভ, ইতিহাসের এই রেকর্ড সে’বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়। আমাদের পরম্পরা চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। আমাদের পতাকার প্রতিই বা ক্ষোভ কাদের? স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্বাস আছে, এমন কোন মানুষ বাংলাদেশের পতাকা ছিঁড়তে পারে, বিশ্বাস করি না। ইসলামি ব্যাংকের রংপুর শাখায় ঘর পরিস্কার করা ঝাড়ুর মাথায় জাতীয় পতাকা বেধে রাখার ছবিও এসেছে। তা’হলে তারা কারা? নিশ্চয়ই বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যাদের অনুগত্য নেই, তারাই। দেখলাম বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতর রাখা জায়নামাজে আগুন দেয়া হয়েছে। কাদের ইতিহাস একই সাথে শহীদ মিনার, জাতীয় পতাকা এবং মসজিদের ভেতর আক্রমণ চালানোর?

প্রার্থনারত মানুষকেই আমরা সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় ধরে নেই, তিনি যে ধর্মেরই হোন; উপাসনা শেষে উঠে আসা মানুষ কখনো সহিংস হতে পারেন না। সেই শান্তিপ্রিয় উপাসনাকারী মানুষদের ইমেজকেই ব্যবহার করা হলো এদেশের মূল প্রতীকগুলোকে আঘাত করার জন্য। করলেন তারা যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে এসেছেন বরাবর। ১৯৭১ সালেও মসজিদের ইমাম রক্ষা পাননি এই শক্তির কাছে। অথচ একটু ঘুরে দাঁড়ালেই এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা জাতীয় পতাকার বিপরীতে তাঁদের দাঁড় করিয়ে দেবার এই রাজনৈতিক কূটচালের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠবেন বলে আমার বিশ্বাস। ফের এমন কোন উদ্যোগ তারা নিজেরাই প্রতিহত করবেন। ইসলামসহ সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ রুপটি এই বাংলা থেকেই বিশ্ববাসী সবচেয়ে পরিপূর্ণভাবে অনুভব করা সম্ভব বলে মনে করি, কারণ সব ধর্মের সহমর্মিতার নির্যাস সংহত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়।

এরপর এই অপশক্তি গত একমাস ধরে ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে হিন্দুদের মন্দির, জনবসতি আর ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর। সরকার হিন্দুদের উপর নেমে আসা এই নির্যাতনকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে আর সেই অভয়ারণ্যে ক্রমাগত হ্রাস পাওয়া হিন্দু ধর্মীয় উপাসনালয়ের উপর আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। শুরু হয়েছিলো বাঁশখালি, সাতকানিয়া, বেগমগঞ্জে। গত একমাসে সারা দেশে এমন কোন এলাকা নেই, যার কোন না কোন মন্দির বা বিগ্রহ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েছে। বেদনা বোধ করি যখন দেখি, দফায় দফায় এই ধ্বংস-লীলা চালিয়েছে যারা, তাদের এক বড় অংশ ছিলো ১২ থেকে ১৫ বছরের শিশু-কিশোর। রামুর বৌদ্ধবিহারগুলোতে যারা আক্রমণ চালিয়েছিলো গত বছর অক্টোবরে, কিংবা তার আগে সাতক্ষীরায়, তাদের মধ্যেও ১৪ থেকে ২২ বছরের কিশোর-তরুণদের আধিক্যই ছিলো বেশি। এইসব শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যত কী?

Shahbag Protest, Dipu Malakar, 2013

এই আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য নানা প্রচারণা চালানো হচ্ছে শুরু থেকেই। রাজীব ব্লগার ছিলেন, কিন্তু তিনি এই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কেউ ছিলেন না। তিনি আস্তিক কি নাস্তিক সেই বিষয়েও কোন কথা তার জীবদ্দশায় ওঠেনি। তাকে হত্যার দুই ঘন্টার মাথায় তার নামে ‘নূরানী চাপা সমগ্র’র লিংক প্রকাশ করে পাকিস্তানের একটি ওয়েবসাইট। সেখানে রাজীবের খুনের খবরের পাশাপাশি ‘নূরানী চাপা সমগ্র’র লেখক হিসাবেও উল্লেখ করা হয়। অনলাইন নিয়ে কাজ করেন এমন প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, এই বিতর্কিত লেখাগুলো রাজীবের নয়। আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টকাস্টের (quantcast.com) দেয়া তথ্যেও এমনই প্রমাণ মেলে। যে পোস্টটিকে দাবি করা হচ্ছে ২০১২ সালে লেখা, ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজীব হত্যাকান্ডের আগে কেউ সাইটটিতে ঢুকেছেন, এমন কোন প্রমাণ নেই কোয়ান্টকাস্টে অথচ লিংকটি ছড়িয়ে দেয়ার ফলে একদিনে মোট ভিজিটর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০ হাজারের বেশী। অনলাইন ট্রাফিক ও পর্যবেক্ষণ সাইট alexa.com- এর মতেও ১৫ ফেব্রুয়ারির আগে এই সাইটটিতে ভিজিট করার তথ্য নেই। আমারব্লগ.কম-এর অন্যতম অ্যাডমিন প্রকৌশলী সুশান্ত দাশগুপ্ত অ্যালেক্সা ও কোয়ান্টকাস্টের তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি জানান, “ব্লগটি এক বছর আগের দেখানো হলেও ওয়েব আর্কাইভে এর কোন হদিস নেই।” (বিডিনিউজ২৪ডটকম)। সবচেয়ে বড় কথা, যাকে হত্যা করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আর কী অভিযোগ থাকা সম্ভব?

ধর্মানুভূতিতে আঘাতের বিপক্ষে দেশে আইন রয়েছে, সে’পথে না গিয়ে আন্দোলনকারীদের ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করার এই উস্কানিমূলক রাজনীতি না বোঝার কারণ নেই। আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছে সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেস, তসলিমা নাসরীনের লজ্জা, ইউটিউব-ই বন্ধ করা হয়েছে ইনোসেন্স অব মুসলিম-এর জন্য। ব্যক্তিগত ব্লগের যে লেখাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে ধর্মানুভূতিতে আঘাতকারী হিসাবে, সেই লেখাকে চিরতরে নিষিদ্ধের দাবি না তুলে কেনো একটি জাতীয় দৈনিকের পাতায় ছাপানো হয়েছে সবার পড়ার জন্য? ধর্মের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির ইতিহাসটি ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই জারি আছে এই ভূখন্ডে। আজ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারা দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠছে, তখন ট্রাম কার্ডটি যে ধর্মের নামেই ফেলা হবে, সেটিই স্বাভাবিক। সেই পঙ্কিল রাজনীতিকে যে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এতো খোলাখুলিভাবে সমর্থন করবেন, সেটি অভাবিত ছিলো। আবার সরকারও যে ক্রমাগত এইসব অপপ্রচারের শক্তির কাছে নতি-স্বীকার করবে, সেটি শুরুর দিকে তাদের সমর্থন এবং উচ্ছ্বাস দেখে বোঝা যায়নি। বিশেষত, কমিটি গঠন করে ব্লগ ঘেঁটে ব্লগারদের কে কে ‘ধর্মীয় অনুভূতি’তে আঘাত করেছে বের করার যে উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে সেটির উদ্দেশ্য খুব পরিস্কার নয়। ভোটের রাজনীতি ভিন্ন এর আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? এ পর্যন্ত সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রশ্নে আন্তরিকই মনে হয়েছে। ফলে এইসব দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করে ব্লগার-অ্যাক্টিভিস্টদের জাতির সামনে নাস্তিক প্রমাণ করার দায়িত্বটি সরকার কেনো নিলেন বোঝা যাচ্ছে না। এই অস্পষ্টতা গোটা আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারকে যেনো বাধাগ্রস্ত না করতে পারে, সেটিই এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত সবার পাহারাদারির জায়গা।

