Kaberi Gayen

  • Academic
  • Researcher
  • Writer

Kaberi Gayen

  • Academic
  • Researcher
  • Writer

Kaberi Gayen is a Bengali academic, author, and social activist known for her outspoken views on the oppression of minorities and gender inequality in Bangladesh.

Wikipedia

সাগর-রুনি-মেঘ প্রতিবেদন: মামুলি হলুদ ছাড়িয়ে কালো সাংবাদিকতায়

5 mins read

সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী মাত্রেই জানেন, অন্তত বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের জানতেই হয় সিলেবাসের সুবাদে, প্রচারণা-প্রপাগান্ডা-গুজবের সাথে সংবাদের পার্থক্য। শ্লাঘা বোধ করি যে বেশিরভাগ গণমাধ্যমেই সাংবাদিকতার বর্তমান এবং সাবেক শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। বিশ্বাস করি যারা সাংবাদিকতার ক্লাশে পড়েন নি কিন্তু সাংবাদিকতা করেন তারা জানেন এই পার্থক্য। সাংবাদিকতার ক্লাশ করতে করতেই, কিংবা সাংবাদিকতা করতে করতেই তারা জেনে যান হলুদ সাংবাদিকতা সম্পর্কেও। জেনে যান কেনো হলুদ সাংবাদিকতা আদৌ সাংবাদিকতা নয়। কিন্তু এসব শ্লাঘা আর বিশ্বাসকে তছনছ করে মামুলি হলুদ সাংবাদিকতাকে ছাড়িয়ে কালো সাংবাদিকতার মহড়া দেখালেন আমাদের প্রায় সব জাতীয় দৈনিক এবং সম্প্রচার মাধ্যমের( দুই একটি ব্যতিক্রম বাদে) তারকা সাংবাদিকরা, তাদেরই দুই সহকর্মীর মৃত্যু-সংবাদ উপস্থাপন করতে গিয়ে।

খবর হিসাবে পুরনো হয়ে তথ্যে পরিণত হয়েছে যে, গত শনিবার নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের দুই সম্প্রচার মাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি এবং সাগর সরওয়ার। নিজ গৃহে। স্বভাবতই দেশজুড়ে এই খুনের সাথে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত বিচারের দাবীতে ব্যাপক বিক্ষোভ, মানব-বন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং অব্যাহত রয়েছে। এসব প্রতিবাদ এবং দাবীর সবচেয়ে সোচ্চার কন্ঠ খুবই ন্যায্য কারণে নিহত সাংবাদিক দম্পতির সতীর্থরা, গণমাধ্যমের সাথে জড়িতরা। তাদের দাবির সাথে একাত্মবোধ করেছেন সারা দেশের পেশাজীবি, সাধারণ মানুষ। এই তীব্র আলোড়নের ভেতরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৪ ঘন্টার মধ্যে খুনীদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দেন।

দুঃখের বিষয় সেই ৪৮ ঘন্টা পার হয়ে ১০০ ঘন্টা ছাড়িয়েছে, দোষী ব্যক্তিদের দেশবাসীর সামনে এখনো সোপর্দ করতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। অথচ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের আগেই সংবাদ শিরোনামে নিহত সাংবাদিক মেহেরুন রুনির কথিত ‘পরকীয়া’ সম্পর্ককে দায়ী করে সংবাদ ছাপাতে এবং প্রচার করতে শুরু করেছে। যেমন, ‘হত্যা রহস্যের কেন্দ্রে রুনি’ (দৈনিক সমকাল, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২), ‘হত্যার কারণ কি রুনি’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২), ‘খুনি নাগালে, তবুও অপেক্ষা!’(দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২)।

কোন কোন সংবাদপত্র আবার এই ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে ইঙ্গিত দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির নামের আদ্যাক্ষর প্রকাশ করে পুরো ঘটনাকে স্রেফ একটি গুজবের আবহে ঠেলে দিয়েছেন। (উদাহরণ, ভোরের কাগজ, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২)।

অন্যদিকে, একেবারে শুরুর দিন থেকেই গণমাধ্যমের সংবাদসূত্র হিসাবে প্রধান লক্ষ্যশেল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সাগর-রুনি দম্পতির পাঁচ বছরের ছেলে মাহিন সরওয়ার মেঘকে। প্রায় প্রতিটি সংবাদমাধ্যমেই ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক কীভাবে, কত কষ্ট করে মেঘ-এর সাথে দেখা করেছেন এবং তাকে কী কী প্রশ্ন করেছেন, সে কী উত্তর দিয়েছে। প্রতিটি ইলেকট্রনিক চ্যানেলে তুমুল প্রতিযোগিতা দেখা গেছে কে কতবেশী মেঘকে প্রশ্ন করতে পেরেছে।