প্রজন্ম চত্ত্বরের তরুণদের অর্জন অনেক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে দেশের দাবিতে পরিণত করা, সেই দাবির পাটাতনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটির রাজনীতি করার বৈধতার বিষয়টিকে জন-পরিসরের অভিতর্কে নিয়ে আসা এসব তাৎক্ষণিক অর্জনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রতিজ্ঞা ছড়িয়ে দেয়া সারা দেশে এবং এদেশে ভবিষ্যতের যে-কোন কর্মকাণ্ডের ন্যূনতম যাত্রাবিন্দু হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এমন আকাঙখাও জাতিকে দেখাতে পেরেছে এই আন্দোলন। তবে জাগরণের প্রথম উচ্ছাসশেষে আন্দোলনটি এখন কঠিন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি। আন্দোলনরত তরুণদের জীবনাচরণসহ নানা ধরণের অপ্রধান বিষয়গুলোকে প্রধান করে তুলে আন্দোলনটিকে মূল দাবি থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা যা শুরু হয়েছে, তা জারি থাকবে। সেইক্ষেত্রে, শুনতে খারাপ লাগলেও, ভোটের রাজনীতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, শাহবাগ আন্দোলনের মূল স্পিরিটের সাথে সরকারি দলের সমর্থন কোন মাত্রায় জারি থাকবে, নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ দেখে। এসব অপচেষ্টার মুখে আন্দোলনের মূল দাবিকে সমুন্নত রাখা এবং বেগবান করাই সামনের দিনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। যারা পতাকা ছেঁড়ে, শহীদ মিনার ভাঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নকে বারে বারেই রক্তাক্ত করে – তাদের হাত থেকে জাতীয় পতাকা সমুন্নত রাখার ঐতিহাসিক দায়িত্ব আজ প্রজন্মের তরুণদের হাতে। শাহবাগের ঐতিহাসিক জাগরণের পরে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তোলার দায়িত্ব অনিবার্যভাবে তাদের হাতেই ন্যস্ত হয়েছে, কারণ যারা স্বপ্ন দেখায় সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্বও তাদের উপরেই ন্যস্ত হয়। একইসাথে রাজনৈতিক দলবিহীন মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এই শাহবাগ চত্ত্বরের প্রতিজ্ঞাকে, আন্দোলনকে এই দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি কীভাবে তাদের রাজনীতিতে সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করতে পারে, তার উপরেই বাংলাদেশের ভবিষ্যত চেহারাটি নির্ভর করছে।
তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি।

The post ‘তোমার পতাকা যারে দাও…’ first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%a4%e0%a7%8b%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%be-%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%93/feed/ 0
কিছু কালোসিধে কথা বলতে চাই https://kaberigayen.com/%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%9b%e0%a7%81-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%a7%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%9a%e0%a6%be/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%9b%e0%a7%81-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%a7%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%9a%e0%a6%be/#respond Tue, 15 Mar 2022 08:30:15 +0000 https://kaberigayen.com/?p=8043 তা’হলে প্রশ্নটা হলো, যদি রুমানার সত্যিই অন্য কোন পুরুষের সাথে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে উঠতো, তা’হলেও সাইদ এই অত্যাচারের অধিকারী কি না বা রুমানার উপর চালানো এই ভয়াবহ অত্যাচারের প্রতিবাদে আমরা দাঁড়াবো কি না। প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো, না। সাইদ বড়জোর বিয়ে-বিচ্ছেদের নোটিশ দেবার অধিকারী। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো, অবশ্যই। একজন নির্যতিত মানুষের পাশে সমর্থন নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য তার চারিত্রিক সনদ হাতে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সামাজিক অনুভব কাঠামোতে এই সত্যটিকে নিয়ে আসার জন্য সচেতন মেয়েদের যেমন এগিয়ে আসতে হবে তেমনি সচেতন রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রয়োজন রয়েছে।

The post কিছু কালোসিধে কথা বলতে চাই first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

ভে’বেছিলাম লিখবো না, কারণ লিখে খুব কিছু হয় যে সবসময় এমন দাবি করা যাচ্ছে না, এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফাহমিদা বা গণযোগাযোগ বিভাগের মেধাবী ছাত্রী সুতপা’র মৃত্যুকে কেন্দ্র করে লেখালেখি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে এ’সব লেখালেখি করে নিজে খানিকটা সান্ত্বনা পাওয়া যায় যে ছিলাম আমিও প্রতিবাদে, এর বাইরে খুব যে কাজ হয় তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবুও আজ লিখছি বা বলা ভালো যে না লিখে পারছি না এই অন্তর্গত তাড়না থেকে যে সত্যিই যখন আজ রুমানা দেশে ফিরেছেন তার ডান চোখের আলো ফিরে পাবার শেষ আশ্বাসটুকু ছাড়াই তখন ওই যে আমিও ছিলাম প্রতিবাদে কেবল সেই গোঁয়ার সান্ত্বনাটুকুর জন্যই হয়তো এই লেখা। ভেতরে কোথায় যেন একটা শুভবোধ কাজ করছিলো যে অন্তত এক চোখের আলো তার ফিরে আসবে। সেই শুভবোধের, আশার ক্ষীণ আলোটিও যখন শেষ হয়ে গেলো, তখন আমি সত্যিই কিছু কালোসিধে কথা বলতে চাই।

যে অন্ধত্ব এবং আপোষ কেড়ে নিয়েছে চোখের আলো
কথা খুব সহজ। রুমানা মঞ্জুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। কানাডার বৃটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষণারত। তার শিক্ষার্থীদের বয়ানে জানা যায় (বিভিন্ন ব্লগে, ফেসবুকে মন্তব্য থেকে) তিনি একজন জোরালো শিক্ষক। তার পারিবারিক অবস্থানও অত্যন্ত জোরালো, বাবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা। স্বামী সুদর্শন এবং বুয়েট থেকে পড়াশুনা করা। সহকর্মীরা দাবি করেছেন তার অমায়িক আচরণের কথা। কানাডা থেকে তার প্রতিবেশীরা একত্রিত হয়ে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছেন তার স্বামী’র শাস্তি দাবি করে এবং সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন রুমানাকে তাদের আড্ডায়-আসরে খুব বেশি পাওয়া যেত না কারণ তিনি ক্যাম্পাস থেকে ফিরে প্রতিদিন ফোন করতেন তার মেয়ে এবং স্বামীর সাথে কথা বলার জন্য। এভাবে শিক্ষিত স্বাবলম্বী শক্তিশালী অবস্থানের সংসারমুখী রুমানা মঞ্জুর সমাজের প্রতিষ্ঠিত ভালো মেয়ের এবং আদর্শ স্ত্রী’র সব তরিকা পূরণ করেছেন। কিন্তু তবুও তাকে স্বামীর হাতে নির্যাতিত বলে নির্যাতিত, একেবারে দু’টো চোখই খুইয়ে বসতে হয়েছে। তার নাক কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে সেই স্বামী, যাকে তিনি একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। প্রায় সব পত্রিকায় আরো যে খবরটি এসেছে তা হলো তিনি গত দশ বছর ধরেই কম-বেশি নির্যাতন সহ্য করে এসেছেন। এমনকি এবার আসার পরও না কি তার বেকার স্বামী, যিনি তার বাবার বাড়িতেই থাকেন, তাকে তিন দিন একটি ঘরে আটকে রেখেছেন। সবশেষে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে (২০ জুন, ২০১১) রুমানা মঞ্জুরের বাবা বলেছেন মেয়ের জীবন এবং তার পরিবারের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তারা শংকিত।

সংবাদ সম্মেলনে রুমানা। মুস্তাফিজ মামুন, ২০১১।
স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসীর সহানুভূতি রুমানার সাথে। আমি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকর্মী হিসাবে ঘটনার শুরু থেকেই বেদনা এবং ক্ষুব্ধতার কোন তল পাচ্ছি না। একই অবস্থা প্রায় সবার। সবাই এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইছেন। আমিও চাই, এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাকে দেয়া হোক যেনো ভবিষ্যতে কেউ এমন করার আগে সম্ভাব্য শাস্তির ভয়াবহতা মনে করে হলেও উদ্যত হাত নামিয়ে ফেলে। এ’কথা সত্য এ’জাতীয় ঘটনা বাংলাদেশের অনেক ঘরেই ঘটে কিন্তু এই ঘটনাটি এতো আলোড়ন তুলেছে এ’কারণেই যে প্রায় অবিশ্বাস্য রকমের নিখুঁত অবস্থানের একজন নারীও কতখানি অসহায় হয়ে উঠতে পারেন মুহূর্তে এবং তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এমন একজন নারী কীভাবে দশবছর ধরে এই নির্যাতনকারীর সাথে ঘর করেছেন প্রশ্ন উঠছে সে বিষয়েও। এই ‘কীভাবে’র উত্তরটি খুঁজতে যাবার আগে আরো একটি প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখ করে রাখতে চাই। রুমানা নির্যাতিত হবার সাতদিন পরে ঘটনাটি গণমাধ্যমে আসতে পেরেছে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসিয়ালি অবগত হয়েছে। জানা যায়, পরিবার থেকেই বিষয়টি চেপে রাখার একটি ব্যাপার ছিলো।

ঘটনার অন্যদিকে, খবরটি গণমাধ্যমে আসার অনেক পরে আসামী গ্রেফতার হয়েছেন, সব মিলিয়ে তিনি প্রায় দশদিনের মত সময় পেয়েছেন নিজেকে গুছিয়ে নেবার। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেবার আগ পর্যন্ত পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি অথচ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছে। কারণ সম্ভবত নির্যাতক হাসান সাইদ জনৈক মন্ত্রীর ভাই। তার এই সামাজিক পরিচিতিটি গুরুত্ত্বপূর্ণ এ’কারণে যে এই অবস্থানের কারণে তিনি পালিয়ে থাকতে পেরেছেন অথচ গণমাধ্যমে তার বেকারত্ব থেকে শুরু করে নানা ধরনের অসহায় অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরে তার আচরণের প্রতি একধরনের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাও করেছেন। দ্বিতীয়ত, গ্রেফতার হবার পর সাইদ হাসান প্রথমেই চেষ্টা করেছেন নিকৃষ্টতম পদ্ধতি দিয়ে শুরু করতে আর তা হলো রুমানার সাথে এক ইরানী তরুণের ‘অবৈধ’ প্রেমের গল্প ফাঁদা, যা আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় প্রায় অব্যর্থ মহৌষধের কাজ করে। ফলে রাতারাতি আরেকটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেলো যারা সাইদের অসহায় দৃষ্টিশক্তিহীন কর্মক্ষেত্রে অসফল এবং প্রতারিত স্বামীর ইমেজের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলেন। যদিও পরে তিনি স্বীকার করেছেন এটি বানানো, তার স্ত্রীর এমন কোন সম্পর্ক নেই। মোটামুটি এই কাঠামোর ভেতর থেকে, পারিবারিক সহিংসতার এই ঘটনা থেকে কয়েকটি প্রবণতা বের করে আনতে চাই। এই প্রবণতাগুলো বের করে আনতে যে চলকগুলো ব্যবহার করা হবে তা হলো, নির্যাতক, নির্যাতিত, সমাজ এবং রাজনীতি।

নির্যাতক সাইদ এবং পুরুষতন্ত্র
শুরু করছি সাইদের ঘটনা থেকে। প্রথমত, সাইদ বুয়েটের পড়ালেখা শেষ না করা, বার বার ব্যবসায় ব্যর্থ, প্রায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, অসফল এবং হতাশ এক পুরুষ, যে নিজের অক্ষমতার জ্বালা মেটাতে চেয়েছে, তার বক্তব্য অনুযায়ী, রুমানাকে খুন করে। এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে সে সাফল্যের পরিচয় দিতে পেরেছে। প্রাণে মেরে ফেলতে না পারলেও কামড়ে রুমানার নাক তুলে নিয়ে এবং চোখ উপড়ে ফেলে সে একবার তার ‘পুরুষত্বের’ জানান দিতে পেরেছে। অর্থাৎ একজন সব অর্থে অসফল পুরুষ, সব অর্থে একজন সফল নারীকে (সাইদকে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের মত অসফল কাজটি করা ছাড়া) নিজের কব্জায় রাখার জন্য মেরে ফেলতে চেয়েছে। এই চাওয়ার বৈধতা হলো তার স্বামীত্ব। স্বামীত্ব হলো সেই প্রভুত্ব যা দিয়ে স্ত্রীকে মেরে ফেলার চিন্তা পর্যন্ত করা চলে এবং সেই চিন্তা ও কাজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করা সম্ভব।

এই ভয়াবহ অপরাধটি সংঘটিত করে সাইদ কিন্তু অনুতপ্ত হননি বরং দ্বিতীয় অপরাধটি করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তার স্ত্রী’র চরিত্রে কালি দিতে চেয়েছেন কল্পিত প্রেমিকের গল্প ফেঁদে। অর্থাৎ শারীরীকভাবে প্রায় খুন হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে তিনি তখন সামাজিকভাবে খুন করতে চেয়েছেন। নিজের অপরাধকে লঘু করার জন্য স্ত্রীকে খুন করতে এবং তার চরিত্র কলঙ্কিত করতে তিনি এতটুকু বিচলিতবোধ করেননি। এখানেও তার স্বামীত্ব তার অহম-কে তৃপ্ত করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কাজটি তিনি করতে পেরেছেন কারণ প্রতারিত স্বামীত্বের ইমেজ তৈরি করতে পারলে স্ত্রী’র বিরুদ্ধে যে-কোন অন্যায়কে আমাদের সমাজ এখনো বৈধতা দেয়, আইন না দিলেও। যেমন ’পতিতা’ প্রমাণ করতে পারলে যে কোন ধর্ষণ বা খুনের মামলা থেকে সামাজিকভাবে মুক্তি পাওয়া যায় । ইয়াসমীন হত্যা বা জেলের কাস্টডিতে থাকার সময় পুলিশের দ্বারা প্রথমে ধর্ষিত ও পরে খুন হয়ে যাওয়া সীমার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি কীভাবে তাদের পতিতা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। যেনো একজন পতিতাকে খুন করা জায়েজ। সাইদ সেই চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। (মানবজমিন, ২১ জুন ২০১১)।

নির্যাতিত রুমানা এবং তার পরিবার
রুমানার দুই চোখের আলো নিভে গেছে। ক্ষতবিক্ষত নাক এবং মুখমন্ডল নিয়ে তিনি ধুকছেন হাসপাতালে। রুমানার প্রতি সহানুভূতি ও শুভকামনার সাথে সাথে একটি প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠছে, কেনো তিনি এতো দিন ধরে এই নির্যাতন সহ্য করেছেন? তার পর্যায়ের এক নারীর তো এমন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কথা না। ধর্ম এবং আইন-দুই-ই বৈধতা দিয়েছে অসহনীয় বিবাহিত সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলার। যেহেতু এই প্রশ্ন করার অবস্থায় রুমানা নেই তাই ধারণা করে নিতে হচ্ছে, হয়তো সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখার ভালোমানুষী চেষ্টা যা ভালাবাসা থেকেই উৎসারিত বা সন্তানের মুখ চেয়ে থেকে যাওয়া বা সামাজিক দৃশ্য-অদৃশ্য চাপের কাছে নতি-স্বীকার। হয়তো সবগুলোই সত্য। শেষ অনুমিতিটিই প্রবল হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় নির্যাতনের সাতদিন পর্যস্ত এই ঘটনাটি অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স লাউঞ্জের মূখ্য আলোচনার বিষয় হলেও অফিসিয়ালি সেটা পরিবার থেকে জানানো হয়নি। না বিশ্ববিদ্যালয়কে, না গণমাধ্যমকে। আমরা এখনো জানিনা, সাইদের পক্ষ থেকে কী ধরণের চাপ ছিলো কিন্তু যদি ধরেও নেই সাইদের পক্ষ থেকে প্রবল কোন চাপ ছিলো কিন্তু তাই বলে হত্যাচেষ্টার পুলিশকেস করা হবে না সাতদিন পর্যন্ত, এ কেমন কথা? তা’হলে কি পরিবার তখন পর্যন্ত ঘটনাটি চেপেই রাখতে চাইছিলো? নির্যাতিত রুমানা এবং তার পরিবারও পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন-কাঠামোকে টিকিয়ে রাখছেন।