মেঘ-এর এলোমেলো, অগোছালো উত্তরের বিপরীতে সাংবাদিকদের উৎসাহব্যঞ্জক অবিরত নির্দেশনামূলক প্রশ্ন, তুমি কী দেখলে? রক্ত? ওরা ক’জন ছিলো? ওদের হাতে কি ছুরি দেখেছো? ছুরি কি রক্তমাখা ছিলো? মেঘ-এর দ্বিধান্বিত চাহনি, অস্পষ্ট সাজুয্যহীন উত্তর, বিমর্ষ মুখ কিছুই তাদের উৎসাহ কমাতে পারেনি। অথচ গণমাধ্যমের না জানার কথা নয় যে একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে রেকর্ড না করলে মেঘ-এর এই ভাষ্য আদালতে গ্রহণ করা হবে না। অন্তত সাংবাদিকদের এই অ্যাডভেঞ্চারমূলকভাবে গৃহীত ভাষ্য আদালতে গ্রহণ করা হবে না।

এই মর্মান্তিক ঘটনাকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের এহেন অবস্থান থেকে দু’টি স্পষ্ট প্রবণতা চিহ্নিত করা যায়।

প্রথমত, যে কোন অপরাধমূলক ঘটনাকেই নারীর তথাকথিত ‘অবৈধ’ সম্পর্কের মোড়কে উপস্থাপনের সবচেয়ে সস্তা প্রবণতা। এমনকি সেই নারী যদি নিজেও নিহত হন। কিংবা তার চোখও যদি উপড়ে ফেলা হয় যেমনটা দেখেছি রুমানা মঞ্জুরের ক্ষেত্রে, তবুও তার রেহাই নেই। নারী তার নিজের মৃত্যুর জন্য বা নিজের চোখ উপড়ে নেবার জন্যও নিজেই দায়ি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এর আগে নারীর দুর্ভাগ্যের জন্য নারীর ‘পরকীয়া’ জাতীয় রসালো খবরের যোগানদাতা হতো কিছু সুড়সুড়ি দেয়া ট্যাবলয়েড। এবার ট্যাবলয়েডের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকতে চায়নি মূলধারার নামি সংবাদপত্রও। তাই প্রধান শিরোনাম করে এসব সুড়সুড়ি গাইলেন তারাও।

দ্বিতীয়ত, চোখের পানি নামানো সাংবাদিকতার (tear jerker journalism) প্রতিযোগিতায় নামা। সাধারণত দুর্বল, ভগ্ন অস্তিত্বের প্রতি মূলত করুণা তৈরি করে নিজের বাণিজ্য হাসিল করাই এসব সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য, যার বলি হলো শিশু মেঘ। আমি নিশ্চিত, যদি মেঘ শিশু না হয়ে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ হতো, তাকে দিয়ে এতোবার এতোভাবে নির্দেশমূলক প্রশ্ন করে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো যেত না। মেঘ পাঁচ বছরের একজন শিশু, তাই সে অসহায়। সে একারণেও অসহায় যে সে সদ্য মা-বাবাহারা, যে মা-বাবা হয়তো তার চোখের সামনেই মারা গেছেন, অন্তত তাদের রক্তাক্ত মৃতদেহ সে দেখেছে। সে আরো অসহায় কারণ এসব ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো ঠেকাতে পারার মত হিতৈষী তার কেউ ছিলো না। এবং সে সবচেয়ে অসহায় কারণ তার মা-বাবার সহকর্মীরাই তার অসহায়ত্বকে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করেছে তার মানসিক-শারীরিক নিরাপত্তার কথা না ভেবেই।

নিজেদের কৃতকর্মের সাফাই গাইতে গিয়ে যখন একটি সম্প্রচার মাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের একজন বলেন যে আমাদের দেশের আবেগের ধরণ ভিন্ন, তারা শিশুটির কুশল জানতে চায় বলেই তাকে ক্যামেরার সামনে প্রশ্ন করা হয়েছে কিংবা যখন একটি চ্যানেল থেকে বলা হয় সে-ই হচ্ছে একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র তাই তাকে ক্যামেরার সামনে আনা হয়েছে, তখন এই সমস্ত মাধ্যমের সাংবাদিকতার মান এবং নৈতিকতাকে প্রশ্ন না করে উপায় থাকে না।

দুটি প্রবণতাই মারাত্মক। এ যেন হলুদ সাংবাদিকতাকে ছাড়িয়ে কালো সাংবাদিকতায় পা রাখা। হলুদ সাংবাদিকতায় সত্যের সাথে মিথ্যার প্রলেপ এবং অতিরঞ্জন থাকে। কিন্তু এবার যা হলো তা হচ্ছে খুনের ভয়াবহতাকে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করা হলো ভিত্তিহীন, মনগড়া, কাল্পনিক গল্প ফেঁদে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের আগেই সংবাদমাধ্যমগুলো গুজব ছড়িয়ে দিলো কোন তথ্যসূত্র উল্লেখ না করেই। সাংবাদিকতার সাথে ‘গুজবাদিকতা’র (গুজব+সাংবাদিকতা) পার্থক্য এখানেই। যদি এমন হতো যে সংবাদমাধ্যমগুলো নিজস্ব অনুসন্ধানী রিপোর্টের ভিত্তিতে এ জাতীয় সিদ্ধান্তে আসতো, সেটি সাদরেই গৃহীত হতো। কিন্তু এগুলো অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছিলো না, কারণ কোন তথ্যসূত্রের উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ফলে যা প্রকাশিত হচ্ছে তা নেহাত গুজব। এ জাতীয় গুজবের চর্চা তখনই করা হয়, যখন প্রকৃত ঘটনার প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করে তোলার প্রয়োজন হয়।