সামাজিক অনুভব কাঠামো
আপাতঃদৃষ্টিতে রুমানাকে এইমতো সম্পর্কের রেশ এতো দীর্ঘদিন বয়ে নেবার জন্য দায়ী করাই যায় কিন্তু একটু খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে তার সন্তানের নিরাপত্তা এবং পিতৃপরিবারের সম্মানের কথা ভেবে তিনি সরে যেতে পারেন নি। পরিবারও তাকে উৎসাহিত করতে পারেনি সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে। সুতপার ক্ষেত্রেও দেখেছিলাম তার মৃত্যুর পর তার ভাইবোনেরা বলেছেন সুতপাকে তার স্বামী প্রায়্ই মারধোর করত। তখনও আমার প্রশ্ন ছিলো যে আদরের বোনকে হারিয়ে তারা পাগল-প্রায়, সেই বোনের দিনের পর দিন নির্যাতনের কাহিনী শুনেও তারা কেন বোনকে ওই বিয়ে থেকে সরিয়ে আনেন নি। সুতপার ক্ষেত্রে পরিবারকেই দায়ী করতে হয় কারণ সুতপা তখনও ছাত্রী, অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করেন নি। রুমানার ক্ষেত্রে তো তা নয়, কিস্তু সত্য হলো রুমানা সরে আসতে পারেন নি। আমরা যে সামাজিক অনুভব কাঠামোর মধ্যে বসবাস করি সেখানে দৃশ্য-অদৃশ্য এতো চাপ থাকে যা অতিক্রম করার জন্য তথাকথিত ‘ভালো মেয়ে’ বা ‘ভালো স্ত্রী’র ইমেজটিকে পরিত্যাগ করার মত মানসিক দৃঢ়তা না থাকলে এই নিপীড়নের সাথেই বসবাস করতে হয়। আমাদের রুপকথা থেকে শুরু করে কাব্যে, সাহিত্যে, পুঁথি-পাঁচালিতে, প্রবাদে, পুরাণে, ধর্মে, ইতিহাসে, উপন্যাসে, গানে, নাটকে, চলচ্চিত্রে ভালো নারীত্বের যে ‘গুণী অথচ দুর্বল’ এবং পুরুষের প্রতি নির্ভরশীল, যা পিতা পুরুষ থেকে স্বামী পুরুষে হস্তান্তরের প্রক্রিয়ামাত্র, তকমাটা এঁটে দেয়া হয়েছে রুমানারা হয়ে উঠেছেন সেই ভালো নারীত্বের প্রতিনিধিত্বকারী অসহায় শিকার। আর তাই তিনি যখন আক্রান্ত তখনও দেখি একদল পত্রিকা চায় তাকে পৃথিবীতে অসম্ভবপ্রায় নিষ্কলুষ চরিত্রের (যেমন তিনি মৃদুভাষী, পাঁচবেলা নামাজ পড়েন, মাথায় কাপড় দিয়ে কানাডার প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করেন, কানাডার প্রতিবেশীরা তাকে চেনেন তার মিষ্টি ব্যবহার এবং ভালো রান্নার জন্য ইত্যাদি) করে উপস্থাপন করতে, আরেকদল পত্রিকা চায় তার কথিত প্রেমের কাহিনী চাউর করে সাইদের অপরাধের ভার লাঘব করতে। দুই ক্ষেত্রেই রুমানার প্রতি কতটা সহানুভূতি থাকবে তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয় তথাকথিত ভালোমেয়ের সার্টিফিকেট সাপেক্ষে। এবং সাইদ নাক থেতলে, চোখ তুলে না নেয়া পর্যন্ত রুমানার এই বিয়ে-সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার বৈধতা তৈরি হয় না।

তা’হলে প্রশ্নটা হলো, যদি রুমানার সত্যিই অন্য কোন পুরুষের সাথে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে উঠতো, তা’হলেও সাইদ এই অত্যাচারের অধিকারী কি না বা রুমানার উপর চালানো এই ভয়াবহ অত্যাচারের প্রতিবাদে আমরা দাঁড়াবো কি না। প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো, না। সাইদ বড়জোর বিয়ে-বিচ্ছেদের নোটিশ দেবার অধিকারী। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো, অবশ্যই। একজন নির্যতিত মানুষের পাশে সমর্থন নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য তার চারিত্রিক সনদ হাতে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সামাজিক অনুভব কাঠামোতে এই সত্যটিকে নিয়ে আসার জন্য সচেতন মেয়েদের যেমন এগিয়ে আসতে হবে তেমনি সচেতন রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রয়োজন রয়েছে।

কেন এটিও রাজনৈতিক লড়াই
কেন কোন মেয়ে নির্যাতিত হয়েও বিবাহিত সম্পর্কে টিকে থাকতে চায় বা মেয়েকে নির্যাতিত জেনেও তার পরিবার সেই সংসারটি টিকিয়ে রাখতেই মদদ দেয়? এই লৈঙ্গিক সংস্কৃতিটি বুঝতে হবে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রীয় সম্পর্কের সাপেক্ষে। স্বামীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আসা মানে তার আর নিজের কোন জায়গা না থাকা। নারী বঞ্চিত তার উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে। মেয়েটির পরিবারে ফিরে আসা মানে ভাইয়ের সম্পত্তিতে অংশভাগ নেয়া। বাবার বা ভাইয়ের পরিবার মেয়ে-জামাই-নাতি এলে তাকে মুরগী জবাই করে খাওয়াতে আগ্রহী কিন্তু মেয়েকে সেই সম্পত্তির অংশভাগ দিতে আগ্রহী নয় পিতা বা ভাই নামের পুরুষতন্ত্র। আগ্রহী নয় তার এবং তার সন্তানের দেখভাল করার দায়িত্ব নিতে। অথচ মেয়েকে গুনী হিসাবে তৈরি করলেও তাকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলেনি পরিবার এবং সমাজ। বিয়ের সময় খুব বড় শিক্ষিত পরিবারেও বলতে শুনেছি, ‘আমার মেয়ে শুধু কলেজে যায় আর বাসায় আসে। আমরাই সাথে করে নিয়ে যাই আবার নিয়ে আসি। ও পথ-ঘাটও চেনে না।’ কাজেই স্বামীর সংসার থেকে ফিরে আসা মানে স্নেহময় পিতা কিংবা ভাইয়ের উপর নির্ভরশীলতা। বিয়ে দেবার মধ্য দিয়ে পিতৃপরিবার এই দায় থেকে এক ধরনের মুক্তি নিয়ে নেয়, ফলে নতুন করে সেই দায় নিতে রাজী থাকে না। দ্বিতীয়ত, সন্তানের অভিভাবকত্ব। বাংলাদেশে বিয়ে, বিয়েবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং সম্পদে অধিকারের মত বিষয়গুলো চলে পারিবারিক আইনের কাঠামোতে। নারীর অধিকার কেবল সন্তানের জন্মদান এবং লালন-পালনে, নারী তার সন্তানের বৈধ অভিভাবক নয়, অভিভাবক সন্তানের পিতা । সেদিক থেকেও নারী অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সন্তানের মুখ চেয়েও তাই নারীকে নিপীড়ক স্বামীর সংসার করে যেতে হয়। কাজেই রাষ্ট্র যতদিন এই বৈষম্যমূলক আইনগুলো পরিবর্তন না করবে বা রাষ্ট্রকে বাধ্য না করানো যাবে, যা আসলে ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কার, ততোদিন পর্যন্ত ধর্মের নামে, সমাজের নামে, লোকলজ্জার নামে নারীর বিরুদ্ধে এই সহিংসতা থেকে মুক্তি আশা করা দুঃসাধ্য। একটি নিরাপদ রাষ্ট্র যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নিরাপদ, যেখানে লিমনও নিরাপদ, নারী সাংসদ কবরীও নিরাপদ, সেই রাষ্ট্রে তো সন্তানের নিরাপত্তার জন্য রুমানাদের কারো উপর নির্ভর করতে হবে না। পুরুষের উপর নারীর এই নির্ভরশীলতার অন্তর্গত রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করতে হলে যে পাল্টা রাজনীতি প্রয়োজন, সেই রাজনীতিতে সামিল হওয়া চাই।

যে ‘ভালো মেয়ে’র সনদ কিনতে হয় নিজের সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে, নিজের অঙ্গহানি নয়তো জীবন দিয়ে, মেয়েদের সময় এসেছে পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া এসব ভালো মেয়ের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে মানুষ হিসাবে নিজের দাবি নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার। যে কোন দামে বিয়ে টিকিয়ে রাখার বিপরীতে নারীর বিয়ে-নিরপেক্ষ মানবিক অবস্থানটি প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। অন্তত নিজের চোখদু’টি তো রক্ষা করতে পারা চাই, নয়তো কীসের জীবন? তবে সমাজের প্রচলিত অনুভব কাঠামো এবং রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়ানো খুব সুখের হবে না, হয়নি কখনো তবু মানুষের চলার বেগেই পায়ের তলায় রাস্তা জাগে। আবেদন-নিবেদনের উন্নয়ন মডেল থেকে বের হয়ে জীবনের দায়িত্ব নেবার রাজনীতিটি বুঝে নেবার এইটাই মাহেন্দ্রক্ষণ। যে সামষ্টিক অন্ধত্ব এবং আপোষ রুমানার চোখের আলো কেড়ে নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোন বিকল্প নেই।

Rumana Monzur Now by Avrinder Dhillon, 2020

The post কিছু কালোসিধে কথা বলতে চাই first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%9b%e0%a7%81-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%a7%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%9a%e0%a6%be/feed/ 0
নারীনীতি ২০১১: সরকার পিছু হটেছে https://kaberigayen.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a7%a8%e0%a7%a6%e0%a7%a7%e0%a7%a7-%e0%a6%b8%e0%a6%b0%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%bf%e0%a6%9b%e0%a7%81/ https://kaberigayen.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a7%a8%e0%a7%a6%e0%a7%a7%e0%a7%a7-%e0%a6%b8%e0%a6%b0%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%bf%e0%a6%9b%e0%a7%81/#respond Tue, 15 Mar 2022 08:02:07 +0000 https://kaberigayen.com/?p=8031 পাশ্চাত্যের নারীবাদীরা গণমাধ্যমে নারীর অপ-রূপায়ন প্রসঙ্গে প্রচুর লিখেছেন। এসব লেখালেখির মাধ্যমে একধরণের সচেতনতা অবশ্যই তৈরি হচ্ছে, বিশেষ করে একাডেমিক এবং অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে। এমনকি এসব লেখালেখির মাধ্যমে নানা ধরণের কোর্স চালু হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু এসব লেখালেখি বাস্তব অবস্থার খুব পরিবর্তন আনতে পেরেছে সমাজে, নিদেনপক্ষে গণমাধ্যমগুলোতেও, এমনটা বলা মুশকিল। গণমাধ্যমে এবং সমাজে এই পরিবর্তনহীনতার কারণ বোঝা যায়। সম্পদ এবং গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ এখনো খুবই সীমিত। গণমাধ্যমে নারীর বাণিজ্যিক অপরূপায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ খুবই ইস্যু-ভিত্তিক, মোটেই কোন পূর্বাপর সমন্বিত পরিকল্পিত কোন কাঠামো নেই এসব প্রতিবাদের। এসব প্রতিবাদও আবার মূলধারার গণমাধ্যমে বা জনপরিসরে জায়গা পায় না।

The post নারীনীতি ২০১১: সরকার পিছু হটেছে first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>

এ’বছর ৮ মার্চ সরকার ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ ঘোষণা করেছে। নতুন নীতিমালার খসড়া মন্ত্রীসভা অনুমোদন করেছে। অতীতে ঘোষিত অন্য তিনটি নারীনীতির মতোই এটি ঘোষণা পর্যায়েই রয়েছে, এখনো আইন হিসেবে পাশ হয়নি। নারীনীতি ঘোষণার দিন থেকেই ধর্মভিত্তিক দলগুলো সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হয়েছে এমন দাবী করে নারীনীতি ২০১১ প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামসহ অন্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো ইতিমধ্যে এ নীতিকে কোরানবিরোধী আখ্যা দিয়ে এমনকি সরকার পতনের হুমকি দিয়েছে। ৮ মার্চ ২০১১ তারিখের বিকালে, নারীনীতি ঘোষণার দিনই, রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে কমিটির আমির ও ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান মুফতি আমিনী ৪ এপ্রিল হরতালের ডাক দেন। সে হরতাল বুকে কোরান বেধে মিছিলকারী ও পুলিশের মধ্যকার সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। সরকারবিরোধী ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পাশাপাশি সরকার সমর্থক ধর্মভিত্তিক দলগুলোও এই নারীনীতির বিরোধিতা করেছে। মহাজোটের শরিক দাবিদার মিসবাহুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্ত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটও এই নীতির বিরোধী।


এসব হুমকির প্রতিক্রিয়া সুখকর হয়নি দীর্ঘদিন ধরে সম্পত্তিতে সমঅধিকারের দাবী জানিয়ে আসা নারী আন্দোলনের জন্য এবং সাধারণভাবে নারীদের জন্য। নারীনীতি ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম হানিফ বলেন, “সরকার মুসলিম সম্পত্তি বন্টন আইনে কোন পরিবর্তন আনেনি। ইসলাম যেভাবে নারী-পুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিয়েছে, সরকার শুধু তা নিশ্চিত করতে সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের কথা বলেছে।”(সমকাল, ৯ মার্চ ২০১১)। এর পরই প্রথমে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী কোরআনবিরোধী কোন আইন করা হবে না মর্মে আশ্বস্ত করেছেন। সবশেষে, গত ২০ এপ্রিল, প্রধানমন্ত্রী আওয়ামীপন্থী মাদ্রাসা শিক্ষকদের সমাবেশে আবারো এই মর্মে আশ্বস্ত করেন, শুধু যে কোরাণ ও সুন্নাবিরোধী কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না তাই নয়, বরং তারা নারীনীতির মধ্যে ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক যেসব আইন আছে ইতিমধ্যে তা তুলে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই পুনরাবৃত্ত আশ্বস্তিবার্তা সত্ত্বেও ইসলামিক আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে ফজলুল হক আমিনীর পার্টি মে মাসের ৬, ৭, ১১, ১২, ১৬ এবং ২২ তারিখ বিভাগীয় শহরগুলোতে এবং ২৭ মে ঢাকায় নারী ও শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। জামাতে ইসলামও ৭ মে দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচী দিয়েছে নারীনীতির কিছু ধারা বাতিলের দাবীতে।

যে ধারাটি নিয়ে এতো হৈ চৈ, বিক্ষোভ-সমাবেশ, ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে সরকারের নতজানু অবস্থান, কী আছে সেই ধারায়?

বিতর্কিত সেই ধারাটি
সরকার পরিস্কার পিছু হটেছে
৯ মার্চ, নারীনীতি ঘোষণার পরদিন, প্রায় সবক’টি জাতীয় দৈনিকে ভুল তথ্যে ভরা যে শিরোনামটি ফলাও করে ছাপনো হয় তা হলো সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমানাধিকার দিয়ে নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ ঘোষিত। এই শিরোনামগুলো এতোই যুতসইভাবে, এতো গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো হয় যে খবরটির সত্যতা নিয়ে প্রায় কারোরই কোন সন্দেহ থাকে না। বিশেষ করে বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রধান শরীক দল আওয়ামীলীগ তাদের ২০০৮-এর নির্বাচনী ইশতেহারে ১৯৯৭ সালের নারীনীতিকে পূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিলো বলে এই খবরে তেমন সন্দেহের অবকাশও ছিলো না। সম্পত্তির সমঅধিকার প্রশ্নে ১৯৯৭ সালের নারীনীতিতে কী বলা হয়েছিলো? আসলেই কি ২০১১ সালের নারীনীতিতে দেয়া হয়েছে উত্তরাধিকার-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার? বাকী দুটো নীতিতেই বা এই ধারাটি কেমন ছিলো? এসব প্রশ্নের ফয়সালা হওয়া জরুরী। তাই এক নজরে দেখে নেয়া যাক চারটি নারীনীতিতে সম্পত্তিতে সমঅধিকারের প্রশ্নটি কীভাবে আবর্তিত, বিবর্তিত এবং পুনরাবৃত্ত হয়ে বর্তমান অবয়ব নিয়েছে।

চারটি নারীনীতিতে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রসঙ্গ

চারটি নারীনীতিতে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রসঙ্গ
১৯৯৭ সালে যেখানে উত্তরাধিকার এবং ভূমির উপর নারীর সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়া এবং সেই লক্ষ্যে নতুন আইন প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে, ২০০৪-এর নারীনীতিতে উত্তরাধিকার এবং ভূমির উপর নারীর অধিকারের বিষয়টি লোপাট করা হয়েছে, ২০০৮-এর নারীনীতিতেও উত্তরাধিকারের বিষয়টি তুলে দিয়ে ‘বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ এবং নিংন্ত্রণের অধিকার দেয়া এবং সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন করা’র কথা বলা হয়েছে। এবং এবারের নারীনীতিতে ‘উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা’র কথা বলার মধ্য দিয়ে তুলে নেয়া হয়েছে উত্তরাধিকারে সমান অধিকারের প্রসঙ্গটি এবং বাদ দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় নতুন আইন করার বিষয়টি। ঠিকই আছে, উত্তরাধিকারে সমান অধিকার দেবার বিষয়টি বিবেচনায় থাকলেই কেবল নতুন আইন প্রনয়ণের প্রয়োজন হত। সেই বিষয়টিই যখন বিলোপ করা হয়েছে তখন নতুন আইনের তো কোন প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী সত্যভাষণ করেছেন মাদ্রাসা শিক্ষকদের সমাবেশে গত ২০এপ্রিল, “আমরা কোরান নিরীক্ষণ করে, বিশেষ করে সুরা আন-নিসা, কোরানের সাথে সাংঘর্ষিক নীতিগুলো বাদ দিয়েছি।” এভাবে ১৯৯৭ সালের নারীনীতি থেকে সম্পত্তির সমঅধিকার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ পরিস্কার পশ্চাদপসারণ করেছে, পিছু হটেছে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ওয়াদা থেকেও।