সন্দেহ করা অমূলক নয় যে তদন্ত প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্নখাতে ঠেলে দেবার জন্যই এসব গুজবের আমদানি ও প্রচার। মেহেরুন রুনির তথাকথিত ‘পরকীয়া’-র রসালো গল্পের নীচে ঢাকা পড়ে গেছে খুনীর প্রতি ক্রোধ। কোন নারীর ‘চরিত্রহীনতা’ প্রমাণ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের সেই সোনার কাঠি যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে সংঘটিত সকল অন্যায়ের বৈধতা দেয় আমাদের সমাজ। ফলে তার হত্যাকারীর অপরাধ গৌণ হয়ে তার ‘অনাচার’-ই মূল ডিসকোর্স হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ধরেও নেয়া যায় তর্কের খাতিরে যে রুনির বিয়ে বহির্ভূত কোন সম্পর্ক ছিলো, তা’হলেই বা কীভাবে খুনীর পরিচয়ের চেয়ে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকেই ফোকাস করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এই কেসের ক্ষেত্রে? দুঃখজনক হলো, আমরা এখন পর্যন্ত খুনিদের সম্পর্কে কোন তথ্য জানতে পারিনি, অথচ সবাই রুনির নামে বানানো কাহিনী জেনে গেছি। এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন দু’জন। অথচ রুনি এবং সাগর দুজনের মৃত্যুর জন্যই এসব গুজবের বিস্তার ঘটিয়ে দায়ী করা হচ্ছে খুনীকে নয়, বরং রুনিকে।

কোন ঘটনার অপ্রধান দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত করার যে রাজনীতি সেই বিন্দুতে এসে এসব প্রতিবেদন আসলে কালো সাংবাদিকতার অন্তর্গত হয়ে যায়। কালো সাংবাদিকতার অন্তর্গত হয়ে যায় মেঘ-কে নিজেদের রিপোর্ট জমকালো করার উপায় এবং উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করাটা, তার শারীরিক-মানসিক নিরাপত্তার কথা একবারও চিন্তা না করাটা।

সংবাদ-মাধ্যমের কাছ থেকে এই দায়িত্বহীন আচরণ দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত। সংবাদ-মাধ্যমের এই কালো সাংবাদিকতাকে তীব্র নিন্দা জানাই। তীব্র নিন্দা জানাই পাঁচ বছরের শিশু মেঘকে দফায় দফায় তথ্য সংগ্রহের নামে যে নির্লজ্জ নিপীড়ন করা হচ্ছে, সেই দায়িত্বহীন নির্মম আচরণের। অনুগ্রহ করে রুনির চরিত্র হননকারী গুজব বন্ধ করুন। শিশু মেঘকে তার মত করে বাঁচতে দিন। প্রকৃত খুনীরা যেনো কোনভাবেই রেহাই না পায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

আর চাই শিক্ষিত গণমাধ্যম, যে পরবর্তী মৃত্যুগুলোকে রোধ করতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু জানা কথা, গণমাধ্যমগুলো যেহেতু ব্যবসানির্ভর তাই মাঝে-মাঝেই এই কালো সাংবাদিকতা মাথা-চাড়া দিয়ে উঠবে যদি না মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ তৈরি করা যায়। মানুষের সেই সংঘবদ্ধ শক্তির জাগরণের কাছেই আমার যত প্রত্যাশা।

বিডিনিউজ২৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১২

Your Opinion

Hello! Thanks for your time. I love to hear your perspectives, please do not hesitate to write back to me.

Got something to say?

    Follow the chariot
    of thoughts.

    Since I write sporadically and publish them here and there (sometimes only in here…), please subscribe to get updates!

      In Progress

      TBA

      Voluptas sed necessitatibus repellendus molestiae molestiae tenetur necessitatibus molestiae et aliquid occaecati et aperiam in soluta rem et ducimus deserunt atque quo repellendus consequatur nemo ratione voluptatem omnis omnis earum in explicabo porro quibusdam rerum sit aliquam ex quia necessitatibus consequatur cupiditate quo voluptas iure id ut reprehenderit amet quod quo qui non eius repudiandae omnis animi voluptates quis nobis saepe et ad consequuntur tenetur molestiae blanditiis nisi quae iste ipsa rerum hic quas.