নারীনীতি ২০১১ অনুযায়ী, প্রচলিত নীতি এবং ধর্মীয় বিধানে নারী যে সম্পত্তির অধিকারী সেই সম্পদে কেবল নারী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবার কথা বলা হয়েছে, যা সম্পত্তিতে সমঅধিকারের সাথে কোনভাবেই সম্পর্কিত নয়। যেহেতু ধরে নেয়া যায় যে এই নীতি বাংলাদেশের সকল নারীর জন্যই ঘোষণা করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে এই নীতির সমস্যা হলো, মুসলিম নারীরা তাদের পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রাপ্যতার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না, আর হিন্দু-বৌদ্ধ এবং কোন কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী যারা মূলত হিন্দু পারিবারিক আইন দ্বারা পরিচালিত তাদের নারীরা বের হতে পারবেন না উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কোন ধরণের অধিকার না থাকার বিধান থেকে। যে নারীর উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কোন অধিকারই নেই, তিনি কোন সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকারী হলেন এবারের এই নীতি অনুযায়ী?

এখন প্রশ্ন, কেনো এতো হৈ চৈ তাহলে?

 

পক্ষ দুটি নয়, তিনটি
আমরা এই নীতি বিষয়ে তিনটি অভিমত দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত, সরকার বলছে এই নীতিটি নারীর অধিকারকে অগ্রগামী করার এক বিশেষ যুগান্তকারী পদক্ষেপ, তবে কোরাণের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় গোষ্ঠী এই নীতিকে প্রত্যাখ্যান করছে কোরান-বিরোধী দাবি করে এবং সে’লক্ষ্যে আন্দোলন-সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছে। শোরগোলটা মূলত সেদিক থেকেই শোনা যাচ্ছে। রয়েছে তৃতীয় আরেকটি শক্তি, নারী-প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনকারী নারী-পুরুষের মিলিত শক্তি এবং কিছু বাম সংগঠনের নারী নেতারা। সম্পত্তির সমান অধিকারের বিষয়ে সরকারের পিছু হটে আসা, বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং সন্তানের অভিভাবকত্ব বিষয়ে অতীতের সকল নারীনীতির মতই এই নারীনীতিতেও নারী সমাজের দাবীকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াকে সমালোচনা করে এই তৃতীয় শক্তি ‘সমঅধিকার আমাদের ন্যূনতম দাবি’ নামের মোর্চা গঠন করে নারীনীতি ২০১১-কে প্রত্যাখান করছে এবং নতুন নারীনীতি তৈরীর দাবি করেছে। গত ৬ মে ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তারা আগামী ২৪ মে ঢাকায় একটি কনভেনশন করার ঘোষণা দিয়েছে এবং উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার, বিয়ে, সন্তানের অভিভাবকত্ত্বসহ পারিবারিক আইনের অধীনে যেসব আইন নারীকে বঞ্চিত রেখেছে সেসব বিষয়ে সংশোধনের দাবিতে একমত সকল নারী-পুরুষকে সেই কনভেনশনে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছে।

 

হৈ চৈ আসলে সম্পত্তিতে সমঅধিকার প্রশ্নে
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গে

উত্তরাধিকার, সম্পদ ও ভূমির উপর নারীর অধিকারের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বিএনপি-জামাত জোটের নারীনীতি ২০০৪ ঘোষিত হলে সংগত কারণেই ধর্মীয় গোষ্ঠী মাঠে সরব হয়নি। বাকী তিনটি নারীনীতির যে কোন ইস্যুতেই যেমন সিডও সনদ বাস্তবায়ন, বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইন বিলোপ, পিতামাতা উভয়ের পরিচয়ে সন্তানের পরিচয়, বাল্যবিয়ে- মেয়েশিশু ধর্ষণ-পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ, নারীশিক্ষা, ফতোয়া প্রসঙ্গে ধমীয় গোষ্ঠীর বক্তব্য একই। আর তা হলো, নারী-পুরুষের অধিকার ও মর্যাদার তারতম্য স্বাভাবিক; নারী-পুরুষের কার কী অধিকার তা কোরআন-সুন্নাতেই বলে দেয়া আছে। জাতীয় জীবনে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, নারীকে দেয়া হবে ‘ন্যায্য অধিকার’। নারী-পুরুষের তারতম্য, আইনগত ফারাক বিলোপের প্রস্তাব কোরান-সুন্না বিরোধী, এসব দূর করা মানুষের কাজ নয়, আল্লাহতালার মহাআজ্ঞাপ্রসূত এবং নারীর জন্য কল্যাণকর। এসব বিষয়ে এ’হেন সুস্পষ্ট অবস্থান ধর্মীয় গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আমরা বরাবরই দেখি, তবে তাদের মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায় যখনই প্রসঙ্গটি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে হয়। এটা তারা কোন অবস্থাতেই মেনে নিতে পারে না। ২০০৮ এবং ২০১১ সালের নারীনীতিতে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকারের বিষয়টি উল্লেখ না করা হলেও তারা মাঠ গরম করেছেন। তাদের এই অবস্থান তাদের ঘোষিত রাজনৈতিক দর্শনের সাথে, নারী প্রসঙ্গে তাদের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যা কিছু নারীর জীবন যাপনের অগ্রগামিতার সাথে সম্পর্কিত, তার বিরুদ্ধেই তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান।

তবে আপাতদৃষ্টে মনে হয় সম্পত্তিতে সমানাধিকারের বিরোধিতাকারী বুঝি কেবল এই ধর্মীয় গোষ্ঠী। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির আপাদমস্তক সম্পত্তিতে সমানাধিকারের বিরোধী। আমরা ধর্মীয় দলগুলোকে কেবল দৃশ্যপটে দেখতে পাই বলে তাদের কাঁধে বন্দুক রেখে অন্যরা নিস্তার পেয়ে যান। এই ধর্মীয় গোষ্ঠী রাস্তায় না থাকলে কি অবস্থার বিশেষ হেরফের হতো? নারীসমাজের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে ১৯৯৭ সালের নীতিমালায় সম্পত্তিতে নারীর অধিকার এবং উত্তরাধিকারের বিষয়টি অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছিলো। তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে যথেষ্ট সময় থাকা সত্ত্বেও (১৯৯৭ থেকে ২০০১) এবং এখনকার মতো ধর্মীয় গোষ্ঠীর দৃশ্যমান কোন আস্ফালন না থাকা সত্ত্বেও নীতিমালা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কোন আইন প্রনয়ণ বা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিএনপি এবং জামাত জোটের ২০০৪ সালের নীতিমালায় উত্তরাধিকার সম্পত্তি ও ভূমিতে অধিকারের পুরো বিষয়টিই লোপাট করে দেয়া হয় ফলে ধর্মীয় গোষ্ঠী মাঠে নামেনি। তাই বলে কেনো প্রগতিশীল ধারাগুলো লোপাট করা হলো সে’মর্মে অওয়ামীলীগ বা অন্য কোন সংগঠনই কোন প্রশ্ন তোলেনি। ২০০৮ সালের নারীনীতিতে ৯.১৩ ধারায় উত্তরাধিকার এবং ভূমির উপর অধিকারের বিষয়টি বাদ দিয়ে কেবল বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ ও নিয়ন্ত্রণের কথা বলায় ধর্মীয় দলগুলোর বিক্ষোভের মুখে প্রথমে ধর্মীয় আলেমদের সমন্বয়ে নীতিটি নীরিক্ষণের কমিটি গঠিত হয়, তারা কাগজে-কলমে তাদের বিধান দেন এবং রাস্তায় সক্রিয় থাকেন। ক্রমশ এটি বাস্তবায়নের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। এবার চতুর্থবারের মতো যে নীতিটি ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে উত্তরাধিকারে সমানাধিকার প্রস্তাব থেকে সরে আসার পরও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন ধর্মীয় আইনের পরিপন্থী কোন আইন করা হবে না। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি’র কোন অফিসিয়াল অবস্থান আমরা এ’পর্যন্ত পাইনি। পাইনি জাতীয় পার্টি বা বাম সংগঠনগুলোর অফিসিয়াল অবস্থান। পরিস্কার নয় সরকারের অবস্থানও। শুধু ধর্মীয় দলগুলোর ক্ষেত্রে আমরা তাদের অবস্থানটি পরিস্কার দেখতে পাই মাঠে। কিন্তু যে দলগুলো ধর্মীয় দল নয় সরাসরি তাদের কোন বক্তব্য না পাবার কারণে তাদের অবস্থানটি এ’পর্যন্ত বোঝা সম্ভব হয়নি। কারণ কোন রাজনৈতিক দলকে নারী প্রসঙ্গে এই গোষ্ঠীর মুখোমুখি দাঁড়াতে আমরা দেখি না। ফলে আস্ফালনকারী ধর্মীয় গোষ্ঠীর মুখোমুখি জেগে থাকতে দেখি শুধু সম্পত্তিতে সমঅধিকারের প্রশ্নে এক নীরবতার রাজনীতিকে। প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক স্টুয়ার্ট হল-এর রেপ্রিজেন্টেশন তত্ত্ব আমাদের জানায়, খালি চোখে যা আমরা দেখি, সেটি যেমন অর্থ তৈরী করে, তার সমান বা বেশী অর্থ বহন করতে পারে যা দেখা যায় না সেই অনুপস্থিতির রাজনীতি। তা’হলে কি ধরে নেবো কোন রাজনৈতিক দলই আসলে সম্পত্তিতে সমঅধিকারের বিষয়টি ফয়সালা করতে চায় না? চারটি নারীনীতির প্রত্যেকটিতেই অনেক ধারাই রয়েছে যা ধর্মীয়নীতির সাথে আক্ষরিকভাবে মিলিয়ে দেখতে চাইলে পার্থক্যমূলকই নয় শুধু, সাংঘর্ষিকও বটে। কিন্তু ধর্মীয় গোষ্ঠী সব সময় সবচেয়ে সোচ্চার যে ধারার বিরুদ্ধে সেটি হলো উত্তরাধিকারে নারীর সমঅধিকারের প্রশ্নটিতে। এভাবে নারীনীতি ঘোষণাকারী সরকার, নীরব রাজনৈতিক দল এবং উন্মত্ততা সৃষ্টিকারী ধর্মীয় গোষ্ঠী মিলে ক্রমশই শক্তিশালী করে তুলছে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মূল উৎসের প্রতি নেতিবাচক এক রাজনীতিকে। সত্যিই তো, নারীকে সম্পত্তিতে সমঅধিকার কেনো পুরুষতন্ত্র দিতে চাইবে যদি ধর্মের নামে বা আইনের নামে বা যে কোন কিছুর নামে হাজার বছর ধরে চলে আসা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা দিয়ে সম্পদের উপর অধিকার নিরঙ্কুশ করা যায়?

 

‘ধর্মবিরোধী আইন’ বনাম ‘ধর্মবিরোধী আইন প্রনয়ণ করা হবে না’ ডিসকোর্স
যারা এই আইনকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিচ্ছেন বা যারা বলছেন ধর্মবিরোধী কোন আইন তারা করেননি বা ভবিষ্যতেও করছেন না, বিনীতভাবে তাদের উদ্দেশ্যে বলার সময় এসেছে, কথিত ধর্মীয় বিধানের অনেক কিছুই কিন্তু পরিবর্তিত হয়েছে যুগের দাবিতে। নারী রাষ্ট্র প্রশাসকের বিধান ধর্মে স্বীকৃত না হলেও গত দুইযুগ ধরে জনগণের ভোটে নির্বাচিত আমদের প্রধানমন্ত্রীরা নারী। নারী নেতৃত্বাধীন দলের সাথে জোট বেধে ক্ষমতায় যাচ্ছে ধর্মীয় দলগুলো। নারী রাষ্ট্র প্রশাসকের অধীনে মন্ত্রী হচ্ছেন প্রধান ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতারা। ব্রিটিশ-ভারতে ১৯৩৭ সালে প্রণীত ‘মুসলিম ব্যক্তিগত (শরিয়ত প্রয়োগ) আইন দ্বারা মুসলিমদের বিবাহ, তালাক, দেনমোহর, উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনের প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী কোন নাবালক তার দাদা বা নানার সম্পত্তি পাবে না যদি তার দাদা/নানার পূর্বেই তার বাবা/মা মারা যায়। কিন্তু ১৯৬১ সালে প্রণীত মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৪ নং ধারা অনুযায়ী নাবালক সন্তান তার দাদা/নানার সম্পত্তির ততটুকু পাবে যতটুকু তার বাবা/মা পেত। ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী একজন মুসলিম পুরুষ সর্বোচ্চ চারজন নারীকে বিয়ে করতে পারলেও ১৯৬১ সালের আইনের ৬নং ধারা অনুযায়ী সালিশ পরিষদের সম্মতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মৌখিকভাবে তালাক দেবার সুযোগ থাকলেও এই আইনের ৮ নং ধারায় স্বামীর মত স্ত্রীকেও তালাক দেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। মুসলিম রীতি অনুযায়ী হিল্লা বিয়েকে বাতিল না করলেও এই আইনের ৭(৬) নং ধারায় কমপক্ষে তিনবার অনুরুপ পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে হিল্লা বিয়েকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশনের কোন বিধান মুসলিম শরিয়া আইনে না থাকলেও ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন ১৯৭৪’ অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, বিধি লংঘনে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। স্বামী দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকলে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী নারী স্বামীকে তালাক দিয়ে পুনরায় বিয়ে করতে না পারলেও ১৯৩৯ সালের ‘মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন’-এর ২নং ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি চার বছর নিখোঁজ থাকলে স্ত্রী স্বামীকে আদালতের মাধ্যমে তালাক দিতে পারে।

জমিজমা সংক্রান্ত দানের ক্ষেত্রেও ধর্মীয় মতে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক না হলেও ২০০৪ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার রেজিস্ট্রেশন আইনে সংশোধনী এনে সম্পত্তিদানের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করেছে। মৃতব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টননামা রেজিস্ট্রেশনের বিধান ধর্মে ছিলো না কিন্তু বিগত জোট সরকারের আমলে রেজিস্ট্রেশনই শুধু বাধ্যতামূলক করা হয়নি, দাতা ও গ্রহীতার ছবি সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যেখানে ছবি তোলা ধর্মীয় দৃষ্টিতে হারাম। মুসলিম আইনের অগ্র ক্রয়াধিকার বা শুফা আইনেরও পরিবর্তন করা হয়েছে ১৯৫০ সালের ‘স্টেট এ্যাকুইজিশন ও টেনান্সি এ্যাক্টে’এর মাধ্যমে। এছাড়া ফৌজদারী আইনের বিভিন্ন ধারায় এমন সব বিধান আমরা মেনে চলি যার সাথে ধর্মীয় আইনের দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। চুরি করলে হাত কেটে দেয়া বা একজন পুরুষ সাক্ষীর সমকক্ষ হিসাবে দুজন নারীর সাক্ষ্য নেয়া হয়না আমাদের ফৌজদারি আইনে। এভাবে অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে দেখানো যাবে যে ধর্মীয় আইনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এমনকি সাংঘর্ষিক অনেক আইন প্রচলিত আছে বা নতুন করে প্রনয়ণ করা হয়েছে। এমনকি আইনের পরিবর্তনের ফলে আজ ধর্ম পালন করতে হলেও ধর্মের বিধান লংঘন করতে হচ্ছে। যেমন, ছবি তোলাকে হারাম ও কুফরি ফতোয়া দিচ্ছেন যে ওলামা-মাশায়েখরা তারাই হজ্ব করতে যাবার সময় পাসপোর্ট আইনের বিধান মেনে হজ্ব করতে যাচ্ছেন। এসব কাজ ‘ধর্মবিরোধী’ হলেও এই ধর্মীয় গোষ্ঠী এসব প্রশ্নে, কিংবা সুদ খাওয়া হারাম প্রশ্নে জান কোরবার করতে মাঠে নামেন না। যত দোষ, যত বজ্রনির্ঘোষ নারীর সম্পত্তিতে অধিকারের প্রশ্ন এলেই। যেখানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে শ্লোগান দেয়া হচ্ছে, ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’, এমনকি ইদানিং একটি সন্তানের ব্যাপারেও জনগনকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে এবং জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের অংশ হিসাবে শুক্রবার মসজিদে মসজিদে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জনমত গড়ে তোলার জন্য ইমামদের সবেতনে নিয়োগ করা হয়েছে দীর্ঘকাল থেকে, সেখানে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে ছেলে ও মেয়ে সন্তানের মধ্যে বৈষম্য বিলোপ না করার কী কারণ থাকতে পারে? মুসলিমপ্রধান দেশ তুরস্ক, সেনেগাল, তিউনিশিয়াসহ কয়েকটি দেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সম-অধিকার রয়েছে।

আরেকটি বিষয়ে না বললেই নয়। আমাদের দেশে যখন এসব আইন পরিবর্তন বা প্রনয়ণের প্রসঙ্গ ওঠে তখন কেবল মুসলিম জনগোষ্ঠীকেই মাথায় রাখা হয় যা একটি গণতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রে কাম্য নয়। যদিও খৃস্টান উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের অধিকার প্রায় সমান, হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারীর অবস্থান সবচেয়ে শোচনীয়। এখানে নারীর নিজস্ব অর্জিত সম্পত্তি বা উপহার সামগ্রী ছাড়া অর্থাৎ স্ত্রীধন ব্যতীত আর কোন সম্পত্তির পূর্ণ স্বত্ত্ব পায় না। অথচ হিন্দুপ্রধান দেশ ভারতে এবং হিন্দু রাষ্ট্র নেপালে এখন ধর্মীয় আইন সংস্কারের মাধ্যমে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

 

এবং বাংলাদেশ এখনো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
যে উদ্দেশ্যে আওয়ামীলীগ ১৯৯৭-এর নারীনীতি থেকে পশ্চাদপসারণ করেছে, সেই লাভের গুড় আওয়ামী লীগ ঘরে তুলতে পারবে সে ভরসা কম। আমিনীর দল বা যারা ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণার হাই কোর্টের রায়কে দশ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টে ঝুলিয়ে রেখেছে, সেইসব শক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে ভোট দিয়ে এমন ভাবনায় খুব বিচক্ষণতার পরিচয় মেলে না। তার হাতে নাতে প্রমাণ হলো, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বস্তি সত্ত্বেও এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্দোলন- বিক্ষোভ-মহাসমাবেশের ডাক।

বাংলাদেশ কোন ধর্মীয় রাষ্ট্র নয় বলেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আইনের মূল ভিত্তি এখনো গণতান্ত্রিক নীতিমালার উপরেই প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে এমন নিরানব্বই ভাগ আইন-ই ধর্মনিরপেক্ষ এবং সার্বজনীন। আমাদের সংবিধানের ১০, ১৯ (১, ২), ২৭, ২৮ (১,২,৩,৪), ২৯(১,২,৩-ক) ধারায় নারী-পুরুষের সবক্ষেত্রে সমাধিকারের বিষয়ে রাষ্ট্র অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনের ক্ষেত্রে যেমন ধর্মীয় কোন পার্থক্য নেই তেমনি বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্বসহ পারিবারিক আইনগুলোকেও দেওয়ানী আইন ও আদালতের আওতায় এনে ইউনিফর্ম সিভিল কোড প্রবর্তন করে পারিবারিক আইনের পার্থক্য দূর করা সম্ভব। সরকার যদি নারীপ্রশ্নে সত্যিই আন্তরিক হয় তবে সিডও সনদ, সংবিধান ও নারী সমাজের দীর্ঘদিনের আকাংখার প্রতি সৎ থেকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে ১৯৯৭ সালের নারীনীতিকেই আইনে পরিণত করতে উদ্যোগী হবেন, যেটি তাদের নির্বাচনী ওয়াদাও ছিলো। আর আমরা যারা নারীর সম্পত্তির প্রশ্নে সত্যিই আন্তরিক বলে দাবী করি তাদেরও উচিত দৃশ্যমান হওয়া। অদৃশ্যমানতার রাজনীতি আসলে সৎসুবিধাবাদ, যার সম্পর্কে লেনিন বার বার হুঁশিয়ার করেছেন। ১৯৯৭ থেকে ২০১১, মোট ১৪ বছর সময় কেটেছে, মানুষকে প্রস্তুত করেনি আমাদের রাজনীতি আর তাই যে নীতির কথা বলা হয়েছিলো ১৪ বছর আগে, সেখান থেকে বার বার পিছু হটতে হয়েছে সরকারকে। এগিয়ে যাবার কালে এগিয়েই যেতে হয়। গুটিকয়েক ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনের দাবীর দোহাই দিয়ে (যেহেতু তাদের ঘাড়েই বন্দুক রাখা হয়) সরকারগুলো বারবার পিছু হটে আসবে না কি মানুষের অধিকারের প্রশ্নে সংবিধানকেই সমুন্নত রাখবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার উৎকৃষ্ট সময় এই বয়ে যায়। নারীর সমানাধিকারের প্রসঙ্গ মানুষের সমানাধিকার প্রশ্নেরই নিরাভরণ রুপ।

এমন গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে সরকারকে জনগণের কাছে যেতে হয় যা আমাদের কোন সরকারই যায়নি। সরকার জনগণের সচেতনতা তৈরির জন্য গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে পারে এবং বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে ব্যাপকহারে গণর‌্যালী ও সভা-সমাবেশের আয়োজন করতে পারে। এসব জনসংযোগ ও প্রচারের আওতায় সাধারণ মানুষকে নিয়ে আসার পাশাপশি রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের নারী এবং কন্যাশিশুর পক্ষে আওয়াজ তোলার ব্যাপারে, নতুন রীতি প্রতিষ্ঠা করার কাজে লাগানো যেতে পারে। স্কুল শিক্ষক এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্থানীয় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব। জনপ্রিয় লোকমাধ্যম যেমন যাত্রা, পুতুল নাচ, কবিগানের মাধ্যমে এসব বার্তা ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে প্রত্যন্ত গ্রামে, ওয়াজে ওয়াজে নারীনীতির বিরুদ্ধে বিষোদগারের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে। তবে এ’সবই করতে হবে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বৃহত্তর ফ্রেমওয়ার্কে। আওয়ামীলীগের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি’ নারী আন্দোলনের জন্য তো বটেই আওয়ামী লীগকেও বাধাগ্রস্তই করবে। দাতা দেশগুলোর চাপে নারী উন্নয়ন নীতি প্রনয়ণ এবং দেশে ভোটব্যাংক ঠিক রাখার জন্য ধর্মীয় শক্তির কাছে নতজানু হবার এই অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত নারী-বিরোধী শক্তিকেই মজবুত করবে সন্দেহ নেই। মাছ ধরতে গেলে পানি না ছোঁয়ার নীতি বর্জন করতেই হবে। আজ সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকারের বিরুদ্ধে যারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে কাল যে তারা নারী-নেতৃত্ব হারাম এবং পরশু মেয়েদের জনপরিসরে নিষিদ্ধ করার প্রবলতর বাসনা নিয়ে লড়াই শুরু করবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে?

এটি একটি রাজনৈতিক লড়াই, এবং বারে বারে সম্পত্তিতে সমঅধিকারের কাল্পনিক ঘোষণাকে ঘিরে মিথ্যা হৈচৈয়ের কুণ্ডলিতে পরার বিলাসিতা করার সময় সত্যিই আর নেই। বরং নারীর সমঅধিকার দাবিতে আন্দোলনরত সচেতন নারী-পুরুষের সাথে ন্যূনতম সমমনা সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির দৃঢ় নেটওয়ার্ক গড়ে উঠুক। উত্তরাধিকারে নারীর সমঅধিকারসহ বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ এবং সন্তানের অভিভাবকত্বসহ পারিবারিক আইনের যেসব ধারায় নারীকে বঞ্চনা করা হয়েছে সেসব আইন বাতিল করে নতুন নীতিমালা ও নতুন আইন প্রনয়ণের লক্ষ্যে সেই মানবিক নেটওয়ার্ক কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলুক সেটিই প্রত্যাশা। মানুষ সমান। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে। মানুষের সমতার পৃথিবী প্রতিষ্ঠাই হলো সকল শুভ উদ্যোগের প্রথম প্রেরণা। ইতিহাস বারে বারে মানবিকতার পক্ষেই তার পরিবর্তনগুলো ঘটানোর সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে।

The post নারীনীতি ২০১১: সরকার পিছু হটেছে first appeared on KG | Kaberi Gayen.

]]>
https://kaberigayen.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a7%a8%e0%a7%a6%e0%a7%a7%e0%a7%a7-%e0%a6%b8%e0%a6%b0%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a6%bf%e0%a6%9b%e0%a7%81/feed/ 0